জঙ্গি-জিহাদ : বিষয়টা কি?
_______________📝কবি মাহদি গালিব
ক’ পত্রিকা : মোদি পেরিয়েছে নদী!
খ’ পত্রিকা : মোদি মারল মাঝির ভাত! নৌকা ছাড়াই পেরোলো নদী!
মোদির মা : আরে, মোদি তো সাঁতার-ই জানে না!!!
মোদি সেদিন হাঁটছিল। নদীর ধার ঘেঁষে। একটা ছিল ব্রিজ। হেঁটেই পেরোলো। কিন্তু পত্রিকার দরকার শিরোনাম। তাই তিল হল তাল।
এই যে তালকে তিল বানানো। এটিকে বলে প্রোপ্যাগান্ডা (propaganda)। শব্দটির ব্যবহার নেতিবাচক, নেগেটিভ। অথচ শব্দটি স্বাভাবিক। উৎসগত ভাবে। কালেকালে এটি একটি টার্মোলজি, পরিভাষায় পরিণত হয়েছে। এখন প্রোপ্যাগান্ডা মানেই খারাপ কিছু।
১৬২২ সাল। ৩৯৭ বছর আগে। ইতালির রোমে একটি অনুষ্ঠান হয়। পোপ পঞ্চাদশ গ্রেগরির আয়োজনে। সেদিন সিদ্ধান্ত হয়। তারা মিশনে নামবে। অধার্মিক দেশে ধর্ম ছড়াবে। সে মিশনের নাম ছিল প্রোপ্যাগান্ডা। যার অর্থ প্রচারণা। এর আগে শব্দটি পরিচিত ছিল না। ধীরেধীরে ব্যবহার বাড়ে।
১৬৪২-১৬৫১ সাল। ‘ইংলিশ সিভিল ওয়ার’ শুরু হয়। ইংল্যান্ডের রাজা আর সুশীলদের মধ্যে। সুশীল মানে অভিজাত-বেসামরিক শ্রেণি। সুশীলেরা তখন প্রোপ্যাগান্ডা চালাত। রাজার বিরুদ্ধে প্রচারণা। তখন থেকে ‘প্রোপ্যাগান্ডা’ শব্দটি নেতিবাচক হয়। প্রশাসন প্রোপ্যাগান্ডা ত্যাড়া চোখে দেখত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। প্রোপ্যাগান্ডা শব্দটি চূড়ান্ত নেতিবাচক হয় তখন। হিটলার একটি মন্ত্রণালয় চালু করে। প্রোপ্যাগান্ডা মিনিস্ট্রি। যুদ্ধের ভুল তথ্য প্রচার, বিশেষত এন্টি-সেমিটিজম বা ইহুদী ও জায়োনিজমকে উস্কানোই যার কাজ। পশ্চিমার তখন প্রোপ্যাগান্ডা মানেই খারাপ বুঝত, বুঝাত।
এভাবে প্রোপ্যাগান্ডা’ শব্দটি একটি ট্যাবু হয়ে যায়। ট্যাবু মানে নিষিদ্ধ কিছু। যেমন, ফরমালিন। কয়েক বছর আগেও চিনতেন না। এখন নাম শুনলেই চমকান। অথচ ফরামেলিনের ভালো দিকও আছে।
‘জঙ্গি’ শব্দটির পরিণতি এমনি। ‘জঙ্গি’ ফার্সী শব্দ। ইরান দেশের ভাষা। মানে যোদ্ধা। ক্রসেডারদের যেমন ‘নাইট’। মুসলিমদের তেমন জঙ্গি। এটি সম্মানী শব্দ। যেমন নূরুদ্দিন জঙ্গি। জঙ্গি রাজবংশের (dynasty) রাজা ছিলেন। ১১৭৪ এ ইন্তেকাল। সালাউদ্দিন আইয়ুবী তাঁর সেনাপতি ছিল। প্রথম জীবনে।
মদিনা-মুনিব (দ) তাঁর স্বপ্নে আসে। বলে- নুরুদ্দিন! দু’জন ইহুদী ঢুকেছে মদিনায়, সুড়ঙ্গ খুঁড়ছে, আমার রওজার ক্ষতি করবে। নুরুদ্দিন জঙ্গি ধরেন দুজনকেই। এরপর গভীর গর্ত করেন। রওজার চারিধারে। সীসা-তামা গলিয়ে ঢালেন। দেয়াল বানান। রওজা সুরক্ষিত করেন।
আবার, আবু সালেহ মূসা জঙ্গি। গাউসে পাকের পিতার নাম। এখানেও জঙ্গি। যা-হোক, খেয়াল করুন। একসময় রাজবংশের নাম ছিল ‘জঙ্গি’। এখন আজকের জঙ্গি, আর তাঁরা কি এক? পড়তে থাকুন প্লিজ। ধৈর্য রাখুন।
জাপানে খৃষ্টধর্ম নিষিদ্ধ ছিল। ১৮৭৩ সাল অবধি। কারণ জাপান জানত, ইউরোপীয়রা প্রথমে ব্যবসা করবে। এরপর মিশনারি আনবে। ধর্মপ্রচার করবে। স্থানীয়রা তা মানবে না। কলহ বাড়বে। খুনখারাবি হবে। আর সে সুযোগটাই নিবে ইংল্যান্ড-ইউরোপীয়রা। বলবে- আমার ধর্মগুরু মারো, আমরাও মারব। ব্যাস, ছিনিয়ে নিবে জাপান। ছুঁত পেলেই হল। দেশ দখল আটকায় কে।
পশ্চিমারা এ কৌশলে পারদর্শী। ধর্ম নিয়ে খেলতে জানে। কারণ, মানব-হৃদয়ে ধর্মের মত তুলতুলে জায়গা দ্বিতীয়টি নেই। আফগানিস্তানকে ধরুন। ১৯৮০-৯০ সাল। রাশিয়ার দখলে ছিল। রাশিয়াকে খ্যাদানো দরকার। না হলে অ্যামেরিকার তেল নেই। পশ্চিমারা ছঁক আঁকলো। আল-কায়েদার বানালো। অর্থায়ন করলো। বলল- ধর্ম ধ্বংস হচ্ছে। ঝাঁপিয়ে পরো। জিহাদ করো।
আরিব্বাস! আর পায় কে! কিছু আফগান লাফালো। ফলাফল, দুই দশকের দাসত্ব। এখনো জ্বলছে। আবার আল-কায়েদাই টুইনটাওয়ার ভাঙলো। আজব না। পশ্চিমার বানালো ওদের। ওরাই পশ্চিমার দেশে আক্রমণ করলো? কখনো ভেবেছেন, কেন? উত্তরটা সহজ। মিছিল-মিটিঙে পুলিশের লোক থাকে। সাদা পোষাকে। পুলিশ-মিছিল মুখোমুখি হয়। সাদাপোষাকের পুলিশ ভিড় থেকে মারে ঢিল। এতে পুলিশের সহজ হয়। অ্যাকশনে নামতে পারে।
ঢিল মেরেছিল আল-কায়েদা। অ্যাকশনে নামল ন্যাটো-অ্যামেরিকা। ব্যাস, বাজিমাৎ! আফগান হল দরজা। ইরান-সিরিয়া-ইয়ামেন-কাতারে ঢুকার।
একটা বিষয় ভাবুন। আল-কায়েদা, আইএস, বোকো হারাম এসব দলের একটি মিল আছে। মানুষ মারো, জবাই করো, প্রাচীন স্থাপত্য-মাজার ভাঙো, ইতিহাস-ঐতিহ্য অমান্য কর; এসব ক্ষেত্রে। আর এসব সমস্ত কিছুই একটি বিশেষ মতাদর্শকে ইঙ্গিত করে। বলা বাহুল্য তা ওহাবি-সালাফিবাদ। পশ্চিমারা এই ওহাবিদের ধ্বংসাত্মক আচরণের সাথে জিহাদি চেতনার স্যুপ বানিয়েছে। খেতে চটকদার। টক-ঝাল-মিষ্টি।
কিন্তু কোনো সুন্নি-সুফি কখনো আইএস, আল-কায়েদা হয়েছে? হবেও না। কারণ সূফীদের জিহাদ আর ওহাবিদের জিহাদ এক না। সূফীরা বড় নদীর মত। ধীরেধীরে বয়। শব্দহীন। কিন্তু যখন মোড় ঘুরায়, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে। যেমন, খাজা গরিবে নেওয়াজ। সূফীদের প্রতিভূ। তিনিও জিহাদ করেছেন। পৃথ্বীরাজকে হটিয়েছেন। কিন্তু কত শাসন এলোগেলো। খাজার সম্মান চিরঅক্ষুণ্ণ। লর্ড কার্জন তাই বলেছিল- ভারত শাসন আমরা করি না। করে একটি দরগাহ। খাজা মইনুদ্দিনের দরবার।
ইবনে আরাবি। তিনিও জিহাদ করেছেন। একটি সালতানাত বানিয়েছেন। উসমানীয় (Ottoman) সাম্রাজ্য। যাঁরা ছয় শতাব্দী দাপিয়েছে পৃথিবী। আবার সালাউদ্দিন আইয়ুবী। জেরুজালেম পুনর্দখল করেন। তাঁর শত্রুরাও তাঁকে সম্মান করে। স্মরণ করে তাঁর উদার-মহানুভবতা। এবং তিনিও সূফী। গাউসে পাক আব্দুল কাদের জিলানির প্রেমিক। দেখুন মুজাদ্দিদ আল-ফেসানিকে। আকবরকে উল্টিয়েছেন। কিন্তু এরা কেউ কি নিরীহ মানুষ মেরেছে? মারলে মুসলিম ব্যতিরেক অন্য ধর্ম থাকত না আজ।
যা-হোক, সূফীরা শুধু দেশ দখল করে নি। মানব হৃদয়ও জয় করেছেন। সূফীরা ধ্বংস করে না। সভ্যতা বিনির্মাণ করে। মানবতা সুরক্ষিত করে। আর বর্তমান জঙ্গিবাদ ও জিহাদ আতংক তৈরী করে। খুন করে, ধ্বংস করে। ওহাবি-সালাফিদের জিহাদ আর ইসলাম-সূফীদের জিহাদ আলাদা। দুটাই বিপরীত, দু’মেরুর। হাজার মাইলেও মিল নেই।
কিন্তু মিডিয়া ও পশ্চিমারা এই ওহাবি-সালাফিদের জঙ্গি বানিয়েছে। প্রোপ্যাগান্ডার মত জঙ্গি শব্দকেও অপব্যবহার করছে। আর আমরা, ওদের শেখানো শব্দ তোঁতার মত আওড়াচ্ছি।
নিউজিল্যান্ডের ঘটনা ধরুন। এক শ্বেতাঙ্গ মসজিদে ঢুকল। মানুষ মারল। আপনারা চেঁচিয়ে উঠলেন খ্রিস্টান জঙ্গি! খ্রিষ্টান জঙ্গি!- আজব রে বাপ। খ্রিস্টান জঙ্গি হয় ক্যামনে? সে মুসলিম মারল। আপনারাও পাগল হলেন। প্রতিশোধ নিবেন। ইসলাম কায়েম করবেন। দুনিয়া উল্টাবেন। হায়রে! ফেসবুকের হুংকারে ধরণী দ্বিধা হয় আরকি।
এটি বিশাল পরিকল্পনা। খুব সূক্ষ্ম। এই যে আপনার ভেতর একটা ক্রেজ, আক্রোশ কাজ করছে। পশ্চিমারা এটাই চায়। এতে তাদেরই সুবিধা। আপনি জানেনও না কিভাবে তাদের সাহায্য করছেন। আসুন গণিত করি।
ইদানিং মানুষের মন বদলাচ্ছে। তুর্কি জেগে উঠছে। সেই উসমানীয় ঢঙে। তুর্কি সিরিয়ালগুলো জনপ্রিয় হচ্ছে। যুবকরা নতুন আইডিয়া পাচ্ছে। আর তুর্কিরা পুরাই ওহাবি-সালাফি বিরোধী।
সচেতনতা বাড়ছে। ধীরেধীরে ওহাবি-সালাফিবাদ স্পষ্ট হচ্ছে। কথিত জঙ্গিবাদ নিয়ে তৈরি হচ্ছে নেচিবাচক ধারণা। বাজারে এ প্রোডাক্ট এখন অচল। আল-কায়েদা নেই। সিরিয়ায় আইএস প্রায় কুপোকাত। পশ্চিমাদের ব্যবসা বন্ধ হয় হয়। সামনে যুদ্ধ হবে না। কেউ অস্ত্র কিনবে না। তাহলে দখলদারি হবে কিভাবে?
বন্দুকের ছবি দেখেছেন? শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী যেগুলো চালিয়েছিল। কমেন্ট বক্সে দিচ্ছি, দেখিয়েন। একটা বন্দুকে লিখা- ‘তুর্কোফগোস’- তুর্কি খাদক। মানে, যে তুর্কিদের খায়। আরেকটাতে লিখা- ‘মিলোশ অবিলিচ’। একজন সার্বিয়ান সৈনিকের নাম। যে সুলতান মুরাদ দ্বিতীয়কে শহীদ করেছিল। মুরাদ দ্বিতীয় ওসমানীয় সুলতান ছিলেন।
তো, কি বুঝলেন? গণিত কি বলে? ঐযে তুর্কি কেন্দ্রিক চেতনা, সেটাইকেই আঘাত করা হয়েছে। যাতে কেউ ওহাবি-সালাফি না হোক নাই। সুন্নি হয়েও যেন কথিত জেহাদি হয়। যাতে খ্রিস্টান মারার আক্রোশে আপনি লাফাতে থাকেন। সেই লাফালাফিতে যুদ্ধ হবে। অস্ত্র বেচা হবে। দখলাদারি চলতে থাকবে। এটাই নীলনকশা।
আচ্ছা উত্তর দিন তো। আপনি খৃষ্টান মারবেন। কিন্তু কতজন মারবেন? সব খ্রিস্টান কি ইসলাম বিরোধী? সব ইহুদী কি জায়োনিস্ট? যদি সবাইকে মারেন, তবে আপনার ও হিটলারের পার্থক্য কি? জালিম আর আপনার পার্থক্য কি? মানুষ মারাই কি সমাধান? আমাদের ইতিহাস কি তাই শিক্ষা দেয়?
আজ একবিংশ শতাব্দী। প্রযুক্তির যুগ। কাঁটাতারে ঘেরা রাষ্ট্রের যুগ। চাইলেই খেলাফত প্রতিষ্ঠা হবে? না, হবে না। ৭১ অস্বীকার অসম্ভব। দু’লক্ষ নারীর সম্ভ্রম সস্তা না। চাইলেই পাক-ভারত-বঙ্গ এক হবে না। সম্ভব না। খেলাফত দূর কি বাত। এজন্যই ইজমা হয়েছে। ইসলামের পণ্ডিতগণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যেহেতু এখন খেলাফত প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। তাই যে দেশে আছেন, সে দেশে যদি ইবাদত পালনের স্বাধীনতা থাকে, তবে সে দেশের আইন মেনে চলতে।
খেলাফত পরবর্তী সাম্রাজ্যের নাম উমাইয়া। একজন উমাইয়া শাসক ছিল। উমর বিন আব্দুল আযিয। একমাত্র ন্যায়বান শাসক। তিনি মা ফাতেমার খেজুর বাগান ফেরত দিয়েছিলেন। আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা ছিল। খেলাফত ফিরাতে চেয়েছিলেন। নিজে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। তবুও পারেন নি। সে যুগেও সম্ভব হয় নি। এখন পারবেন কিভাবে?
তাহলে কি জিহাদ করবো না? অবশ্যই করবেন। নিজেকে গড়ুন। সংশোধন করুন। নফস, প্রবৃত্তি পূজা বাদ দিন। এটাই প্রকৃত সবচে বড় জিহাদ। প্রজন্মকে বাঁচান। তারা যেন, নাস্তিক-ওহাবি-সালাফি-জামাতি-জায়োনিস্ট-ফ্রিম্যাসন না হয়। কোর’আন বলেছে, নিজে বাঁচো, নিজের আহাল (প্রজন্ম) কে বাঁচাও।
জিহাদের সংজ্ঞা ঠিক করুন। পশ্চিমাদের শেখানো, ওহাবি-সালাফিদের দেখানো জিহাদে এগুবেন না। মনে রাখবেন, ইসলাম সহজ কিন্তু সস্তা না। জিহাদ একটা বিশাল বিষয়। বোমা মারলাম, জান্নাত গেলাম, সত্তুর হুর পেলাম, এমন না বিষয়টা। প্রোপ্যাগান্ডার ফাঁদে পড়বেন না। হুজুগ জিনিষটা ভালো না।
ধৈর্য ধরুন। পরিবার-সমাজ গড়ুন। মাদানি সমাজ বানান। সমাজ রাষ্ট্র গড়বে। আর যে সমাজে শুধু মদিনাপ্রেমিক থাকবে, সে রাষ্ট্র হবে মদিনার রাষ্ট্র। মদিনা হয়ত হাজার মাইল দূরে থাকবে। কিন্তু হৃদয় থেকে দূরে থাকবে না। হৃদয়ে মদিনা না, মদিনাকেই হৃদয় বানান। তখন খেলাফত সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এজন্যই ইমাম আ’লা হযরত বলেছেন- হার কাম কি ইয়াক ওয়াক্ত হ্যাঁয় রেযা। প্রত্যেক কাজের একটি সময় আছে।




Users Today : 115
Users Yesterday : 368
This Month : 15357
This Year : 187228
Total Users : 303091
Views Today : 460
Total views : 3625899