কিতাবঃ বায়াত ও খিলাফতের বিধান (২য় অধ্যায়)

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

কিতাবঃ বায়াত ও খিলাফতের বিধান (২য় অধ্যায়)

মূলঃ ইমাম আ’লা হযরত (রহঃ)

Text : ফাতিমাতুজ যুহরা শাকিলা

                              ||২||

اَلحَمدُ لِلّٰهِ وَالصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ عَلٰی حَبِیبِهِ المُصطَفٰی وَاَلِهِ الکِرَامِ السَّادَاتِ الشُّرفَاءِ وَصَحَبَةِ العِظَامِ وَالأَولِیَاءِ العُرَفَاءِ وَعَلَینَا مَعَهُم دَاٸِمًا أَبَدًا

আল্লাহ তাআলা আউলিয়া কিরামের বরকতে দুনিয়া ও আখিরাতে আমাদেরকে উপকার দান করুন।

খিলাফতের প্রকারভেদ ও তার বর্ণনা।

    (নিশ্চয় জেনে রাখুন যে,) হযরাতে আওলিয়া কিরামের প্রচলিত খিলাফত দু’প্রকার :

১. খিলাফতে আম্মাহ্ (خلافت عامة)

২. খিলাফতে খাসসাহ্ (خلافت خاصة

এক. ‘খিলাফতে আম্মাহু’ হচ্ছে, পীর-মুরশিদ স্বীয় নিকটবর্তী ও দূরবর্তী মুরিদগণ থেকে যাকে যাকে এরশাদ ও প্রশিক্ষণদানের উপযুক্ত মনে করবেন স্বীয় খলিফা ও নায়েব (প্রতিনিধি) মনােনীত করবেন এবং তাদেরকে বায়আত গ্রহণের, যিকর, দৈনন্দিন ওযিফা ও আমলসমূহের তালকীন, তরীকতের দীক্ষাগ্রহণকারীদের প্রশিক্ষণ ও তরীকত অম্বেষণকারীদের পথপ্রদর্শনের জন্য খিলাফত বা প্রতিনিধিত্বের মর্যাদায় ভূষিত করবেন। এ অর্থে এটা দ্বীনি পদবি। এতে খলিফার সংখ্যা অগণিত ও অসংখ্য হওয়া বৈধ। বস্তুত হুযুর সাইয়্যিদুল আলামীন মুরশিদুল কুল মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের সকল সম্মানিত সাহাবা এ অর্থে হুযুরের খলিফা ছিলেন। আর ওই খিলাফতকেই নবীগণের উত্তরাধিকার (ورثة الأنبیاء) বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। এবং এ অর্থে ওলামায়ে দ্বীন, শরীয়ত ও তরীকতের কামিল পীর-মুরশিদগণ কিয়ামত পর্যন্ত সকলেই হুযুর আলায়হিস সালাতু ওয়াস্সালাম-এর খলিফাগণের নায়িব (প্রতিনিধি) ও খলীফা। আর এ প্রকার খিলাফত খিলাফতদাতার জাহেরী জীবনের সাথে একত্রিত হয়ে থাকে। যা কারাে অজনা নয়। 

দুই. ‘খিলাফতে খাসসাহ্’ হচ্ছে, স্বীয় মুরশিদে মুরব্বীর ওফাতের পর তাঁর নির্দিষ্ট মসনদের ওপর উপবেশন করা, যে মসনদের ওপর তাঁর জীবদ্দশায় তিনি ব্যতীত কেউ বসতে পারে নি এবং খানকাহ ও দরবারের সকল নিয়ম-শৃঙ্খলা, আয়-ব্যয়, খাদিম নিয়ােগ ও বরখাস্ত, দরগাহের ওয়াক্ সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ ও খানকাহর ব্যয়ভার নির্বাহ ইত্যাদি ওই খিলাফতের সাথে সংশ্লিষ্ট। সুতরাং এ অর্থেও এটা দ্বীনি কাজ, যদিও বাহ্যিকভাবে এসব কাজ পার্থিব কাজের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। যেমন,

হযরত সায়্যিদুনা আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু, হযরত সায়্যিদুনা আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর খিলাফত প্রসঙ্গে বলেছেন,

                   رَضِیَةُ رَسُولُ اللّٰهِ ﷺ لِدِینِنَا أَفَلاَ نَرضَاهُ لِدُنیَانَا      

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে (হযরত আবু বক্কর সিদ্দিককে) আমাদের দ্বীনের জন্য পছন্দ করেছেন, সুতরাং আমরা তাঁকে আমাদের দুনিয়ার জন্য কেন পছন্দ করবাে না!

      এ প্রকার খিলাফত, ‘ইমামতে কুরবা’র সাথে বেশ সাদৃশ্যপূর্ণ । খিলাফতদাতার জাহেরী জীবনের সাথে এ প্রকার খিলাফত একত্রিত হয় না। এ প্রকার খিলাফতকে ‘সাজ্জাদানশীনী’ও বলা হয়। 

সাজ্জাদানশীন মনােনীত করার পদ্ধতি

     প্রথম প্রকারের খিলাফতের ক্ষেত্রে পীর-মুরশিদ যাকে খিলাফতের ভার অর্পণ করবেন অথবা তার ওফাত পূর্বক্ষণে যার ব্যাপারে ওসীয়ত করে যাবেন আর এই ওসীয়তও যদি শরীয়ত সম্মত হয় এবং ওই ব্যক্তিও খিলাফতের যােগ্য হয় আর দরগাহের কিছু ওয়াকফ-সম্পত্তি থাকে এবং ওই সম্পত্তির তত্ত্বাবধানেও সক্ষম হয় তবে এই ব্যক্তি ‘সাজ্জাদানশীন হিসেবে সাব্যস্ত হবে। উক্ত গ্রহণযােগ্য দলীল দ্বারা সাব্যস্ত ও শরীয়তসম্মত খিলাফতকে অসম্পূর্ণ মনে করে শূরা সদস্য ও আহলে হিল ওয়া আকদের সামনে এ ব্যাপারে মতামত চাওয়ার ভিত্তিতে (সাজ্জাদানশীন মনােনীত করার) প্রয়ােজন নেই।

   সাজ্জাদানশীন হওয়ার ব্যাপারে আপন পীর-মুরশিদের নির্দেশ ও ওসীয়ত ইত্যাদির মতাে স্পষ্ট দলিলের তােয়াক্কা না করে কেউ যদি নিজে নিজে সাজ্জাদানশীন হয়ে বসে, তবে তা কখনাে গ্রহণযােগ্যতা পাবে না। যেমন, কোন ব্যক্তি পীর-মুরশিদের সামনে বললাে যে, হুযুরের পর জায়েদ সাজ্জাদানশীন অথবা এ বিষয়ে কারাে নামে পীরের সামনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করা হলাে, আর তিনি ওই প্রস্তাব ও বক্তব্য শুনে নিশ্চুপ থাকলেন। পরবর্তীতে আমরের নামে বা জায়েদ ও আমর উভয়ের যৌথ নামে সাজ্জাদানশীন হওয়ার ওসীয়ত করে যান তবে এই শেষােক্ত ওসীয়তই গ্রহণযােগ্যতা লাভ করবে। আর ওই নিশ্চুপ থাকাটা গ্রহণযােগ্যতা পাবে না। উপরিউক্ত এই বক্তব্য ফিকহের এ দু’টি নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত যে,

১, ইবনে সা’দ, আত-তবকাতুল কুবরা, ذکر بیعة أبي بکر, ৩/১৮৩, দারু সাদির, বৈরুত, দেখুন মূল হাদীস:

عن الحسن قال قال علي لما قبض ﷺ نظرنا فی أمرنا فوجدنا النبی ﷺ قد قدم أبا بکر في الصلاة فرضينا لدنیانا من رضی رسول اللّٰه ﷺ لدیننا.

                                           لاَ یُنسَبُ إلَی سَاکِتٍ قَولَ            

নিশ্ৰুপ বা মৌনতা অবলম্বকারীর প্রতি কোন বিধান প্রযােজ্য হবে না।

                                          أَنَّ الصَّرِیحَ یَفُوقُ الدَّلاَلَةَ       

সুস্পষ্টতা (الصریح) অস্পষ্টতার উপর প্রাধান্য পেয়ে থাকে।

   আর যদি দু’টি সুস্পষ্ট দলিল (النص الصریح) পাওয়া যায়, (যেমন-) একটিতে জায়েদের প্রতি ওসীয়তের বর্ণনা রয়েছে আর অপরটিতে রয়েছে আমরের প্রতি অথবা উভয়ের প্রতি আর ওই সব ওসীয়তে একটির তারিখ অপরটির পরবর্তীতে হয়, তবে উভয় দলিলের উপর আমল করা যাবে । জায়েদ ও আমর উভয় ওসী (অনুমতিপ্রাপ্ত) সাব্যস্ত হবে। হাঁ! যদি শেষ দলিলে প্রথম ওসীয়ত থেকে প্রত্যাবর্তন ও প্রথম ওসীকে বরখাস্ত করা হয়েছে মর্মে বিবরণ থাকে তবে পরবর্তী দলীল পূর্ববর্তী দলীলের রহিতকারী হিসেবে সাব্যস্ত হবে। যেমন- ফতওয়া তাতারখানিয়ার সূত্রে রাদ্দুল মুহতার আদাবুল আওসিয়া থেকে বর্ণিত আছে যে,

أَوصَی إلَی رَجَلٍ وَمَکَثَ زَمَانًا فَأَوصَی إلَی آخَرَ فَهُمَا وَصِیَّانِ فِي کُلِّ وَصَایَاهُ، سَوَاءُ تَذَکَّرَ إیصَاءَهُ إلَی الاَوَّلِ أَو نَسِيَ لِأَنَّ الوَصِيَّ عِندَنَا لاَ یَنعَزِلُ مَا لَم یَعزِلُهُ المُوصِي، حَتَّی لَو کَانَ بَینَ وَصِیَّتَیهِ مُدَّةُ سَنَةٍ أَو اَکثَرَ لاَ یَنعَزِلُ الأَوَّلُ عَن الوِصَایَةِ.

কেউ যদি কোন পুরুষকে নিজ ওসী (প্রতিনিধি) বানালাে আর কিছুকাল পর অন্য একজনকে প্রতিনিধি বানালাে, তবে তারা উভয়েই ওই ব্যক্তির সমস্ত ওসিয়তে প্রতিনিধি সাব্যস্ত হবে। প্রথম ব্যক্তিকে প্রতিনিধি বানানাে তার স্মরণে থাকুক বা ভুলে যাক-উভয়ই সমান। কারণ আমাদের মযহাবে ওসিয়তকারী ওসী (প্রতিনিধি)-কে যতক্ষণ পর্যন্ত পদচ্যুত করবে না, পদচ্যুত হবে না। এমনকি উভয় ওসিয়তের মধ্যে এক বছর বা ততােধিক ব্যবধান হােক না কেন। তবুও প্রথম ব্যক্তি ওসী (প্রতিনিধি) সাব্যস্ত হওয়াকে বাতিল করবে না।

১. ইবনে নুজাইম, আল-আশবাহ ওয়ান নাযায়ির,القاعدة الثانیة عشر ،الفن الأول, ১/১৮৪, এদারাতুল কুরআন, করাচি 

২. ইবনে আবেদীন আশ-শামী, রদ্দুল মুহতার, کتاب النکاح, অধ্যায়: المهر, ২/৩৫৭, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাসিল আরবী, বৈরুত

৩. ইবনে আবেদীন আশ-শামী, রদ্দুল মুহতার, کتاب الوقف, অধ্যায়:فَصٸلُ یُرَاعَی شَرطُ الوَاقِفِ إجَارَتِهِ , ৩/৪১০, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাসিল আরবী, বৈরুত

আর যদি কারাে জন্য ওসী হওয়ার কোন দলীল না থাকে, তবে ওই দরগাহ ও খানেকায় ওসী নির্ধারণের ক্ষেত্রে পূর্ব থেকে যে নিয়ম চলে আসছে তার উপরই বিধান। কার্যকর হবে অথবা পঞ্চায়েত যার উপর ঐক্যমত পােষণ করবে সেই ওসী হিসেবে গণ্য হবে। তবে এ উভয় পদ্ধতিতে এটা জরুরি যে, উক্ত ব্যক্তি ওই মুরশিদ-মুরব্বী থেকে সবর্জন গ্রহণযােগ্য খিলাফতে আম্মাহ্’র অধিকারী হতে হবে। অন্যথায় আমাদের দেশে শরঈ বিচার ব্যবস্থা না থাকার কারণে সকলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে ও প্রথাগত কারণে ওয়াকফের উপর কর্তৃত্ব যদিও প্রতিষ্ঠিত হবে কিন্তু সাজ্জাদানশীন’ হওয়া কখনাে শুদ্ধ হবে না। কারণ এটা হচ্ছে খিলাফতে খাসসাহ্’। আর কোন ‘খিলাফতে খাসসাহ্’, ‘খিলাফতে আম্মাহ্’ অর্জন করা ছাড়া সম্ভব নয়। এবং খিলাফত-ই আম্মাহ্ সহীহ অনুমতি ছাড়া কখনাে লাভ করা যায় না।

সাত ধরনের খিলাফতের বিবরণ

   হযরত আসাদুল আরিফীন সায়্যিদুনা ওয়া মাওলানা হযরত সায়্যিদ শাহ্ হামযা আয়নী মারহারাভী কাদ্দাসাল্লাহ সিররাহু তাঁর বয়ায শরীফ (بیاض)-এ এরশাদ করেছেন- ‘প্রকাশ থাকে যে, মাশায়িখ কিরামের যে খিলাফত এ উপমহাদেশে প্রচলিত আছে তা সাত প্রকার । তম্মধ্যে কিছু আছে গ্রহণযােগ্য ও পরিচিত আর কিছু অজ্ঞাত । যেমন- প্রথমতঃ হচ্ছে ‘সরাসরি’ (إصاالة), দ্বিতীয়তঃ অনুমতিক্রমে (إجازة), তৃতীয়তঃ ঐক্যমতের ভিত্তিতে (إجماعا), চতুর্থতঃ উত্তরাধিকারসূত্রে (وراثة), পঞ্চমতঃ নির্দেশগত (حکما), ষষ্ঠতঃ বাধ্যগত (تکلیفا) ও সপ্তমতঃ ওয়াইসীগত (أویسیا)। 

এক. সরাসরি (إصالة) হচ্ছে, কোন বুযর্গ আল্লাহ তা’আলার হুকুমে কোন ব্যক্তিকে নিজ খলিফা বা জা-নশীন (প্রতিনিধি) মনােনীত করা।

     এটা এভাবে যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হাদীস শরীফে ইরশাদ করেছেন,

                      مَا قَدَّمتُ اَبَا بَکَرٍ وَعُمَرَ وَلَکِنَّ اللّٰهَ قَدَّمَهُمَا

  ‘আমি আবু বক্কর সিদ্দিক ও উমর ফারুককে অগ্রবর্তী করিনি বরং আল্লাহ তা’আলা তাদের উভয়কে অগ্রবর্তী করেছেন।

     হুযূর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে আরাে বর্ণিত আছে যে,

১. আলী মুত্তাকী হিন্দী, কনযুল উম্মাল ফী সুনানিল আকওয়াল ওয়া আফ’আল, ইবনে নাজ্জার হযরত আনাসের সূত্রে, হাদীস : ৩২৭০৬, ১১/৫৭২

یَا عَلِيُّ! سَأَلتُ اللّٰهَ ثَلاَثُا أَن یُّقَدَّمَكَ فَأَبَي إلاَّ أَن یَّقَدَّمَ أَبَا بَکَر

‘হে আলী! আমি তােমার ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলার কাছে তিনবার এমর্মে প্রার্থনা করেছি যে, তিনি যেন তােমাকে অগ্রবর্তী করেন। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা আবু বকর ব্যতীত অন্য কাউকে অগ্রবর্তী করতে চাননি।

হুযুর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাে ইরশাদ করেছেন,

یَأَبِي اللّٰهُ والمُٶمِنُونَ إلاَّ أَبَا بَکَرٍ.

‘আবু বকর সিদ্দিক ব্যতীত অন্য কাউকে ইমাম (খলিফা) মনােনীত করার ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা এবং মুমিনগণ অস্বীকার করবেন ।

    উপরিউক্ত বর্ণনা ছাড়াও অন্যান্য হাদীস শরীফে এ মর্মে আরাে অনেক বর্ণনা রয়েছে। 

দুই. অনুমতিক্রমে (إجازة) হচ্ছে, কোন শায়খ (পীর) কোন মুরিদকে চাই ওই মুরিদ তার ওয়ারিস হােক বা অন্য কেউ (শরীয়ত ও তরীকতের) কাজে উপযুক্ত দেখে নিজ সন্তুষ্টিতে ও প্রীত হয়ে স্বীয় খলিফা মনােনীত করা । 

   [যেমনিভাবে আমিরুল মু’মিনীন হযরত আলী মুরতাজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হযরত আমিরুল মু’মিনীন হাসান ইবনে আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে খলিফা মনােনীত করছিলেন। 

তিন. ঐক্যমতের ভিত্তিতে (إجماعا) হচ্ছে, শায়খ (পীর) স্বীয় জীবদ্দশায় কাউকে খলিফা মনােনীত না করেই ওফাতবরণ করলাে ফলে আহলে খানকাহ বা শায়খের মুরীদগণ শায়খের কোন ওয়ারিস বা কোন মুরিদকে শায়খের খলিফা। বা জা-নশীন (প্রতিনিধি) মনােনীত করা।

   [যেমনিভাবে আসহাবুর রায় হযরত উসমান গনি রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর শাহাদতের পর আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে খলিফা মনােনীত করেছেন।

    কিন্তু এ প্রকার খিলাফত তরীকতের শায়খগণের নিকট বৈধ নয়। এ প্রকার খিলাফতকে খিলাফতে ইখতিরায়ী (خلافت إختواعي) বা মনােনয়নগত খিলাফত বলা হয়।

১. আলী মুত্তাকী হিন্দী, কনযুল উম্মাল ফী সুনানিল আকওয়াল ওয়া আফ’আল, ইবনে নাজ্জার হযরত আনাসের সূত্রে, হাদীস : ৩২৭০৬, ১১/৫৭২ 

২. ইবনে সা’দ, আত-তবকাতুল কুবরা,ذکر الصلاة التی امر بمارسول اللّٰه علیه وسلم أبا بکر عند وفاته  ৩/১৮০,দারু সাদির, বৈরুত

   (কারণ, এ ক্ষেত্রে খিলাফতে আম্মাহ্ পাওয়া যায়নি। অথচ খিলাফতে খাসের জন্য এটা শর্ত। কিন্তু হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর ক্ষেত্রে এ প্রকার খিলাফত বৈধ হওয়ার কারণ হলাে, তার ‘খিলাফতে আম্মা’ অর্জিত ছিলাে। কারণ, তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের মহান সম্মানিত খলিফাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। 

চার. উত্তরাধিকারসূত্রে (وراثة) হচ্ছে, কোন শায়খ (পীর) আপন জীবদ্দশায় নিজের কোন প্রতিনিধি মনােনীত করা ছাড়াই ইন্তেকাল করলে, খিলাফতের উপযুক্ত ওই শায়খের কোন ওয়ারিশ তার স্থানে বসে যাওয়া এবং নিজেকে ওই শায়খের খলিফা বানিয়ে নেওয়া।

   ‘যেমন, হযরত আমীর-ই মুআবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর খিলাফতের দাবি করা, তার চাচাতাে ভাই আমিরুল মু’মিনীন হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর শাহাদতের পর এবং ইমাম হাসান মুজতাবা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করার পূর্বমুহূর্ত সময়গুলােতে। আর এ দাবি তখনই গ্রহণযােগ্য হবে যখন খিলাফতের দাবি তার পূর্বে করবে। আর সঠিক অভিমত হচ্ছে, হযরত আমীর মুআবিয়া খিলাফতের দাবি অস্বীকার করতেন। তিনি বলতেন,

إِنِّي لأَعلَمُ أَنَّهُ أَفضَلُ مِنِّي وَأَحَقُّ، وَلَکِن أَلَستُم تَعلَمُونَ أَنَّ عُثمَانَ قُتِلَ مَظلُومًا، وَأَنَا ابنُ عُمِّهِ وَوَلِیِّهِ، وَاطَّالِبُ بِدَمِهِ.

   ‘অবশ্য আমি মানি যে, তিনি (আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু) আমার চেয়ে উত্তম এবং খিলাফতের জন্য বেশি উপযুক্ত। কিন্তু তােমরা জানাে না, হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে আর আমি তার চাচার ছেলে ও তার ভাই এবং ওসী (অভিভাবক) হই। আমি তার হত্যার বদলা চাচ্ছি।”

    কিন্তু ইমাম হাসান মুজতাবা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু যখন তাঁকে খিলাফতের দায়িত্ব সমর্পন করেছেন, তখন নিঃসন্দেহে তিনি (হযরত আমীরে মু’আবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু) সত্য ইমাম ও সত্যবাদী আমীর ছিলেন। ইমাম ইবনে হাজর মক্কী আস- সাওয়াইকে এ কথা বলেছেন।

১. যাহাবী,معاویة بن أبي سفیان ، سیر أعلام النبلاء, ২/১৪০

   এ হাদীস ইমাম বােখারীর উস্তাদ ইহইয়া ইবনে সুলায়মান জু’ফী কিতাবুস সিফফীনে উত্তম সনদ সহকারে আবু মুসলিম খাওলানীর সূত্রে বর্ণনা করেছেন। 

২. ইবনে হাজর মক্কী, আস-সাওয়ায়িকুল মুহরাকা, الخاتمة في بیان إعنقاد أهل السنة, পৃ- ২১৮, মকতবায়ে মজিদিয়া মুলতান

কিন্তু এ প্রকারের খলিফা নির্বাচন বা মনােনয়ন করা তরীকতের শায়খগণের কাছে গ্রহণযােগ্য নয়।

সাত, আর (ওয়াইসীগত হচ্ছে,) কখনাে ওফাতপ্রাপ্ত শায়খ তার (মুরিদের) বাতিনে খিলাফতের নির্দেশ দেওয়া তরীকতে বা তাসাওউফে এ প্রকার খিলাফত বৈধ। কেননা, রুহের প্রতি নির্দেশ প্রদান করার বৈধতা তাসাউফপন্থীগণ স্বীকার করে থাকেন। [এই সময় ওয়াইসীয়া তরীকার প্রতি এ বিধান প্রত্যাবর্তন করা হবে। যেমন, হযরত আবুল হাসান খিরকানী হযরত আবু ইয়াযীদ বােস্তামী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর খলিফা ছিলেন। কিন্তু এ বিধান প্রত্যেক দাবিদারের ক্ষেত্রে মানা যাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা তার ন্যায়পরায়ণতা ও নির্ভরযােগ্যতার ব্যাপারে নিশ্চিত না জানি অথবা আহলে-বাতিন-ব্যক্তিগণ তার ব্যাপারে সাক্ষ্য না দেবেন।

হ্যাঁ, খিলাফতে আম্মাহ্’ শুদ্ধ হওয়ার পর খলিফার মতাে আচরণ করা এবং সবার ঐক্যমতে খলিফা নির্বাচিত হওয়া গ্রহণযােগ্যতা লাভ করবে এবং তা যথেষ্ট হবে । কারণ, (لِأَنَّ المَعهُودَ عُرفًا کَالمَشرُوطِ لَفظً) উরফের (লৌকিক প্রথার) ভিত্তিতে প্রমাণিত বিষয় নাম দ্বারা প্রমাণিত হওয়ার অনুরূপ। (مَا رَأَی المُسلِمُونَ حَسَنًا فَهُوَ عِندَ اللّٰهِ حَسَنُ) মুসলমানগণ যা ভাল মনে করবে, তা আল্লাহ তা’আলার কাছেও ভালাে। 

      এ ক্ষেত্রে সর্বজন স্বীকৃত লৌকিক প্রথা (عرف) হচ্ছে, বড় সন্তানই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খিলাফতের হকদার হবে। তার বর্তমানে অন্য কেউ দাবি করতে পারবে না। কিন্তু যদি বড় সন্তান খিলাফতের যােগ্যতা না রাখে অথবা শায়খ শুধু অন্যের নামে অথবা অন্যকে তার সাথে সমান অংশীদার করে ওসীয়ত করে যান, তবে অবশ্যই ওই ওসীয়তের উপর আমল করা থেকে বিরত থাকার কোন সুযােগ নেই। শরঈ যুক্তিসঙ্গত কারণে শায়খে তরিকত তার কোন নিকট-আত্মীয়কে খিলাফত থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত করা যেমন তার জন্য বৈধ, তেমনিভাবে অন্যজনকে বিশেষ প্রয়ােজনে তার অংশীদার ও সহযােগী করাও বৈধ।

     যুক্তিগত কারণসমূহ থেকে একটি কারণ এ-ও হতে পারে যে, যখন ওই সম্মানিত পদের একটি দিক দুনিয়ার সাথে সম্পৃক্ত হয় আর অপরদিক হয় দ্বীনের সাথে,

১. ইবনে আবেদীন আশ-শামী, রদ্দুল মুহতার, کتاب البیوع, ৪/৩৯, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাসিল আরবী, বৈরুত 

২. হাকিম, আল-মুস্তাদরক, کتاب معرفة الصحابة, ৩/৭৮

তখন যে শুধু একটি বিষয় পরিচালনায় যথেষ্ট পারদর্শী, তার থেকে সমস্ত কিছুর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার আশা করা অনিশ্চিত। তাই যদি পরিনামদর্শী শায়খ (পীর) নিজ আত্মীয়ের মধ্যে একজনের পার্থিব বিষয়ে পরিচালনায় অভিজ্ঞ আর অন্যজনকে দ্বীনি বিষয় পরিচালনায় অভিজ্ঞ দেখেন, তবে তিনি আরিফ, অন্তদৃষ্টি সম্পন্ন, পরিনামদর্শী, দ্বীনি বিষয়ে সবচেয়ে হিদায়প্রাপ্ত সরল-সঠিক পথের পথিক, পার্থিব লেনদেনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী ব্যক্তিকে ‘খলিফা মনােনীত করলে এবং পার্থিব ব্যবস্থাপনায় বিজ্ঞ ব্যক্তিকে তার অংশীদার ও সহযােগি নির্বাচন করলে তাতে কারাে আপত্তি বা অভিযােগের সুযােগ নেই।

      কারণ, এ উভয়ের ঐক্যমতের ভিত্তিতে একটি সামাজিক ভিত্তি অর্জিত হয় এবং এ মহান পদের সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য উত্তম এবং সুচারুরূপে বিকাশ লাভ করে। কিন্তু ইমামতে কুবরা বা রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে দ্বৈত্ব নেতৃত্ব অবৈধ। কারণ, দ্বৈত্ব নেতৃত্ব অনেক বড় বড় ফিতনার জন্ম দেয় এবং ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে অবতারণার কারণ হয় যা কারাে অজানা নয়। প্রবাদ আছে যে, এক রাষ্ট্রে দু’বাদশা রাজত্ব করতে পারে না। আর তরীকতের খিলাফত অনেকক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় খিলাফতের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও তরীকতের খিলাফতের ক্ষেত্রে এ দ্বৈত খিলাফত জায়েয কিন্তু রাষ্ট্রীয় খিলাফতের ক্ষেত্রে তার চিন্তা। করাও যাবে না। তাই তরীকতের খিলাফতে রাষ্ট্রীয় খিলাফতের সকল বিধান কার্যকর হয় না। ফলে তরীকতের খিলাফতের জন্য খলিফাকে কুরাইশ বংশীয় হওয়া শর্ত নয় ।

      যে যুক্তিগত কারণে আমি দ্বৈত খিলাফতের যে উদাহরণ পূর্বে বর্ণনা করেছি, তা যদি সত্যে পরিণত হয়, তবে বর্ণিত বিধান কার্যকর হবে। কারণ এ প্রকার দ্বৈত খিলাফত বাতিল হওয়ার ব্যাপারে কোন দলিল নেই। কেউ অবৈধ বললে তার দলিল পেশ করা আবশ্যক। হ্যাঁ, সাজ্জাদানশীন হওয়ার ক্ষেত্রে যে সাধারণ প্রথা চলে আসছে তা একজনের জন্যই প্রযােজ্য হবে। কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া তার বিরােধিতা করা উচিত নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, যখন পীর ও মুরশিদ দু’জনকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যান, তা রদ করার কোন পথ নেই।

      হ্যাঁ উপরিউক্ত পদ্ধতিতে এটা বুঝে নিতে হবে যে, দ্বীনের ব্যাপারে যিনি বেশি হিদায়তের উপর প্রতিষ্ঠিত তিনি হলেন মূল স্থলাভিষিক্ত (জা-নশীন) আর অপরজন হচ্ছেন দরবার, দরগাহ বা খানেকার দেখাশােনাকারী ও ব্যবস্থাপক।

    যেমন (ইতােপূর্বে) এ দিকে ইঙ্গিত করেছি। আর আল্লাহ ত্রুটিমুক্ত ও মহান, সঠিক অভিমত সম্পর্কে তিনি সবচেয়ে বেশি পরিজ্ঞাত। তার নিকটই মূল কিতাব সংরক্ষিত। আল্লাহ তা’আলা দরূদ প্রেরণ করুন আমাদের আকা ও সরদার হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র প্রতি এবং তাঁর সকল আত্মীয়-স্বজন, সাহাবী, খলিফা, প্রতিনিধি তাবিঈ ও বন্ধুর প্রতি। আমীন।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment