আলবানী সাহেবের বাড়াবাড়ি
সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেম ও ইমামের সঙ্গে এ বিষয়ে ইমাম শাফেয়ী রহ.এর দ্বিমত থাকলেও সেটা জায়েয-নাজায়েযের নয়। উত্তম-অনুত্তমের। তাই এ নিয়ে কখনোও বাড়াবাড়ি ছিল না। ফাতাওয়ায়ে জহীরিয়ার বরাতে আল্লামা ইবনে নুজায়ম রহ. তার আলবাহরুর রায়েক গ্রন্থে শামসুল আইম্মা হালওয়ানী রহ.এর এ বক্তব্য উল্লেখ করেছেন যে,
إن الخلاف إنماهو في الأفضلية حتى لو فعل كما هو مذهب الشافعي لا بأس به عندنا (فصل ما يفعله من أراد الدخول في الصلاة ، ১/৩৪০)
এ বিষয়ে দ্বিমত হয়েছে উত্তম অনুত্তম নিয়ে, তাই যদি কেউ শাফেয়ী রহ. এর মাযহাব মতো আমল করে তাতেও আমাদের মতে তেমন কোন অসুবিধা নেই।
কিন্তু দুঃখের বিষয় আলবানী সাহেব এক্ষেত্রে খুব বাড়াবাড়ি করেছেন। আর তারই অনুসরণ করছেন আমাদের দেশের লা-মাযহাবী বন্ধুরা।
আলোচ্য বিষয়ে তার লেখার দুর্বলতা ও ফাঁকগুলো তুলে না ধরলে পাঠক হয়তো ভুল বুঝবেন। তাই এখানে কিছু পর্যালোচনা তুলে ধরা হলো।
এক. বুখারী শরীফে আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হাদীসটি তিনি বিলকুল চেপে গেছেন। হাদীসটি পেছনে ২ নং দলিল হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
দুই, আবু হুমায়দ রা. বর্ণিত একটি হাদীস তিনি বিশ্রামের বৈঠকের পক্ষে প্রমাণস্বরূপ পেশ করেছেন। হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন আবু দাউদ (৭৩০), ইবনে মাজাহ (১০৬১), ইবনুল জারূদ (১৯২), ইবনে হিব্বান (১৮৬৭) ও বায়হাকী (৪০৮)।
হাদীসটি সম্পর্কে আলবানী সাহেব মন্তব্য করেন:
حديث أبي حميد فيه وصف صلاة النبي صلى الله عليه وسلم – وفيها الجلسة – بحضرة عشرة من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم وفي آخره : قالوا : صدقت هكذا كان يصلي صلى الله عليه وسلم أخرجه أصحاب السنن وغيرهم وهو مخرج في ” الإرواء ” ( ৩০৫ ) فليس الحديث من رواية أبي حميد وابن الحويرث فقط كما يوهمه الكلام المذكور عن ابن القيم وإنما معهما عشرة آخرون من أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم الذين شاهدوا صلاته صلى الله عليه وسلم وقليل من السنن يتفق على روايتها مثل هذا الجمع الغفير من الصحابة رضي الله عنهم )تمام المنة)
অর্থাৎ আবু হুমায়দ রা. বর্ণিত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামাযের বিবরণ রয়েছে, এই বৈঠকের কথাও সেখানে উল্লেখ আছে। হাদীসটি তিনি দশজন সাহাবীর উপস্থিতিতে বর্ণনা করেছেন। হাদীসটির শেষে আছে, তারা বলেছেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। তিনি (নবী সা.) এভাবেই নামায পড়তেন। সুনান (চতুষ্টয়) এর সংকলক অন্যান্য হাদীস গ্রন্থকারগণ এটি উদ্ধৃত করেছেন। ইরওয়া গ্রন্থেও এটি বিধৃত হয়েছে (৩০৫)। সুতরাং (বৈঠকের) হাদীস শুধু মালেক ইবনুল হুওয়ায়রিছ রা. ও আবু হুমায়দ রা. কর্তৃক বর্ণিত, একথা ঠিক নয়। যেমনটি ধারণা জন্মে ইবনুল কায়্যিমের পূর্বোক্ত বক্তব্য থেকে। বরং তাদের দু’জনের সঙ্গে আরো দশজন সাহাবী আছেন যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায প্রত্যক্ষ করেছেন। আর এমন সুন্নাহ খুব কমই পাওয়া যাবে, যা এত বিরাট সংখ্যক সাহাবী বর্ণনা করেছেন। (দ্র. তামামুল মিন্নাহ, ১/২১১-২১২)
ক. এটি আবু হুমায়দ রা. থেকে মুহাম্মদ ইবনে আমর ইবনে আতা বর্ণনা করেছেন, তাঁর সূত্রে আবার অনেকেই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। কিন্তু আব্দুল হামীদ ইবনে জাফর ছাড়া অন্য কেউ এ বৈঠকের কথা উল্লেখ করেননি।
খ.আব্দুল হামীদের বিশ্বস্ততা নিয়ে দ্বিমত আছে। সুফিয়ান ছাওরী ও ইয়াহয়া ইবনে সাঈদ আলকাত্তান তাকে ‘দুর্বল’ বলেছেন। আবু হাতেম রাযী বলেছেন, لا يحتج به অর্থাৎ তাকে প্রমাণস্বরূপ পেশ করা যাবে না। ইমাম নাসায়ী যুআফা গ্রন্থে বলেছেন, ليس بالقوي তিনি মজবুত নন। অন্যত্র তিনি বলেছেন, ليس به بأس তার ব্যাপারে অসুবিধার কিছু নেই। ইমাম আহমদও এমন মন্তব্য করেছেন। আলী ইবনুল মাদীনী ও ইয়াহয়া ইবনে মাঈন অবশ্য তাকে বিশ্বস্ত বলেছেন। কিন্তু তাদের দৃষ্টিতেও তিনি খুব উঁচু মানের রাবী ছিলেন না। তার একটি প্রমাণ এও যে, ইবনে মাঈন অন্যত্র তার সম্পর্কে বলেছেন,ليس بحديثه بأس তার হাদীসের ব্যাপারে তেমন অসুবিধা নেই। একারণেই যাহাবী সিয়ার গ্রন্থে বলেছেন, وهو حسن الحديث তিনি এমন স্তরের, যার হাদীস হাসান হয়ে থাকে। ইবনে হাজার তাকরীবে বলেছেন, صدوق ربما وهم তিনি সাদূক (মধ্যম স্তরের জন্য ব্যবহৃত শব্দ) তবে মাঝেমধ্যে ভুলের শিকার হন। ইবনে হিব্বানও বলেছেন,ربما أخطأ তিনি কখনও কখনও ভুলের শিকার হন।
এ ধরনের বর্ণনাকারী যদি কোন হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে নিঃসঙ্গ হন তবে তা দ্বারা প্রমাণ পেশ করা কঠিন। এটা উক্ত বর্ণনার বিশুদ্ধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
গ. আব্দুল হামীদ ইবনে জাফর যে এই বৈঠকের উল্লেখ করেছেন, তাও নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। কেননা তার অনেক শিষ্যই তার সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তাদের বর্ণনায় এ বৈঠকের উল্লেখ আসে নি। যেমন, আব্দুল মালেক ইবনুস সাব্বাহ আল মিসমাঈ। (দ্র. ইবনে খুযায়মা ৬৭৭) ইয়াহয়া আলকাত্তান, (দ্র. ইবনে হিব্বান ১৮৬৫)।
ঘ. এসব কারণেই হয়তো ইমাম আহমদ এ হাদীসকে দুর্বল মনে করেছেন। কেননা মালেক ইবনুল হুয়ায়রিছ রা. বর্ণিত হাদীসটি সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ليس لهذا الحديث ثان এ হাদীসটির পক্ষে দ্বিতীয় কোন হাদীস নেই। অথচ এ বিষয়ে আবু হুমায়দ রা.এর হাদীসটির উক্ত বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু ইমাম আহমদ রহ. এটিকে সমর্থক ও সাক্ষীরূপেও গুরুত্ব দেওয়ার উপযুক্ত বিবেচনা করেন নি।
তাঁর এ মন্তব্য উদ্ধৃত করে ইবনে রজব বলেছেন,
هذا يدل على أن ما روى في هذه الجلسة من الحديث غير حديث مالك بن الحويرث فإنه غير محفوظ فإنها قد رويت في حديث أبي حميد وأصحابه في صفة صلاة النبي صلى الله عليه وسلم ، أخرجه أحمد وابن ماجه.
অর্থাৎ একথা নির্দেশ করে যে, মালেক ইবনুল হুয়ায়রিছ রা. বর্ণিত হাদীস ব্যতীত উক্ত বৈঠকের পক্ষে আরো যেসব হাদীস বর্ণিত আছে, সেগুলো বিশুদ্ধ নয়। (সেগুলোর একটি হলো,) নবী সা. এর নামাযের বিবরণে আবু হুমায়দ রা. ও তাঁর সঙ্গীগণ কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটি, সেখানে এ বৈঠকের উল্লেখ এসেছে। এটি আহমদ ও ইবনে মাজাহ উদ্ধৃত করেছেন। (দ্র. ফাতহুল বারী, ৭/২৮২, ৮৩২ নং হাদীসের আলোচনায়) ইমাম আহমদ এটিরই দুর্বলতার প্রতি ইংগিত করেছেন।
ঙ. আব্দুল হামীদের আরেক সঙ্গী ঈসা ইবনে আব্দুল্লাহ একই উস্তাদ মুহাম্মদ ইবনে আমর ইবনে আতা থেকে এটি বর্ণনা করেছেন। তার বর্ণনায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, রাসূল সা. বৈঠক না করেই উঠে গেছেন। এটিও আবু হুমায়দ রা.এর হাদীস। পেছনে ৪ নম্বরে হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে।
চ. আলবানী সাহেব দাবি করেছেন, দু’জন নয়, বারোজন সাহাবী এ বৈঠকের বর্ণনাকারী।
কিন্তু এ হাদীসটি যদি সহীহ না হয় তবে তো এগারজনই বাদ। বাকি থাকেন শুধু একজন। যেমনটি বলেছেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল। পক্ষান্তরে বৈঠক না করার পক্ষে অনেক হাদীস আমরা পেশ করেছি। বিশেষ করে আব্বাস ইবনে সাহল বর্ণিত হাদীসটিতে বলা হয়েছে, তিনি আনসার সাহাবীগণের এক মজলিসে ছিলেন। সেখানে তার পিতা সাহল ইবনে সাদ, আবু হুমায়দ, আবু উসায়দ ও আবু হুরায়রা রা. প্রমুখ ছিলেন। আবু দাউদ (৭৩৩), মুসনাদে সাররাজ (১০০) (১৯২৬)। তাহাবী শরীফের বর্ণনায় উল্লিখিত সাহাবীগণের নাম উল্লেখ করার পর বলা হয়েছে, ‘ওয়াল আনসার রা.’ অর্থাৎ আরো অন্যান্য আনসার সাহাবীগণ ছিলেন। তাদের উপস্থিতিতে আবু হুমায়দ রা. এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, যেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, অতঃপর তিনি তাকবীর বললেন এবং সেজদা করলেন। এরপর আবার তাকবীর বললেন এবং দাঁড়িয়ে গেলেন, বৈঠক করেন নি। তাহলে এখানেও তো একই হাদীসে অনেক বর্ণনাকারী সাহাবী পাওয়া গেল।
তিন, আব্বাস ইবনে সাহল বর্ণিত হাদীসটি সম্পর্কে আলবানী সাহেব মন্তব্য করেছেন,
إن هذه الزيادة ضعيفة لأنه تفرد به عيسى بن عبد الله بن مالك وهو مجهول(أصل صفة الصلاة)
অর্থাৎ এ বাড়তি অংশটুকু (বৈঠক করেন নি) দুর্বল। কেননা ঈসা ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে মালেক এটি একাই বর্ণনা করেছেন। আর তিনি অজ্ঞাত ছিলেন।
কিন্তু এটাকে দুর্বল বলা আলবানী সাহেবের একটি ভুল। কারণ ঈসা ইবনে আব্দুল্লাহকে কেউ দুর্বল বলেন নি। বরং ইবনে হিব্বান তার আছছিকাত গ্রন্থে (বিশ্বস্ত রাবীচরিত) তাকে উল্লেখ করেছেন। ইমাম বুখারী তাঁর আত তারীখুল কাবীর গ্রন্থে এবং ইবনে আবু হাতেম তার আল জারহু ওয়াত তাদীল গ্রন্থে তাকে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তারা বিরূপ কোন মন্তব্য করেন নি। আলী ইবনুল মাদীনী অবশ্য তাকে অজ্ঞাত বলেছেন। তবে তিনি তাকে অজ্ঞাত আখ্যা দেওয়ার কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন যে, শুধু মুহাম্মদ ইবনে ইসহাকই তাঁর সূত্রে হাদীস বর্ণনা করেছেন। অথচ রিজাল শাস্ত্র অনুসন্ধান করে দেখা গেছে তার সূত্রে আরো সাতজন রাবী হাদীস বর্ণনা করেছেন। তারা হলেন যিয়াদ ইবনে সাদ, জাহহাফ ইবনে আব্দুর রহমান, হাসান ইবনে হুরর, উতবা ইবনে আবু হামীম, ফুলায়হ ইবনে সুলায়মান ও ঈসার ভ্রাতা মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ। সুতরাং যে কারণে ইবনুল মাদীনী তাকে মাজহুল বা অজ্ঞাত বলেছেন, সেটি যখন ঠিক রইল না, তাই তাকে অজ্ঞাত বলাও আর সঙ্গত হবে না। তাই তো ইবনুল মাদীনীর পর অন্য কেউই তাকে মাজহুল বলেন নি। হাফেজ যাহাবী কাশেফ গ্রন্থে বলেছেন, وثق তাকে বিশ্বস্ত বলা হয়েছে। আর হাফেজ ইবনে হাজার তাকরীব গ্রন্থে বলেছেন, مقبول। এ মাকবূল শব্দটি ইবনে হাজারের বিন্যাস অনুসারে গ্রহণযোগ্য রাবীর সর্বনিম্নস্তর।
তাছাড়া তাহাবী শরীফে (নং ১৫৪৮) উতবা ইবনে হাকীম এটি বর্ণনা করেছেন ঈসা ইবনে আব্দুর রহমান আল আদাবীর সূত্রে আব্বাস ইবনে সাহল থেকে, সেখানেও এই বৈঠকের কথা নেই।
চার. ফিকহুস সুনান গ্রন্থে সায়্যেদ সাবেক এ বৈঠক সম্পর্কে লিখেছেন,
وقد اختلف العلماء في حكمها تبعا لاختلاف الأحاديث ونحن نوردها ما لخصه ابن القيم في ذلك.
অর্থাৎ হাদীসের বিভিন্নতার কারণে এ বৈঠকটি সম্পর্কে আলেমগণেরও মতভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে। আমরা এখানে ইবনুল কায়্যিমের সংক্ষিপ্ত আলোচনা তুলে ধরব। (দ্র. তামামুল মিন্নাহ, ১/২১০)
এ বক্তব্য সম্পর্কে আলবানী সাহেব লিখেছেন,
هذا يوهم أن في هذه المسألة أحاديث متعارضة وليس كذلك بل كل ما ورد فيها مثبت لها ولم يرد مطلقا أي حديث ينفيها غاية الأمر أنها لم تذكر في بعض الأحاديث وهذا لا يوجب الاختلاف المدعى وإلا للزم ادعاء مثله في كل سنة لم تتفق عليها الأحاديث وهذا لا يقول به أحد
অর্থাৎ উক্ত বক্তব্য এই ধারণা জন্মায় যে, এ মাসআলায় পরস্পর বিরোধী হাদীস রয়েছে। অথচ ব্যাপারটি এমন নয়। বরং এক্ষেত্রে যতগুলো হাদীস এসেছে সবগুলো এ বৈঠক প্রমাণ করে। এমন একটি হাদীসও আসে নি, যা এই বৈঠক সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দেয়। খুব বেশি এ কথা বলা যায় যে, কিছু কিছু হাদীসে এর উল্লেখ আসে নি। আর এই না আসা ঐ বিভিন্নতাকে অনিবার্য করে না, যার দাবি করা হচ্ছে। অন্যথায় অনুরূপ দাবি প্রত্যেক সুন্নাহ সম্পর্কেই করা যাবে, যেগুলোর বিবরণ সব হাদীসে আসে নি। অথচ এমন কথা কেউ বলতে পারে না। (তামামুল মিন্নাহ, ১/২১০)
আলবানী সাহেবের এ বক্তব্য যে কতটা অন্তঃসারশূন্য তা পেছনের হাদীসগুলো লক্ষ করলেই ধরা পড়বে। নবী করীম সা. যখন এক ব্যক্তিকে নামায শেখাচ্ছিলেন, আর বলছিলেন, এরপর দ্বিতীয় সেজদা কর, এরপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যাও, এতে কি উক্ত বৈঠক সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা বা নির্দেশনা পাওয়া যায় না? তবে কি সংখ্যাগরিষ্ট সাহাবী তাবেয়ী ও মুজতাহিদ ইমামগণ এতকাল ভুল বুঝেছেন?
পাঁচ. হাফেজ ইবনুল কায়্যিমের বরাতে ফিকহুস সুন্নাহ গ্রন্থকার লিখেছেন,
وفي حديث ابن عجلان ما يدل على أنه كان ينهض على صدور قدميه وقد روى عدة من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم وسائر من وصف صلاته صلى الله عليه وسلم لم يذكر هذه الجلسة وإنما ذكرت في حديث أبي حميد ومالك بن الحويرث
অর্থাৎ ইবনে আজলান এর সূত্রে বর্ণিত হাদীসটি নির্দেশ করে যে, তিনি (রাসূল সা.) পায়ের উপর ভর দিয়েই দাঁড়িয়ে যেতেন। রাসূল সা. এর অনেক সাহাবী এবং তাঁর নামাযের বিবরণদানকারীগণের কেউই এ বৈঠকের কথা উল্লেখ করেন নি। শুধুমাত্র আবু হুমায়দ ও মালেক ইবনুল হুয়ায়রিছ রা. বর্ণিত হাদীসে এর উল্লেখ এসেছে।
আলবানী সাহেব উক্ত বক্তব্যের উপর টীকা লিখে মন্তব্য করেছেন:
قلت : إن كان يعني حديث ابن عجلان عن رفاعة المذكور في رواية عبد الله عن أحمد المتقدمة فليس فيها ما ذكر من النهوض ثم هو من تعليمه صلى الله عليه وسلم للمسيء صلاته وليس من فعله صلى الله عليه وسلم كما تقدم وإن كان يعني غيره فلم أعرفه وعلى الأول فالعبارة مشكلة لأنها تفيد أن حديث رفاعة غير حديث ابن عجلان مع أنهما حديث واحد فتأمل
অর্থাৎ আমি বলব, যদি তাঁর উদ্দেশ্য হয়ে থাকে রিফায়া রা. থেকে ইবনে আজলানের সূত্রে বর্ণিত হাদীস, যা ইতিপূর্বে আহমদ রহ.থেকে আব্দুল্লাহ’র বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে, তাহলে সেখানে সেজদা থেকে ওঠার উল্লেখ নেই। তাছাড়া হাদীসটি মূলতঃ নামাযে গলদকারী ব্যক্তিকে দেওয়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তালিম বা শিক্ষা। এটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিজের আমল সম্পর্কে নয়। যেমনটি পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। আর যদি তাঁর উদ্দেশ্য অন্য কিছু হয়, তবে তা আমার জানা নেই। আর প্রথমটি উদ্দেশ্য হয়ে থাকলে বাক্যটি দুর্বোধ্য। কারণ এতে অনুমিত হয়: রিফায়া রা. বর্ণিত হাদীসটি ইবনে আজলান কর্তৃক বর্ণিত হাদীস থেকে ভিন্ন। অথচ দুটি একই হাদীস। (তামামুল মিন্নাহ, ১/২১১)
অধমের আরজ এই যে, আসলে ইমাম আহমদ রহ. ইবনে আজলানের সূত্রে বর্ণিত রিফাআ ইবনে রাফে রা.এর হাদীসকে আমলের জন্য অবলম্বন করেছেন। হাদীসটি মুসনাদে আহমদে (নং ১৮৯৯৭) উদ্ধৃত হয়েছে। এখানে ৩নং প্রমাণে আরো কে কে উদ্ধৃত করেছেন তার বিবরণ আছে।
হাদীসটিতে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় সেজদার পরেই তুমি দাঁড়িয়ে যাও। আর এর থেকেই বোঝা যায়, রাসূল সা. নিজেও দ্বিতীয় সেজদার পর সোজা দাঁড়িয়ে যেতেন। কেননা তিনি অন্যদেরকে যা আদেশ করতেন, নিজেও তাই করতেন। তাঁর তালীম ও নিজের আমলে কোন ফারাক ছিল না। এটাই স্বাভাবিক। হ্যাঁ, বার্ধক্যের কারণে কখনও কখনও বসতেন, সেটাই মালেক রা.এর হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে। ইমাম আহমদ রহ. বলেছেন:وأذهب أنا إلى حديث رفاعة “ثم قم” অর্থাৎ রিফায়া রা.এর বর্ণিত হাদীসে রাসূল সা. যে বলেছেন:এরপর তুমি দাঁড়িয়ে যাও, আমি এ হাদীস অনুযায়ী আমল করি।
এর উপর মন্তব্য করতে গিয়ে আলবানী সাহেব বলেন:
وهذا لا حجة فيه على نفي ما ثبت في حديث ابن الحويرث وغيره إذ غاية ما فيه أن الجلسة لم تذكر فيه وهي سنة وليست بواجب فكيف تذكر في حديث المسئ صلاته الذي علمه صلى الله عليه وسلم فيه الواجبات دون السنن والمستحبات راجع ” المجموع ” ( ৩ / ৪৪৩ ) وكأنه لضعف هذه الحجة رجع الإمام أحمد رحمه الله إلى العمل بحديث ابن الحويرث وهو الحق الذي لا شك فيه
অর্থাৎ হযরত মালেক ইবনুল হুওয়াইরিছ রা. প্রমুখের হাদীস থেকে যে বৈঠক প্রমাণিত, এটি তার বিপক্ষে প্রমাণ হয় না। কারণ বেশির থেকে বেশি একথা বলা যায় যে, এতে বৈঠকটির কথা উল্লেখ করা হয় নি। এ বৈঠক সুন্নত, ওয়াজিব নয়। সুতরাং নামাযে গলদকারী ব্যক্তির হাদীসে এর উল্লেখ থাকার কথা নয়। তাঁকে তো নবী সা. সুন্নত-মুস্তাহাব শেখান নি, ফরজ-ওয়াজিব শিখিয়েছেন। দেখুন, আলমাজমু’ ৩/৪৪৩। এ প্রমাণটি দুর্বল হওয়ার কারণেই হয়তো ইমাম আহমদ রহ. মালেক ইবনুল হুওয়াইরিছ রা. বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী আমলের দিকে ফিরে এসেছেন। এটা এমন সত্য, যাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। (তামামুল মিন্নাহ, ১/২১১)
আমাদের তো বুঝে আসে না, রিফায়া রা.এর হাদীসটি কেন প্রমাণ হতে পারবে না। উক্ত হাদীসে তো নবীজী সা. দ্বিতীয় সেজদার পর সোজা দাঁড়িয়ে যেতে বলেছেন। তাহলে বসার সুযোগ থাকল কোথায়?