চন্দ্র দ্বিখণ্ডিতকরণ

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

ইতোপূর্বে আলোচিত হয়েছে, সাইয়্যেদুল মুরসালীন (ﷺ) এর সর্ববৃহৎ মোজেজা হচ্ছে কোরআন মজীদ। তাছাড়া চাঁদকে দ্বিখন্ডিত করা, পানির ঝর্ণা প্রবাহিত করা, খাদ্যবস্তুকে বাড়িয়ে দেয়া, পাথর ইত্যাদি জড় পদার্থ দ্বারা কথা বলানো- এগুলোও নবী করীম (ﷺ) এর বড় বড় মোজেজার অন্তর্ভূত। এগুলোর মধ্যে কোনো কোনো মোজেজা আহাদ, কোনোটি মশহুর, আবার কোনোটি মুতাওয়াতিরের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু মোজেজার বর্ণনা খবরে ওয়াহেদের (একক বর্ণনার) ভিত্তিতে পাওয়া গেলেও বর্ণনায় বিভিন্ন ধারা এবং সনদের পরিপ্রেক্ষিতে সেগুলোও বহুবর্ণিত হাদীছের (মুতাওয়াতির) মর্যাদা পেয়েছে। কিন্তু কিছু মোজেজা তো তাঁর নবুওয়াতের প্রচারের পূর্বেই সংঘটিত হয়েছে। সেগুলোকে এরহাসাত বলা হয়। ‘এরহাস’ এর অর্থ কোনোকিছুর ভিত্তি স্থাপন করা। ওই সকল মোজেজা তাঁর নবুওয়াতের ভিত্তি স্থাপন করেছিলো। আবার কিছু কিছু মোজেজা রসুলেপাক (ﷺ) এর নবুওয়াত প্রকাশের প্রাক্কালে ঘটেছিলো। নবী করীম (ﷺ) এর মোজেজার আরেকটি প্রকারও রয়েছে, যা তাঁর ওফাতের পর আওলিয়া কেরামের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এগুলোকে কারামত বলা হয়। আওলিয়া কেরামের কারামতসমূহ রসুলেপাক (ﷺ) এরই মোজেজার অন্তর্ভূত। এগুলো তাঁর নবুওয়াতের বিশুদ্ধতা এবং রেসালতের সত্যতার প্রমাণ। 

চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করার মোজেজাটি একটি মহান মোজেজা। এটি অন্যান্য মোজেজা থেকে উন্নততর। কেনোনা এর মাধ্যমে ঊর্ধ্বজগতে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা হয়েছিলো, যা অন্য কোনো নবী কর্তৃক সংঘটিত হয়নি। এই মোজেজার বর্ণনা কোরআন করীমেও রয়েছে। আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ ফরমান, ‘কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে এবং চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হয়েছে।’ এই আয়াতে করীমা নবী করীম (ﷺ) এর চন্দ্র দ্বিখ-িত করার ঘটনার দিকেই ইঙ্গিত করছে। মুফাসসেরীনে কেরাম এরকমই তাফসীর করেছেন। অবশ্য কোনো কোনো তাফসীরকার এই আয়াত দ্বারা কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে এবং সেদিন চন্দ্র টুকরা টুকরা হয়ে যাবে এরকম মত গ্রহণ করেছেন। তাদের উক্ত মতামত আল্লাহ্তায়ালার এই আয়াত দ্বারাই খন্ডিত হয়ে যায় ‘কাফেরেরা যখন কোনো নিদর্শন দেখে তখন তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে, এটা পুরাতন যাদু।’ কাফেরেরা তো কিয়ামতের দিন চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়াকে পুরাতন যাদু বলে মনে করবে না। 

হজরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেছেন, রসুলেপাক (ﷺ) এর জামানায় চন্দ্র দু’টুকরা হয়ে এক টুকরা পাহাড়ের উপর ছিলো আর এক টুকরা পাহাড়ের নীচে চলে গিয়েছিলো। এই বর্ণনাটি সাহাবা কেরামের এক বড় জামাত উল্লেখ করেছেন। তাঁরা বলেন, কুরাইশ বংশের কাফেরেরা নবী করীম (ﷺ) এর নিকট মোজেজার দাবি করলো এবং বললো, আপনি সত্য নবী হয়ে থাকলে চাঁদকে দু’টুকরা করে দেখিয়ে দিন। রসুলেপাক (ﷺ) চাঁদের দিকে হাত দ্বারা ইশারা করলেন। চাঁদ দু’টুকরা হয়ে গেলো। লোকেরা হেরা পর্বতকে চাঁদের দু’টুকরার মধ্যখানে দেখতে পেলো। এরপর রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, তোমরা সাক্ষ্য দাও।কাফেরেরা বললো, নিশ্চয়ই ইবনে আবী কাবশা তোমাদের উপর যাদু করেছে। তাদের ভিতর থেকে একজন বললো, তিনি যদি যাদু করে থাকেন, তাহলে তোমাদেরকে করেছেন। কিন্তু সমস্ত পৃথিবীর উপর তো তিনি যাদু করতে পারেন না। ময়দান থেকে মুসাফিরেরা যখন বাড়ি ফিরলো, তখন চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করার ঘটনা বর্ণনা করলো। আবু জাহেল একথা শুনে বলল, আরে এটাতো সেই পুরনো যাদুই। 

হাদীছ শাস্ত্রের একজন বড় আলেম ছিলেন ইবনে আবদুল বার। তিনি বলেন, চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করার হাদীছ সাহাবা কেরামের একটি বিরাট জামাত বর্ণনা করেছেন। তাবেয়ীনের অনেক লোক তা প্রচার করেছেন। এভাবে বর্ণনাকারীদের এক বিশাল সংখ্যা আমাদের যুগ পর্যন্ত পৌঁছেছে। আর কোরআন করীমও তার পক্ষে। তাছাড়া মুতাকাদ্দেমীন ও মুতাআখখেরীনের অনেকে হাদীছ গ্রন্থে বর্ণনার বিভিন্ন ধারা এবং বিভিন্ন সনদের মাধ্যমে উক্ত মোজেজার কথা উল্লেখ করেছেন। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়ায় উদ্ধৃত হয়েছে, মুখতাসারইবনে হাজেরের শরাহতে আল্লামা ইবনে সুবকী (رحمة الله) বলেছেন, আমার মতে চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়ার বর্ণনাটি ব্যাপক বর্ণিত। কোরআন মজীদে এর সাক্ষ্য বিদ্যমান।

সহীহ্ বোখারী ও মুসলিম এবং অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে বহু সহীহ্ সনদে উক্ত ঘটনা বিবৃত হয়েছে। কাজেই বিষয়টি বহুল প্রচারিত বলে বিশুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। অবশ্য কিছু কিছু বেদাতী লোক উক্ত মোজেজাকে অস্বীকার করেছে। তাদের মতটি ওই বিরুদ্ধবাদীদের মতের অনুরূপ, যারা বলে, ঊর্ধ্বাকাশ বিদীর্ণ হওয়া এবং জোড়া লাগা সম্ভব নয়। মিল্লাতে ইসলামীর অনুগত আলেমগণের অভিমত হচ্ছে, উক্ত কাজে জ্ঞানগত অসম্ভাব্যতা নেই। কেনোনা চন্দ্র সূর্য আল্লাহ্তায়ালাই সৃষ্টি। তিনি সেখানে যা ইচ্ছা তাই করতে সক্ষম। যেমন কিয়ামতের বর্ণনায় বলা হয়েছে। বিপথগামীরা বলে থাকে, চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করার হাদীছ বহু বর্ণিত হলে পৃথিবীর সকলেই জানতে পারতো। শুধু মক্কাবাসীদের জন্য এটা বিশিষ্ট থাকতো না। কেনোনা ব্যাপারটা দর্শন ও অনুভূতির অন্তর্গত। আর দৃষ্টি ও অনুভূতিতে আশ্চর্যজনক এই ব্যাপারটি সহজেই সকলকে প্রভাবিত করতে পারতো। ইতিহাসের পাতায় এর উল্লেখ থাকতো। অথচ ঘটনাটি ইতিহাসে নেই। তারকাবিদ্যার পুস্তকেও নেই। 

উলামা কেরাম তাদের সন্দেহের জওয়াব দিয়েছেন এভাবে, রসুল করীম (ﷺ) এর কাছে মোজেজার দাবি করেছিলো একটি কাওমের বিশেষ কতিপয় ব্যক্তি। কাজেই সারা পৃথিবীর মানুষকে দেখানো উদ্দেশ্য নয়। দ্বিতীয়তঃ ঘটনাটি ঘটেছিলো রাতে, যেসময় মানুষ ঘুমিয়ে থাকে। কিছু লোক জেগে থাকলেও ঘরের মধ্যে থাকে। মরুভূমিতে রাতে জেগে থাকার ঘটনা স্বাভাবিক নয়। আর ব্যাপারটি ছিলো এক মুহূর্তের। এমন নয় যে, চন্দ্রটি সারা রাত দ্বিখ-িত অবস্থায় ছিলো। অথবা এমনও হতে পারে, তখন তাদের দৃষ্টিপথে কোনো না কোনো অন্তরায় ছিলো, যেমন পাহাড় পর্বত বা আকাশের মেঘমালা। অথবা মানুষ সে সময় আনন্দ উল্লাস কিস্সা কাহিনীতে নিমজ্জিত ছিলো। তাই সেদিকে কারো খেয়ালই পড়েনি। এটাও স্বাভাবিকতা থেকে বহুদূরে যে, মানুষ চাঁদের দিকে সারাক্ষণ চোখ মেলে বসে থাকবে। হাঁ, এরূপ অবস্থা তখনই কল্পনা করা যেতে পারে যে, মানুষের মধ্যে পূর্ব থেকেই এরকম চাঁদের দিকে অবিরত তাকিয়ে থাকার প্রবণতা ছিলো এবং একটি নির্দিষ্ট তারিখ ও সময় ঘোষণা দিয়ে সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো। এরকম করা হলে সকলের পক্ষেই হয়তো দেখা সম্ভব হতো। আবার এমনও হতে পারে, চন্দ্র সে রাত্রিতে এমন অবস্থানে ছিলো যেখান থেকে কোনো প্রান্তে চাঁদ দেখা গিয়েছিলো, আবার কোনো প্রান্তে দেখা যায়নি। 

যেমন এক কাওমের কাছে চাঁদ প্রকাশমান, কিন্তু অপর কাওমের চোখে তা লুপ্ত থাকে। চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণের সময় তো এরকমই হয়ে থাকে। কোনো দেশ থেকে পূর্ণগ্রহণ দৃষ্টিগোচর হয়, কোনো দেশে আংশিক হয়, কোনো দেশে আবার দেখাই যায় না। গ্রহবিদ্যার পন্ডিতেরা হিসাব করে শুধু গ্রহণ সম্বন্ধে বলতে পারে।

চোখে দেখতে পায় না। হকপন্থীদের নিকট দেখতে পাওয়া না পাওয়া আল্লাহ্তায়ালার কুদরতের অধীন ব্যাপার। আল্লাহ্তায়ালা যাকে ইচ্ছা দেখান। যাকে ইচ্ছা বঞ্চিত করেন। এ মোজেজা তাদেরকেই দেখানো উদ্দেশ্য ছিলো, যারা চ্যালেঞ্জ করেছিলো। তারা রসুলেপাক (ﷺ) এর কাছে নবুওয়াতের আলামত দেখতে চেয়েছিলো। তারা তা দেখেছে। এখানে অন্যের দেখাটা সম্ভাব্য। আবশ্যিক নয়। 

মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়ায় এসেছে, কতিপয় কাহিনীকার এরকম বলে থাকেন, ওইসময় চন্দ্র দ্বিখ-িত হয়ে রসুলেপাক (ﷺ) এর জামা মোবারকের ভিতর দিয়ে ঢুকে আস্তিন দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলো। এ জাতীয় কথার কোনো ভিত্তি নেই। শায়েখ বদরুদ্দীন যারকাশী (رحمة الله) শায়েখ এমাদুদ্দীন ইবনে কাছীর (رحمة الله) থেকে এরকম উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন। ওয়াল্লাহু আ’লাম। 

➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)] 

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment