জানাজা নামাজের নিয়মাবলী | জানাযার নামাযের পদ্ধতি (হানাফী)
জানাজা একটি আরবি শব্দ যার অর্থ মৃতদেহ বা লাশ। আর জানাজা নামাজ হল মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়ার একটি মাধ্যম। এ কারণে একজন মুসলমান মারা গেলে তার মাগফেরাতের জন্য তার মৃতদেহের সামনে যে দোয়া করা হয় তাকে জানাজা নামাজ বলে। আশেপাশের দু-একজন লোক নামাজ আদায় করলেই মহল্লার সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যায় এইজন্য এটাকে ফরযে কেফায়া বলা হয় । কিন্তু কেউ যদি আদায় না করে, তাহলে সবাই গুনাহগার হবে।
জানাযার নামায ফরযে কিফায়া
জানাযার নামায ফরযে কিফায়া। অর্থাৎ কোন এক ব্যক্তি আদায় করলে সকলেই দায়মুক্ত হয়ে যাবে, নতুবা যাদের নিকট মৃত্যুর সংবাদ পৌঁছেছে কিন্তু জানাযায় উপস্থিত হয়নি তারা সবাই গুনাহগার হবে। জানাযার নামাযের জন্য জামাআত শর্ত নয়। মাত্র একজন ব্যক্তিও যদি আদায় করে নেয় তবে ফরয আদায় হয়ে যাবে। এ নামায ফরয হওয়াকে অস্বীকার করা কুফরী। (আলমগিরী, ১ম খন্ড, ১৬২ পৃষ্ঠা। দুররে মুখতার, ৩য় খন্ড, ১২০ পৃষ্ঠা। বাহারে শরীয়াত, ১ম খন্ড, ৮২৫ পৃষ্ঠা)
জানাযার নামাযে দুইটি রুকন ও তিনটি সুন্নাত
রুকন দুইটি হচ্ছে: (১) চারবার اَللهُ اَكْبَرُ (আল্লাহু আকবর) বলা, (২) ক্বিয়াম বা দাঁড়িয়ে নামায আদায় করা। (দুররে মুখতার, ৩য় খন্ড, ১২৪ পৃষ্ঠা) তিনটি সুন্নাতে মুয়াক্কাদা হচ্ছে: (১) সানা পড়া, (২) দরূদ শরীফ পাঠ করা, (৩) মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করা। (বাহারে শরীয়াত, ১ম খন্ড, ৮২৯ পৃষ্ঠা)
মুক্তাদী এভাবে নিয়্যত করবে: আমি আল্লাহর ওয়াস্তে এই ইমামের পিছনে এই মৃত ব্যক্তির দোয়ার জন্য এই জানাযার নামাযের নিয়্যত করছি। (ফতোওয়ায়ে তাতারখানিয়্যাহ, ২য় খন্ড, ১৫৩ পৃষ্ঠা) এবার মুক্তাদী ও ইমাম উভয়ে প্রথমে কান পর্যন্ত হাত উঠাবেন এবং اَللهُ اَكْبَرُ বলে দ্রুত নিয়মানুযায়ী নাভীর নিচে হাত বেঁধে নিবেন এবং সানা পড়বেন।
সানা পড়ার সময় وَ تَعَالٰى جَدُّكَ এরপর وَجَلَّ ثَنَاءُكَ وَ لَآ اِلٰهَ غَيْرُكَ ط পড়বেন। অতঃপর হাত উঠানো ব্যতীত اَللهُ اَكْبَرُ বলবেন, অতঃপর দুরূদে ইবরাহীম পড়বেন, এরপর হাত না উঠিয়ে আবার اَللهُ اَكْبَرُ বলবেন এবং দোয়া পাঠ করবেন (ইমাম সাহেব তাকবীর সমূহ উচ্চ আওয়াজে বলবেন আর মুক্তাদীগণ নিম্নস্বরে। বাকী দোয়া, যিকির আযকার ইত্যাদি ইমাম ও মুক্তাদী সকলেই নিম্নস্বরে পাঠ করবেন।)
দোয়া পাঠ শেষে পুনরায় اَللهُ اَكْبَرُ বলবেন এবং হাত ছেড়ে দিবেন, অতঃপর উভয় দিকে সালাম ফিরাবেন।সালামে মৃত ব্যক্তি ফেরেশতাগণ এবং নামাযে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গদের নিয়্যত করবেন। ঐভাবে যেমন অন্যান্য নামাযের সালামে নিয়্যত করা হয়, এখানে এতটুকু কথা বেশি যে মৃত ব্যক্তিরও নিয়্যত করবেন। (বাহারে শরীয়াত, ১ম খন্ড, ৮২৯, ৮৩৫ পৃষ্ঠা)
বালিগ (প্রাপ্ত বয়স্ক) পুরুষ ও মহিলার জানাযার দোয়া
اَللّٰهُمَّ اغْفِرْ لِحَيِّنَا وَ مَيِّتِنَا وَ شَاهِدِنَا وَ غَآئِبِنَا وَ صَغِيْرِنَا وَ كَبِيْرِنَا وَ ذَكَرِنَا وَ اُنْثٰنَا ط اَللّٰهُمَّ مَنْ اَحْيَيْتَهٗ مِنَّا فَاَ حْيِهٖ عَلَى الْاِسْلَامِ وَ مَنْ تَوَفَّيْتَهٗ مِنَّا فَتَوَفَّهٗ عَلَى الْاِيْمَان
অনুবাদ: হে আল্লাহ! ক্ষমা করে দাও আমাদের প্রত্যেক জীবিতকে ও আমাদের প্রত্যেক মৃতকে, আমাদের প্রত্যেক উপস্থিতকে ও প্রত্যেক অনুপস্থিতকে, আমাদের ছোটদেরকে ও আমাদের বড়দেরকে, আমাদের পুরুষদেরকে ও আমাদের নারীদেরকে।
হে আল্লাহ! তুমি আমাদের মধ্যে যাকে জীবিত রাখবে তাকে ইসলামের উপর জীবিত রাখো। আর আমাদের মধ্যে যাকে মৃত্যু দান করবে, তাকে ঈমানের উপর মৃত্যু দান করো। (আল মুসতাদরাক লিল হাকিম, ১ম খন্ড, ৬৮৪ পৃষ্ঠা, হাদীস-১৩৬৬)
নাবালিগ (অপ্রাপ্ত বয়স্ক) ছেলের দোয়া
اَللّٰهُمَّ اجْعَلْهُ لَنَا فَرَطًا وَّ اجْعَلْهُ لَنَآ اَجْرًا وَّ ذُخْرًا وَّ اجْعَلْهُ لَنَا شَافِعًا وَّ مُشَفَّعًا ط
অনুবাদ: হে আল্লাহ! এই (ছেলে) কে আমাদের জন্য আগে গিয়ে সামগ্রী সঞ্চয়কারী করে দাও! তাকে আমাদের জন্য প্রতিদান (এর মাধ্যম) এবং সময় মতো কাজে আসার উপযোগী করে দাও। আর তাকে আমাদের জন্য সুপারিশকারী বানিয়ে দাও এবং তেমনই করো, যার সুপারিশ গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকে। (কানযুদ দাকায়িক, ৫২ পৃষ্ঠা)
নাবালিগ (অপ্রাপ্ত বয়স্ক) মেয়ের দোয়া
اَللّٰهُمَّ اجْعَلْهَا لَنَا فَرَطًا وَّ اجْعَلْهَا لَنَآ اَجْرًا وَّ ذُخْرًا وَّ اجْعَلْهَا لَنَا شَافِعَةً وَّ مُشَفَّعَةً ط
অনুবাদ: হে আল্লাহ! এই (মেয়ে) কে আমাদের জন্য আগে গিয়ে সামগ্রী সঞ্চয়কারীনী করে দাও! তাকে আমাদের জন্য প্রতিদান (এর মাধ্যম) এবং সময় মতো উপকারে আসার উপযোগী করো, তাকে আমাদের জন্য কারো সুপারিশকারীনী এবং এমনই যার সুপারিশ গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকে।
জুতার উপর দাঁড়িয়ে জানাযার নামায আদায় করা
জুতা পরিহিত অবস্থায় যদি জানাযার নামায আদায় করা হয়, তাহলে জুতা এবং মাটি দুটোই পবিত্র হওয়া আবশ্যক, আর জুতা খুলে যদি এর উপর দাঁড়িয়ে পড়ে, তাহলে জুতার তলা এবং মাটি পবিত্র হওয়া আবশ্যক নয়।
আমার আক্বা, আ’লা হযরত, ইমামে আহ্লে সুন্নাত মাওলানা শাহ্ ইমাম আহমদ রযা খাঁন رَحْمَۃُ اللّٰہِ تَعَالٰی عَلَیْہِ ইত্যাদিতে নাপাকী ছিলো। অথবা ঐ জুতার তলায় নাপাকী ছিলো এবং ঐ অবস্থায় জুতা পরিধান করে নামায আদায় করে, তার নামায হবে না। সাবধানতা যে, জুতা খুলে এটার উপর পা রেখে নামায পড়বে। তবে মাটি ও তলা যদি নাপাক হয়, তাহলে নামাযে বিঘ্নতা আসবে না। (ফতোওয়ায়ে রযবীয়া (সংশোধিত) , ৯ম খন্ড, ১৮৮ পৃষ্ঠা) ফাতাওয়া আলমগিরি: ১/৬২
স্বপ্নে জানাজা দেখার ব্যাখ্যা কী?
- ইবনে সিরিন বলেছেন যে স্বপ্নে জানাজা দেখা সাধারণভাবে ইঙ্গিত দেয় যে দ্রষ্টা সমস্যা ও উদ্বিগ্ন হবেন, তবে আল্লাহর নৈকট্য এবং প্রার্থনা তাকে দুঃখ থেকে বাঁচতে সাহায্য করবে।
- স্বপ্নে জানার নামায দেখা ইঙ্গিত দেয় যে স্বপ্নদ্রষ্টা একজন শাসককে অনুসরণ করেন।
- ইবনে সিরিন স্বপ্নে একটি মসজিদে জানাযার নামাজকে অন্যদের সাথে স্বপ্নদ্রষ্টার সুসম্পর্ক এবং তার পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্ব ও ভালবাসার একটি প্রশংসনীয় চিহ্ন হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
- স্বপ্নে মৃত ব্যক্তি ছাড়া জানাজার নামাজ নিষিদ্ধ অর্থ, খারাপ খ্যাতি এবং অনৈতিকতার বা দুর্নীতির প্রতীক।
মৃত ব্যক্তিকে গোসল দান ও অন্যান্য কার্যাবলীর ফযীলত
হযরত মাওলায়ে কায়েনাত সায়্যিদুনা আলী মুরতাজা, শেরে খোদা کَرَّمَ اللہُ تَعَالٰی وَجۡہَہُ الۡکَرِیۡم থেকে বর্ণিত;সুলতানে দো-জাহান, শাহানশাহে কাওনো মাকান, রহমতে আলামিয়ান, হুযুর صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْہِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেছেন: “যে কোন মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেয়, কাফন পরায়, সুগন্ধি লাগায়, জানাযা কাধে উঠায়, নামায আদায় করে এবং (মৃত ব্যক্তির) যে সব মন্দ বিষয় দৃষ্টিগোচর হয় তা গোপন রাখে, সে গুনাহ থেকে এমনভাবে পবিত্র হয়ে যায় যেভাবে ঐদিন সে তার মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হয়েছিল।” (ইবনে মাজাহ, ২য় খন্ড, ২০১ পৃষ্ঠা, হাদীস নং-১৪৬২)
জানাযার লাশবাহী খাট দেখে পাঠ করার ওযীফা
হযরত সায়্যিদুনা মালিক বিন আনাসرَضِیَ اللہُ تَعَالٰی عَنۡہُ এর ইন্তেকালের পর কেউ তাকে স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞাসা করলো: مَافَعَلَ اللهُ بِكَ؟ অর্থাৎ-আল্লাহ তাআলা আপনার সাথে কিরূপ আচরণ করেছেন?” বললেন: “একটি বাক্যের কারণে ক্ষমা করে দিয়েছেন, যা হযরত সায়্যিদুনা ওসমান গনী رَضِیَ اللہُ تَعَالٰی عَنۡہُ জানাযাকে দেখে বলতেন: (বাক্যটি হলো:) سُبْحٰنَ الْحَىِّ الَّذِىْ لَايَمُوْتُ (অর্থাৎ- ঐ পুতঃপবিত্র সত্ত্বা যিনি জীবিত, যার কখনো মৃত্যু আসবে না।) সুতরাং আমিও জানাযা দেখে এরূপ বলতাম, আর এ বাক্য বলার কারণে আল্লাহ তাআলা আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।” (ইহইয়াউল উলূম থেকে সংগৃহীত, ৫ম খন্ড, ২৬৬ পৃষ্ঠা)
রাসুলুল্লাহ ﷺ সর্বপ্রথম কার জানাযার নামায আদায় করেছেন?
জানাযার নামাযের শুরু হযরত সায়্যিদুনা আদম ছফিউল্লাহ عَلٰی نَبِیِّنَاوَعَلَیْہِ الصَّلوٰۃُ وَالسَّلام এর যুগ থেকে হয়েছে। ফেরেশতারা সায়্যিদুনা আদম ছফিউল্লাহ عَلٰی نَبِیِّنَاوَعَلَیْہِ الصَّلوٰۃُ وَالسَّلام এর জানাযা মোবারকে চারবার তাকবীর বলেছিলো। ইসলামের জানাযা নামায ওয়াজীব হওয়ার হুকুম মদীনা শরীফে অবতীর্ণ হয়। হযরত সায়্যিদুনা আসআদ বিন যুরারা رَضِیَ اللہُ تَعَالٰی عَنۡہُ এর ইন্তিকাল হিজরতের নবম মাসের শেষের দিকে হয়েছিলো। তিনিই প্রথম মৃত সাহাবী ছিলেন। রাসুলে আকরাম صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْہِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم তাঁর জানাযার নামায আদায় করেন। (ফতোওয়ায়ে রযবীয়া (সংশোধিত) , ৫ম খন্ড, ৩৭২-৩৭৫ পৃষ্ঠা)