জুমআর আগের ও পরের সুন্নত
আমাদের লা-মাযহাবী ভাইয়েরা আজকাল কিছু কিছু মিডিয়ায়ও প্রচার শুরু করেছে, জুমআর আগে পরে কোন সুন্নত নাই। তাদেরকে না চেনার কারণে অনেকে ধোঁকায় পড়ে যাচ্ছে। যারা এ সুন্নত আদায় করে আসছেন তারা সন্দেহে পড়ে যাচ্ছেন। অনেকে স্থানীয় ইমাম সাহেবের কাছে জিজ্ঞেস করে বিষয়টি পরিস্কার করে নিচ্ছেন। আবার অনেকে ঐ অপপ্রচারকেই গনিমত মনে করে সুন্নত ছেড়ে দিয়ে গোনাহগার হচ্ছেন। এসব কারণে এ মাসআলাটিও পরিস্কার করার প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে। তাই জুমআর সুন্নত সম্পর্কে হাদীসগুলো তুলে ধরা হচ্ছে:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী
১. হযরত আবূ হুরায়রা রা. বর্ণনা করেছেন:
عَنِ النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ مَنِ اغْتَسَلَ ثُمَّ أَتَى الْجُمُعَةَ فَصَلَّى مَا قُدِّرَ لَهُ ثُمَّ أَنْصَتَ حَتَّى يَفْرُغَ مِنْ خُطْبَتِهِ ثُمَّ يُصَلِّىَ مَعَهُ غُفِرَ لَهُ مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْجُمُعَةِ الأُخْرَى وَفَضْلَ ثَلاَثَةِ أَيَّامٍ أخرجه مسلم (٨٥٧)
অর্থ: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি গোসল করলো, অতঃপর জুমআয় আসলো, এবং তৌফিক অনুসারে নামায পড়লো, এরপর ইমাম খুতবা শেষ করা পর্যন্ত চুপ রইলো এবং তার সঙ্গে নামায আদায় করলো তার পরবর্তী জুমআ পর্যন্ত এবং আরো অতিরিক্ত তিন দিনের গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হবে। মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ৮৫৭।
২. হযরত সালমান ফারসী রা. বলেছেন:
قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يَغْتَسِلُ رَجُلٌ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَيَتَطَهَّرُ مَا اسْتَطَاعَ مِنْ طُهْرٍ وَيَدَّهِنُ مِنْ دُهْنِهِ أَوْ يَمَسُّ مِنْ طِيبِ بَيْتِهِ ثُمَّ يَخْرُجُ فَلَا يُفَرِّقُ بَيْنَ اثْنَيْنِ ثُمَّ يُصَلِّي مَا كُتِبَ لَهُ ثُمَّ يُنْصِتُ إِذَا تَكَلَّمَ الْإِمَامُ إِلَّا غُفِرَ لَهُ مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْجُمُعَةِ الْأُخْرَى. أخرجه البخاري (رقم ৮৮৩) وفي رواية له: ثُمَّ إِذَا خَرَجَ الْإِمَامُ أَنْصَتَ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোন ব্যক্তি যদি জুমআর দিন গোসল করে, সাধ্যমতো পবিত্রতা অর্জন করে, তেল ব্যবহার করে কিংবা ঘরে থাকা সুগন্ধি ব্যবহার করে, তারপর ঘর থেকে বের হয় এবং (বসার জন্য বা পার হওয়ার জন্য) দুজনকে আলাদা না করে, এরপর তাওফিক মতো নামায পড়ে, অতঃপর ইমাম যখন খুতবা দেয় তখন চুপ থাকে, তাহলে অন্য জুমআ পর্যন্ত তার পাপ ক্ষমা করা হয়। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৮৮৩) বুখারী শরীফের অপর এক বর্ণনায় আছে, অতঃপর ইমাম (খুতবার উদ্দেশ্যে) বের হলে চুপ থাকে। (হাদীস নং ৯১০)
৩. এ মর্মে হযরত নুবায়শা আল হুযালী রা. থেকে আরেকটি দীর্ঘ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তাতেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
فَإِنْ لَمْ يَجِدْ الْإِمَامَ خَرَجَ صَلَّى مَا بَدَا لَهُ
অর্থাৎ যদি ইমামকে বের হতে না দেখে তবে যে পরিমাণ ইচ্ছা নামায পড়ে। …. (মুসনাদে আহমদ, ৫খ. ৭৫পৃ.)
৪. হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. বর্ণিত অপর একটি হাদীসে জুমআর পূর্বে নামায পড়ার কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে বলেছেন, ثم ركع ما شاء أن يركع অর্থাৎ তার যে পরিমাণ ইচ্ছা রুকু (নামায আদায়) করে। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ১১৭৬৮)
এসব হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমআর পূর্বে নামায পড়তে উৎসাহিত করেছেন। এসব হাদীস পেশ করলে ঐ সব বন্ধু সুর পাল্টে বলেন, হ্যাঁ, নামায তো আছে, তবে সুন্নতে মুয়াক্কাদা নেই। অথচ মুয়াক্কাদা: গয়র মুয়াক্কাদা ফকীহগণের পরিভাষা। ফিকাহ শাস্ত্র ও ফকীহগণের কোন গুরুত্ব তাদের কাছে নেই। তারা তো দেখবেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সম্পর্কে উৎসাহিত করেছেন কি না। তিনি উৎসাহিত করে থাকলে তারাও উৎসাহিত করবেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উৎসাহিত করেছেন এমন বিষয়কেই তো সুন্নত বলা হয়। চাই তা মুয়াক্কাদা হোক বা গয়র মুয়াক্কাদা।
আসলে কোন আমলকে সুন্নতে মুয়াক্কাদা বা রাতিবা আখ্যা দেওয়া মুজতাহিদ ফকীহগণের ইজতিহাদ বা সুচিন্তিত মত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক কোন আমলের প্রতি উৎসাহ প্রদান, উক্ত আমলের উপর তাঁর নিজের পাবন্দি ও সাহাবায়ে কেরামের আমল ও গুরুত্বারোপের আলোকেই ফকীহগণ উক্ত পরিভাষা ব্যবহার করে থাকেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে এই সুন্নতের প্রতি উৎসাহিত করেছেন, তা পেছনের হাদীসগুলো থেকেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। তাঁর নিজস্ব আমল এবং তাঁর সাহাবীগণের নির্দেশ ও আমল সংক্রান্ত হাদীসগুলো এখানে তুলে ধরা হচ্ছে। তার আগে হাদীসশাস্ত্রবিদদের একটি সর্বস্বীকৃত মূলনীতির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। নীতিটি তারাবীর আলোচনায় সবিস্তারে আসছে। তা হলো, কোন হাদীস যদি একাধিক সনদ বা সূত্রে বর্ণিত থাকে, আর পৃথক পৃথক ভাবে সবগুলো সূত্র দুর্বল হয়, তথাপি সেগুলোর সমষ্টি মিলে হাসান স্তরে উন্নীত হয় এবং প্রমাণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। পরিভাষায় এটাকেই হাসান লিগায়রিহী বলে। আর তদনুযায়ী সাহাবীগণের আমল পাওয়া গেলে তা আরো শক্তিশালী হয়। আর যদি মূল হাদীসটিরই কোন শক্তিশালী সনদ থাকে তবে তো কোন কথাই নেই। আলোচ্য বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল সম্পর্কে একাধিক হাদীস রয়েছে। সূত্র ও সনদের দিক থেকে এর কোন কোনটি বেশ শক্তিশালী। সেই সঙ্গে রয়েছে বহু সাহাবীর আমল। নিম্নে এগুলো তুলে ধরা হলো।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল:
১. হযরত ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন,
كان النبي صلى الله عليه و سلم يركع قبل الجمعة أربعا . لا يفصل في شيء منهن
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমআর পূর্বে চার রাকাত পড়তেন। মাঝে সালাম ফেরাতেন না। ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১১২৯, তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীস নং ১৬৪০। এর সনদ দুর্বল।
২. হযরত আলী রা. বর্ণনা করেন,
كان رسول الله يصلي قبل الجمعة أربعا وبعدها أربعا يجعل التسليم في آخرهن ركعة
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমআর পূর্বে পড়তেন চার রাকাত, পরে পড়তেন চার রাকাত। আর চার রাকাতের পরেই তিনি সালাম ফেরাতেন। তাবারানী, আল মুজামুল আওসাত, হাদীস নং ১৬১৭; আবু সাঈদ ইবনুল আরাবী, (মৃত্যু ৩৪০ হি.) আল মুজাম, হাদীস নং ৮৭৪।
এ হাদীসটির সনদ বা সূত্র নিম্নরূপ:
حدثنا أحمد بن الحسين بن نصر أبو جعفر نا خليفة بن خياط شباب العصفري نا محمد بن عبد الرحمن السهمي عن حصين بن عبد الرحمن السلمي عن أبي إسحاق عن عاصم بن ضمرة عن علي
এ সনদটির সকল রাবী (বর্ণনাকারী) নির্ভরযোগ্য। শুধু সামান্য আপত্তি করা হয়েছে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুর রহমান আসসাহ্মী সম্পর্কে। ইবনে হাজার আসকালানী তার ফাতহুল বারী গ্রন্থে বলেছেন, وهو ضعيف عند البخاري وغيره অর্থাৎ তিনি বুখারী প্রমুখের দৃষ্টিতে দুর্বল। অথচ ইমাম বুখারী রহ. কোথাও তাকে দুর্বল বলেন নি। তিনি বরং তাঁর আত তারীখুল কাবীর গ্রন্থে উক্ত বর্ণনাকারীর অন্য একটি হাদীস উল্লেখ করে বলেছেন, لا يتابع عليه অর্থাৎ তার এ বর্ণনায় অন্য কারো সমর্থন মেলে না। বুখারী রহ. এর এ কথাটিই ইবনে হাজার রহ. তার লিসানুল মীযান গ্রন্থে এভাবে উল্লেখ করেছেন: لا يتابع على روايته অর্থাৎ তার বর্ণনার সমর্থন মেলে না। অথচ এই ব্যাপক অর্থে ইমাম বুখারী রহ. ঐ কথা বলেননি। বুখারী রহ. ছাড়া আবু হাতেম রাযী রহ. উক্ত বর্ণনাকারী সম্পর্কে বলেছেন, ليس بمشهور অর্থাৎ তিনি প্রসিদ্ধ নন। এ কথাটি উক্ত বর্ণনাকারীর দুর্বল হওয়ার ব্যাপারে স্পষ্ট নয়। হ্যাঁ, ইবনে আবু হাতেমের সূত্রে ইবনে মাঈন রহ. এর কথা লিসানুল মীযানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি তাকে দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু কথাটি ইবনে আবী হাতেমের ইলাল কিংবা আলজারহু ওয়াত তাদীলেও নেই। তারীখে ইবনে মাঈনেও নেই। অপর দিকে ইবনে আদী রহ. তার আলকামিল গ্রন্থে উক্ত বর্ণনাকারীর হাদীসসমূহ যাচাইপূর্বক বলেছেন, عندي لا بأس به অর্থাৎ আমার দৃষ্টিতে তার মধ্যে অসুবিধার কিছু নেই। এমনকি ইবনে আদী এই দাবিও করেছেন, বুখারী রহ. যার সম্পর্কে لا يتابع عليه বলেছেন, তিনি হয়তো মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে তালহা আলকুরাশী হবেন।
ইবনে হিব্বানও সাহমীকে আছছিকাত (বিশ্বস্ত রাবী চরিত) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এ কালে সারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস হাবীবুর রহমান আজমী রহ. তার ‘আলআলবানী শুযুযুহু ওয়া আখতাউহু’ গ্রন্থে বলেছেন,
والحق عندي أنه حسن الحديث لأنه روى عنه ابن المثنى ونصر بن علي وخليفة العصفرى فبطل قول أبي حاتم أنه ليس بمشهور ووثقه ابن عدي وابن خبان فحديثه هذا حسن لذاته ولا شك في كونه حسنا لغيره لأن له شواهد.
অর্থাৎ আমার মতে সঠিক হলো, তিনি হাসানস্তরের রাবী। কারণ তাঁর থেকে ইবনুল মুছান্না, নাস্র ইবনে আলী ও খালীফা আলউসফুরী প্রমুখ হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাই আবু হাতেমের বক্তব্য: ‘তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন না’ সঠিক থাকল না। ইবনে আদী ও ইবনে হিব্বান তাকে বিশ্বস্ত আখ্যা দিয়েছেন। সুতরাং তার বর্ণিত এ হাদীসটি হাসান লি যাতিহী। আর হাসান লি গাইরিহী হওয়ার ব্যাপারে তো কোন সন্দেহই নেই। কেননা এ হাদীসটির অনেক শাহেদ বা সমর্থক বর্ণনা রয়েছে।
এতো গেল তাবারানী ও ইবনুল আরাবী রহ. এর সনদ সম্পর্কে পর্যালোচনা। এ ছাড়া এই হাদীসটি আবুল হাসান আল খিলায়ীও (মৃত্যু ৪৯২ হি.) তার আল ফাওয়াইদ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। তাঁর বর্ণিত সনদ আবু ইসহাক রহ. থেকে উপরের দিকে আলী রা. পর্যন্ত ঠিক তেমনই, যেমনটি তাবারানীর সনদে উদ্ধৃত হয়েছে। কিন্তু আবু ইসহাক থেকে নীচে খিলায়ী পর্যন্ত সনদ সম্পর্কে আমরা অবগতি লাভ করতে পারিনি। সনদের এ অংশে আস সাহমী’র উল্লেখ রয়েছে কি না তাও আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি। তবে যারা অবগত ছিলেন তাদের মধ্যে একাধিক হাফেযে হাদীস খিলায়ীর সনদ সম্পর্কে ভাল মন্তব্য করেছেন। হাফেজ যায়নুদ্দীন ইরাকী (মৃত্যু ৮০৬ হি.) বলেছেন, وإسناده جيد অর্থাৎ খিলায়ী বর্ণিত সনদটি জাইয়েদ। (দ্র. ফায়যুল কাদীর, হাদীস নং ৭০৩৩)। হাফেয ওয়ালীউদ্দীন ইরাকীও (মৃত্যু ৮২৬ হি.) তার ‘তারহুত তাছরীব’ গ্রন্থে ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত উল্লিখিত ১নং হাদীসটির আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন,
وَالْمَتْنُ الْمَذْكُورُ رَوَاهُ أَبُو الْحَسَنِ الْخلَعِيِّ فِي فَوَائِدِهِ بِإِسْنَادٍ جَيِّدٍ مِنْ طَرِيقِ أَبِي إِسْحَاقَ عَنْ عَاصِمِ بْنِ ضَمْرَةَ عَنْ عَلِيٍّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
অর্থাৎ ইবনে আব্বাস রা. বর্ণিত হাদীসটির মূল বক্তব্য আবুল হাসান আলখিলায়ী রহ. তার ফাওয়াইদ গ্রন্থে জাইয়েদ বা উত্তম সনদে উদ্ধৃত করেছেন। আবু ইসহাক আসিম ইবনে দামরা’র সূত্রে আলী রা. থেকে এটি বর্ণনা করেছেন। (দ্র. ৩খ. ৪২ পৃ.)
শুধু এই দুই খ্যাতিমান মুহাদ্দিস উল্লিখিত সনদকে জাইয়েদ বলেছেন তা নয়। বরং তাদের সঙ্গে সহমত ব্যক্ত করেছেন আরো তিনজন বিখ্যাত মুহাদ্দিস। তাদের একজন হলেন হাফেজ শিহাবুদ্দীন বূসিরী রহ. (মৃত্যু ৮৪০ হি.) তার মিসবাহুয যুজাজাহ গ্রন্থে (১ খ. ১৩৬ পৃ.)। দ্বিতীয় জন মুহাদ্দিস আব্দুর রউফ আল মুনাবী রহ. (মৃত্যু ১০৩২ হি.) তার ফায়জুল কাদীর গ্রন্থে (হাদীস নং ৭০৩৩) ও তৃতীয়জন মুহাদ্দিস মুরতাজা হাসান যাবীদী রহ. (মৃত্যু ১২০৫ হি.) তার ইতহাফু সাদাতিল মুত্তাকীন গ্রন্থে( ৩ খ. ২৭৫ পৃ.)।
হযরত মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব লিখেছেন, মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুর রহমান আস-সাহমীর এ বর্ণনার সমর্থন আলী রা.এর ঐ প্রসিদ্ধ হাদীস দ্বারাও হয়, যা সুন্নত ও নফল সম্পর্কে খুবই প্রসিদ্ধ এবং ‘সুনান’ ও ‘মাসানীদ’ গ্রন্থসমূহে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত।
আসিম ইবনে দামরা বলেন-
أتينا عليا، فقلنا : يا أمير المؤمنين ألا تحدثنا عن صلاة النبي صلى الله عليه وسلم بالنهار تطوعا؟ فقال : من يطيق ذلك منكم؟ قلنا نأخذ منه ما أطقنا.
আমরা আলী রা. এর কাছে এলাম এবং আরজ করলাম, আমীরুল মু’মিনীন! আপনি কি আমাদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ‘সালাতুত তাতাওউ’ (সুন্নত ও নফল নামাযসমূহের) বিষয়ে অবগত করবেন না? তিনি বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে তার (অনুসরণের) হিম্মত রাখে? আরজ করলাম, ‘আমরা সাধ্যমতো আমল করব।’
এরপর আলী রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিবসের সুন্নত ও নফল নামাযের বিবরণ দিলেন। প্রথমে ফজরের পর সূর্য মাথার উপর আসার আগ পর্যন্ত দুই নামাযের কথা বললেন: দুই রাকাত এবং চার রাকাত (অর্থাৎ ইশরাকের দুই রাকাত ও চাশতের চার রাকাত)
এর পর বলেন-
ثم أمهل فإذا زالت الشمس قام فصلى أربعا، ثم صلى بعد الظهر ركعتين، ويصلي قبل العصر أربعا، يفصل بين كل ركعتين بتسليم على الملائكة المقربين ومن اتبعهم من المؤمنين والمسلمين، فتلك ست عشرة ركعة.
‘এরপর তিনি নামায পড়া থেকে বিরত থাকতেন। যখন সূর্য ঢলে যেত তখন দাঁড়াতেন ও চার রাকাত পড়তেন। এরপর যোহরের পর দুই রাকাত পড়তেন, আসরের আগে চার রাকাত পড়তেন। প্রতি দুই রাকাতকে তাশাহহুদ দ্বারা আলাদা করতেন। এ হল সর্বমোট ষোল রাকাত। (আল-আহাদীসুল মুখতারা, যিয়াউদ্দীন আলমাকদেসী খ. ১, পৃ. ১৪২-১৪৩ হাদীস : ৫১৪)
সুনানে ইবনে মাজায় (হাদীস : ১১৬১) এই হাদীসের শেষে আছে-
قال علي فتلك ست عشرة ركعة، تطوع رسول الله صلى الله عليه وسلم بالنهار، وقل من يداوم عليها. قال وكيع : زاد فيه أبي : فقال حبيب بن أبي ثابت : يا أبا إسحاق! ما أحب أن لي بحديثك هذا مِلْءَ مسجدك هذا ذهبا.
অর্থাৎ, আলী রা. বললেন, ‘এ হচ্ছে সর্বমোট ষোল রাকাত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিনের তাতাওউ (নফল ও সুন্নত) নামায। খুব অল্প সংখ্যক মানুষই তা নিয়মিত আদায় করে।’
রাবী বলেন, এই হাদীস বর্ণনা করার পর (উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে থেকে ইমাম) হাবীব ইবনে আবী ছাবিত বলে উঠলেন, ‘আবু ইসহাক! আপনার বর্ণিত এই হাদীসের বিনিময়ে তো আপনার এই মসজিদ ভরা স্বর্ণের মালিক হওয়াও আমি পছন্দ করব না!
এ হাদীসে সূর্য ঢলে যাওয়ার পর যে চার রাকাতের কথা এসেছে, খুব সহজেই বোঝা যায়, সপ্তাহের ছয়দিন তা যোহরের আগের সুন্নত আর জুমার দিন জুমার আগের সুন্নত। কিন্তু অধিকাংশ দিনে তা যেহেতু ‘কাবলায যোহর’ আর জুমাও হচ্ছে যোহরেরই স্থলাভিষিক্ত, তাই এ চার রাকাতকে অন্যান্য বর্ণনায় এভাবে বলা হয়েছে-وأربعا قبل الظهر إذا زالت الشمس (এবং যোহরের আগে চার রাকাত, যখন সূর্য ঢলে যায়) এবং এভাবে- ويصلي قبل الظهر أربعا. (এবং যোহরের আগে চার রাকাত পড়তেন)
এই বর্ণনাগুলোতে ‘যোহর’ শব্দ ব্যবহৃত হওয়ায় অনেকে মনে করেছেন, এই চার রাকাত শুধু ‘যোহরের নামাযে’র আগে পড়তে হবে, কারণ এই হাদীসে তো ‘কাবলায যোহর’ বলা হয়েছে, ‘কাবলাল জুমা নয়।’ বলাবাহুল্য, এটা অগভীর চিন্তার ফল। কারণ,এখানে ঐ সকল সুন্নত ও নফল নামাযের আলোচনা হচ্ছে, যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিনে আদায় করতেন। জুমার দিনও তো দিনই বটে, রাত তো নয়।
তাহলে এই ‘দিন’ সূর্য ঢলে যাওয়ার পর চার রাকাত নামায কেন হবে না? এ বিষয়ে জুমার দিনের নিয়ম যদি আলাদা হত তাহলে আলী রা. তা বলতেন। বলেননি যখন বোঝা গেল যে, জুমার দিনেও এ নামায পড়া হত। জুমার দিন কি ইশরাক, চাশত ও আসরের আগের সুন্নতসমূহ নেই? তাহলে সূর্য ঢলে যাওয়ার পরের এই চার রাকাত কেন থাকবে না? এটিও তো ‘আন নাহার’ (দিবস) শব্দের অন্তর্ভুক্ত। (সূত্র: কাবলাল জুমা : কিছু নিবেদন, মাওলানা আব্দুল মালেক, মাসিক আলকাউসার, ডিসেম্বর, ২০১২)
৩. আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বর্ণিত হাদীস:
ইমাম তাবারানী রহ. তাঁর আল মু’জামুল আওসাত গ্রন্থে হাদীসটি এভাবে উদ্ধৃত করেছেন:
حدثنا علي بن سعيد الرازي قال نا سليمان بن عمر بن خالد الرقي قال نا عتاب بن بشير عن خصيف عن ابي عبيدة عن عبد الله عن النبي صلى الله عليه و سلم أنه كان يصلي قبل الجمعة اربعا وبعدها أربعا
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমআর পূর্বে চার রাকাত ও পরে চার রাকাত পড়তেন। (হাদীস নং ৩৯৫৯)
ইবনে হাজার আসকালানী রহ. ফাতহুল বারী গ্রন্থে এ হাদীস সম্পর্কে বলেছেন, وفي إسناده ضعف وانقطاعঅর্থাৎ এর সনদে দুর্বলতা ও বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। (২খ. ৫১৮পৃ.)
উল্লেখ্য, এ হাদীসের বর্ণনাকারী কেউ দুর্বল নন। সনদের বিচ্ছিন্নতার কারণেই হয়তো ইবনে হাজার রহ. এটিকে দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। আর সনদের বিচ্ছিন্নতা বলতে তিনি বুঝিয়েছেন, আবু উবায়দা তাঁর পিতা ইবনে মাসউদ রা. থেকে হাদীস শোনেন নি। কিন্তু এ অভিযোগে এই হাদীসকে দুর্বল আখ্যা দেওয়া ঠিক নয়। তার কারণগুলো নি¤œরূপ:
ক. হাফেজ যাহাবী রহ. আবু উবায়দা সম্পর্কে সিয়ার গ্রন্থে লিখেছেন, روى عن أبيه شيئا وأرسل عنه اشياء অর্থাৎ তিনি কিছু হাদীস সরাসরি তাঁর পিতা থেকে (শুনে) বর্ণনা করেছেন, আর অনেক হাদীস মুরসালরূপে বর্ণনা করেছেন। (৪খ, ৩৬৩পৃ)
খ. ইমাম বুখারী রহ. তার আলকুনা গ্রন্থে (নং ৪৪৭) সহীহ সনদে উল্লেখ করেছেন, أنه فيما سأل أباه عن بيض الحمام فقال صوم يوم অর্থাৎ তিনি তার পিতাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইহরামরত ব্যক্তি যদি কবুতর জাতীয় পাখির ডিম ভেঙ্গে ফেলে তাকে কী ক্ষতিপূরণ আসবে? তিনি বললেন, একদিনের রোজা রাখতে হবে।
এসব থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আবু উবায়দা তার পিতা থেকে কিছুই শোনেননি: কথাটি সঠিক নয়। ফলে সূত্র বিচ্ছিন্নতার অভিযোগটিও ঠিক থাকে না।
গ. যদি ধরেও নিই যে, তিনি তাঁর পিতা থেকে শোনেন নি, তথাপি এ অভিযোগে তার বর্ণিত হাদীসকে দুর্বল আখ্যা দেওয়া মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতেই সঠিক নয়। আলী ইবনুল মাদীনী রহ. আবূ উবায়দা বর্ণিত একটি হাদীস সম্পর্কে বলেছেন, هو منقطع وهو حديث ثبت অর্থাৎ সূত্র বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও এটি একটি দৃঢ় ও উত্তম হাদীস। ইয়াকুব ইবনে শায়বা রহ. বলেছেন,
إنما استجاز أصحابنا أن يدخلوا حديث أبي عبيدة عن أبيه في المسند – يعني في الحديث المتصل ـ لمعرفة أبي عبيدة بحديث أبيه وصحتها ، وأنه لم يأت فيها بحديث منكر
অর্থাৎ আমাদের মুহাদ্দিসগণ পিতার সূত্রে আবু উবায়দার বর্ণিত হাদীসকে মুসনাদ তথা মুত্তাসিল বা সূত্র অবিচ্ছিন্ন হাদীসের অন্তর্ভুক্ত এজন্য করেছেন যে, তিনি তার পিতার হাদীস সম্পর্কে খুব ভালো জ্ঞান রাখতেন। তার সে সম্পকির্ত জ্ঞান বিশুদ্ধ ছিল। এবং তিনি তাতে কোন আপত্তিকর বর্ণনা পেশ করেননি। (দ্র. শারহু ইলালিত তিরমিযী, ইবনে রজব হাম্বলী, পৃ. ১৮২)
এসব কারণে হাকেম আবু আব্দুল্লাহ নিশাপুরী রহ. মুসতাদরাক গ্রন্থে এ সূত্রের অনেক হাদীসকে সহীহ আখ্যা দিয়েছেন। (দ্র. আলকাশিফ এর টীকা)
লক্ষ করুন, এসব সিদ্ধান্ত ঐ মুহাদ্দিসগণের, যাদের কেউই হানাফী নন। এতদসত্ত্বেও আলবানী সাহেব তাঁর সিলসিলাহ যয়ীফা গ্রন্থে বলেছেন,
وقد حاول بعض من ألف في مصطلح الحديث من حنفية هذا العصر أن يثبت سماعه منه دون جدوى
অর্থাৎ হাদীস শাস্ত্রের মূলনীতি বিষয়ক রচনায় বর্তমান কালের কোন কোন হানাফী লেখক আবু উবায়দার স্বীয় পিতা থেকে হাদীস শ্রবণ প্রমাণ করতে অনর্থক চেষ্টা চালিয়েছেন। (হাদীস নং ১০১৬)
আলবানী সাহেব এ হাদীস সম্পর্কে পাঁচটি অভিযোগ এনেছেন। এর একটির জবাব পূর্বোক্ত আলোচনায় এসে গেছে। ৫ম অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেছেন,
وهي العلة الحقيقية، وهي خطأ عتاب بن بشير في رفعه، فإنه مع الضعف الذي في حفظه قد خالفه محمد بن فضيل فقال : عن خصيف به موقوفا على ابن مسعود. أخرجه ابن أبي شيبة
অর্থাৎ পঞ্চম কারণটি হচ্ছে এ হাদীস দুর্বল হওয়ার প্রধান ও প্রকৃত কারণ। আর তা হলো, হাদীসটি মারফূ রূপে বর্ণনা করার ক্ষেত্রে আত্তাব ইবনে বশীরের ভ্রান্তি। তার স্মৃতিশক্তিতে কিছুটা দুর্বলতা তো ছিলই। অধিকন্তু তাঁর বিপরীতে মুহাম্মদ ইবনে ফুযায়ল একই সূত্রে এ হাদীসটি ইবনে মাসউদ রা. এর আমলরূপে বর্ণনা করেছেন। ইবনে আবী শায়বা এটি উদ্ধৃত করেছেন।
এর জবাবে আমরা বলব, আত্তাব ইবনে বশীর বুখারী শরীফের রাবী। (দ্র. হাদীস নং ৫৭১৮ ও ৭৩৪৭) অধিকাংশ মুহাদ্দিস তার বিশ্বস্ত হওয়ার পক্ষে। তাঁর বর্ণনাসমূহ বিচার-বিশ্লেষণ পূর্বক ইবনে আদী রহ. বলেছেন, ومع هذا فإني أرجو أنه لا بأس به. অর্থাৎ এতদসত্বেও আমি মনে করি তাঁর মধ্যে অসুবিধার কিছু নেই। অপর দিকে মুহাম্মদ ইবনে ফুযায়লও সমালোচনার উর্ধ্বে নন। ইবনে সাদ বলেছেন, وبعضهم لا يحتج بهঅর্থাৎ কেউ কেউ তাকে প্রমাণযোগ্য মনে করেন না। আবু হাতিম রাযী রহ. বলেছেন, كثير الخطأ অর্থাৎ তিনি অনেক ভুলভ্রান্তির শিকার। তিরমিযী শরীফে একটি হাদীস সম্পর্কে ইমাম বুখারীর বাচনিক উদ্ধৃত হয়েছে যে, وحديث محمد بن فضيل خطأ أخطأ فيه محمد بن فضيلমুহাম্মদ ইবনে ফুযায়লের হাদীসটি ভুল। ভুলটির শিকার হয়েছেন ইবনে ফুযায়ল। (হাদীস নং ১৫১)
সুতরাং ইবনে ফুযায়লের বর্ণনার কারণে আত্তাবের বর্ণনাকে দুর্বল আখ্যা দেওয়া যায় না। বিশেষ করে এ কারণেও যে আত্তাব সম্পর্কে ইবনে সাদ বলেছেন, راوية لخصيف অর্থাৎ তিনি খুসায়ফ রহ. এর বিশিষ্ট রাবী।
৪. নাফে’ রহ. বর্ণনা করেন,
كَانَ ابْنُ عُمَرَ يُطِيلُ الصَّلاَةَ قَبْلَ الْجُمُعَةِ وَيُصَلِّى بَعْدَهَا رَكْعَتَيْنِ فِى بَيْتِهِ وَيُحَدِّثُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- كَانَ يَفْعَلُ ذَلِكَ
ইবনে উমর রা. জুমআর পূর্বে দীর্ঘ নামায পড়তেন এবং জুমআর পরে ঘরে গিয়ে দুই রাকাত পড়তেন। আর বলতেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনই করতেন। (আবু দাউদ শরীফ, ১১২৮)
এ হাদীসের শেষ বাক্যটি থেকে বোঝা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমআর পূর্বে চার রাকাত পড়তেন। ইমাম নববী রহ. এ হাদীস দ্বারা জুমআর পূর্বে চার রাকাত সুন্নত হওয়ার দলিল পেশ করেছেন। ইবনে রজব হাম্বলী রহ. তো স্পষ্ট করে তার বুখারী শরীফের ভাষ্যগ্রন্থ ফাতহুল বারীতে বলেছেন,
وظاهر هذا : يدل على رفع جميع ذلك إلى النبي ( صلى الله عليه وسلم ) : صلاته قبل الجمعة وبعدها في بيته ؛ فإن اسم الإشارة يتناول كل ما قبله مما قرب وبعد ، صرح به غير واحد من الفقهاء والأصوليين .وهذا فيما وضع للإشارة إلى البعيد أظهر ، مثل لفظة : ” ذلك ” ؛ فإن تخصيص القريب بها دون البعيد يخالف وضعها لغة .
অর্থাৎ এই শেষ বাক্যটি বাহ্যিকভাবে নির্দেশ করে যে, জুমআর পূর্বে চার রাকাত ও পরে ঘরে পড়া দুই রাকাত সবটাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল ছিল। কেননা ইসমে ইশারা বা ইংগিত বাচক বিশেষ্য (ذلك) তার পূর্বের নিকটবর্তী ও দূরবর্তী সবটাকেই ইংগিত করে। একাধিক ফকীহ ও উসূলবিদ একথা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন। আর এ ذلك দূরবর্তী বস্তুর প্রতি ইংগিতবাচক হওয়ার ক্ষেত্রে ততধিক স্পষ্ট। কারণ দূরবর্তীকে বাদ দিয়ে নিকটবর্তী বস্তুর জন্য সেটাকে খাস করা তার শাব্দিক গঠনের উদ্দেশ্য বিরোধী। (দ্র. হাদীস নং ৯৩৭)
৫. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনুস সাইব রা. বর্ণনা করেন,
أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يصلي أربعا بعد أن تزول الشمس قبل الظهر – أي :قبل صلاة فريضتها – وقال أنها ساعة تفتح فيها أبواب السماء وأحب أن يصعد لي فيها عمل صالح. أخرجه أحمد ٣/٤١١ والترمذي (٤٧٨) وهذا المعني مذكور في حديث أبي أيوب عند ابن أبي شيبة (٥٩٩٢) ولفظه: أن أبواب الجنة تفتح عند زوال الشمس.
অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্য ঢলে যাওয়ার পর জোহরের পূর্বে – অর্থাৎ জোহরের ফরজ পড়ার পূর্বে – চার রাকাত নামায পড়তেন। তিনি বলেছেন, এ সময়টায় আসমানের দ্বার খোলা হয়। আর এ সময় আমার নেক আমল উপরে উঠুক, আমি তা পছন্দ করি। মুসনাদে আহমদ, ৩/৪১১; তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং ৪৭৮।
হযরত আবূ আইয়্যুব রা. এর হাদীসেও অনুরূপ বক্তব্য পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে- সূর্য ঢলার সময় জান্নাতের দরজা খোলা হয়। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৫৯৯২।
হাদীস দুটির সনদ সম্পর্কে শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামা লেখেন,
فحديث أبي أيوب وحده بطرقه قوي وحديث عبد الله بن السائب كذلك حسن لذاته فازداد قوة.
অর্থাৎ শুধু আবূ আইয়্যূব রা. এর হাদীসটি তার সূত্রগুলোর কারণে বেশ মজবুত। আর আব্দুল্লাহ ইবনুস সাইব রা. এর হাদীসটি حسن لذاته । সুতরাং এতে আরো শক্তি বেড়ে গেল। পরিশেষে শায়খ বলেন,
فهذا المعنى هو حجة لمن يقول بسنية أربع ركعات قبل فرض الجمعة لأن فتح أبواب السماء أو الجنة مناط بزوال الشمس وهذا متحقق في يوم الجمعة وغيره. (المصنف لابن أبي شيبة: ৪/١١٥-١١٦)
অর্থাৎ যারা জুমআর ফরজের পূর্বে চার রাকাত সুন্নতের কথা বলেন এ হাদীসটিই তাদের প্রমাণ। কেননা আসমান কিংবা জান্নাতের দরজা খোলাটা সূর্য ঢলার সঙ্গে সম্পৃক্ত। আর এ অবস্থা জুমআর দিন ও অন্যান্য দিনে সমানভাবে বিদ্যমান। দ্র, মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বার টীকা, ৪খ, ১১৫-১১৬পৃ।
আল্লামা যাইনুদ্দীন ইরাকী র. বলেছেন,
بأنه حصل في الجملة استحباب أربع بعد الزوال كل يوم، سواء يوم الجمعة وغيرها وهو المقصود
অর্থাৎ এ হাদীস থেকে সূর্য ঢলার পর প্রতিদিন: জুমআর দিন হোক আর অন্য কোন দিন: চার রাকাত নামায পড়া উত্তম প্রমাণিত হয়। আর এটাই এর উদ্দেশ্য। (দ্র. ফায়যুল কাদীর, হাদীস নং ৭০৭১