গাউসে পাক’র সাধনা ও ইবাদত –
মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস আলকাদেরী
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, নবী ও অলিগণ তাঁদের কবরে নামায পড়েন যেভাবে তাঁরা তাঁদের ঘরে নামায পড়তেন। ঈমানদারদের ইহজগত হতে পরজগত অধিকতর উত্তম। কবরে যাওয়ার সাথে তাঁদের কবরে বেহেশতের নেয়ামত জারি হয়ে যায়। পরকালে এসব নেয়ামত পাওয়ার জন্য ইহকালে কাঠোর সাধনা ও ইবাদত করতে হয়। কেমন সাধনা ও ইবাদত করতে হয়, কী ধরনের কষ্ট করতে হয়, তা গাউসে পাকের জীবন থেকে শিক্ষা পাওয়া যায়। নিুে গাউসে পাকের সাধনা ও ইবাদত তুলে ধরার চেষ্টা করব, আল্লাহ্ তা‘আলা তাওফিক দাতা ও সাহায্যকারী। ইরাকের জনহীন গহীন জঙ্গলে সাধনা
প্রখ্যাত লেখক আলম ফক্বরী তাঁর ‘সিরতে গাউসে আযম’ কিতাবে লেখেন, গাউসে পাক যখন পূর্ণ যৌবনে পদার্পণ করেন, তখন তিনি কঠোর সাধনায় মগ্ন থাকতেন। আল্লাহ্ তা‘আলার পরিচয় লাভে ইরাকের জনমানবহীন গহীন জঙ্গলে অবস্থান করতে থাকেন। একবার তিনি নিজেই বলেন, ‘‘আমি পঁিচশ বছর ইরাকের অরণ্য ও জঙ্গলে রিয়াযত করতে থাকি। চল্লিশ বছর ফজরের নামায ইশার অজু দ্বারা আদায় করেছি। পনের বছর যাবত ইশার নামায পড়ে ফজর পর্যন্ত ক্বোরআনুল করিম খতম করছিলাম। কখনো কখনো তিন থেকে চল্লিশ দিন পর্যন্ত পানাহার ব্যতীত দিনযাপন করেছি।’’
ক্ষুধার মধ্যে অতিরিক্ত ধৈর্যধারণের ঘটনা
হযরত আবদুল্লাহ্ হালিমী বর্ণনা করেন যে, হযরত শেখ সৈয়্যদ আমাকে একটি ঘটনা এভাবে শুনিয়েছেন যে, ‘‘যখন আমি শহরের একটি মহল্লা কুতুবিয়া কারকির মধ্যে মুকিম ছিলাম তখন কয়েকটা দিন এমন অতিবাহিত হলো যে, না আমার কাছে কোন খাদ্য দ্রব্য ছিল, না কিছু ক্রয় করার সামর্থ ছিল- এ অবস্থায় আচানক একটি লোক এসে আমার হাতে কাগজে বাঁধা একটি পুঠলি দিয়ে চলে গেলেন। কাগজে বাঁধা মুদ্রা দ্বারা হালুয়া-রুটি ক্রয় করে মসজিদে পৌঁছে গেলাম এবং কিবলামুখী হয়ে বসে এ চিন্তায় ডুবে গেলাম- এ হালুয়া-রুটি খাব কিনা? এমতাবস্থায় মসজিদের দেওয়ালে রাখা কাগজের উপর আমার নজর পড়ল, আমি তা পড়লাম, তাতে লেখা আছে, ‘‘আমি দুর্বল মু’মিনের জন্য রিজিকের প্রবৃত্তি সৃষ্টি করেছি। যেন সে সেটার মাধ্যমে ইবাদত করার শক্তি অর্জন করে।’’ তিনি বলেন এ লেখা দেখে, আমি নিজের রুমাল ওঠালাম এবং তাতে সে খাবার রেখে দু’রাকাত নামায পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে আসলাম। [কলায়েদুল জাওয়াহের]
খিজির আলায়হিস্ সালামের সাথে সাক্ষাৎ
শেখ আবু সাঈদ আহমদ ইবনে আবু বকর হারিমীর বিবরণ, তিনি বলেন, আমি শেখ সৈয়্যদ আবদুল কাদের রাহমাতুল্লাহি আলায়হিকে বলতে শুনেছি যে, আমি যখন ইরাকের গহীন জঙ্গলে প্রবেশ করলাম, তখন প্রথম পর্যায়ে হযরত খিজির আলায়হিস্ সালাম আমার সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং বলতে থাকেন, আমার কথা মোতাবেক আমল করবে। এরপর আমাকে এক জায়গায় বসার ইশারা করে অদৃশ্য হয়ে যেতেন। তিন বছর যাবত আমার কাছে বছরে একবার আসতেন এবং আমাকে স্বীয় জায়গায় বসে থাকার কথা বলে চলে যেতেন। এ সময়ে দুনিয়ার লোভ লালসা ও সৌন্দর্যের বস্তু বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করে আমার সামনে দৃশ্যমান হত। কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে সেগুলো হতে রক্ষা করতেন। শয়তান ভয়ংকর আকৃতিতে আমার মোকাবেলার জন্য আসত! কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে তার উপর বিজয়ী করতেন। আমি এক বছর পর্যন্ত নিজের নসফকে অনুগত করার জন্য তুচ্ছ ও মা’মূলী জিনিস খেয়ে কালাতিপাত করেছি এবং দ্বিতীয় বছর না কোন কিছু খেতাম না পান করতাম এবং না আরাম করতাম।
শয়তানের সাথে যুদ্ধ
শেখ আরেফ আবু আমরের বর্ণনা, তিনি বলেন, আমি সৈয়্যদ আবদুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হিকে বলতে শুনেছি তিনি বলেছেন, আমি ইরাকের গভীর জঙ্গলে রাত-দিন অবস্থান করতাম। বাগদাদের কোথাও স্বতন্ত্র বাসগৃহ গ্রহণ করিনি। শয়তানের দল ভয়ংকর আকৃতিতে বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার নিয়ে আমার কাছে আসত। এক দলের পর আরেক দল পদব্রজে ও সওয়ার হয়ে আমার কাছে আসত, মোকাবেলা করত এবং আমার দিকে আগুনের মশাল নিক্ষেপ করত। তবে আমি স্বীয় মনে শান্তি অনুভভ করতাম। কোন ধরনের অশান্তি হতো না। আমি অদৃশ্য আওয়াজ শুনতে পেতাম, ‘‘আমি তোমাকে অটল ও অবিচল করে দিয়েছি এবং আমার সাহায্য তোমার সাথে রয়েছে। এ লোকগুলো তোমার কিছুই করতে পারবে না’’। আমি বসা থেকে উঠা মাত্রই এ সকল শয়তান ডানে-বামে পলায়ন করত। অবশ্যই একজন শয়তান একাকী আমার কাছে আসত এবং আমাকে বলত, এখান থেকে চলে যাও। নতুবা আমি এটা করব, ওটা করব। মোট কথা, এ শয়তান আমাকে ভীতি প্রদর্শন করত। আমি তাকে থাপ্পর মারতাম। সে পলায়ন করত। আমি যখন, ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আজিম’ পড়তাম, তখন সে আমার সামনে জ্বলে যেত।
বুরজে আজমীতে এগার বছর
একবার গাউসে পাক খোতবার মধ্যে বলেন, আমি এগার বছর যাবত বুরজে আজমীতে মুকিম ছিলাম। এ বুরজে সর্বদা আমি আল্লাহর স্মরণে লিপ্ত ছিলাম। আমি আল্লাহ্ তা‘আলাকে এ প্রতিশ্র“তি দেই যে, যতক্ষণ তিনি (আল্লাহ্ তা‘আলা) আমার মুখে খাদ্য দেবে না ততক্ষণ আমি খাব না, যতক্ষণ তিনি আমাকে পান করাবে না আমি নিজ হাতে পান করব না। একবার চল্লিশ দিন পর্যন্ত আমি কিছু খাইনি ও পান করিনি। চল্লিশ দিন পর এক ব্যক্তি আমার কাছে আসল এবং অল্প খাবার আমার সামনে রেখে চলে গেল। আমার নফস ওই দিকে ঝুঁকে পড়ার কাছাকাছি। কেননা ক্ষুধা ছিল সহ্যের বাইরে। তখন আমি নিজে নিজে বলতে লাগলাম আল্লাহ্ তা‘আলার শপথ আমি আল্লাহ্ তা‘আলাকে যে ওয়াদা দিয়েছি তা থেকে বিচ্যুত হব না। তখন আমি শুনলাম, আমার ভেতর হতে উচুঁ আওয়াজে ফরিয়াদ করছে ‘আলজু’, ‘আলজু’ অর্থাৎ ক্ষুধা ক্ষুধা বলে।
খিজির আলায়হিস্ সালামের নির্দেশ
সে সময়ে শেখ সাঈদ মাখযুমী আমার কাছে তশরিফ আনলেন, তিনি এ আওয়াজ শুনলেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আবদুল কাদের এটা কিসের আওয়াজ। আমি উত্তর দিলাম এটা নাফসের অস্থিরতা। তবে রূহ স্থির আছে। তিনি বলেন, আমার ঘরে চল। এ কথা বলে তিনি চলে গেলেন। আমি মনে মনে বললাম আমি এখান থেকে বাইরে যাব না। আচানক সে সময়ে আবুল আব্বাস হযরত খিজির আলায়হিস্ সালাম আসলেন এবং নির্দেশ দিলেন ওঠ, আবু সাঈদের কাছে যাও। আমি তার নির্দেশ পালন করলাম। আমি যখন তার বাড়িতে পৌঁছলাম, দেখলাম তিনি ঘরের দরজায় আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। বলতে লাগলেন, ‘‘হে আবদুল কাদের! আমার বলা কী যথেষ্ট ছিল না? আবার হযরত খিজির আলায়হিস্ সালাম-এর বলার প্রয়োজন হলো?’’ এ কথা বলে আমাকে ঘরের ভেতর নিয়ে গেলেন এবং নিজের হাতে আমাকে রুটি খাওয়ালেন। এতে আমি পরিতৃপ্ত হয়েছি। [নফখাতুল উন্স]
শয়তানের প্রতারণা হতে রক্ষা
গাউসে পাকের সাহেবজাদা শেখ জিয়া উদ্দিন আবু নসর মুসা বলেন, আমার পিতা বলেন, আমি দেখলাম যে, একটি অত্যুজ্জ্বল আলো উদ্ভাসিত হলো, যার দ্বারা আসমানের কিনারা আলোকিত হয়ে গেল। সে আলোতে একটি আকৃতি দৃশ্যমান হলো। সে আকৃতি আমাকে সম্বোধন করে বললো, ‘হে আবদুল কাদের, আমি তোমার প্রভু! আমি তোমার জন্য সব বস্তু হালাল করে দিলাম। তখন আমি আ’উযুবিল্লাহি মিনাশ্ শায়তানির রাজিম’ পড়ে, তাকে ধিক্কার দিলাম। সে আলো মুহূর্তের মধ্যে আধার হয়ে গেল এবং সে আকৃতি ধোঁয়া হয়ে গেল। সে ধোঁয়া হতে আমি আওয়াজ শুনলাম, খোদা তোমাকে তোমার ইলম ও ফিক্হের বদৌলতে আমার প্রতারণা হতে রক্ষা করেছে। নতুবা আমি তো আমার প্রতারণা দ্বারা সত্তর সূফিকে পথভ্রষ্ট করেছি। আমি বললাম আমার করিমের করম- যার উসিলায় আমি রক্ষা পেয়েছি। [কলায়েদুল জাওয়াহের]
সাধনার মধ্যে ধৈর্য
শেখ আবদুল্লাহ্ নাজজার বলেন, শেখ আবদুল কাদের জিলানী স্বীয় সাধনা ও কঠোর পরিশ্রমের কথা এভাবে বলেছেন যে, আমি যেরূপ কষ্ট সহ্য করেছি- যদি তা পর্বতমালা হতো, তাহলে তা টুকরা টুকরা হয়ে যেত। সে কষ্ট যখন আমার বরদাশতের বাইরে হতো, তখন আমি ভূমিতে পড়ে গিয়ে বলতাম, প্রত্যেক কষ্টের সাথে সহজতা আছে। প্রত্যেক দুঃখের সাথে সুখ আছে। এ বলে আমি মাথা উঠাতাম তখন আমার হালত (অবস্থা) পরিবর্তন হত এবং আমি শান্তি পেতাম। তিনি বলেন, আমি যখন ইলমে ফিক্হ হাসিল করছিলাম, তখন মরুভূমি ও বন-জঙ্গলে রাত-যাপন করতাম।
গাউসে পাকের শাদী মোবারক
‘সিরতে গাউসে আজম’ কিতাবের ২৪৭ পৃষ্ঠায় লেখক আলম ফক্বরী লিখেন, গাউসে পাক বলেন, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নতের অনুসরণের জন্য দীর্ঘ দিন ধরে শাদী করার ইচ্ছা পোষণ করছিলাম। তবে এ ভয়ে বিবাহ করার সাহস করিনি যে, হয়তো এ বিবাহ্ আল্লাহ্ তা‘আলার ইবাদত ও রিয়াজতে প্রতিবন্ধক হতে পারে। কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা প্রত্যেক কাজের জন্য একটি সময় নির্ধারণ করেছেন। সুতরাং সে সময় যখন আসল, তখন আল্লাহ্ তা‘আলার ফজল ও অনুগ্রহে আমার শাদী হয়ে গেল এবং আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে পরপর চার স্ত্রী দান করেছেন। তাদের প্রত্যেকে আমাকে গভীর ভালবাসতেন। তাঁর অধীনে চার জন স্ত্রী থাকা সত্তেও বিবাহের পূর্বে ইবাদতের জন্য যে সময় নির্ধারিত ছিল তার মধ্যে কোন ঘাটতে হয়নি। অর্থাৎ বিবাহের পূর্বে তিনি যতটুকু উচুঁ মানের আবেদ (ইবাদতকারী) ও যাহেদ (কৃচ্ছতা সাধানকারী) ছিলেন বিবাহের পরেও ইবাদত ও রিয়াজতের অনুরূপ মকামে ছিলেন। আর সুলুকের পথে এটাই পরিপূর্ণতা, দুনিয়া ও সংসারের সাথে পূর্ণাঙ্গ সম্পর্কিত হওয়া সত্ত্বেও এগুলো হতে পৃথক থাকা।
গাউসে পাকের সন্তানাদি
গাউসে পাক আবদুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি স্ত্রীর গর্ভের উনপষ্ণাশজন সন্তান ছিলেন- এত অধিক সন্তান হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাদের শিক্ষা-দীক্ষা খুবই সুন্দরভাবে ও উত্তমরূপে দিয়েছেন এবং বান্দার হক তথা এ সন্তানদের হক আদায়ে কোন কমতি ও ঘাটতি করেননি।
হযরত শেখ আবদুল্লাহ্ জুবাই বর্ণনা করেন, আমাদের সরকার শেখ আবদুল কাদের জিলানী বর্ণনা করেছেন যে, যখন আমার ঘরে কোন সন্তান ভূমিষ্ঠ হতো তখন আমি নিজের হাতে নিতাম এবং ঐ সন্তান মৃত এ কথা বলে তার মহব্বত আমার অন্তর থেকে বের করে দিতাম। তারপর যদি সে সন্তান মরেও যেত, তার মুত্যুতে আমার অন্তরে কোন আঘাত হতো না। এ কথার প্রমাণ স্বরূপ একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়- একবার ওয়াজের মজলিসে তিনি তার এক সন্তানের মৃত্যুর সংবাদ পান। কিন্তু এ সংবাদ পাওয়ার পরও তাঁর বয়ানে তিনি স্বাভাবিক থাকেন। আর যখন গোসল ও কাফন পরিয়ে এ মৃতু শিশুকে তার সামনে আনা হয় তখন স্বয়ং তিনি সন্তানের জানাযার নামায পড়ান। তিনি চার স্ত্রী ও উনপষ্ণাশ সন্তানের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাদের মহব্বত আল্লাহ্ তা‘আলার মহব্বতের উপর প্রাধান্য পায়নি এবং আল্লাহ্ তা‘আলার ইবাদতের ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র বিষন্নতা সৃষ্টি করেনি।