জুমার খুতবা:-
=========
২য় জুমা, জুমাদা আল উখরা, ১৪৩৮ হি:
সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আয্হারী
সহকারী অধ্যাপক, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
খতিব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ, নন্দনকানন, চট্টগ্রাম।
♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥
بسم الله الرحمن الرحيم. الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على سيد المرسلين وعلى آله وصحبه أجمعين. أما بعد!
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য। দরূদ ও সালাম নবী ও রাসূলদের সর্ব শ্রেষ্ঠ আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর।
ঈমান ও ইসলামের সঠিক মাপকাঠি হলেন সাহাবাগন। কারণ ইসলাম প্রবর্তন ও পালনের প্রথম ধাপ শুরু হয় এই মহান গোষ্ঠীর অনুকরনের মাধ্যমে। নবীদের পর উম্মতকুলে সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা সর্বোচ্চ বলেই বিবেচিত হয়। আর সেই সাহাবিদের মধ্যে যাঁর নাম অগ্রগণ্য, তিনি হযরত আবু বকর সিদ্দিক রদিয়াল্লাহু আনহু।
বংশ ও জন্ম:
আরবের ঐতিহ্যবাহী কোরায়েশ বংশেই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, আল্লাহর সর্বশেষ নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্ম গ্রহন করেন। এ বংশেরই একটি শাখার নাম বনু তাইম। এই বনু তাইম বংশেই ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর রদিয়াল্লাহু আনহু জন্ম গ্রহন করেন। কুরাইশ বংশের উপর দিকে ষষ্ঠ পুরুষ ‘মুররা’ এ গিয়ে রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নসবের সাথে তাঁর নসব মিলিত হয়েছে। রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মের দু’বছরের কিছু বেশী সময় পর ৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং অনুরুপ সময়ের ব্যবধানে তাঁরা উভয়ে ইন্তেকাল করেন। তাই ইন্তিকালের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বয়সের সমান।
নাম ও উপাধি: তাঁর নাম আবদুল্লাহ ও ডাকনাম বা কুনিয়াত আবু বকর। সিদ্দীক ও আতিক হচ্ছে তাঁর উপাধি। মিরাজের ঘটনাকে সর্বপ্রথম মনেপ্রাণে এবং নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করেছিলেন বলেই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে সিদ্দীক উপাধিতে ভূষিত করেন।
পিতার নাম ওসমান, কুনিয়াত আবু কুহাফা, তিনি মক্কা বিজয়ের দিন রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র খেদমতে হাজির হয়ে ইসলামের ঘোষনা দেন। হিজরী ১৪ সনে একশ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। শেষ বয়সে তিনি দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন।
মাতার নাম সালমা বিনতে সাখ্র এবং কুনিয়াত উম্মুল খায়ের। তিনি স্বামীর বহু পুর্বে মক্কায় ইসলামের প্রথম পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। মক্কার ‘দারুল আরকামে’ ইসলাম গ্রহণকারীদের মদ্যে তিনি অন্যতম। স্বামীর মত তিনিও দীর্ঘ জীবন লাভ করেন। প্রায় ৯০ বছর বয়সে পুত্রকে খেলাফতের পদে অধিষ্টিত রেখে তিনি ইন্তেকাল করেন। উম্মাহাতুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দিকার পিতা হলেন হযরত আবু বকর সিদ্দীক রদিয়াল্লাহু আনহু ।
গুনাবলী:
সত্যভাষণ, সদাচার, বিণয়-নম্রতা, দয়া-দাক্ষিণ্য, মায়া-মমতা প্রভৃতি গুনে তিনি বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিলেন । এছাড়া তিনি বহুবিধ যোগ্যতারও অধিকারী ছিলেন । তিনি ছিলেন তৎক্লাীন কুরাইশ বংশের মধ্যে একজন শ্রেষ্ঠ বিদ্বান, উঁচু শ্রেনীর বক্তা ও সাহিত্যিক। আইয়্যেমে জাহেলিয়াতের পশু চরিত্রসম্পন্ন মানুষের মাঝে তিনি এত বেশি বিশ্বাসী ও ভক্তি শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন যে শত্রু মিত্র সকলেই তাঁকে নিজেদের হৈতেষী ও আপনজন মনে করতেন। তিনি ছিলেন সম্মানীত কুরাইশদের অন্যতম। জ্ঞান, মেধা, অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি, বিচক্ষনতা ও সচ্চরিত্রতার জন্য আপামর মক্কাবাসীর শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী, দানশীল ও চরিত্রবান। জাহেলী যুগেও কখনো শরাব পান করেননি।
ইসলাম গ্রহণ:
প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সর্বপ্রথম আবু বকর রদিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণ করেন, পুরুষদের মধ্যে তিনিই প্রথম মুসলমান। তিনি শুধু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেই ক্ষান্ত থাকেনি বরং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ইসলাম প্রচারেও আত্মনিয়োগ করেন। তার ব্যক্তিগত প্রভাব ও প্রচেষ্টায় তৎকালীন কুরাইশ বংশের বিশিষ্ট যুবক হযরত ওসমান, যুবাইর, আবদুর রহমান ইবনে আউফ, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ও তালহা রদিয়াল্লাহু আনহুম’র মত ব্যক্তিরা সহ আরো অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেন।
শৈশব থেকে আবু বকরের সাথে রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র বন্ধুত্য ছিল। তিনি রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র অধিকাংশ বাণিজ্য সফরের সফর সঙ্গী ছিলেন।
একবার রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে ব্যবসা উপলক্ষে সিরিয়া যান। তখন তাঁর বয়স প্রায় আঠার আর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বয়স বিশ। তাঁরা যখন সিরিয়া সীমান্তে; বিশ্রামের জন্য রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি গাছের নীচে বসেন। আবু বকর রদিয়াল্লাহু আনহু একটু সামনে এগিয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলেন। এক খ্রীষ্টান পাদ্রীর সাথে তাঁর দেখা হয় এবং ধর্ম বিষয়ে কিছু কথা-বার্তা হয়। আলাপের মাঝখানে পাদ্রী জিজ্ঞেস করে ওখানে গাছের নীচে কে? আবু বকর বললেন, এক কুরাইশ যুবক, নাম মুহাম্মাদ বিন আবদিল্লাহ। পাদ্রী বলে উঠল, এ ব্যক্তি আরবদের নবী হবেন। কথাটি আবু বকরের অন্তরে গেথে যায়। তখন থেকেই তার অন্তরে রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবী হওয়া সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয় হতে থাকে। ইতিহাসে এ পাদ্রীর নাম ‘বুহাইরা’ বা’ নাসতুরা’ বলে উল্লেখিত হয়েছে।
কুরাইশদের ধনবান ও সম্মানী ব্যক্তিদের মধ্যে এক মাত্র আবু বকর রদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গ দেন, তাঁকে সাহস দেন এবং বিনা দ্বিধায় তাঁর নবুয়তের প্রতি ঈমান আনেন। এই প্রসঙ্গে রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আমি যাকেই ইসলামের দাওয়াত দিয়েছি, একমাত্র আবু বকর ছাড়া প্রত্যেকের মধ্যেই কিছু না কিছু দ্বিধার ভাব লক্ষ্য করেছি। (বায়হাক্বী: দালায়েলুন নুবুয়্যাহ ০২/১৬৪)
হযরত আবু বকর রদিয়াল্লাহু আনহু প্রকাশ্যভাবে ইসলাম প্রচারের জন্য কুরাইশদের দ্বারা অসংখ্যবার নির্যাতিত হয়েছেন। তবুও তিনি কখনো নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচর্য ত্যাগ করেননি। বরং শত অত্যাচার র্নিযাতন সহ্য করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাশে থেকে তাঁকে ইসলাম প্রচারে সাহস উৎসাহ জুগিয়েছেন।
ইসলামের জন্য তাঁর সকল সম্পদ ব্যয়:
রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নবুওয়াতের প্রকাশ্য ঘোষনা দিলেন, আবু বকর রদিয়াল্লাহু আনহুর নিকট তখন চল্লিশ হাজার দিরহাম। ইসলামের জন্য তিনি তাঁর সকল সম্পদ ওয়াকফ করে দেন। কুরাইশদের যেসব দাস-দাসী ইসলাম গ্রহনের কারনে নিগৃহীত ও নির্যাতিত হচ্ছিল, এ অর্থ দ্বারা তিনি সেই সব দাস-দাসী খরিদ করে আযাদ করেন। তেরো বছর পর যখন রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তিনি মদীনায় হিজরাত করেন তাঁর কাছে এ অর্থের মাত্র আড়াই হাজার দেরহাম অবশিষ্ট ছিল। অল্পদিনের মধ্যে অবশিষ্ট দিরহাম গুলিও ইসলামের জন্য ব্যয়িত হয়।
হযরত বিলাল,খাব্বাব,আম্মার,আম্মারের মা সুমাইয়্যা, সুহাইব, আবু ফুকাইহ প্রমুখ দাস-দাসী তাঁরই অর্থের বিনিময়ে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভ করেন। তাই পরবর্তী কালে রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আমি প্রতিটি মানুষের ইহসান পরিশোধ করেছি। কিন্তু আবু বকরের ইহসান সমূহ এমন যে, পরিশোধ করতে আমি অক্ষম। তাঁর প্রতিদান আল্লাহ দেবেন। তাঁর অর্থ আমার উপকারে যেমন এসেছে, অন্য কারো অর্থ তেমন আসেনি। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘আমার উম্মতের মাঝে আবু বকরই বেশি দয়ালু।’ (তিরমিযী)
তাবুকের যুদ্ধে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হলে যেখানে অন্য সাহাবিরা মোটা অঙ্ক দান করলেন, সেখানে হযরত আবু বকর রদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে দান করার তেমন কিছুই ছিল না। তাই তিনি ব্যাকুল চিত্তে ঘরে গিয়ে প্রয়োজনীয় আসবাব, কাপড়চোপড় থেকে শুরু করে চুলার ছাই পর্যন্ত (যুদ্ধে আহত যোদ্ধাদের ক্ষতস্থানে ছাই উপকারী) রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে প্রদান করেন। রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবু বকরের এ ত্যাগ দেখে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য কী রেখে এসেছ? তদুত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে।’ (তিরমিযী, হা-৩৬৭৫)
এ অবদানের স্বীকৃতির ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘দুনিয়তে আমি প্রত্যেক মানুষের এহসানের পরিপূর্ণ বদলা আদায় করেছি কিন্তু সিদ্দিকে আকবরের ত্যাগের প্রতিদান আদায় করতে পারিনি। হাশরের ময়দানে স্বয়ং রাব্বুল আলামিন তাঁকে ওই প্রতিদান দান করবেন।'(তিরমিযী, হা- ৩৬৬১)
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘বন্ধুত্ব ও সাহায্য আবু বকরই আমাকে বেশি করেছিলেন। ইহজগতে যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতাম তাহলে আবু বকরকেই করতাম।’
তিনি আরো বলেন: দুনিয়ায় এমন কোনো ব্যক্তির ওপর সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত হয়নি, যে পয়গম্বরদের পর হযরত আবু বকর থেকে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ (রূহুল বয়ান)।
وصلى الله على سيدنا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين. والحمد لله رب العالمين.