শারীরিক অক্ষমতায় চেয়ারে বসে নামায আদায় জায়েজ
শারীরিক অসুস্থতা বা অক্ষমতার কারণে চেয়ারে বসে নামায আদায় বৈধ হবে না। মসজিদে চেয়ার রাখা যাবে না। এমন এক ফতোয়া দেয়া হয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন’র পক্ষ থেকে। ফাউন্ডেশনের গবেষণা বিভাগের মুফতি মুহাম্মদ আবদুল্লাহ্ স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এ ফতোয়া বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে ১ জুন প্রকাশিত হয়।
ফতোয়াসম্বলিত এ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয় যে, নামায আদায়ের শরিয়তসম্মত বিস্তারিত বিবরণ সংবলিত বিধি-বিধান বিভিন্ন হাদীসে যা পাওয়া যায়, তাতে তিনটি অবস্থানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ক. দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে হবে, খ. অসুস্থ হলে বসে বা শুয়েও নামায আদায় করা যাবে, গ. ইশারায় রুকু সিজদা আদায়ের মাধ্যমে করা যাবে। সাহাবাদের সময় থেকে যুগ যুগ ধরে বিকল্প পন্থা হিসেবে চেয়ারে বসে নামায আদায়ের কোন প্রামাণ্য দলিল পাওয়া যায় না। এসব কারণে অসুস্থ অবস্থায়ও চেয়ারে বসে নামায আদায় জায়েজ হবে না, মসজিদে চেয়ার রাখা যাবে না- ফতোয়ার বিজ্ঞপ্তিতে এর উল্লেখ করা হয়েছে। এ ফতোয়া প্রকাশিত হওয়ার পর দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। পরদিন মন্ত্রিসভার বৈঠকেও বিষয়টি আলোচনায় উঠে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এতে বিস্ময় প্রকাশ করেন।
এ ফতোয়ার সঙ্গে একমত নন দেশের বিজ্ঞ আলেমরা। এ ব্যাপারে দ্বিমত প্রকাশ করেছে শীর্ষস্থানীয় মাদরাসা জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার ফতোয়া বিভাগ। এ বিষয়ে উক্ত মাদ্রাসার প্রধান মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ অছিয়র রহমান উল্লেখ করেন- ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাতে মুয়াক্কাদা নামাযে কিয়াম তথা দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে সামর্থ্যবান এবং রুকু ও সিজদা করতে সক্ষম মুসল্লিদের জন্য না দাঁড়িয়ে চেয়ারে বসে বা নামাযের বৈঠকের মত বসে অথবা শুয়ে নামায আদায় করলে উক্ত নামায ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক শুদ্ধ হবে না। যেহেতু সক্ষম ও সামর্থ্যবান নামাযির জন্য ফরয, ওয়াজিব, ও সুন্নাতে মুয়াক্কাদা নামায দাঁড়িয়ে, সূরা কেরাত, রুকু, সিজদা ইত্যাদির মাধ্যমে আদায় করা ফরয। আর যে মুসল্লি জটিল রোগ ও শারীরিক কঠিন সমস্যার কারণে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে এবং যথাযথভাবে রুকু-জিজদা আদায় করতে সম্পূর্ণ অক্ষম তিনি নামাযের বৈঠকের ন্যায় বসে সূরা-কেরাত পড়ে রুকু-সিজদা ঝুঁকে (রুকু হতে সিজদায় একটু বেশি ঝুঁকবে) নামায আদায় করবে। আর যদি বসেও নামায পড়তে সক্ষম না হয়, তখন শুয়ে মাথা ও মুখমণ্ডল কেবলার দিকে করে সূরা, কেরাত পড়ে ইশারা, ইঙ্গিতে রুকু-সিজদা আদায় করবে। যা কিতাবুল হেদায়া, ফতহুল ক্বদির, শরহুল বেকায়া, আদদুররুল মোখতার, ফতোয়ায়ে হিন্দিয়াসহ ফিকহ্-ফতোয়া গ্রন্থে অসুস্থ ব্যক্তির নামায অধ্যায়ে উল্লেখ রয়েছে। তবে কোন মুসল্লি যদি বিশেষ ওযর/ জটিল সমস্যার কারণে দাঁড়িয়ে এবং নামাযের বৈঠকের মত বসে এবং রুকু-সিজদা যথা নিয়মে আদায় করে নামায পড়তে অপারগ ও অক্ষম হয়, তখন তিনি চেয়ারে বসে সূরা, কেরাত পড়ে রুকু-সিজদায় ঝুকে নামায আদায় করবে। ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী তাঁর নামায হয়ে যাবে। তবে নামাযের বৈঠকের মত বসে বা চেয়ারে বসে নামায আদায়কালে নামাযির সামনে টেবিল ও উঁচু কিছু/বেঞ্চ বা বালিশ রেখে সিজদা আদায়ের অনুমতি নেই। হাদিস শরীফ ও ফিকহ্ ফতোয়ার বর্ণনা দ্বারা তা নিষিদ্ধ। আর উক্ত মুসল্লি জমাতে শরিক হলে কাতারের এক পার্শ্বে চেয়ারে বসে নামায পড়বে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ, মিশর ও আরব বিশ্বসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষত পবিত্র মক্কা ও মাদীনা শরীফে অক্ষম ও জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি যারা দাঁড়িয়ে ও নামাযের বৈঠকের ন্যায় বসতে অপারগ, তারা চেয়ারে বসে সূরা, কেরাত পড়ে, রুকু-সিজদায় ঝুঁকে নামায আদায় করছেন। মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফের মুফতি সাহেবানসহ বিশ্বের কোন অভিজ্ঞ ফকিহ উক্ত পন্থাকে সুস্পষ্টভাবে শরীয়তের দৃষ্টিতে নাজায়েজ বলে ফতোয়া দেননি। বরং মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীতে কর্তৃপক্ষ এ ধরনের রোগী ও অক্ষম মুসল্লিদের জন্য অসংখ্য চেয়ারের ব্যবস্থা রেখেছেন। যেহেতু প্রিয়নবী রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, খোলাফায়ে রাশেদা, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তবে তাবেঈন ও মুজতাহিদ ইমামগণ একান্ত অপারগ ও অক্ষম নামাযির জন্য চেয়ারে বসে নামায আদায় করতে নিষেধ করেননি। সেহেতু এটাই বৈধ ও মুবাহ্ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। আর ইসলাম ধর্মের অন্যতম একটি মূলনীতি হল শরিয়তের বিধান এর ক্ষেত্রে সহজতা অবলম্বন করা ও জটিলতা সৃষ্টি না করা। যা হাদীসে রাসূল দ্বারা প্রমাণিত। বিশেষ প্রয়োজনে অনেক নিষিদ্ধ বস্তুও মুবাহ্/জায়েজ হয়ে যায়। (কিতাবুল আশবাহ্ ওয়ান্নাযায়ের কৃত: ইমাম ইবনে নুজাইম মিশরী হানাফী )রহ.) প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন আল্লামা মুফতি মুনিবুর রহমান তাঁর রচিত তাফহিমুল মাসায়েল তৃতীয় খণ্ড ১৭ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে উপরিউক্ত ফায়সালা প্রদান করেছেন। মাসিক তরজুমান-এ আহলে সুন্নাত প্রশ্নোত্তর বিভাগে একাধিকবার উক্ত মাসআলা আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং ‘‘চেয়ারে বসে নামায আদায় জায়েজের প্রমাণ নেই’’ চেয়ারে বসে নামায আদায়ের বৈধতা দানের অবকাশ থাকে না।’’ এবং ‘‘চেয়ারে বসে নামায আদায় বৈধ নয়।’’ এ ধরনের কথা বলা বিভ্রান্তিকর। উপরিউক্ত ফায়সালায় ঐকমত্য পোষণ করেছেন চট্টগ্রাম জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার বিশিষ্ট ফকিহ্ আল্লামা কাজী আবদুল ওয়াজেদ, জামেয়ার প্রধান মুহাদ্দিস আল্লামা হাফেজ সোলায়মান আনসারী, চট্টগ্রাম সোবহানিয়া আলিয়ার প্রধান মুহাদ্দিস আল্লামা কাজী মুঈনুদ্দীন আশরাফী, জামেয়ার প্রধান মুফাস্সির আল্লামা কাজী সালেকুর রহমান আলকাদেরী, সাদার্ন ইউনিভারসিটি চট্টগ্রাম-এর ইসলামিক স্টাডিস বিভাগের প্রফেসর আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ জালালুদ্দীন আলকাদেরী, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও জামেয়ার মুফাসসির আল্লামা বখতিয়ার উদ্দীন, জামেয়ার আরবী প্রভাষক আল্লামা মীর মুহাম্মদ আলাউদ্দীন, জামেয়ার অনার্স বিভাগের প্রভাষক মুফতি হামেদ রেযা নঈমী, হাফেজ মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ আজিজুর রহমান প্রমুখ।
আল্লামা প্রফেসর মুফতি মুনিবুর রহমান উপরিউক্ত বিষয়ে বলেন-
معذور نمازى كو چاھئے كه بهٹি كر نمازپڑهے اگر زمين پر بينار اسكے لئے دشوار هے تو كرسى پر بيٹه كر نماز پڑه سكتاهے البته ركوع وسجود اشارے سے كرے ركوع ميں مناسب حدتك جےےল اور سجدے كيلے اس سے زياده جےحد اسى كو اشارے سے ركوع وسجده كرنا كهےك هيں كسى مينر يا تخته يا بنج پر سرر كه كر سجده نه كرے يه مكروه تحريمى هے- (تفهيم المسائل جلد سوم)
অর্থাৎ মাযূর তথা দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে অক্ষম নামাযী বসে নামায আদায় করবে। যদি জমিনের উপর (নামাযের বৈঠকের ন্যায়) বসা তার জন্য কঠিন হয় তখন চেয়ারে বসে নামায আদায় করতে পারবে। তবে রুকু-সিজদা ইশারায় আদায় করবে। রুকুর জন্য নিয়ম মত ঝুঁকবে আর সিজদার জন্য একটু বেশি ঝুঁকবে। এটাকে ইশারায় রুকু-সিজদা করা বলা হয়। সামনে কোন কাঠ জাতীয় কিছু অথবা বেঞ্চ রেখে তার উপর সিজদা যেন না করে। করলে মাকরূহে তাহরীমা হবে।
[তাফহিমুল মাসায়েল: ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬১-৬২]
ইসলামী ফিকহের অন্যতম গ্রন্থ হেদায়ায় বর্ণনা করা হয়েছে-
ولا يرفع الى وجهه شئ يسجد عليه لقوله عليه الصلوة والسلام ان قدرت ان نسجد على الارض فاسجدوا الا فاوم برأسك- (الحديث)
অর্থাৎ-যে মুসল্লি দাঁড়িয়ে নামায পড়তে অক্ষম সে বসে নামায আদায় করবে আর সিজদা করার জন্য কোন কিছু চেহারা বা কপালের দিকে উঠাবে না। যেহেতু রাসুল পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- যদি তুমি জমিনে সিজদা করতে সক্ষম তবে জমিনে সিজদা করবে। আর যদি জমিনে সিজদা করতে সক্ষমতা না রাখ তবে মাথা ঝুঁকিয়ে ইশারা করে সিজদা আদায় করবে।
[হেদায়া সালাতুল মারিজ: ১ম খণ্ড, ১৪৪ পৃষ্ঠা,
কৃত: ইমাম ফরগানী মরগিনানী হানাফী]
ইমাম বজ্জাজ রহমাতুল্লাহি আলায়হি ও ইমাম বায়হাকী রহমাতুল্লাহি আলায়হি, হযরত জাবের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেছেন- হযরত জাবের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন যে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এক অসুস্থ সাহাবীকে দেখতে গেলেন। তখন তিনি (অসুস্থ সাহাবী) বসে বালিশের /(তাকিয়ার) উপর সিজদা আদায় করছিলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তার সম্মুখ হতে বালিশ সরিয়ে দিলেন। অতঃপর তিনি (রুগ্ন সাহাবী) কাঠ নিলেন তার উপর সিজদা করার জন্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাও সরিয়ে দিলেন। ইরশাদ করলেন- যদি তুমি জমিনের উপর সিজদা করতে সক্ষম তবে জমিনের উপর সিজদা কর আর যদি অক্ষম হও তবে মাথা ঝুঁকিয়ে ইশারা করে সিজদা কর।
[হাশিয়ায়ে হেদায়া কৃত: আবদুল হাই লখনবী ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪৪]
সুতরাং যারা দাঁড়িয়ে বা জমিনে বসে নামায আদায় করতে অক্ষম তাদের জন্য ঘরে/অফিসে/মসজিদের কাতারের এক পার্শ্বে চেয়ারে বসে সূরা কেরাত পড়ে রুকু-সিজদায় মাথা ঝুঁকিয়ে ইশারায় নামায আদায় করা বৈধ ও জায়েজ। তবে দাঁড়িয়ে অথবা জমিনে বসে নামায আদায়ে সক্ষম ব্যক্তি চেয়ারে বসে নামায পড়ার সুযোগ গ্রহণ করবে না, এটা একমাত্র দাঁড়িয়ে ও জমিনে বসে নামায আদায়ে অপারগ ও সম্পূর্ণ অক্ষম ব্যক্তির জন্য বৈধ।
উল্লেখ্য, প্রিয় নবী সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তবে তাবেঈন, মুজতাহিদ ইমামগণের কোন চেয়ারে বসে নামায আদায়ের প্রমান পাওয়া যায় না একথা বলে অক্ষম মুসল্লিদের জন্য চেয়ারে বসে নামায আদায় করাকে অবৈধ বলা যাবে না। যেহেতু তারা কেউ নিষেধ করেছেন তার প্রমাণও পাওয়া যায় না। সে কারণে এটা বৈধ ও জায়েজ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এ ছাড়া ক. চেয়ারে বসা অবস্থায় মাথা-কপাল মাটি হতে দূরে সরে যাচ্ছে, খ. মসজিদে চেয়ার ঢুকিয়ে আসন গ্রহণ করা রাজাধিরাজ, শাহানশাহ্, আহকামুল হাকেমীনের শাহী দরবারের আদবের পরিপন্থি, গ. চেয়ার দ্বারা মসজিদের কাতারের বিঘœ ঘটে, ঘ. মসজিদের চেয়ারে আসন পাতায় বিধর্মীদের সঙ্গে সদৃশ্য থাকে ইত্যাদি। এসব কথা সমীচীন নয় বরং অযৌক্তিক। যেহেতু চেয়ারে বসে নামায আদায়ের বৈধতা একমাত্র অপারগ ও অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য, সকলের জন্য নয়। সুতরাং উপরিউক্ত বিষয়ে বিভ্রান্তির শিকার না হওয়ার জন্য ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের প্রতি আহ্বান জানাই।
وما علينا الا البلاع- الله ورسوله اعلم بالصوب