॥ শেষ কিস্তি ॥ মোহাম্মদ আবু নোমান : প্রথম দশদিনের আমল- প্রত্যেকেরই উচিত ইবাদতের মৌসুমগুলোকে সুন্দর প্রস্তুতির মাধ্যমে স্বাগত জানানো। জিলহজ মাসকে আমরা স্বাগত জানাতে পারি নিচের আমলগুলোর মধ্য দিয়ে-সিয়াম পালন : জিলহজের ১ থেকে ৯ তারিখে যে কোনো দিন বা পূর্ণ ৯ দিন সাওম পালন করা যেতে পারে। তিরমিযি শরিফে এসেছে এই মাসের প্রথম ১০ দিনের যেকোন দিনের সাওম পুরো বছরের সাওমের সমান এবং এই রাতগুলোর ইবাদত লায়লাতুল কদরের ইবাদতের সমান। উলামাদের মত হল এই রোজার দিন হল যার যার দেশের ৯ জিলহজ যখন আসে তখন অর্থাৎ সৌদি আরবের ৯ জিলহজের সাথে মিলিয়ে নয়।মুসলমানের জন্য উচিত হবে জিলহজ মাসের এই মুবারক দিনগুলোতে যত বেশি সম্ভব সিয়াম পালন করা। সাওম আল্লাহর অতি প্রিয় আমল। হাদীসে কুদসীতে সিয়ামকে আল্লাহ নিজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন। রাসূল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ বলেছেন, সিয়াম ছাড়া আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য; শুধু সিয়াম ছাড়া। কারণ, তা আমার জন্য। তাই আমিই এর প্রতিদান দেব। সিয়াম ঢালস্বরূপ।’ [বুখারী; মুসলিম]আবূ কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, ‘আরাফার দিনের সাওম আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিগত ও আগত বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন।’ [মুসলিম] তবে আরাফার এ দিনে আরফার ময়দানে অবস্থানকারী হাজীগণ সওম পালন করবেন না।এ হাদীসের ভিত্তিতে জিলহজের ৯ তারিখ সাওম পালন করা সুন্নত। ইমাম নববী (রহ.) বলেন, এসব দিনে সাওম পালন করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ মুস্তাহাব। কোনো কোনো দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মহিলাদের মাঝে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, জিলহজ মাসের সাত, আট ও নয় তারিখে সাওম পালন করা সুন্নত। কিন্তু সাওমের জন্য এ তিন দিনকে নির্দিষ্ট করার কোনো ভিত্তি নেই। জিলহজের ১ থেকে ৯ তারিখে যে কোনো দিন বা পূর্ণ নয় দিন সাওম পালন করা যেতে পারে। তবে জিলহজের দশ তারিখে রোজা রাখা যাবে না। কেননা সেদিন ঈদুল আযহা।তাকবির পাঠ : ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ জিলহজ মাসের সূচনা থেকে আইয়ামে তাশরীক শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ তাকবীর পাঠ করা সকলের জন্য ব্যাপকভাবে মুস্তাহাব। তবে বিশেষভাবে আরাফা দিবসের ফজরের পর থেকে মিনার দিনগুলোর শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ যেদিন মিনায় পাথর নিক্ষেপ শেষ করবে সেদিন আসর পর্যন্ত (৯ তারিখ ফজর সালাতের পর থেকে ১৩ তারিখ আসর সালাতের পর পর্যন্ত) প্রত্যেক সালাতের পর এ তাকবীর পাঠ করার জন্য বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে।রাসূল (সা.) বলেন, ‘এ দশ দিনে নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় ও মহান কোন আমল নেই। তাই তোমরা এ সময়ে তাহলীল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবীর (আল্লাহু আকবার) ও তাহমীদ (আল-হামদুলিল্লাহ) বেশি বেশি করে পড়।’চুল-নখ ইত্যাদি না কাটা : আল্লাহর কাছে এই মাসের একটি পছন্দনীয় আমল (মুস্তাহাব) হচ্ছে জিলহজের চাঁদ দেখার পর থেকে যারা কোরবানির নিয়ত করেছেন তাদের হাত পায়ের নখ, মাথার চুল ও অবাঞ্ছিত চুল ইত্যাদি কাটবে না, যদি ৪০ দিন না হয়ে থাকে। যদি ৪০ দিনের বেশি হয়ে থাকে, তাহলে এসব কেটে ফেলা আবশ্যক। নতুবা ১০ দিন পর কোরবানির পর পরিষ্কার করবে।হযরত উম্মে সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন যে, যখন জিলহজের ১০ দিনের সূচনা হয়, আর তোমাদের কেউ কোরবানি করার ইচ্ছে করে, সে যেন চুল-নখ ইত্যাদি না কাটে।কোরবানি করা : এ দিনগুলোর দশম দিন সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কোরবানি করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর নবীকে কোরবানি করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন ও কোরবানি করুন।’ [কাউসার] এই ১০ দিনের অন্যতম সেরা প্রিয় আমল হলো কোরবানি। কোরবানির পশু জবাই ও গরিবদের মধ্যে এর গোশত বিতরণের মাধ্যমে আল্লাহর বিশেষ নৈকট্য লাভ হয়। এর দ্বারা গরিবদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ পায় এবং তাদের কল্যাণ সাধন হয়।রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, কোরবানির দিন কোন ব্যক্তি (কোরবানির পশুর) রক্ত ঝরানোর ন্যায় আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় ও পছন্দনীয় অন্য কোন কাজই করতে পারে না। যবাহ করা জন্তু কিয়ামতের দিন তার শিং, পশম ও খুর নিয়ে উপস্থিত হবে। কোরবানির রক্ত মাটিকে পড়ার আগেই আল্লাহর দরবারে তা সন্তুষ্টির মর্যাদায় পৌঁছে যায়। অতএব তোমরা এতে মনের সুখ ও সন্তোষ নিবদ্ধ কর (তিরমিযী, ইবনে মাজা)।হজ ও উমরা সম্পাদন : এ দুটি হলো এ দশকের সর্বশ্রেষ্ঠ আমল। যারা এ দিনগুলোতে হজ আদায়ের সুযোগ পেয়েছেন তারা যে অনেক ভাগ্যবান তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আল্লাহ যাকে তাঁর নির্দেশিত এবং রাসূল (সা.) প্রদর্শিত পন্থায় হজ বা উমরা করার তাওফীক দান করেন তার পুরস্কার শুধুই জান্নাত। রাসূল (সা.) বলেন, ‘এক উমরা থেকে আরেক উমরা এতদুভয়ের মাঝের গুনাহগুলোর কাফফারা এবং মাবরূর হজের প্রতিদান কেবলই জান্নাত।’ [বুখারী; মুসলিম] আর মাবরূর হজ সেটি যাতে কোনো রিয়া বা লোক দেখানো কিংবা সুমআ বা মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর মানসিকতা নেই। নেই কোনো অশ্লীলতা বা পাপাচারের স্পর্শ। যাকে বেষ্টন করে থাকে নেক কাজ ও পুণ্যময় আমল। সালাত কায়েম : সালাত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ, সম্মানিত ও মর্যাবান আমল। তাই এ দিনগুলোতে আমাদের সবার চেষ্টা করা উচিত ফরজ সালাতগুলো জামাতে আদায় করতে। রাতে বেশি বেশি ইবাদত করা, যথা- নফল নামায, কোরআন তিলাওয়াত, তাসবীহ-তাহলীল, তাওবা-ইস্তিগফার ও রোনাজারী ইত্যাদি ইবাদতের মাধ্যমে রাত কাটানো। কারণ, নফল সালাতের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর সবচেয়ে বেশি নৈকট্য হাসিল করে। দান-সাদাকা : এ দিনগুলোতে যে আমলগুলো বেশি বেশি দরকার তার মধ্যে অন্যতম হলো সাদাকা। রাসূল (সা.) বলেন, ‘সাদাকা সম্পদকে কমায় না, ক্ষমার মাধ্যমে আল্লাহ বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং কেউ আল্লাহর জন্য বিনয়ী হলে আল্লাহ তাকে উঁচু করেন।’ [মুসলিম] একনিষ্ঠ তওবা : তওবার অর্থ প্রত্যাবর্তন করা বা ফিরে আসা। যেসব কথা ও কাজ আল্লাহপাক অপছন্দ করেন তা বর্জন করে যেসব কথা ও কাজ তিনি পছন্দ করেন তার দিকে ফিরে আসা। সাথে সাথে অতীতে এ ধরনের কাজে লিপ্ত হওয়ার কারণে অন্তর থেকে অনুতাপ ও অনুশোচনা ব্যক্ত করা। জিলহজের শুভাগমনের আগে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার এ তওবা তথা সকল গুনাহ থেকে ফিরে আসার প্রতি। প্রকৃত তওবা সেটি যার মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। প্রথম. গুনাহটি সম্পূর্ণভাবে বর্জন করা। দ্বিতীয়. গুনাহের জন্য অনুতপ্ত হওয়া এবং তৃতীয়. এই গুনাহটি ভবিষ্যতে না করার সংকল্প করা। দয়াময় খোদা ইরশাদ করেন, যে তাওবা করেছিল, ঈমান এনেছিল এবং সৎকর্ম করেছিল, আশা করা যায় সে সাফল্য অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (কাসাস)। ‘হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজদের উপর বাড়াবাড়ি করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (যুমার)মনে রাখতে হবে সৎ কর্মের মাধ্যমে যেমন আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয়, গুনাহের কাজের মাধ্যমে তেমন আল্লাহর রহমত ও করুণা থেকে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। মানুষ তার নিজের করা অপরাধের কারণে কখনো আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়। তাই আমরা যদি অপরাধ মার্জনা এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তির প্রত্যাশী হই, তাহলে এ দিনগুলোতে এবং এর শিক্ষা কাজে লাগিয়ে বছরের অন্য দিনগুলোতে গুনাহ পরিত্যাগ করতে হবে। কেউ যখন জানতে পারেন কী বড় অর্জনই না তার জন্য অপেক্ষা করছে, তার জন্য যে কোনো কষ্ট সহ্য করা সহজ হয়ে যায়। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান, গ্রহণযোগ্য আমল এবং উত্তম রিজিক দান করুন, সেসব ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করুন যারা সময়ের সূবর্ণ সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার করেছেন। সাথে সাথে আমাদের জাহের-বাতেন রাসূল (সা.)-এর সুন্নতের পায়রবীতে ভরে দিন। লেখক : ধর্মীয়বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমকর্মী।
জিলহজের প্রথম ১০ দিনের করণীয় আমল
পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।





Users Today : 250
Users Yesterday : 767
This Month : 14672
This Year : 186543
Total Users : 302406
Views Today : 17198
Total views : 3593941