সায়্যিদুনা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর মোবারক একটি অভ্যাস ছিল মেহমানদারি। যতক্ষণ দস্তরখানায় মেহমান না আসতো তিনি খাবার খেতেন না। এরই ধারাবাহিকতা তাঁর জীবনে চলমান ছিল।
একদিন আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নিষ্পাপ ফেরেশতাগণ তাঁর ঘরে মেহমান হয়ে আসলেন। সংখ্যায় ১০/১২ জন ছিলেন। সেখান সৌভাগ্যক্রমে সন্মানিত ফেরেশতা জিবরাঈল আলাইহিস সালামও ছিলেন। তাঁরা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম’কে সালাম করলেন। তিনিও উত্তরে সালাম বললেন। কুশলাদি শেষ হওয়ার পর নিজের ঘরে তাশরীফ নিয়ে সায়্যিদুনা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সুন্দর একটি মোটাতাজা বাচুর জবাই করে ভূনা করলেন। রান্না পর্ব শেষ হলে, খাবারগুলো সম্মানিত মেহমানদের নিকট পেশ করা হলো। মনে রাখবেন, উত্তম খাবার পেশ করাও মেহমানদারির একটি আদব।
ফেরেশতাগন খাবার খেতে অস্বীকৃতি জানালেন। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম জিজ্ঞেস করলেন— আপনারা কি খাবার খান না? উত্তর আসলো— না। তিনি মনে মনে একটু ভয় পেলেন। সায়্যিদুনা ইবন আব্বাস রাদ্বিআল্লাহু আনহু বলেন— তিনি ভেবেছিলেন হয়তো তাঁরা আজাবের ফেরেশতা। তাই একটু ঘাবড়ে যান। ফেরেশতারা তাকে আশ্বস্ত করলেন। ‘আপনি ভয় পাবেন। আমরা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এসেছি এবং আপনাকে একজন জ্ঞানী ছেলে সন্তানের সুসংবাদ শুনাচ্ছি।’
ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর স্ত্রী হযরত সারা সালামুল্লাহ আলাইহা এর বয়স তখন ছিলো ৯০-৯৯ বছর আর ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর ছিল ১০০-১২০ বছর। অতএব, উভয়েরই অবাক হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সারা সালামুল্লাহ আলাইহা এই কথা শুনে চিৎকার করে উঠলেন এবং নিজের চেহারায় হাত দিতে দিতে বললেন— এ কিভাবে সম্ভব? আমি তো বৃদ্ধ হয়ে গেছি। ফেরেশতাগণ আরয করলেন— এটা আমরা বলছি না। এটা দয়াময় রবের ইরশাদ। নিশ্চয়ই, তিনি তা করতে সক্ষম যা আপনার কাছে অসম্ভব মনে হয়। নিশ্চয়ই, তিনি তাঁর কাজে হিকমত, জ্ঞান সম্পন্ন। আর কোনো জিনিসই তাঁর নিকট গোপন নয়।
পবিত্র কালামে ফুরকানে রাব্বে কারীম সূরা যারিয়াত এর ২৪-৩০ নং আয়াতে এই ঘটনা কিছুটা এভাবে বর্ণনা করেন:
هَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ ضَيْفِ إِبْرَاهِيمَ الْمُكْرَمِينَ
إِذْ دَخَلُوا عَلَيْهِ فَقَالُوا سَلَامًا ۖ قَالَ سَلَامٌ قَوْمٌ مُنْكَرُونَ
فَرَاغَ إِلَىٰ أَهْلِهِ فَجَاءَ بِعِجْلٍ سَمِينٍ
فَقَرَّبَهُ إِلَيْهِمْ قَالَ أَلَا تَأْكُلُونَ
فَأَوْجَسَ مِنْهُمْ خِيفَةً ۖ قَالُوا لَا تَخَفْ ۖ وَبَشَّرُوهُ بِغُلَامٍ عَلِيمٍ
فَأَقْبَلَتِ امْرَأَتُهُ فِي صَرَّةٍ فَصَكَّتْ وَجْهَهَا وَقَالَتْ عَجُوزٌ عَقِيمٌ
قَالُوا كَذَٰلِكِ قَالَ رَبُّكِ ۖ إِنَّهُ هُوَ الْحَكِيمُ الْعَلِيمُ
কানযুল ঈমান: ❝হে মাহবুব! আপনার নিকট কি ইব্রাহিম এর সম্মানিত অতিথিদের খবর এসেছে? যখন তারা তার নিকট এসে বললো- সালাম। সেও বলল- সালাম। অপরিচিতের মতো লোকগুলো। অতঃপর আপন ঘরে গেল এবং একটি গো-বৎস নিয়ে এলো। অতঃপর সেটা তাদের নিকট রাখলো। বললো, তোমরা কি খাচ্ছ না? অতঃপর তাদের ব্যাপারে আপন অন্তরে ভয় অনুভব করতে লাগলো। তারা বলল- ‘ভয় করবেন না’। এবং তাকে এক জ্ঞানী পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিল।
অতঃপর তার স্ত্রী চিৎকার করতে করতে আসলো। তারপর আপন মাথা ঠুকল আর বললো- ‘বৃদ্ধা বন্ধ্যারও কি?’ তারা বললো- তোমার রব এমনই বলে দিয়েছেন; এবং তিনিই প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ।❞
বর্ণনাকৃত ঘটনার আলােকে শায়খুল হাদীস হযরত আল্লামা আব্দুল মুস্তফা আযমী রাহিমাহুল্লাহ বলেন— এই ঘটনা দ্বারা এই হেদায়তের আলাে অর্জিত হয় যে, ফিরিশতারা কখনাে কখনাে মানব আকৃতিতে মানুষের নিকট এসে থাকে। অতএব কিছু কিছু বর্ণনায় এসেছে যে, হজ্বের সময় হেরেমে কাবায় এবং মিনা, আরাফাত ও মুজদালিফা ইত্যাদিতে কিছু ফিরিশতার দল মানব আকৃতিতে বিভিন্ন বেশে এসে থাকে। যাদেরকে হাজীদের পরীক্ষা করার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানাে হয়।
তাই হাজ্বীয়ানে কিরামগণের জন্য আবশ্যক যে, মক্কায়ে মুকাররমা, মিনা, আরাফাত ও মুজদালিফা এবং কাবার তাওয়াফ ও মদীনা মুনাওয়ারার যিয়ারতের ভীড়ে সাবধান থাকা!
কখনােই কোন মানুষও যেনাে বেআদবী ও মনে কষ্ট না পায় এবং ব্যবসায়ী বা কুলি অথবা ফকীরদের সাথে যেনাে ঝগড়া ও বাড়াবাড়ি না হয়। কে জানে? সে মানুষের আকৃতিতে কোন ফিরিশতা কিনা, যে তােমাকে ধাক্কা মারলাে বা ধমক দিয়ে তােমার ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরীক্ষা করছে কিনা। এটি হলাে এমন একটি পয়েন্ট, যা সম্পর্কে সাধারণত মানুষেরা অজ্ঞ। তাই হজ্বের সফরে মানুষ প্রতিটি পদক্ষেপে মানুষের সাথে ঝগড়া করতে থাকে এবং অনেক সময় দুনিয়া ও আখিরাতের প্রবল ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকে।
সুতরাং, এই মহা ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য উত্তম উপায় এটাই যে, প্রতিটি মানুষের ব্যাপারে এই সাবধাণতা অনুভব করতে থাকা যে, হয়তাে সে কোন ফিরিশতা হবে। যে ব্যবসায়ী বা ফকীর অথবা শ্রমিকের বেশে রয়েছে। অতঃপর তার সাথে সাবধানতার সহিত কথাবার্তা বলা এবং যথাসম্ভব তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করা আর কখনােই কোন কড়া কথা যেনাে না বলা হয়, কেননা এতেই নিরাপত্তা নিহিত।
এখান থেকে এই বিষয়টিও স্পষ্ট প্রতীয়মান, মেহমান কখনো কখনো আমাদের জন্য সুসংবাদও নিয়ে আসে। মেহমান নাওয়াজি করা আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামগণের একটি পবিত্র অভ্যাস। অথচ আমরা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। বাসায় মেহমানদের আগমন হলে আমাদের চেহারা অন্ধকারে ছেঁয়ে যায়। বিরক্তির ছাপ ফোটে ওঠে চেহারায়। এ কোথা থেকে চলে আসল? আমার বাসায়ই আসতে হলো? এসেই পরেছে না খেয়ে তো আর যাবে না!— এমনসব কিছু বিরক্তিকর কথা-বার্তা দিয়েই হয়তো আমরা মেহমানদের অভিবাদন জানাই।
এমনটা যদি আমরা করি তবে, আমরা তো ইসলামী তালিমাত এর পরিপন্থী আমলই জারি রেখেছি। একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের পার্সোনালিটি কেমন হওয়া উচিত, তা হাদীসে পাকের রশ্মিতে জেনে নেই।
❝মেহমান নিজের রিযক নিয়ে আসে এবং যারা খাওয়ায় তাদের গুণাহ নিয়ে যায়।❞ [১]
❝যে ঘরে খাবার খাওয়া হয়, সে ঘরে কল্যাণ এত দ্রুত গতিতে আসে; যত দ্রুত ছুরি উটের কুজ পর্যন্ত পৌঁছে।❞ [২]
এই হাদীসে পাকের ব্যাখ্যায় হাকিমুল উম্মাহ মুফতি আহমদ ইয়ার নঈমী রাহিমাহুল্লাহ বলেন— যে ঘরে মেহমান, ভ্রমণকারী এবং সাক্ষাতের লোক খাবার খেতে আসে সেখানে বরকত থাকে। অন্যথায়, ঘরের মানুষ তো প্রত্যেক ঘরেই খাবার খায়। তিনি আরো বলেন— উটের কুজে হাড় থাকে না শুধু চর্বি থাকে। তাই ছুরি দ্রুত গভীরে পৌঁছে যায় এবং এর সাথেই সেই ঘরে কল্যাণ ও বারাকাহ দ্রুত আসার তুলনা করা হয়েছে। [৩]
সুতরাং, মেহমানদের সম্মান করা, তাদের আসায় বিরক্ত না হওয়া এটা একজন মুসলিমের পার্সোনালিটি হওয়া উচিত। এবং এটা খুবই কল্যাণ, বারকাহ এবং সুসংবাদ আনয়নের কারণ হয়। আর মেহমানদেরও এ বিষয়টি খেয়াল রাখা উচিত, যেন মেজবানের বাড়িতে এত বেশি সময় অবস্থান না করে, যাতে তার কষ্ট হওয়ার সম্ভবনা আছে।
Reference:
[১] কাশফুল খফা, ২/৩৩, হাদীস- ১৬৪১।
[২] ইবন মাজাহ, কিতাবুল আতইম্মা, ৪/১৫, হাদীস- ৩৩৫৬।
[৩] মিরাতুল মানাযীহ, ৬/৬৭।
‘গল্পটা কোরআনের- ০৩’
__স্বাধীন আহমেদ