নিদিষ্ট দিনে আল্লাহ্ পাকের নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট পশু জবেহ করার নাম কুরবানী। কুরবানী হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের সুন্নাত। এই সুন্নাতকে কেয়ামত পর্যন্ত চালু রাখার জন্য হুজুর ﷺ সামর্থ্যবান উম্মতের প্রতি ওয়াজিব করে দিয়েছেন। অবশ্য সূরা কাওসারের মধ্যে আল্লাহ্পাক হুজুর ﷺ কে সরাসরি কুরবানী করার নির্দেশ করেছেন। কুরবানী ওয়াজিব হবার জন্য কয়েকটি শর্ত রয়েছে। যথাঃ-
(১) মুসলমান হওয়া অর্থাৎ অমুসলিমের প্রতি কুরবানী ওয়াজিব নয়।
(২) মুকীম হওয়া অর্থাৎ মুসাফিরের প্রতি কুরবানী ওয়াজিব নয়।
(৩) সামর্থ্যবান হওয়া অর্থাৎ যার প্রতি সাদকায়ে ফিতির ওয়াজিব। গরীবের প্রতি ওয়াজিব নয়।
(৪) স্বাধীন হওয়া অর্থাৎ পরাধীনের প্রতি ওয়াজিব নয়। পরাধীন বলতে কৃতদাস। বর্তমানে পৃথিবীতে দাস প্রথা নেই। কুরবানীর জন্য পুরুষ হওয়া শর্ত নয়। যদি কোনো মহিলা সামর্থ্যবান হয়, তাহলে কুরবানী করা ওয়াজিব হবে। নাবালেগ সামর্থ্যবান হলে তার প্রতি কুরবানী ওয়াজিব নয় (দুররে মুখতার)।
অর্থ ও শর্ত সংক্রান্ত কতিপয় মসলাঃ –
=====================
মাসয়ালা (১) - মুসাফির কুরবানী করলে নফল হয়ে যাবে। অনুরূপ গরীব কুরবানী করলে নফল হয়ে যাবে। (আলমগিরী)
মাসয়ালা (২) - গরু ছাগলের মালিক তার কুরবানী করার নিয়ত করলে কুরবানী ওয়াজিব হবেনা। অনুরূপ পশু ক্রয় করার সময় কুরবানীর নিয়ত না থাকলে ক্রয় করার পর নিয়ত করলে কুরবানী করা ওয়াজিব হবে না।। (আলমগিরী)
মাসয়ালা (৩) - হজ্ব করতে গিয়া মুসাফির থাকলে কুরবানী করা ওয়াজিব হবে না। কিন্ত কুরবানী করলে সওয়াব পাবে। (রদ্দুলমুহতার)
মাসয়ালা (৪) - কুরবানীর দিনগুলোর মধ্যে যদি কোনো সামর্থ্যবান অমুসলিম মুসলিম হয়ে যায় এবং কুরবানী করার সময় থাকে তাহলে তার প্রতি কুরবানী করা ওয়াজিব হবে। অনুরূপ ঐ দিনগুলোর মধ্যে কোনো গরীব ধনী হয়ে গেলে এবং কুরবানী করার সময় বাকী থাকলে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব হবে। (আলমগীরি)
মাসয়ালা (৫) - কুরবানীর দিনে কুরবানীর নিয়তে মোরগ, মুরগী ইত্যাদি জবেহ করা নাজায়েজ (দুররে মুখতার)।
মাসয়ালা (৬) – যে ব্যক্তি দুইশত দিরহাম অথবা কুড়ি দিনারের মালিক হবে অথবা প্রয়োজনীয় জিনিষ পত্র ছাড়া এমন জিনিষের মালিক হবে যার মূল্য দুইশত দিরহাম, এপ্রকার ব্যক্তির উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। প্রয়োজনীয় জিনিষ বলতে ঘর-বাড়ি, পরিধানের কাপড়, চলাচলের ঘোড়া বা সাইকেল এবং সংসারের যাবতীয় আসবাবপত্র ইত্যাদি (আলমগীরি)।
মাসয়ালা (৭) - যার নিকট নেসাব পরিমাণ মাল রয়েছে, কিন্ত সাথে সাথে ঋণও রয়েছে, যদি ঋণ পরিশোধ করা হয় তাহলে নেসাব কমে যাবে। এমতাবস্থায় কুরবানী ওয়াজিব হবেনা। অনুরূপ যার নিকট বর্তমানে নেসাব পরিমাণ মাল নেই বরং কুরবানীর দিন অতিক্রম হবার পর সে পরিমাণ মাল হাতে এসেছে তাহলে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হবেনা (আলমগীরি)।
মাসয়ালা (৮) - এক ব্যক্তির নিকটে দুইশত দিরহাম ছিলো। বৎসর পূর্ণ হবার কারণে পাঁচ দিরহাম জাকাত প্রদান করেছে। এখন একশত পঁচানব্বই দিরহাম রয়েছে। এমতাবস্থায় কুরবানীর দিন আসলে কুরবানী করা ওয়াজিব হয়ে যাবে। অবশ্য দুইশত দিরহামের মধ্যে পাঁচ দিরহাম নিজের প্রয়োজনে খরচ করলে কুরবানী করতে হবে না (আলমগীরি)।
মাসয়ালা (৯) – সামর্থ্যবান (সাহেবে নিসাব) কুরবানীর জন্য পশু ক্রয় করার পর তা হারিয়ে গিয়েছে এবং মাল নিসাব হতে কম হয়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় কুরবানীর দিন আসলে তার প্রতি কুরবানী ওয়াজিব হবেনা। কুরবানীর দিনে হারানো পশুটি পেলেও কুরবানী ওয়াজিব হবেনা (আলমগীরি)।
মাসয়ালা (১০) - স্ত্রী স্বামীর নিকট মোহরের টাকা পেলেও স্ত্রীকে মালিকে নিসাব ধরা হবেনা। অবশ্য স্ত্রীর নিকট তা ছাড়া নিসাব পরিমাণ মাল থাকলে কুরবানী করা ওয়াজিব হবে (আলমগীরি)।
মাসয়ালা (১১) – যদি কোরআন শরীফের মুল্য দুইশত দিরহাম হয় এবং তা দেখে ভালো ভাবে তিলাওয়াত করতে পারে, তাহলে কুরবানী করা ওয়াজিব হবেনা। চাই তিলাওয়াত করুক অথবা নাই করুক। আর যদি তিলাওয়াত করতে না পারে, তাহলে কুরবানী করা ওয়াজিব। অনুরূপ প্রয়োজনীয় কিতাব থাকলে কুরবানী ওয়াজিব হবেনা। অন্যথায় কুরবানী করা ওয়াজিব হবে (আলামগিরী)।
মাসয়ালা (১২) - প্রয়োজনীয় জিনিষ ছাড়া অন্য জিনিষগুলোর মূল্য যদি দুইশত দিরহাম হয়, তাহলে কুরবানী করা ওয়াজিব হবে। একটি ঘর শীতের জন্য এবং একটি ঘর গরমের জন্য রাখলে প্রয়োজনের মধ্যে গণ্য হবে। তা ছাড়া বেশি ঘর থাকলে সেই ঘরের মূল্য যদি দুইশত দিরহাম হয়, তাহলে কুরবানী ওয়াজিব হবে। অনুরূপ বাড়ির মধ্যে পরিধান করার কাপড়, কাজ করার সময় পরিধান করার কাপড়, জুমা ও ঈদে যাবার সময় পরিধান করার কাপড় প্রয়োজনের মধ্যে গণ্য হবে। তা ছাড়া বেশি কাপড় থাকলে যদি তার মূল্য দুইশত দিরহাম হয়, তাহলে কুরবানী ওয়াজিব হবে (রুদ্দুলমুহতার)।
মাসয়ালা (১৩) - স্ত্রী অথবা বালেগ সন্তানের বিনা অনুমতিতে কুরবানী করলে তাদের ওয়াজিব আদায় হবেনা। নাবালেগ সন্তানের পক্ষ হতে কুরবানী করা উত্তম, যদিও তার প্রতি কুরবানী ওয়াজিব নয় (আলমগীরি)।
মাসয়ালা (১৪) - কুরবানী করলেই ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। অবশ্য ভালো নিয়তে করলে, আল্লাহর ফজলে আখিরাতে সওয়াব পাবে (দুররে মুখতার)।
মাসয়ালা (১৫) – ১০ই জিলহজ্ব কুরবানী করা জরুরী নয়। ১২ই জিলহজ্ব পর্যন্ত জায়েজ। প্রথমদিনে যদি কারো কুরবানী করার সামর্থ্য না থাকে, কিন্ত শেষদিনে সামর্থ্য হয় তাহলে কুরবানী করা ওয়াজিব হবে। প্রথম দিন কুরবানী করার সামর্থ্য ছিলো কিন্ত কুরবানী করেনি, শেষ দিনে যদি সামর্থ্য না থাকে, তাহলে ওয়াজিব হবেনা (আলমগিরী)।
মাসয়ালা (১৬) - অসামর্থ্য গরীব মানুষ যদি কুরবানী করে থাকে এবং কুরবানীর দিনগুলোর মধ্যে ধনী হয়ে যায়, তাহলে পুনরায় কুরবানী করা ওয়াজিব হবে। অবশ্য কিছু উলামা প্রথম কুরবানী যথেষ্ট হবে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন (আলমগিরী)।
মাসয়ালা (১৭) - যদি কোনো মানুষ সামর্থ থাকা সত্বেও কুরবানী না করে এবং কুরবানীর সময় শেষ হয়ে যাবার পর গরীব হয়ে যায় তাহলে একটি ছাগলের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব হবে। যদি ধনী ব্যক্তি কুরবানী না করে কুরবানীর দিনে ইন্তেকাল করে তাহলে কোন গোনাহ হবেনা (আলমগির)।
মাসয়ালা (১৮) – কুরবানীর দিনগুলোতে কুরবানী করা ওয়াজিব। বিনা কারণে কুরবানী না করে তার মূল্য সাদকা করলে জায়েজ হবেনা (আলমগির)।
মাসয়ালা (১৯) - কুরবানীর সমস্ত শর্তাবলি পাওয়া গেলে একটি বকরী জবেহ করা ওয়াজিব অথবা উট, গরু ও মহিষের সাত অংশের একাংশ দেয়া ওয়াজিব (রুদ্দুলমুহতার)।
মাসয়ালা (২০) - সাত অংশের একাংশ কম হলে কুরবানী হবেনা। অংশীদারদের মধ্যে যদি কারো অংশ সাত অংশের একাংশ কম হয়, তাহলে কারো কুরবানী হবেনা। যথা একটি গরুর মূল্য সাত হাজার টাকা সাতজন অংশীদারের মধ্যে একজনের অংশমাত্র ৫০০ টাকা হলে কারো কুরবানী জায়েজ হবেনা (রুদ্দুলমুহতার)।
মাসয়ালা (২১) - সাতজন ব্যক্তি একটি গরু অথবা মহিষ বা উট কুরবানী করতে পারে। অনুরূপ সাতের কম তিনজন চারজন, পাঁচজন, ছয়জন, মিলে করতে পারে। প্রত্যেকের সমান অংশ হওয়া জরুরী নয়। অবশ্য কমপক্ষে একাংশ নেওয়া জরুরী। দেড়, আড়াই, সাড়ে তিন, ও সাড়ে চার, এই প্রকারে অংশ নেওয়া জায়েজ নয় (রুদ্দুলমুহতার)।
মাসয়ালা (২২) –সাত ব্যক্তি মিলে পাঁচটি গরু কুরবানী করলে জায়েজ হবে। কিন্ত আট ব্যক্তি মিলে সমান অংশে পাঁচটি অথবা ছয়টি গরু কুরবানী করলে জায়েজ হবেনা (রুদ্দুলমুহতার)।
মাসয়ালা (২৩) – সাত ব্যক্তি মিলিতভাবে সাতটি ছাগল কুরবানী করলে জায়েজ হবে। অনুরূপ দুই ব্যক্তি মিলে দুইটি ছাগল কুরবানী করলে জায়েজ হবে (রদ্দুলমুহতার)।
মাসয়ালা (২৪) - একাধিক ব্যক্তি একটি পশু কুরবানী করলে মাংস ওজন করে বণ্টন করতে হবে। আনুমানিক বণ্টন জায়েজ নয়। একপক্ষের মাংস বেশি হলে অপর পক্ষ ক্ষমা করলে ও ক্ষমা হবেনা (দুররে মুখতার)।