ক্বিরতাস্: হযরত উমর (রা:)’এর প্রতি শিয়াদের অপবাদের খণ্ডন

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

ক্বিরতাস্: হযরত উমর (রা:)’এর প্রতি শিয়াদের অপবাদের খণ্ডনঅনুবাদঃ কাজী সাইফুদ্দিন হোসাইন

উপস্থিত সাহাবা কেরাম (رضي الله عنهم)’কে কাগজ-কলম আনতে বলেন

প্রিয়নবী (ﷺ)’এর প্রকাশ্য হায়াতে জিন্দেগীর সায়াহ্নে তিনি উপস্থিত সাহাবা কেরাম (رضي الله عنهم)’কে কাগজ-কলম আনতে বলেন। সহীহ হাদীসে এর বর্ণনা এসেছে এভাবে:

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ لَمَّا اشْتَدَّ بِالنَّبِیِّ صلّی الله علیه وسلم وَجَعُهُ قَالَ ائْتُونِی بِکِتَابٍ اَکْتُب لَکُمْ کِتَاباً لَا تَضِلُّوْا بَعْدَہُ۔ قَالَ عُمَرُ اِنَّ النَّبِیَّ صلّی الله علیه وسلم غَلَبَهُ الْوَجَعُ وَعِنْدَنَا کِتَابُ اللهِ حَسْبُنَا فَاخْتَلَفُوْا وَکَثُرَ اللَّغَطُ قَالَ قُوْمُوْا عَنِّی، وَلَا یَنْبَغِیْ عِنْدِی التَّنَازُعُ

অর্থ: হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন: যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর অসুখ বৃদ্ধি পায়, তিনি তখন বলেন, “আমাকে একটি (লেখার) কাগজ এনে দাও এবং আমি এমন কিছু লিখবো যাতে তোমরা আর কখনো পথভ্রষ্ট না হও।” কিন্তু হযরত উমর (رضي الله عنه) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) গুরুতর অসুস্থ; আর আমাদের কাছে রয়েছে আল্লাহর কিতাব (ক্বুরআন) এবং সেটা আমাদের জন্যে যথেষ্ট।” কিন্তু (উপস্থিত) সাহাবায়ে কেরাম (رضي الله عنهم) এই ব্যাপারে পরস্পর ভিন্নমত পোষণ করেন, যার দরুন বেশ মতপার্থক্যপূর্ণ বাকবিতণ্ডা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় মহানবী (ﷺ) বলেন, “উঠে দাঁড়াও আমা হতে (মানে আমাকে একা থাকতে দাও)! আমার সামনে তোমাদের বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হওয়া উচিৎ নয়।” (সহীহ বুখারী)

এই হাদীসটি ‘ক্বিরতাসের হাদীস’ নামে বহুল পরিচিত। এটা সুন্নী ও শিয়া সম্প্রদায় দুটোর মাঝে তুমুল বিতর্কের সূত্রপাত ঘটিয়ে থাকে।

শিয়া বনাম আহলুস সুন্নাহর দাবিঃ

শিয়া গোষ্ঠী দাবি করে যে, প্রিয়নবী (ﷺ) কাগজ ও কলম চেয়েছিলেন যাতে তিনি হযরত আলী (رضي الله عنه)’এর পক্ষে একটি উইল লিখে দিতে পারেন এই মর্মে যে, তাঁর বেসালপ্রাপ্তির পরে হযরত আলী (رضي الله عنه)-ই হবেন ইসলামের খলীফা। তবে শিয়ারা আরো অভিযোগ করে হযরত উমর (رضي الله عنه) কাগজ-কলম আনা হতে মানুষকে বাধা দেন যাতে রাসূল (ﷺ) উইলটি লিখতে না পারেন।

অপর দিকে, সুন্নী মুসলমান সমাজ দাবি করেন যে হযরত উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه) সত্যিসত্যি প্রিয়নবী (ﷺ)’এর অসুস্থতাজনিত কষ্টে উদ্বিগ্ন ছিলেন। এই কারণেই তিনি অন্যদেরকে কাগজ-কলম আনতে বারণ করেছিলেন। তিনি চান নি নবী পাক (ﷺ) আরো কষ্ট পান। সুন্নী মুসলমানবৃন্দ বিশ্বাস করেন হযরত উমর (رضي الله عنه)’এর অন্তরে (হযরত আলী’র পক্ষে লিখিত কোনো উইল গোপন করার) ওই চিন্তাভাবনার উদয়ই হয়নি।

হাদিসে ক্বিরতাস থেকে শিক্ষনীয়ঃ

ওপরোক্ত হাদীস হতে পরিস্ফুট হয়:

১/ এটা হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত;

২/ প্রিয়নবী (ﷺ) বলেন –  اَکْتُب لَکُمْ کِتَاباً لَا تَضِلُّوْا بَعْدَہُ – অর্থাৎ, “আমি লিখবো এমন কিছু, যা যথাযথভাবে অনুসরণ করলে তোমরা (আর কখনোই) পথভ্রষ্ট হবে না;”

৩/ ওই সময় অনেক মানুষ প্রিয়নবী (ﷺ)’এর ঘরে উপস্থিত ছিলেন;

৪/ হযরত উমর (رضي الله عنه) বলেন – اِنَّ رَسُولَ اللهِ صلی الله علیه وسلم قَدْ غَلَبَهُ الْوَجَعُ وَعِنْدَکُمُ الْقُرْآنُ، حَسْبُنَا کِتَابُ اللهِ – অর্থাৎ, রাসূল (ﷺ) অসুখে কষ্ট পাচ্ছেন, আর তাঁদের কাছে হেদায়াতের দিশাস্বরূপ আল-ক্বুরআন বিদ্যমান;

৫/ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অসুখে কষ্ট পাচ্ছেন, হযরত উমর (رضي الله عنه)’এর এই কথাকে উপস্থিত কেউই প্রত্যাখ্যান করেননি;

৬/ অন্যান্য রওয়ায়াত/বর্ণনায় উল্লেখিত – فَاخْتَلَفَ اَھْلُ الْبَیْتِ – উদ্ধৃতিটি (অর্থ: আহলে বায়তবৃন্দের মাঝে মতপার্থক্য দেখা দেয়) ইঙ্গিত করে যে, প্রিয়নবী ((ﷺ)’এর পরিবার-সদস্যবৃন্দও এই ব্যাপারটিতে পারস্পরিক ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন।অনেকে হযরত উমর (رضي الله عنه)’এর সাথে একমত হন, আবার অনেকে ভিন্নমত পোষণ করেন;

৭/ উপস্থিত সবাই এমন মতপার্থক্যে জড়ান যে উচ্চস্বরে বাকবিতণ্ডা হয়;

৮/ এরই ফলশ্রুতিতে প্রিয়নবী (ﷺ) সবাইকে ঘর ত্যাগ করতে আদেশ করেন এই বলে যে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ)’এর উপস্থিতিতে তর্কবিতর্ক করা শোভনীয় বা কাম্য নয়।

হাদিসে ক্বিরতাস এর বিশ্লেষণঃ 

আমরা যদি স্বীকার করি, নবী করীম (ﷺ)’এর অব্যবহিত পরে হযরত আলী (رضي الله عنه)’কেই খলীফা নিযুক্ত করার জন্যে মহানবী (ﷺ) লিখিত উইল করতে চেয়েছিলেন, তাহলে বোঝা যাবে সাহাবা কেরাম (رضي الله عنهم) ইচ্ছাকৃতভাবে তা মান্য করেন নি; আমাদের তখন মানতে হবে তাঁরা এ কাজ করে মিথ্যুক ও সীমালঙ্ঘনকারী সাব্যস্ত হয়েছেন (আল্লাহ মাফ করুন)! কেননা এ কাজটি হযরত আলী (رضي الله عنه)’এর প্রথম খলীফা হবার অধিকারকে খর্ব করবে, যা সাহাবা কেরাম (رضي الله عنهم)’এর পক্ষে একটা ধোকাবাজিপূর্ণ পরিকল্পনা বলে প্রতিপন্ন হবে।

বস্তুতঃ শিয়াপন্থীরা মনে করে সাহাবা কেরাম (رضي الله عنهم) প্রকৃতপ্রস্তাবে হযরত আলী (رضي الله عنه)’এর এই সম্মান জোরজবরদস্তি কেড়ে নিয়েছিলেন। আমরা যদি এই অভিযোগ স্বীকার করি, তাহলে ইসলামী বিজয় অভিযান, উন্নতি-অগ্রগতি ও খেদমতের দীর্ঘ তালিকা এবং খুলাফা আর-রাশেদীনের খেলাফত প্রতিষ্ঠার সমস্ত অর্জনই শূন্যে পরিণত হবে এবং অনৈসলামী হয়ে যাবে।

দ্বিতীয়তঃ প্রিয়নবী (ﷺ)‘এর এই বার্তা যা তিনি হযরত আলী (رضي الله عنه)’এর পক্ষে খলীফা হবার জন্যে উইল করে লিখে দিতে চেয়েছিলেন, আর যেটা মুসলমানদেরকে গোমরাহী হতে রক্ষা করবে বলে তিনি জানিয়েছিলেন, তা জেনেও শিয়া গোষ্ঠী বিচ্যুত হয়েছে কেন? তাদের তো উচিৎ ছিলো সঠিক পথে থাকা এবং বিভক্ত না হওয়া! বাস্তবতা হলো, শিয়ারা বহুধা বিভক্ত এবং এক দল আরেক দলকে জাহান্নামী বলে ফতোয়া দেয়। তাদের একটি দল এমন সীমা লঙ্ঘন করে যে তারা হযরত আলী (رضي الله عنهم)’কে খোদা জ্ঞান করে।

তৃতীয়তঃ প্রিয়নবী (ﷺ)’এর কাছে ওই সময় অন্যান্যরাও উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া ছিলেন আহলে বায়ত (رضي الله عنهم)’বৃন্দও। হযরত আলী (رضي الله عنه) নিজেও ছিলেন সেখানে উপস্থিত। এমতাবস্থায় হযরত উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه)’কে যদি রাসূল (ﷺ)’এর আদেশ অমান্যকারী সাব্যস্ত করা হয়, তাহলে সেখানে উপস্থিত হযরত আলী (رضي الله عنه), আহলে বায়ত ও অসহাবে কেরাম (رضي الله عنهم) সবাইকেই একইভাবে অবাধ্যতার দোষে অভিযুক্ত করতে হবে! (আল্লাহ মাফ করুন)

অধিকন্তু, যাঁরা জানতেন প্রিয়নবী (ﷺ) হযরত আলী (رضي الله عنه)’কে খলীফা করে একটি উইল লিখতে মনস্থ করেছিলেন, তাঁরাও কাগজ-কলম না আনার দায়ে অভিযুক্ত হবেন। (আল্লাহ মাফ করুন)

সমাপ্ত

[জনৈক ভিন্ন মতাবলম্বীর লেখনীর অনুসরণে]

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment