জুমার নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত
মুফতি মোহাম্মদ এহছানুল হক জেহাদী মুজাদ্দেদী
পবিত্র জুমা সারা বিশ্বের মুসলমানদের সাপ্তাহিক ঈদের দিন। জুমার গুরুত্ব প্রসঙ্গে সুরা জুমার ৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করছেন, ‘হে মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের জন্য আজান দেওয়া হয় তখন তোমরা আল্লাহর ইবাদতের জন্য দ্রুত যাও এবং বেচাকেনা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বোঝ।’ এ আয়াতের মাধ্যমে জুমার নামাজের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। জুমার নামাজের তাগিদ শুধু কোরআনেই নয়, হাদিস শরীফেও এসেছে। হজরত তারিক ইবনে শিহাব (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ক্রীতদাস, মহিলা, নাবালেগ শিশু ও অসুস্থ ব্যক্তি এ চার প্রকার মানুষ ছাড়া সব মুসলমানের ওপর জুমার নামাজ জামাতে আদায় করা অপরিহার্য কর্তব্য।’ (আবু দাউদ, মুসতাদরিকে হাকেম।) কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে জুমার নামাজ ছেড়ে দেয়, তবে তার ব্যাপারে রয়েছে কঠোর হুশিয়ারি।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো শরিয়তসম্মত কারণ ছাড়া জুমার নামাজ বর্জন করবে, তার নাম মুনাফিক হিসেবে এমন দপ্তরে লিপিবদ্ধ হবে, যা মুছে ফেলা হবে না এবং পরিবর্তনও করা যাবে না।’ তাফসিরে মাজহারি।
জুমার দিন মুসলমানদের জন্য সাপ্তাহিক ঈদের দিন এবং এটি দিনগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। ইবনে মাজায় বর্ণিত হাদিসে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘নিঃসন্দেহে জুমার দিন সেরা দিন ও আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম দিন। আল্লাহর কাছে তা ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতরের দিনের চেয়েও উত্তম।’ আর মুসলিমের হাদিসে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যেসব দিনে সূর্য উদিত হয়েছে তার মধ্যে সর্বোত্তম হলো জুমার দিন। সেদিনেই আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং সেদিনেই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং সেদিনেই জান্নাত থেকে তাকে বের করা হয়েছে। যেদিন কেয়ামত হবে, সেদিনও হবে জুমার দিন।’ সাপ্তাহিক ঈদ হিসেবে জুমার দিনের ফজিলত অনেক। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জুমার দিনে ফেরেশতারা মসজিদের প্রতিটি দরজায় দাঁড়িয়ে যায়। তারা মসজিদে আগমনকারী মুসল্লিদের নাম পর্যায়ক্রমে লিপিবদ্ধ করতে থাকে। অতঃপর যখন ইমাম এসে যায়, তখন তারা রেজিস্ট্রার বন্ধ করে খুতবা শুনতে থাকে। যে সবার আগে মসজিদে প্রবেশ করে, সে একটি উট আল্লাহর রাস্তায় দান করার সওয়াব লাভ করে। যে দুই নম্বরে প্রবেশ করে, সে একটি গরু আল্লাহর রাস্তায় দান করার সওয়াব পায়। যে তিন নম্বরে প্রবেশ করে, সে একটি দুম্বা দান করার সওয়াব পায়। যে চার নম্বরে প্রবেশ করে, সে একটি মুরগি দান করার সওয়াব লাভ করে। আর যে পাঁচ নম্বরে প্রবেশ করে, সে একটি ডিম আল্লাহর রাস্তায় দান করার সওয়াব পায়।’ বুখারি, মুসলিম, মুসনাদে শাফি। হজরত সালমান (রা.) থেকে একটি হাদিসে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিনে সুন্দর করে গোসল করবে, অতঃপর তেল ব্যবহার করবে এবং সুগন্ধি নেবে, তারপর মসজিদে গমন করবে, দুই মুসল্লির মাঝে জোর করে জায়গা নেবে না, সে নামাজ আদায় করবে এবং ইমাম যখন খুতবা দেবে, চুপ করে মনোযোগসহকারে তার খুতবা শুনবে। দুই জুমার মধ্যবর্তী সময়ে তার সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ আবু দাউদ। জুমাবারের ফজিলতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো, এদিনে এমন একটা সময় আছে, যখন মুমিন বান্দা কোনো দোয়া করলে আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন।
হাদিস শরিফে এসেছে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করল, আগে আগে মসজিদে গমন করল, হেঁটে মসজিদে গেল, ইমামের কাছাকাছি বসল, মনোযোগ দিয়ে খুতবা শুনল, কোনো কথা বলল না, আল্লাহতায়ালা তাকে প্রতি কদমে এক বছরের নফল ইবাদতের সওয়াব দান করবেন।মুসনাদে আহমাদ : ৫৮১।
হাদিসে জুমার দিনের ছয়টি সুন্নতের আলোচনা করা হয়েছে। সুন্নত ছয়টি হলো :
১. ভালোভাবে গোসল করা। আমরা বাংলাদেশের অধিবাসীরা প্রতিদিন গোসল করে অভ্যস্ত। প্রতিদিনের গোসল আর জুমার দিনের গোসল এক নয়। জুমার দিন গোসল করার সময় সুন্নত পালনের নিয়ত করতে হবে এবং সওয়াবের আশা রাখতে হবে। হাদিসে ভালোভাবে গোসল করার কথা বলা হয়েছে। শরীর নাপাক হয়ে গেলে যেমনিভাবে খুব ভালোভাবে গোসল করা হয় যেন শরীরের প্রতিটি অংশে পানি পৌঁছে যায়, ঠিক তেমনিভাবে জুমার দিনও ভালোভাবে গোসল করে নেবে।
২. আগে আগে সকাল সকাল মসজিদে গমন করা। জুমার দিন সাধারণত অফিস-আদালত, দোকানপাট বন্ধ থাকে। মানুষ অবসরই থাকে। তাই আগে আগে মসজিদে চলে যাওয়া চাই। অপর এক হাদিসে জুমার দিন আগে আগে মসজিদে যাওয়ার ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি গোসল ফরজ হলে যেভাবে গোসল করে জুমার দিন ঠিক সেভাবে ভালো করে গোসল করে অতঃপর সর্বপ্রথম মসজিদে গমন করে, সে একটি উট সদকা করার সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করবে। এরপর দ্বিতীয়তে যে মসজিদে গমন করবে সে একটি গরু আল্লাহর রাস্তায় সদকা করার সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করবে। তৃতীয়তে যে গমন করবে, সে একটি বকরি আল্লাহর রাস্তায় সদকা করার সওয়াব লাভ করবে। চতুর্থতে যে গমন করবে সে একটি মুরগি সদকা করার সওয়াব লাভ করবে। এরপর পঞ্চম নম্বরে যে প্রবেশ করবে, সে একটি ডিম সদকা করার সওয়াব লাভ করবে। -সহিহ বুখারি : ৮৮১
মসজিদে যে যত বেশি আগে আসবে তত বেশি সওয়াব ও ফজিলতের অধিকারী হবে। আগে আগে মসজিদে এসে আমরা কী আমল করব? যাদের উমরী কাজা বা এমনিতেই কাজা নামাজ রয়েছে, তারা কাজা আদায় করব। কাজা আদায় করা ফরজ। তাই যাদের জিম্মায় ফরজ আদায়ের ভার রয়ে গেছে তারা নফলের চেয়ে ফরজকে গুরুত্ব দেব। আগে ফরজ আদায় করব। যারা উমরী কাজা আদায় করব, তারা দৈনিক ছয় ওয়াক্ত হিসেবে আদায় করব। অর্থাৎ ফজরের দুই রাকাত ফরজ, জোহরের চার রাকাত ফরজ, আসরের চার রাকাত ফরজ, মাগরিবের তিন রাকাত ফরজ, এশার চার রাকাত ফরজ ও বিতরের তিন রাকাত। এভাবে পেছনের কাজা আদায় করে নেব। যাদের কাজা নামাজ নেই, তারা নফল নামাজ আদায় করব।
৩. হেঁটে মসজিদে যাবে, কোনো বাহনে আরোহণ করবে না। জুমার নামাজের জন্য কোনো বাহনে আরোহণ না করে হেঁটে হেঁটে মসজিদে যাওয়া সুন্নত। বিশেষ কোনো ওজর না থাকলে এ সুন্নত ত্যাগ করবে না।
৪. ইমামের কাছাকাছি বসবে। আগে আগে মসজিদে গেলে ইমামের কাছাকাছি বসার সুযোগ পাওয়া যায়। তো ইমামের কাছাকাছি বসাও সুন্নত।
৫ : মনোযোগসহ খুতবা শুনবে। মনে রাখতে হবে, জুমার খুতবা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা শুক্রবারে জোহরের সময় জুমার নামাজ পড়ি। জোহর পড়ি চার রাকাত কিন্তু জুমা পড়ি দুই রাকাত। জুমার খুতবা দিতে হয় বলে দুই রাকাত নামাজ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তো জুমার খুতবা দুই রাকাত নামাজের মর্যাদা রাখে। তাই জুমার খুতবা প্রদান করাও ওয়াজিব, শ্রবণ করাও ওয়াজিব। আমরা জুমার খুতবা খুব মনোযোগসহ শ্রবণ করব।
৬ : অনর্থক কোনো কথাবার্তা বা কার্যকলাপে লিপ্ত হবে না। মসজিদে এসে নীরবে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকব। কোনো অনর্থক কথা বলব না। অনর্থক কোনো কাজও করব না। মসজিদে দ্বীনি কথা বলা যাবে। কোরআন তেলাওয়াত করব। জিকির করব। অপ্রয়োজনীয় কোনো কথা বলব না।
যে ব্যক্তি জুমার দিন এ ছয়টি সুন্নত পালন করবে, তার মসজিদে যেতে যতগুলো কদম ফেলতে হয় প্রতিটি কদমে আল্লাহতায়ালা তাকে এক বছর নফল ইবাদতের সওয়াব দান করবেন। এক বছর একাধারে দিনের বেলা রোজা রাখলে এবং রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত-বন্দেগি করলে যে পরিমাণ সওয়াব হবে আল্লাহ পাক তার প্রতি কদমে সে পরিমাণ সওয়াব দান করবেন। সুবহানাল্লাহ! আল্লাহপাক রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে এ সুন্নতগুলো পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ইমাম, আরবি প্রভাষক, আউশপাড়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসা, লাকসাম, কুমিল্লা।
খতিব, মনিপুর বায়তুল আশরাফ জামে মসজিদ মিরপুর-২, ঢাকা।