উমরী কাযা : কুরআন-সুন্নাহর আলোকে
তাওহীদ, রিসালত ও আখেরাতের আলোচনার পর কুরআনে সর্বাধিক গুরুত্ব নামাযের প্রতি দেওয়া হয়েছে। বস্তুত শরীয়তে ঈমানের পরেই নামাযের স্থান এবং তা ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ।
এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
رأس الامر الاسلام وعموده الصلاة وذروة سنامه الجهاد. رواه الترمذى فى سننه ۲/۸۹ وقال : هذا حديث حسن صحيح.
“সব কিছুর মূল হল ইসলাম আর নামায হল এর খুঁটি; জিহাদ এর উচ্চতা।” জামে তিরমিযী ২/৮৯ হা.২৬১৬
অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু দারদা রা. কে বলেন:
ولا تترك صلاة مكتوبة معتمدا فمن تركها متعمدا فقد برئت منه الذمة
“তুমি ফরয নামায ইচ্ছাকৃতভাবে পরিত্যাগ করবে না। কেননা, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে তা পরিত্যাগ করে তার উপর থেকে আল্লাহ তাআলার দায়িত্ব ওঠে যায়।” সুনানে ইবনে মাযাহ হা.৩০১
হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রা. তাঁর গভর্ণরদের নিকট ফরমান লিখে পাঠান যে:
أن اهم امركم عندى الصلاة فمن حفظها أو حافظ عليها حفظ دينه، ومن ضيعها فهو لما سواها أضيع.
“নিঃসন্দেহে তোমাদের সকল কর্মের মধ্যে নামাযই আমার নিকট সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। যে ব্যক্তি এর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করল, সে নিজের দ্বীনকে রক্ষা করল। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তা নষ্ট করল সে অপর বিষয়াবলীকে আরো অধিক বিনষ্ট করল।” এরপর তিনি নামাযের সময়ের বিবরণ উল্লেখ করেন।: মুয়াত্তা ইমাম মালেক পৃ.৩
উপরোক্ত হাদীসসমূহ থেকে শরীয়তে নামাযের মান ও অবস্থান সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় এবং নামায ছেড়ে দেওয়ার পরিণতি যে কত ভয়াবহ হতে পারে তাও সুস্পষ্টভাবে জানা যায়।
নামাযের সময় নির্ধারিত
পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে: إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَوْقُوتًا “নিঃসন্দেহে মুমিনদের প্রতি নামায অপরিহার্য রয়েছে, যার সময়সীমা নির্ধারিত।”(সূরা নিসা ১০৩) পবিত্র কুরআনে নামাযের সময়সীমা নির্ধারিত হওয়ার বিষয়টি যেমন উল্লিখিত হয়েছে তেমনি নির্ধারিত সময়ে তা অনাদায় থেকে গেলে পরবর্তী সময়ে তা কাযা করার বিষয়টিও পরোক্ষভাবে উল্লিখিত হয়েছে। সহীহ হাদীস ও আছারে সাহাবাতে বিষয়টির সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা বিদ্যমান।
‘আদা ’ ও ‘কাযা’র বিবরণ
নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই যদি নামায আদায় করা হয় তবে তাকে ‘আদা’ বলা হয় এবং পরে আদায় করা হলে ‘কাযা’ বলা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই এক হাদীসে ইবাদতের ‘কাযা’র দর্শনটি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী করে বুঝিয়েছেন।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, “এক মহিলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলল, আমার মা মান্নত করেছিলেন যে, তিনি হজ্জ করবেন। কিন্তু তা পূর্ণ করার আগেই তিনি মারা গেছেন। (এখন আমার করণীয় কী) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন:
حجي عنها أرأيت لو كان على أمك دين أكنت قاضية اقضوا الله فالله أحق بالوفاء
তুমি তাঁর পক্ষ থেকে হজ্জ কর। বল তো যদি তোমার মা কারো নিকটে ঋণী হতেন তুমি কি তার ঋণ পরিশোধ করতে? মহিলাটি বলল,হ্যাঁ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তবে তোমরা আল্লাহর ঋণও পরিশোধ কর। কেননা তিনি তাঁর প্রাপ্য পাওয়ার অধিক উপযুক্ত।” সহীহ বুখারী, ১৮৫২; সুনানে নাসায়ী ২/২, ২৬৩৪।
অপর এক বর্ণনায় আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন:এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলল, হে আল্লাহর রাসুল ! আমার পিতা মারা গেছেন । কিন্তু তিনি হজ্জ করতে পারেননি । আমি কি তাঁর পক্ষ থেকে হজ্জ করতে পারি ? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:
أرأيت لو كان على أبيك دين أكنت تقضيه؟ قال: نعم, قال :فدين الله احق.
বলতো তোমার পিতা যদি কারো নিকট ঋণী হতেন তবে কি তুমি তার ঋণ পরিশোধ করতে? লোকটি বলল, হ্যাঁ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:আল্লাহর ঋণ অধিক আদায়যোগ্য। সুনানে নাসায়ী ২/৩, নং ২৬৩৯
উপরোক্ত বর্ণনা সমূহে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী:فاقضواالله ‘তোমরা আল্লাহর ঋণ পরিশোধ কর’, فدين الله احق ‘আল্লাহর ঋণ আদায়ের অধিক উপযুক্ত’, এসব থেকে সুস্পষ্টভাবে জানা যাচ্ছে যে, যে ইবাদতটি বান্দার উপর ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য, তা থেকে দায়মুক্তির পথ হল তা আদায় করা। নির্ধারিত সময় পার হওয়ার ফলে যেমন মানুষের ঋণ থেকে দায়মুক্ত হওয়া যায় না, তেমনি আল্লাহ তাআলার ঋণ থেকেও দায়মুক্ত হওয়া যায় না।
শরীয়তে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত নামাযের ব্যাপারেও এই মূলনীতি প্রযোজ্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী ও আমল এবং সাহাবায়ে কেরামের ‘আছার’ এ প্রমাণই বহন করে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত:
১.এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীগণকে নিয়ে সফর করছিলেন। শেষ রাতে তাঁরা বিশ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা বিরতি করলেন এবং হযরত বিলাল রা. কে ফজরের নামাযের জন্য জাগিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লেন। এদিকে হযরত বিলাল রা.ও তন্দ্রাভিভূত হয়ে গেলেন এবং সবার ফজরের নামায কাযা হয়ে গেল। ঘুম থেকে জাগার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবাইকে নিয়ে ফজরের নামায আদায় করেন। এর পর ইরশাদ করেন ঘুম বা বিস্মৃতির কারণে যার নামায ছুটে গেল, যখন সে জাগ্রত হবে তখন যেন তা আদায় করে।”
প্রসিদ্ধ সকল হাদীসগ্রন্থেই বিভিন্ন সূত্রে ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ঘটনাটি বর্ণনা করার পর বলেন, সেই দুই রাকাত (যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাযা হিসেবে আদায় করেছেন) আমার নিকট সমগ্র দুনিয়ার মালিকানা লাভ করার চেয়েও অধিক পছন্দনীয়।” মুসনাদে আহমদ ৪/১৮১ হা.২৩৪৯ মুসনাদে আবূ ইয়ালা ৩/২২-২৩ হা.২৩৭১
হযরত আব্দুল্লাহ ইবরে আব্বাস রা. এর খুশির কারণ হল, এই ঘটনার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহচরবৃন্দ, যাঁরা আগামী দিনে শরীয়তের বিধি-বিধান পৌঁছানোর গুরুদায়িত্ব পালন করবেন, তাঁদের সামনে (এ মূলনীতি) স্পষ্ট হয়ে গেল যে, নামায নির্ধারিত সময়ে আদায়যোগ্য ইবাদত হলেও যদি তা সে সময়ে আদায় করা না হয়, তবে সময়ের পরে হলেও আদায় করা অপরিহার্য়। আল-ইসতিযকার ১/৩০০
২.খন্দকের যুদ্ধে শত্রুবাহিনী দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকার কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদের কয়েক ওয়াক্ত নামায কাযা হয়ে যায়। তাঁরা রাতের বেলায় তা আদায় করেন। সহীহ বুখারী ১/৮৩, ৮৪, ৮৯, ৪১০, ২/৫৯০ সহীহ মুসলিম ১/২২৬,২২৭
৩.খন্দকের যুদ্ধ থেকে ফেরার দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের বললেন-
لايصلين احد العصر الا فى بنى قريضة
“তোমাদের কেউ বনী কুরায়যায় না পৌঁছে আসরের নামায পড়বে না।” সহীহ বুখারী ১/১২৯ ২/৫৯০ সহীহ মুসলিম ২/৯৬
সাহাবায়ে কেরাম রওয়ানা হলেন। পথে আসরের নামাযের সময় অতিবাহিত হওয়ার উপক্রম হলে কতক সাহাবী পথেই নামায পড়ে নেন। আর কতক সাহাবী বনী কুরায়যায় পৌঁছে পরে আসরের কাযা পড়েন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ঘটনা শুনেছেন। কিন্তু পরে কাযা আদায়কারী সাহাবীদের একথা বলেননি যে, নামায শুধু নির্ধারিত সময়েই আদায়যোগ্য; সময় অতিবাহিত হওয়ার পর এর কোন কাযা নেই।
এসব দৃষ্টান্তের বিপরীতে কোন একটি হাদীসে একথা উল্লিখিত হয়নি যে, নির্ধারিত সময়ে নামায পড়া না হলে তা আর পড়তে হবে না। ইস্তেগফার করে নেওয়াই অপরাধ মোচনের জন্য যথেষ্ট।
এ প্রসঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আরো একটি দলীল হল, ইজমায়ে উম্মত। মুসলিম উম্মাহর সকল মুজতাহিদ ইমাম এ ব্যাপারে একমত যে, ফরয নামায নির্ধারিত সময়ে আদায় করা না হলে সময়ের পরে হলেও তা আদায় করতে হবে। এ ব্যাপারে ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্ব করা বা ওযরবশত নামায কাযা হয়ে যাওয়া উভয়টাই সমান। ইমাম ইবনে আব্দুল বার র. বিনাওযরে কাযাকৃত (ছেড়েদেয়া) নামায আদায় করা অপরিহার্য হওয়ার স্বপক্ষে শরয়ী প্রমাণাদি উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন:
ومن الدليل على أن الصلاة تصلي وتقضى بعد خروج وقتها كالصائم سواء وإن كان إجماع الأمة الذين أمر من شذ منهم بالرجوع إليهم وترك الخروج عن سبيلهم يغني عن الدليل في ذلك قوله عليه السلام. . . الاستذكار ۱/٣۰۲–٣۰٣
“ফরয রোযার মত ফরয নামাযও সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে কাযা করতে হয়। এ ব্যাপারে যদিও উম্মতের ইজমাই যথেষ্ট দলীল, যার অনুসরণ করা ঐ সব বিচ্ছিন্ন মতের প্রবক্তাদের জন্যও অপরিহার্য ছিল: তারপরও কিছু দলিল উল্লেখ করা হল। যথা: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী . . .। আল ইসতিযকার ১/৩০২, ৩০৩
পঞ্চম হিজরী শতকের মাঝামাঝি সময়ে কোন কোন বাহ্য-অনুসারী ব্যক্তি এই মত প্রকাশ করে যে, ফরয নামায সময় মত পড়া না হলে তা আর কাযা করতে হবে না। তখনকার এবং পরবর্তীযুগের ইমামগণ এই মতটি অত্যন্ত কঠোর ভাষায় প্রত্যাখ্যান করেন। ইমাম ইবনে আব্দুল বার র. (মৃত.৪৬৩ হি.) তাঁর রচনা আল ইসতিযকারে ১২ পৃষ্ঠা ব্যাপি (১/২৯৯-৩১১) শুধু এই বিষয়েই আলোচনা করেছেন। এবং সহীহ হাদীসের আলোকে উপরোক্ত মতটির ভ্রান্তি সুপ্রমাণিত করেছেন। একে ‘সাবীলুল মুমিনীন’ তথা সকল মুমিনের পথ থেকে বিচ্যুত মত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। (১/৩০২) অন্যান্য ইমামগণও এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট মতামত পেশ করেছেন। যার কিছু উদ্ধৃতি আমাদের এ আলোচনায় রয়েছে। উলামায়ে কেরামের ভূমিকার কারণে এই মতটি একদম বিলুপ্ত হয়ে যায়। তা শুধু পাওয়া যেত বইয়ের পাতায়, বাস্তবে এর কোন অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু ইদানিং কোন কোন মহল থেকে এই পরিত্যক্ত মতটি নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করতে দেখা যাচ্ছে।
এ বিষয়টি সর্বজন স্বীকৃত যে, হুকূকুল ইবাদ বা বান্দার হক বিনষ্ট করা হলে শুধু অনুতপ্ত হওয়া ও ইসতিগফার করাই তাওবার জন্য যথেষ্ট নয়; বরং হকদারের প্রাপ্য আদায় করাও তাওবার অপরিহার্য অংশ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধিক সহীহ হাদীসে ‘আল্লাহর হক্ব’কে বান্দার হক্বের সাথে তুলনা করে বলেন:دين الله احق بالوفاء ‘আল্লাহর হক্ব বিনষ্ট হলে তা আদায় করা (বান্দার হক্বের চেয়ে) অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।’ অতএব আলোচ্য মাসআলাতে নামাযের কাযা আদায় করা ‘তাওবা’রই অংশ। কৃতকর্মের উপর অনুতপ্ত হওয়া, আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করা , আগামীতে এ কাজ না করার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প হওয়া এবং ছুটে যাওয়া নামাযসমূহ আদায় করা: এসব মিলেই ব্যাক্তির তাওবা পূর্ণ হবে। অতএব তাওবাই যথেষ্ট কথাটি ঠিক, কিন্তু মনে রাখতে হবে তওবার মধ্যে কাযা হয়ে যাওয়া নামাযসমূহ আদায় করাও অন্তর্ভুক্ত । শরীয়তের দলীলসমূহ থেকে তাই প্রমাণ হয় এবং এ ব্যাপারে উম্মতের ইজমাও হয়েছে।
ইমাম ইবনে আব্দুল বার র. এই বিষয়টিকেই নিম্নোক্ত শব্দে ব্যক্ত করেছেন:
وأجمعوا على أن على العاصي أن يتوب من ذنبه بالندم عليه واعتقاد ترك العودة إليه قال الله تعالى وتوبوا إلى الله جميعا آية المؤمنون لعلكم تفلحون النور ٣۱ ومن لزمه حق لله أو لعباده لزمه الخروج منه.الاستذكار ۱/٣۰۷
আর একথাও ঠিক নয় যে, হাদীস শরীফে ছুটে যাওয়া নামায আদায় করার বিষয়টিকে ঘুম বা বিস্মৃতি এ দুই অবস্থার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। হাদীসের বক্তব্য দেখুন:
من نسى صلاة أو نام عنها فكفارتها أن يصليها إذاذكرها
‘যে ব্যক্তি নামাযের কথা ভুলে যায় বা ঘুমিয়ে থাকে, তার কাফফারা হল যখন তার নামাযের কথা স্মরণ হবে তখন তা আদায় করা।’ সহীহ বুখারী হা.৫৯৭, সহীহ মুসলিম হা.৬৮৪/৩১৫
উপরোক্ত হাদীসে ঘুম ও বিস্মৃতি এ দুই অবস্থায় কাযা হয়ে যাওয়া নামায আদায় করার আদেশ করা হয়েছে। কিন্তু নামায আদায়ের বিষয়টিকে এ দুই অবস্থার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করা হয়নি এবং বলা হয়নি যে, ইচ্ছাকৃতভাবে যে নামায পরিত্যাগ করা হয়েছে তা আর আদায় করার প্রয়োজন নেই, বা সময়ের পরে আদায় করা হলে তা কোন নামাযই নয়; বরং একটি অর্থহীন কাজ।
উসূলে ফিকহের সাথে সম্পর্ক আছে এমন ব্যক্তিমাত্রই বুঝবেন যে, এ হাদীসে ‘দালালাতুন নস এর নীতি অনুযায়ী ইচ্ছাকৃতভাবে নামায পরিত্যাগকারী ব্যক্তির জন্যও নামায আদায় করার বিধানটি সুপ্রমাণিত হয়। যেমন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:ولا تقل لهما اف‘পিতামাতার সামনে ‘উফ’ (বিরক্তিসূচক) শব্দটি উচ্চারণ করো না।’ এই আয়াতে শুধু ‘উফ’ শব্দটি উচ্চারণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। বলাবাহুল্য এ আয়াত থেকে পিতামাতাকে প্রহার করার অবৈধতাও সুপ্রমাণিত। যে নীতিতে শেষোক্ত বিষয়টি প্রমাণিত হল উসূলে ফিকহের পরিভাষায় তা ‘দালালাতুন নস’ এর অন্তর্ভুক্ত । আমাদের আলোচ্য ক্ষেত্রেও এ একই নীতি কার্যকর হয়েছে।
শুধু তাই নয় হাদীসটির অন্যান্য বর্ণনা এবং পূর্বাপর বক্তব্যের প্রতি মনোযোগের সাথে লক্ষ্য করলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে:
إِذَا رَقَدَ أَحَدُكُمْ عَنِ الصَّلاَةِ أَوْ غَفَلَ عَنْهَا فَلْيُصَلِّهَا إِذَا ذَكَرَهَا فَإِنَّ اللَّهَ يَقُولُ أَقِمِ الصَّلاَةَ لِذِكْرِى.
“যখন তোমাদের কেউ নামায ছেড়ে ঘুমিয়ে পড়ে বা নামায থেকে গাফেল হয়ে যায় তো যখন তার বোধোদয় হবে তখন সে যেন তা আদায় করে নেয়। কেননা আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন: أَقِمِ الصَّلاَةَ لِذِكْرِى ‘আমাকে স্মরণ হলে নামায আদায় কর।’ সহীহ মুসলিম, হা. ৬৮৪/৩১৬
অন্য হাদীসে এসেছে:
سئل رسول الله صلى الله عليه وسلم عن الرجل يرقد عن الصلاة أو يغفل عنها، قال: كفارتها أن يصليها اذا ذكرها.
যে ব্যক্তি নামায রেখে ঘুমিয়ে গেছে বা নামায থেকে গাফেল রয়েছে তার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এর কাফফারা হল যখন তার নামাযের কথা স্মরণ হবে তখন তা আদায় করে নেওয়া। হা.৬১৪
উপরোক্ত হাদীসসমূহে সামান্য চিন্তা করলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, কোন নামায সময় মত আদায় না করা হলে পরবর্তী সময়ে তা আদায় করা অপরিহার্য। নামাযটি ভুলক্রমে কাযা হোক, নিদ্রার কারণে হোক অথবা গাফলতি বা অবহেলার কারণে হোক। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনে কারীমের যে আয়াতাংশটি : أَقِمِ الصَّلاَةَ لِذِكْرِى উদ্ধৃত করেছেন তা খুবই মনোযোগের সাথে লক্ষ্য করা উচিত। কেননা এতে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, উক্ত আয়াতে নামাযের কাযা আদায় করার বিধানটিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এবং তা তখনই হবে যখন আয়াতের অর্থ এই হবে ‘আমাকে স্মরণ হলে নামায আদায় কর।’ অর্থাৎ যখন এই ফরয দায়িত্বটির ব্যাপারে মানুষের বোধোদয় ঘটবে তখন তা আদায় করা অবশ্যকর্তব্য।
বলাবাহুল্য, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু নামায পরিত্যাগ করেছে এমন ব্যক্তির যখন তাওবার তাওফীক হয় এবং গাফলতি ও অবহেলা থেকে জাগ্রত হয় তখন নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলার হুকুমের কথা তার স্মরণ হয় এবং এর গুরুত্বের ব্যাপারে তার বোধোদয় ঘটে। অতএব উপরোক্ত আয়াতের মর্মার্থ অনুযায়ী এ ব্যক্তির কাযাকৃত নামাযসমূহ আদায় অপরিহার্য।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, শরীয়তসম্মত ওযর ছাড়া নামাযকে সময়চ্যুত করা অনেক বড় কবীরা গোনাহ, এ থেকে খালেস হৃদয়ে তাওবা ও ইস্তেগফার করা অপরিহার্য । কিন্তু সময় পার হওয়ার পর নামায পড়া হলে এতে কোন লাভ নেই: এমন কথা নিঃসন্দেহে শরীয়তের উসূল ও নীতিমালা এবং সহীহ হাদীসের পরিপন্থি।
শরীয়তের দৃষ্টিতে একটি বিষয় অপরিহার্য প্রমাণিত হওয়ার পর তা অনর্থক হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। আর ইচ্ছাকৃতভাবে নামায পরিত্যাগকারীর জন্য কাযা আদায় করা যে অপরিহার্য তা তো আমাদের ইতিপূর্বেকার আলোচনায় উল্লেখিত শরয়ী দলীলসমূহ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ হাদীসটি তো সবাই জানেন, যাতে পরবর্তী যুগের আমীরদের ব্যাপারে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, তারা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর নামায আদায় করবে। সে সময় দীনদারদের করণীয় ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
صل الصلاة لوقتها فإن ادركتها معهم فصل فإنها لك نافلة
“তুমি সময় মত নামায পড়ে নাও, এরপর যদি সেইসব আমীরের সাথে নামায আদায়ের পরিস্থিতি আসে (অর্থাৎ তখন যদি তুমি মসজিদে থাক) তবে তাদের সাথেও নামায পড়ে নিবে। এটা তোমার জন্য নফল হবে। (সহীহ মুসলিম হা.৬৪৮/২৩৮-২৪৪ সুনানে আবু দাউদ হা.৪২৭-৪২৮)
এসব আমীর যারা সময় পার হওয়ার পর নামায পড়েছিল তাদের নামায নিঃসন্দেহে কাযা ছিল। কিন্তু তাদের এই নামাযকে অনর্থক সাব্যস্ত করা হয়নি, তাদের পেছনে আদায় করা নামাযটিকে নামায হিসেবেই গণ্য করা হয়েছে। যদি সময়ের পরে নামায পড়া অনর্থকই হত তবে না ইক্তেদা শুদ্ধ হত, না আদায়কৃত নামাযটি শরীয়তের দৃষ্টিতে ধর্তব্য হত।
এখানে লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হল, নির্ধারিত সময় থেকে নামায বিলম্বিত করার কারণে হাদীস শরীফে সেই সব আমীরের অবশ্যই নিন্দাবাদ করা হয়েছে, কিন্তু (সময়ের পরে হলেও) তাদের নামায পড়াকে নিন্দার চোখে দেখা হয়নি বা একে একটি অর্থহীন কাজ হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয়নি। : আল আসতিযকার ১/৩০৪-৩০৫
সূরা মারয়াম (আয়াত ৫৯) এ আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন:
فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلَاةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوَاتِ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا
এই আয়াতের তাফসীরে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা., মাসরুক র., উমর ইবনে আব্দুল আযীয র., কাসেম ইবনে মুখাইমিরা সহ মুফাসসির সাহাবী ও তাবেয়ীগণ বলেছেন, এখানে নামায বিনষ্ট করার অর্থ হল, সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর নামায আদায় করা। তাঁরা বলেছেন-
أخروها عن مواقيتها ولو كان تركا لكان كفرا
অর্থাৎ উপরোক্ত আয়াতে যে শাস্তির কথা এসেছে তা নির্ধারিত সময়ের পরে পড়ার কারণে। অন্যথায় একদম নামায ছেড়ে দেওয়া তো কুফরী। আল ইসতিযকার ১/৩১০ তাফসীরে ইবনে কাসীর ৩/১৪২
এ থেকে বোঝা গেল, ইচ্ছাকৃতভাবে নামায পরিত্যাগ করা কবীরা গোনাহ হলেও সময়ের পরে নামায পড়ে নেওয়া অনর্থক কাজ নয়। একেবারে ছেড়ে দেওয়া থেকে তা অনেক ভাল। এতে একটি কুফরী কাজে নিপতিত হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। আরো দেখুন, আফসীরে ইবনে কাসীর ৪/৫৫৬, সূরা মাউন ৪-৫
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের নিকট দিয়ে গমনকালে বললেন, তোমরা কি জান তোমাদের পালনকর্তা কী বলেন? সাহাবীগণ বললেন, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। এভাবে তিন বার প্রশ্নোত্তরের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ বলেন:
عزتى وجلالى لا يصليها لوقتها إلا أدخلته الجنة ومن صلاها لغير وقتها إن شئت رحمته وإن شئت عذبته . رواه الطبرانى فى الكبير ۱:٣۲۸ وقال الهيثمى فى مجمع الزوائد :فيه يزيد بن قتيبة ذكره ابن ابى حاتم وذكر له راويا واحدا ولم يوثقه ولم يجرحه انتهى.وله شاهد من حديث كعب بن عجرة عند الطبرانى فى الكبير والأوسط وعند احمد فى المسند وفيه عيسى بن المسيب البجلى وهو ضعيف.راجع المجمع ۲:٣۹
“আমার মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের কসম! যে ব্যক্তি নির্ধারিত সময়ে নামায আদায় করবে, আমি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাব, আর যে ব্যক্তি নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পর তা আদায় করবে আমি তাকে অনুগ্রহও করতে পারি এবং আযাবও দিতে পারি”। -আল মুজামুল কাবীর ১০/২২৮, হাদীস ১০৫৫৫) হাদীসটি ‘হাসান’।
সামান্য চিন্তা করলে দেখা যাবে, এই হাদীসে নামাযকে নির্ধারিত সময় থেকে বিলম্বকারীর প্রতি আল্লাহ তাআলার জিম্মাদারি থেকে বঞ্চিত হওয়ার ধমকি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ নামাযটিকে অনর্থক বা মূল্যহীন সাব্যস্ত করা হয়নি।
কাযা নামায সমূহ সুন্নতসহ আদায় করতে হবে কিনা এ সম্পর্কে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া র. বলেন:
المسارعة الى قضاء الفوائت الكثيرة أولى من الاشتغال بالنوافل ، وأما مع قلة الفوائت فقضاء السنن معها أحسن.
“যদি কাযা নামাযের পরিমাণ অনেক বেশী হয় তবে সুন্নত নামাযে লিপ্ত হওয়ার চেয়ে ফরয নামাযসমূহ আদায় করাই উত্তম। আর যদি কাযা নামাযের পরিমাণ কম হয় তবে ফরযের সাথে সুন্নত নামায আদায় করলে তা একটি উত্তম কাজ হবে।” :ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া রহ., ২২/১০৪
এ প্রসঙ্গে সর্বশেষ কথা হল, প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর বালেগ হওয়ার পর থেকে নামায ফরয হয়। এ ফরয শরীয়তের সকল ফরযের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। বলাবাহুল্য, যে বিষয়টি শরীয়তের অকাট্য দলীলসমূহের ভিত্তিতে প্রমাণিত, তা কারো উপর থেকে রহিত করার জন্য অনুরূপ মানের অকাট্য দলীল প্রয়োজন। কোন দলীল প্রমাণ ছাড়া আল্লাহ তাআলার বিধানকে রহিত করার দুঃসাহস কার হতে পারে? আলোচ্য বিষয়ে কোন অকাট্য দলীলতো দূরের কথা, অতি দুর্বল কোন দলীলের ভিত্তিতেও এ কথা প্রমাণিত হয় না যে , যে নামায মানুষের উপর ফরয হয়েছিল তা ব্যক্তির অবহেলা ও অমনোযোগিতার কারণে রহিত হয়ে গেছে। এর বিপরীতে বুদ্ধিমান মাত্রই স্বীকৃত এবং শরীয়তের সুস্পষ্ট ভাষ্যও যে, ঋণ আদায় করা ছাড়া তা থেকে দায়মুক্ত হওয়া যায় না।’ এ মৌলিক নীতিটি ছাড়াও বহু শরয়ী দলীল প্রমাণ দ্বারা কাযা নামাযসমূহ আদায় করা অপরিহার্র্য হওয়ার বিষয়টি সুপ্রমাণিত। এসব শরয়ী দলীলের বিরোধিতা করা এবং ‘সাবীলুল মুমিনীন’ থেকে বিচ্যুত হওয়া কোন দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন আলেমের কাজ হতে পারে না।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক জ্ঞান দান করুন এবং সিরাতে মুসতাকীমের উপর অটল-অবিচল থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।