কেন কোলাহল?
🖋মাহদি গালিব
========
বছর খানেক আগের কথা। চট্টগ্রামে ছিলাম। ঢাকা ফিরব। শরীরটা অসুস্থ্। ভাবছি যাব কীভাবে? সল্প-সফরের সাধ হচ্ছে। বিমানে পনে-ঘন্টা লাগে, সবচে কম সময়। কিন্তু সাধ্য নেই। ট্রেনে যাওয়া যায়। টয়লেট আছে। ব্যারামে আরাম মিলবে। টিকেট পেলাম না। বাস-ভ্রমণে আতঙ্কে আছি। যখন-তখন আসে প্রকৃতির হাক-ডাক। ড্রাইভারকে ক’বার বলব- ওস্তাদ একটু চাপান, পেটের পাপে যায় প্রাণ!
একটা উপায় আছে। সীতাকুণ্ড যাই আগে, আমির’দার বাসায়। অল্প রাস্তা। ওখানে হালকা হব। আবার গাড়িতে চড়ব। কুমিল্লা যাব। রাতে থাকব। কুমিল্লা যখন যাচ্ছি, মিলাদ’দার ওখানেও যাওয়া যায়। চাঁদপুর, মির্জাগঞ্জ খুব কাছে কুমিল্লার। বহুদিন দেখি না দাদারে। চাঁদপুর থেকে লঞ্চ আছে। নদীর বুকের বসন্ত-বাতাস গায়ে লাগিয়ে ঢাকায় ঢুকব।
অবশেষে অলংকার এলাম। অলংকার জায়গার নাম। বাসের বিশাল বহর এখানে। একটায় চড়ব। সীতাকুণ্ড নামব৷ সরল মনে গিয়েছি৷ গরল গিলতে হলো। গাড়ি পাচ্ছি না সরাসরি৷ এক ধরণের লেগুনা আছে, থেমে থেমে যায়। লক্করঝক্কর লোকাল আছে।
ইতোমধ্যে বিশ মিনিট গেছে। অলংকার মোড়েই আছি। তাকিয়ে তাকিয়ে লেগুনা-লোকাল দেখছি। এগুলো ভরবে কখন, ছাড়বে কখন, পৌঁছাবে কখন; সে ফিরিস্তি ধৈর্যের ফেরেশতার হাতেই দিলাম। অন্য উপায় খুঁজছি। একটা পেলামও। ঢাকার বাসে উঠা যায়৷ ভাড়া পুরোটাই নিবে। নামাবে সীতাকুণ্ডে।
টাকা খসাতে খচখচ করছে মন। গুটিগুটি পায়ে এগোলাম। কাউন্টারে গেলাম। সিট পাই, কিন্তু সবার শেষের। পিছনে বসব কী-না ভাবছি। ধাক্কার চোটে পেট বাবাজান কি বাজনা বাজাবে বুঝছি না। কয়েকটা কাউন্টার গেলাম। একই অবস্থা সবখানে। ঘুরতে ঘুরতে একটা বেজেছে। এসেছিলাম এগারোটায়৷ দু’ঘন্টা কিভাবে গেল, কে জানে! দু ঘন্টায় তিনবার টয়লেটে গিয়েছি।
এদিকে চৈত্রের রোদ উদার আগ্রহে আগুন ঝারছে। শরীরটা শাসিয়ে উঠলো। যেন বলছে- এভাবে ঢাকা যাব না বাপু। কী আর করা! মত বদলালাম, আরও দুদিন থাকব চট্টগ্রামে। সুস্থ্য হয়েই ফিরব। অগত্যা আসিফরে কলাইলাম। ফোনে বিপ হচ্ছে। আসিফের গলা ভেসে এলো।
– মোটা, তুই কইরে?
– ভাই আপনি কই? ঢাকা পৌঁছাইছেন?
– এত দ্রুত ঢাকা ক্যামনে?
– বাসা থেকে বাইরাছেন সকালে। পাঁচ ঘন্টা হইলো। ঢাকা না গেলেও নারায়ণগঞ্জে থাকার কথা।
– কোথাও যাই নাই। তুই এখন অলংকার আয়। আমারে নিয়া যা। শরীর ভালা না।
সিএনজিতে আমরা। পাশে আসিফ। এসেই একগাদা অভিযোগ ছুঁড়ল। কেন তাকে আনিনি? দুপুরে গাড়িতে চড়ব তো সকালে কেন বেরোলাম, ইত্যাদি ইত্যাদি। জবাবে মুচকি হাসলাম। হাসিটা নিতান্তই নিরীহ ছিল। সেটাও দোষের কারণ হল। আসিফের বক্তব্য- ভাই, হিমুর মতো বিভ্রান্তকর হাসি দিবেন না, আপনি হিমু না। কী বলব বুঝছি না। চুপ থাকাই শ্রেয়।
আসিফের শরীরটা বিশাল। এজন্যই মোটা ডাকি। তাঁর বিশাল ঘাড়ে মাথা হেলালাম। সিএনজির গ্রিল দিয়ে, চট্টলার ব্যস্ত সড়ক ছাপিয়ে, চৈত্রের ঝলসানো আকাশ দেখছিলাম।
ভাবনাটা তখনি মাথায় খেলে গেলো। এজন্যই হয়ত বলা হয়েছে- জ্ঞানের অর্ধেক রয়েছে ভ্রমণে। এতদিন ভাবতাম, আমাদের অঙ্গনে এত এলোমেলো কেন? এত হট্টগোল কেন? কেউ কাউকে মানে না কেন? বর্ষায় ক্ষয়িষ্ণু নদীপাড়ের মত ভাঙছি কেন আমরা? সে কোন আগ্রাসী নদী গিলছে আমাদের? এতদিন এ বিষয়টি ভাবিয়েছে অনেক। উত্তর পাইনি এতদিন। সেদিন, তখন পেলাম।
একটা জিনিস দেখুন। আমি চাঁটগাম শরিফ থেকে ঢাকা যাব। বিকল্প বা অপশন অনেক ছিল। তাই সহজটা বাছতে গিয়ে পড়লাম বিপাকে। শেষ অবধি যাওয়াই হলো না। কথায় আছে না- অতি সন্ন্যাসীতে গাঁজন নষ্ট, তেমনি হলো।
গালিবকে বা আমাকে ‘বঙ্গ-সুন্নি’ অঙ্গন ভাবুন। যে কী-না অসুস্থ্। ধুঁকেধুঁকে চলছে। ঢাকাকে ভাবুন লক্ষ্য। তাহলে সুন্নিদের লক্ষ্য হচ্ছে ঢাকা। যেখানে যাবার অনেক উপায়। বিমান আছে। ট্রেন আছে। ঘুরিয়ে গেলে লঞ্চও আছে। বাস তো আছে। সে বাসের ধরণ অনেক। এসি বাস। ননএসি বাস। এসি বাসে আবার স্ক্যানিয়া, হুন্ডাই ইত্যাদি আছে। ননএসিতে চেয়ার কোচ আর কাউন্টার কোচ। চেয়ার কোচে আবার ৩৬ আর ৪০ সিটও আছে।
বাবারে! অপশনের শেষ নেই। সুন্নিদের সমস্যা এই অপশনে। এত বেশি অপশন যে, কোনটা নিব ঠিক বুঝে উঠি না। কারণ আমাদের লক্ষ্যের দূরত্ব অল্প। মাত্র ২৪৮.৪ কিলোমিটার (ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব আরকি)।
এখন ভাবুন তো, আপনি যদি সুদূর সাউথ আফ্রিকা যেতে চান, ঢাকা থেকে যার দূরত্ব ৮,৮৭৩ কি.মি. প্রায়। তখন কী এতো ভাববেন? নাকি সবচে দ্রুতগামী বিমানেই উঠে বসবেন? নাকি? হ্যাঁ, অতি জ্ঞানীগণ এখানে কহিবেন- বাপু, বিমানে তফাৎ আছে; এক বিমানে বিজনেস আবার লাক্সারি সিটও থাকে।
ভাও, বাহুল্য ছাড়ুন। পয়েন্টে আসুন। বলতে চাচ্ছিলাম- চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার দূরত্ব অল্প। তাই অপশন বেশি। আবার সাউথ আফ্রিকায় যেতে বিমান ছাড়া গতি নেই। যেমনটা বলেছি, বঙ্গ-সুন্নিদের সমস্যা এখানেই। আমাদের লক্ষ্যগুলো ছোট। এক্কবারে ছোট। ফলে অন্যের ধার না ধারলেও চলে। নিজের খেয়ানৌকা নিজেই বাইতে পারে। তাই কলহ বেশি! তাই এত কোলাহল!
কিন্তু আমাদের লক্ষ্যগুলো যদি হতো সুবিশাল, সুগভীর! যদি রেনেসাঁ প্রভাবিত সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদ থেকে বেরিয়ে মহাবৈশ্বিক ‘উম্মাহ চেতনা’ ধারণ ও লালন করতাম আমরা, তবে? যদি, অমুকে কেন আমার গ্রুপে না; এটা না ভেবে, ভাবতাম- ৭৫৩ কোটি মানুষের মধ্যে ১৮০ কোটি মুসলিম আমরা। এত বিশাল জনগোষ্ঠি! তবুও কেন সোমালিয়ায় প্রতিদিন শিশু না খেয়ে মরবে? কেন ৭০ লক্ষ বা তারো কম জায়নবাদিরা বিশ্ব চুষবে? এত বিশাল জনসংখ্যা তবে কী কাজে লাগে আমাদের!
আমরা লক্ষ্য সংকটে ভুগছি। ক্ষুদ্র লক্ষ্য ভোগাচ্ছে আমাদের। আমাদের চিন্তার ক্ষেত্র বিস্তৃত হওয়া দরকার। ভাবনার জগতে মহাকালের দায়বদ্ধতা আনা দরকার। বিশাল কাজে দায়বদ্ধতা বাড়ে, অন্যকে প্রয়োজন হয়। এই অন্যের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই আসে মহাবৈশ্বিক চেতনা। এই মহাবৈশ্বিক চেতনাই মানবতা। আর মানবতা ছাড়া ধর্ম কীসের!
আসুন ভাবতে শিখি। নিজের ভাবনাগুলো নতুন করে সাজাই। আজকে যা আছে, তা দিয়ে হয়ত আপনার ভালোই চলে যাবে। কিন্তু আগত প্রজন্মকে কী দিয়ে যাবেন? তারা আপনার কবর জিয়ারত করবে তো! নাকি শিরিকি-বিদাতের তবলা বাজাবে?
ইমামে আযমের সেই উক্তিটা মনে পড়ল- যে যুগের চাহিদা বুঝে না, সে মূর্খ।