কিতাবঃ ফতোয়ায়ে আজিজি (২য় খন্ড)
রচনায়ঃ মুহাম্মদ আজিজুল হক আল্-কাদেরী
প্রকাশনায়ঃ আন্জুমানে কাদেরীয়া চিশ্তীয়া আজিজিয়া, বাংলাদেশ
গ্রন্থ স্বত্ব: লেখক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
সার্বিক তত্ত্বাবধানেঃ
প্রফেসর ড. আবুল ফাতাহ মোহাম্মদ মহিউদ্দীন
অধ্যক্ষ আল্লামা আবুল ফরাহ মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দীন
অধ্যক্ষ মাওলানা আবুল ফছিহ মোহাম্মদ আলাউদ্দীন
অনুবাদঃ
মুহাম্মদ আবদুল অদুদ
উপাধ্যক্ষ- ছিপাতলী জামেয়া গাউছিয়া মূঈনীয়া আলিয়া মাদ্রাসা
আর্থিক সহযোগিতায়ঃ
হাজী মুহাম্মদ ইলিয়াস আলী
টেক্সট রেডীঃ
মুহাম্মদ সিরাজুম মুনির তানভীর ও মাসুম বিল্লাহ সানি
সূচীপত্রঃ প্রশ্ন
ঈমান ও আক্বীদার বর্ণনা
❏ প্রশ্ন-১: ‘তাওহীদে উলূহিয়্যাত’ বা আল্লাহ’র একত্ববাদের ওপর ঈমান আনার মমার্থ ও উদ্দেশ্য কি?
❏ প্রশ্ন-২: রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর ওপর ঈমান আনার মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য কি?
❏ প্রশ্ন-৩: আল্লাহ্ তা‘আলার সত্তা ও গুণাবলীতে মুহাব্বত ও ভালবাসার মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য কী?
❏ প্রশ্ন-৪: ‘ইরাদা-ই ইলাহি’ বা ‘আল্লাহর ইচ্ছা’ কাকে বলে? এর মর্মার্থ কী?
❏ প্রশ্ন-৫: لَا اِلٰه اِلّا هُو‘’ বাক্যে هو‘ সর্বনামের মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য কী?
❏ প্রশ্ন-৬: তাওহীদের ভিত্তি কিসের ওপর প্রতিষ্ঠিত ?
❏ প্রশ্ন-৭: ‘আল্লাহ্’ (اللهُ) শব্দটি প্রকৃত মাবুদের সত্তাগত নাম, না গুণবাচক নাম?
❏ প্রশ্ন-৮: তাওহীদ ও ‘তাওহীদে রাবুবিয়্যাত’-এর সংজ্ঞা কী?
❏ প্রশ্ন-৯: ‘দ্বীন’ দ্বারা কী উদ্দেশ্য এবং দ্বীন ও মাযহাবের মধ্যে কী পার্থক্য?
ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা ৭৩ দলে বিভক্ত হওয়ার বর্ণনা
❏ প্রশ্ন-১০: ইসলামের ৭৩ দলগুলো কি কি?বর্ণনা করো।
মোস্তফা (ﷺ)-এর ফযিলত ও বৈশিষ্ট্যাবলীর বর্ণনা
❏ প্রশ্ন-১১: মোস্তফা (ﷺ) এর ইচ্ছানুযায়ী তিন ওয়াক্ত নামায না পড়ার অনুমতি সাপেক্ষে ইসলাম কবুল করা কিভাবে হলো?
❏ প্রশ্ন-১২: হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)-এর আসরের নামায ও সূর্য পুনরায় উদিত হওয়ার প্রমাণ সম্পর্কে মতামত কি?
❏ প্রশ্ন-১৩: মি‘রাজ কতবার হয়েছে? কখন এবং কোন তারিখে সংঘটিত হয়েছে?
❏ প্রশ্ন-১৪: মি‘রাজ শরীফ রাত্রে কেন হয়েছে?
❏ প্রশ্ন-১৫: হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)’র জন্য রদ্দুস শামস বা সূর্য পুনরায় উদিত হওয়া সংক্রান্ত ঘটনাটি কি?
❏ প্রশ্ন-১৬: যদি হুযূর(ﷺ)কে স্বপ্নযোগে শরীয়ত বিরোধী কোন হুকুম প্রদান করতে দেখলে এর হুকুম কী?
❏ প্রশ্ন-১৭: عيد (ঈদ) অর্থ কী? ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা ছাড়া অন্য কোন ঈদ হতে পারে?
❏ প্রশ্ন-১৮: হুযূর মোস্তফা (ﷺ) এর পবিত্র জীবনী ও বংশধারা নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলীর উদ্ধৃতিসহ দাও।
❏ প্রশ্ন-১৯: হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম (ﷺ)-এর সম্মানিত মাতা-পিতার মধ্যকার বিশেষ বংশীয় সম্পর্ক কি ছিল?
❏ প্রশ্ন-২০: হুযূর তাঁর সম্মানিত পিতার ইন্তিকালের কতদিন পর এ ধরাধামে তাশরীফ আনেন?
❏ প্রশ্ন-২১: হুযূর ইহ জগতে তাশরীফ আনয়নের মাস, দিন ও বছর কী ছিল?
❏ প্রশ্ন-২২: হুযূর মোস্তফা (ﷺ) -এর মুরদি‘আ বা দুধপানকারীনী মাতাগণের বরকতময় নাম কি কি?
❏ প্রশ্ন-২৩: হুযূর (ﷺ) রেযায়ী বা দাইমাগণের তত্ত্বাবধানে কতো দিন ছিলেন?
❏ প্রশ্ন-২৪: হুযূর (ﷺ)-এর শৈশবকাল কীভাবে অতিবাহিত হয়?
❏ প্রশ্ন-২৫: হুযূর (ﷺ)-এর কফীল বা অভিভাবক কে কে ছিলেন এবং তাদের নিকট কতো দিন ছিলেন?
❏ প্রশ্ন-২৬: হযরত সায়্যিদাতুনা খাদিজাতুল কুবরা (رضى الله تعالي عنها) সঙ্গে বিবাহ এবং তাঁর সিরিয়া সফর কখন হয়?
❏ প্রশ্ন-২৭: ওহি নাযিল কখন থেকে আরম্ভ হয়?
❏ প্রশ্ন-২৮: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর মি‘রাজ কখন সংঘটিত হয়?
❏ প্রশ্ন-২৯: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর হিজরতের বর্ণনা কর।
❏ প্রশ্ন-৩০: হুযূর মোস্তফা (ﷺ) পবিত্র মক্কায় কতোদিন অবস্থান করেন এবং কখন মদিনায় হিজরত করেন?
❏ প্রশ্ন-৩১: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে বর্ণনা কর।
❏ প্রশ্ন-৩২: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর জীবদ্দশায় যুদ্ধের সংখ্যা কত ছিল ?
❏ প্রশ্ন-৩৩: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর সম্মানিত বিবিগণের সংখ্যা এবং তাঁদের নাম মুবারক কি ছিল?
❏ প্রশ্ন-৩৪: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর বাঁদী বা ক্রীতদাসী কতজন ছিলেন এবং তাঁদের নাম কি ছিল ?
❏ প্রশ্ন-৩৫: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর আওলাদ বা সন্তান-সন্ততি কতজন ছিলেন?
❏ প্রশ্ন-৩৬: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর ঘোড়াগুলোর নাম কি ছিল?
❏ প্রশ্ন-৩৭: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর যুদ্ধাস্ত্রের নাম কি ছিল?
❏ প্রশ্ন-৩৮: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর ধনুকের সংখ্যা কত ছিল?
❏ প্রশ্ন-৩৯: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর যুদ্ধের পোশাক সংখ্যা কত ছিল?
❏ প্রশ্ন-৪০: হযরত যয়নব বিনতে জাহাশের নাম পরিবর্তন করার কারণ কি ছিল?
❏ প্রশ্ন-৪১: হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম (ﷺ) -এর শাহজাদীগণের মাঝে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ কে ছিলেন?
❏ প্রশ্ন-৪২: দু’জাহানের সরদার হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর সম্মানিতা মাতা কখন এবং কোথায় ইন্তিকাল করেন?
❏ প্রশ্ন-৪৩: ‘আহমদ’ এটা কার নাম ? বর্ণনা কর।
❏ প্রশ্ন-৪৪: মাওলাদ বা জন্মস্থান ও জন্ম তারিখ দ্বারা উদ্দেশ্য কি বর্ণনা কর?
❏ প্রশ্ন-৪৫: সিদরাতুল মুন্তাহা ও সিদরাতুন নবী কাকে বলে এবং উভয়ের মধ্যে পার্থক্য কি?
❏ প্রশ্ন-৪৬: ‘বাহ্যিক দৃষ্টিতে আদম (عليه السلام) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আদম (عليه السلام)-এর পিতা।’ উক্ত বাণীর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও মর্মার্থ কি?
❏ প্রশ্ন-৪৭: সরকারে দু’আলম (ﷺ)-এর পবিত্র জানাযায় কোন নির্দিষ্ট ইমাম ছিলেন কি না?
❏ প্রশ্ন-৪৮: হুযূর আক্বদাস (ﷺ)-এর পবিত্র জানাযায় ইমামতি না হওয়ার হিকমত কী ছিল?
❏ প্রশ্ন-৪৯: হুজুর আক্বদাস (ﷺ) পবিত্র অন্তিম রোগ শয্যায় কোন কোন বিষয়ে অসিয়ত করেছিলেন?
ঈমান ও আক্বীদার বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-১: ‘তাওহীদে উলূহিয়্যাত’ বা আল্লাহ’র একত্ববাদের ওপর ঈমান আনার মমার্থ ও উদ্দেশ্য কি? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: আল্লাহ্ তা‘আলাকে প্রকৃত মাবুদ, একমাত্র উপাস্য হিসেবে মান্য করা, আল্লাহ্ পাককে এক ও অদ্বিতীয় জানা, যার কোন অংশীদার নেই, একথা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করা- প্রথম ফরয ও ঈমানের মূলভিত্তি। যেহেতু আল্লাহ্ এক, তাঁর কোন শরীক নেই। না সত্তায়, না গুণাবলীতে, এমনকি তাঁর নামে, কর্মে, আদেশে ও রাজত্বে,বাদশাহীতে সকল ক্ষেত্রে তিনি একক। এতে কারো অংশীদারিত্ব নেই। আল্লাহ্ তা‘আলা প্রত্যেক সৌন্দর্য ও উৎকর্ষতার পরিপূরক। তাঁর সকল গুণাবলী সম্পূরক। তিনি যে কোন ধরনের দোষ-ত্রুটি থেকে পবিত্র। দোষ-ত্রুটি তাঁর মধ্যে পাওয়া অসম্ভব। বরং যেসব বিষয় সম্পূরক নয়, ত্রুটি মুক্তও নয়- সেটাও তাঁর সত্তায় অসম্ভব। কোন বিষয়ে কেউ তাঁর শরীক নেই। ঐ মহান সত্তা প্রত্যেক বস্তুর ওপর ক্ষমতাবান। তিনি প্রত্যেক সম্ভাব্যের ওপর ক্ষমতা রাখেন। কোন সম্ভাব্য বস্তু তাঁর ক্ষমতা বর্হিভূত নহে। তাঁরই ক্ষমতা প্রত্যেক অস্তিত্বশীল ও অস্তিত্বহীন সকল বস্তুর ওপর বিরাজমান। এমনকি কোন নশ্বর ও সম্ভাব্য বস্তুও তাঁর ক্ষমতার বর্হিভূত নহে। অর্থাৎ আল্লাহ’র পক্ষে সবই সম্ভব। সম্ভব নয় এমন কিছু থেকে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু পবিত্র। আর অসম্ভব বলতে যা কখনো অস্তিত্বে আসে নাই।
❏ প্রশ্ন-২: রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর ওপর ঈমান আনার মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য কি? বিস্তারিতভাবে বর্ণনা কর?
✍ উত্তর:
صَلَّى اللهُ عَلَيْكَ يَا رَسُوْلَ اللهِ وَعَلٰى اٰلِكَ وَاَصْحَابِكَ اَجْمَعِيْنَ وَبَارَكَ وَسَلَّمَ
হযরত মুহাম্মদ কে সকল প্রকার পূর্ণাঙ্গ গুণাবলীতে সমগ্র বিশ্ব জগত থেকে একক, স্বতন্ত্র ও অতুলনীয় মনে করা- ফরয এবং নিশ্চিতরূপে ঈমানের অংশ। যা পরিপূর্ণ নাজাত ও আমলসমূহ কবুল হওয়ার মূলভিত্তি। পবিত্র কুরআনে মূলতঃ তাকেই বলা হয়েছে ঈমান। আর ঈমান একথা বলে যে, তিনিই আমার প্রাণ। রিসালতের শান ও মর্যাদা সম্পর্কে এটাই হচ্ছে সারকথা।
তাওহীদ দু’প্রকার:
প্রথমতঃ তাওহীদে ইলাহি, তা হচ্ছে- আল্লাহ্ তা‘আলা এক, অদ্বিতীয় তাঁর কোন শরীক নেই। না সত্তাগত ভাবে, না গুণাবলীতে এবং না হুকুমে, না আহকামে- তাঁর কোন শরীক নেই, অংশদারিত্বও নেই।
দ্বিতীয়ত: তাওহীদে রাসূল, হুযূর মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) তাঁর সকল পরিপূর্ণ গুণাবলীতে ও সুমহান মর্যাদায় উপমাবিহীন ও অতুলনীয় এবং তাঁর তুলনা করাও অসম্ভব। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে অতুলনীয় ও বে-নযীর রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন। এমন প্রাণাধিক প্রিয় রাসূলকে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন গুণাবলি, সুমহান সৌন্দর্য এবং অতুলনীয় ও প্রশংসনীয় চরিত্র দান করেছেন- যা অন্য কাউকে শরীক করেন নি এবং অন্য কাউকে এ মর্যাদাও দান করেন নি।
আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর প্রত্যেক গুণাবলীর বিকাশস্থল এবং স্বীয় সত্তা ও সকল গুণাবলীর সুমহান আয়না ও প্রতিচ্ছবি হিসেবে পাঠিয়েছেন তাঁর প্রিয় হাবীব মুহাম্মদ (ﷺ)কে। তাঁর গুণাবলীতে অদ্বিতীয় ও একক হিসেবে বানিয়েছেন এবং সুমহান গুণাবলীতেও তুলনাবিহীন ও বে-মেছাল গুণের অধিকারী করে শরীকমুক্ত ও পবিত্র করেছেন। হযরত ইমাম শরফুদ্দীন বুসিরী (رحمه الله تعالي ) স্বীয় ‘কাসীদা-ই বুরদা শরীফে’ কতই না সুন্দর বলেছেন,
مُـنَزَّهٌ عَنْ شَرِيْكٍ فِىْ مُحَاسِـنِـهٖ
فَجَـوْهَرُ الْحُسْنِ فِـيْهِ غَيْرُ مُنْـقَسِمٖ .
‘হুযূর আক্বদাস (ﷺ) -এর স্বীয় গুণাবলী ও সৌন্দর্য অন্য কারো অংশীদারিত্ব থেকে পুতঃপবিত্র। মোস্তফা (ﷺ)-এর মাঝে যে অতুলনীয় সৌন্দর্য রয়েছে তা অবিভক্ত ও অবিচ্ছেদ্য।’
❏ প্রশ্ন-৩: আল্লাহ্ তা‘আলার সত্তা ও গুণাবলীতে মুহাব্বত ও ভালবাসার মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য কী?
✍ উত্তর: وبالله التوفيق অধিকাংশ যুক্তিবিদগণ বলেন, মুহাব্বত হচ্ছে ইরাদা বা ইচ্ছার একটি প্রকার। আর ইরাদা বা ইচ্ছার সম্পর্ক কেবল সম্ভাব্য বিষয়ের সাথে হয়। এ কারণে আল্লাহ্ তা‘আলার সত্তা ও গুণাবলীর সঙ্গে মুহাব্বতের সম্পর্ক অসম্ভব। তাই আমরা যখন একথা বলি, আমরা আল্লাহকে ভালবাসি; তখন এর দ্বারা উদ্দেশ্য হবে- আমরা আল্লাহর আনুগত্য ও খিদমত অথবা আল্লাহ প্রদত্ত সওয়াব, প্রতিদান ও দয়াকে ভালবাসি।
“সুফিয়ায়ে কিরামগণ বলেছেন, আল্লাহ্ তা‘আলা শুধুমাত্র তাঁর সত্তার কারণে ভালবাসেন এবং তাঁর প্রদত্ত খিদমত, সওয়াব ও প্রতিদানকে মুহাব্বত করা মানে তাঁর দেওয়া ইহসান ও সওয়াবের স্বাদ গ্রহণ করা। এ স্বাদ ও দুঃখ-দুর্দশা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া তাঁর আনুগত্য ও খিদমতের ওপর নির্ভরশীল। এজন্যে আমরা আল্লাহ্ তা‘আলার আনুগত্য করাকে ভালবাসি। আর এটাই হলো আল্লাহ্ তা‘আলাকে ভালবাসার প্রকৃত উদ্দেশ্য ও মর্মার্থ। যেমন- আমরা বলি যে, আমরা হযরত ইমাম আবু হানিফা এবং হযরত ইমাম শাফেঈ রাহমাতুল্লাহি আলাইহিমাসহ অন্যান্য সকল ইমামকে ভালবাসি- এটা তাঁদের ইলম ও ফিক্হ শাস্ত্রে পান্ডিত্য ও গভীর জ্ঞানের কারণে। অনুরূপভাবে কেউ যদি বলেন- বেলায়তের অধিকারী অমুক ওলীকে মুহাব্বত করি- এটা তাঁর ইবাদত, রিয়াযত, তাকওয়া পরহেযগারীর কারণে। মানুষ হাতেম তাঈকে তাঁর দানশীলতা ও বদান্যতার কারণে ভালবাসে। পরম সুন্দর ও লাবণ্যময় ব্যক্তিকে তার সৌন্দর্যের কারণে মুহাব্বত করে। রাজা-বাদশা ও আমীর-ওমারাদেরকে ভালবাসে তাঁদের বীরত্ব, সাহসিকতা, নির্ভীকতা ও রাজনীতির কারণে। কিন্তু উপরিউক্ত সকল গুণাবলী পরিপূর্ণতার সাথে সত্তাগতভাবে একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার জন্যেই নিহিত; অন্যান্যদের গুণাবলী সত্তাগত নয়। তাই কাউকে যদি পরিপূর্ণ গুণাবলীর কারণে ভালবাসতে হয়, তাহলে আল্লাহ্ তা‘আলাই এর পরিপূর্ণ ও অধিক হকদার। কারণ পরিপূর্ণ গুণাবলীর অধিকারী সত্তাগতভাবে একমাত্র আল্লাহই।”
1. তাফসীরে রাযী এবং যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা গোলাম রাসুল সাঈদি হানাফি চিশ্তি ছারেবী (رحمة الله)
❏ প্রশ্ন-৪: ‘ইরাদা-ই ইলাহি’ বা ‘আল্লাহর ইচ্ছা’ কাকে বলে? এর মর্মার্থ কী? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: قصد (কসদ) ও مرضى (মরযী) উভয়টি সমার্থক শব্দ। অর্থঃ ইচ্ছে করা, মর্জি বা আত্মার চাহিদা। আত্মা নিজ উদ্দেশ্য ও পছন্দনীয় দিক থেকে ফিরে গিয়ে আল্লাহ্ তা‘আলার হুকুম পালনে লিপ্ত হওয়া।
আল্লাহ্ তা‘আলার ইচ্ছা নশ্বর নয়, অবিনশ্বর ও শাশ্বত। তাঁর ইচ্ছাশক্তি প্রত্যেক বিদ্যমান বস্তুর সাথে সম্পর্কিত- তা মূল সত্তাগত হোক কিংবা অস্থায়ী, গুণগত ভাল হোক কিংবা মন্দ; কুফরী হোক কিংবা ইসলামী, আনুগত্য হোক কিংবা অবাধ্য। যাই হোক আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কোন বস্তু অস্তিত্ব লাভ করতে পারে না। তাই তাঁর সৃষ্টি বা আবিষ্কার শক্তি প্রত্যেক সম্ভবপর বিষয় অনুপাতে সময়ের বিবর্তনের দরুন মতভিন্নতা ও আলাদা হয় না। ইরাদা বা ইচ্ছা বলা হয় প্রত্যেক অস্তিত্বশীল বস্তুর জন্য সুনির্দিষ্ট করে একটি নির্দিষ্ট সময়, নির্ধারিত সংখ্যা বা পরিমাণ এবং অবস্থা ইত্যাদির নির্ধারিত সময় অনুযায়ী আল্লাহ’র ইচ্ছা অবশ্যই পূর্ণ হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ’র বাণী,
فَعَّالٌ لِمَا يُرِيْدُ
অর্থাৎ- ‘নিশ্চয়ই তিনি যা ইচ্ছা তাই করেন’।
2. সূরা বুরূজ, আয়াত: ১৬
❏ প্রশ্ন-৫: لَا اِلٰه اِلّا هُو‘’ বাক্যে هو‘ সর্বনামের মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য কী? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: هو‘ সর্বনামটি (একবচনে নাম পুরুষ, পুংলিঙ্গ) واحد مذكر غائب এর সীগাহ বা পদ। অর্থ- তিনি, বা সে। বর্ণিত আয়াতটি সূরা আলে-ইমরানের প্রথম নির্দেশনা। অর্থাৎ- তিনি ব্যতীত প্রকৃত কোন মাবুদ নেই। যিনি চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী।
সুফিয়ায়ে কিরামগণের মতে, هو সর্বনামটি মহান আল্লাহ তা‘আলার নির্দিষ্ট নাম, সর্বনাম নহে। তাই অধিকাংশ বুযূর্গানে দ্বীনের যিকর-আয্কারে ও অযিফাতে নামটি সম্বোধন করা হয়। কারো মতে, هو‘ সর্বনামটি মহান আল্লাহর (اسم اعظم) ইসমে আযম। অর্থাৎ- এই ضمير غائب বা সর্বনামের مرجع বা প্রত্যাবর্তনস্থল হলো ‘আল্লাহ’।
❏ প্রশ্ন-৬: তাওহীদের ভিত্তি কিসের ওপর প্রতিষ্ঠিত ?
✍ উত্তর: রিসালতের বিশুদ্ধ ও সঠিক ভিত্তির ওপর তাওহীদ প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং যার তাওহীদের ভিত্তি রিসালতের বিশুদ্ধ আক্বীদার ওপর প্রতিষ্ঠিত না হবে, তা প্রকৃত তাওহীদ নয়। তাই যার রিসালত সম্পর্কে চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণা ভুল হবে, তার তাওহীদও প্রকৃত ইসলামী তাওহীদ নয়। বরং উহা ঐ সকল লোকের তাওহীদ হবে যারা রাসূলে কারীম (ﷺ) -এর আসল পরিচয় সম্পর্কে অবগত না হয়ে কেবল তাকে মাটির মানুষই মনে করে এবং যারা মুস্তফা (ﷺ) কে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল হিসেবে অস্বীকার করেছে, তারা অবশ্যই গোমরাহ, পথভ্রষ্ট ও অভিশপ্ত ফেরকা, প্রকৃত তৌহিদপন্থি নহে।
তাই لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ হলো মহান আল্লাহ’র একত্ববাদের দাবী, আর مُحَمَّدٌ رَسُوْلُ اللهِ হলেন এ দাবীর প্রকাশ্য ও প্রকৃষ্ট দলিল। অতএব দলিল উপস্থাপনে যদি কোন রকম ভুল-ত্রুটি হয়, তার দাবি উপস্থাপন গ্রহণযোগ্য হবে না। সুতরাং একথা প্রমাণিত হলো যে, রিসালতের সঠিক ও বিশুদ্ধ আকীদার ভিত্তির ওপর প্রকৃত তাওহীদের ইমারত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
যাঁকে আল্লাহ্ তা‘আলা তাওহীদের বাহক হিসেবে বিশ্ব জগতের জন্য রহমতরূপে পাঠিয়েছেন তাঁর জ্যোর্তিময় নূরানী অস্তিত্বকে যারা অস্বীকার করছে এবং পবিত্র কোরআন মাজীদের পরিপন্থী এ ভ্রান্ত আক্বীদা পোষণ করছে যে, হুযূর মুস্তফা (ﷺ) মাটির তৈরী আমাদের মতো সাধারণ মানুষ। কিন্তু এসব ভ্রান্ত আক্বীদা সম্পর্কে গভীর দৃষ্টি নিবন্ধ করলে একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এ সকল মুসিবত, গোমরাহি ও পথভ্রষ্টতা এবং রাসূল কারীম (ﷺ) এর শারীরিক, দৈহিক ও আত্মার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অনবগত ও অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ।
এ সম্পর্কে চার অন্ধের হাতী সম্পর্কে একটি ঘটনা উদাহরণ স্বরূপ উপস্থাপন করা যায়। কথিত আছে যে, চার অন্ধের একজনের হাত হাতীর লম্বা দাঁতের ওপর পড়ল, দ্বিতীয় জনের হাত কানের ওপর, তৃতীয় জনের হাত পায়ের ওপর এবং চতুর্থ জনের হাত তার লেজের ওপর পড়ল। এ চারজনই ভাগ্যের নিমর্মতায় নিজ নিজ জ্ঞানানুসারে তাদের দাবীতে সত্য ছিল। কিন্তু অন্ধত্বের কারণে তারা হাতীর দেহের প্রকৃত অবস্থা জানতে পারেনি। তাই তাদের প্রত্যেকের দাবী ভুল ও অবাস্তব প্রমাণিত হলো, যা তাদের মতভেদ ও মত পার্থক্যের মূল রহস্য ও কারণ ছিল। অন্ধ লোক সম্পর্কে হাতীর উদাহরণ তো সাধারণ লোকের মধ্যে প্রচলিত আছে।
বেশ কিছু দিন পূর্বে একটি আশ্চার্যজনক ঘটনার অবতারণা হয়েছে যে, লাউড স্পীকার আবিষ্কারের সূচনা থেকেই সাধারণ ওলামায়ে কিরাম ছাড়াও প্রখ্যাত শীর্ষ ও বিজ্ঞ ওলামায়ে কিরামরাও এ ফতোয়া প্রদান করেন যে, লাউডস্পীকার শুধু বাদ্যযন্ত্র ও খেলা-ধুলার যন্ত্রের নাম। সুতরাং ওয়াজ-নসিহত ও দ্বীন-ধর্মের প্রচারের মতো ভালো কাজে এর ব্যবহার মাকরূহ ও নিষিদ্ধ। অথচ লাউডস্পীকার শুধু আওয়াজ বর্ধক যন্ত্র বৈ আর কিছুই নয়। এটাকে ভাল-মন্দ সব কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
অতএব, পরবর্তীতে আওয়াজ বর্ধক যন্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধকারী সকল শীর্ষ ওলামায়ে কিরামের ফতোয়া ভুল প্রমাণিত হলো। যার মূল কারণ এটাই ছিল যে, মাইক তৈরীর মূল উদ্দেশ্য ও বাস্তবতার প্রতি দৃষ্টি দেয়া ছাড়াই ফতোয়া দেয়া হয়েছিল। তাই একথা প্রমাণিত হলো যে, মূল উদ্দেশ্য ও বাস্তব বিষয় সম্পর্কে গভীর চিন্তা-ভাবনা ছাড়া গতানুগতিক রায় প্রদান করলে, তা যত বড় জ্ঞানী-গুণীর পক্ষ থেকে হোক বা সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে হোক- তা ভুলই প্রমাণিত হবে।
ঠিক একই অবস্থা তাদের যারা রাসূলে কারীম(ﷺ) -এর আসমানী জ্যোর্তিময় আত্মা এবং তাঁর মাটির দেহের বাস্তবিক অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞাত; তারা অনবগতি ও মূর্খতার দরুন বরাবরই অজ্ঞতায় শামিল। তারা সর্বসাধারণ হোক বা সাধারণ লোকের দৃষ্টিতে আলেম-ওলামা হোক। সুতরাং তাদের অজ্ঞতা ও মূর্খতার সুস্পষ্ট দলিল এটাই যথেষ্ট যে, উপরিউক্ত বিষয়ে তাদের পরস্পরের মধ্যে যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে। কারো মতে, রাসূল সম্পূর্ণরূপে মাটির মানুষ। আবার কারো মতে, তিনি তো আমাদের মতো সাধারণ মানব কিংবা আমাদের মতো মাটির তৈরী মানুষ। অনুরূপভাবে তারা তাঁর আসমানী নূরানী আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। যা আসমান থেকে নাযিল করা হয় এবং জমিনে মাটির দেহে মানবরূপে গোপন থেকে আল্লাহর ঐশি বাণী প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত হয়। ওহীর প্রত্যাদেশ এবং মাটির দেহের সমন্বয়ে অলৌকিক ও অতীব আশ্চার্যজনক মু‘জিযা তাঁর থেকে প্রকাশিত হয়।
অতএব তাদের এ সকল মতামত ও প্রোপাগান্ডা শুধু কিয়াস ও আন্দায নির্ভর কথা-বার্তা। যা মূলতঃ বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। ফলে তারা গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট হয়েছে। কেননা যে সকল কথা কিয়াস ও আন্দায নির্ভর বলা হয়ে থাকে, তা সত্য ও হক্বের মোকাবিলায় অকার্যকর।
যেমন এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন,
وَمَا يَتَّبِعُ أَكْثَرُهُمْ إِلَّا ظَنًّا إِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِيْ مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا إِنَّ اللهَ عَلِيْمٌ بِمَا يَفْعَلُوْنَ .
‘ওদের অধিকাংশ অনুমানেরই ভিত্তিতে অনুসরণ করে। সত্যের পরিবর্তে অনুমান কোন কাজে আসে না। ওরা যা করে নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা সে বিষয়ে সবিশেষ অবগত।’
3. সূরা ইউনুস, আয়াত: ৩৬।
এখন দেখার বিষয় হলো, রাসূল এর হাকিকত এবং তাঁর জাত বা সত্তার আসল ও বাস্তবতা কী? হুযূর মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ আল্লাহ’র রাসূল। তাঁর পবিত্র দেহ কখনো মানবীয় নয়, বরং আসমানী নূরানী পবিত্র সত্তা। এটাই মূলতঃ তাঁর রূহের বাস্তব রূপ এবং সত্তাগতভাবে নূরানী অস্তিত্ব। যা মানবীয় আসমানী নূরানী অস্তিত্বের চেয়ে অধিক পূতঃপবিত্র। অতএব রাসূলে পাক এর আসমানী নূরানী আত্মা দ্বারা তাঁর আসমানী নূরানী অস্তিত্ব উদ্দেশ্য; আর এটাই হলো রাসূল সত্তার মূল হাকিকত। কেননা মানবীয় মাটি-পানি পঞ্চইন্দ্রীয় দ্বারা সৃষ্ট দেহের হাকিকত মাটিই হয়ে থাকে। যেহেতু রাসূলে পাক এর রূহ মুবারক ঊর্ধ্বজগতের- মাটি ও পানি থেকে নয়; ফলে তা সৌন্দর্যের বিষয়ও হতে পারে না। তাঁর আত্মা হলো আসমানি যাকে মানবীয় আত্মাও বলা যায়। বাস্তবিক পক্ষে ওটাই মানবজাতির মূল হাকিকত। অনুরূপভাবে রাসূলে পাক-এর প্রকৃত সত্তা কখনো মানবীয় দেহ নয়।
মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআন মাজীদে ইরশাদ করেছেন, وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُوْلٌ ‘মুহাম্মদ ইলাহ বা মাবুদ নন বরং মানব আকৃতিতে প্রেরিত আল্লাহর রাসূল। এভাবেও বলা যায় যে, মুহাম্মদ আল্লাহ’র বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ্ ও বান্দার মধ্যকার আড়াল বা আবরণের নাম রাসূল। যাকে برزخ كبرىٰ ‘বরযখে কুবরাও’ বলা যায়। আল্লাহ্ তা‘আলার পরিচিতি লাভ এবং তাঁর তাওহীদ বা একত্ববাদের কেন্দ্রবিন্দুর নাম রিসালত বা বরযখে কুবরা, বা তাঁর গোপন রহস্যের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু এবং এটাকে قصر اضافىও বলা যায়।
قصر اضافى অর্থাৎ- قصر الموصوف على الصفة-এর ব্যাখ্যা হলো- তিনি মাবুদ, ইলাহ বা রাব্বুল আলামীন নন, বরং তিনি হলেন- রাহমাতুলিল আলামিন (বিশ্বজগতের জন্য রহমত), শফিউল মুয্নিবীন (পাপীদের সুপারিশকারী) এবং খাতামুন নাবীয়্যীন (সর্বশেষ নবী)।
❏ প্রশ্ন-৭: ‘আল্লাহ্’ (اللهُ) শব্দটি প্রকৃত মাবুদের সত্তাগত নাম, না গুণবাচক নাম? যুক্তি ও বর্ণনা ভিত্তিক দলিল দ্বারা আলোচনা কর?
✍ উত্তর: هو المعين والمستعان আল্লাহ্ (اللهُ) অর্থ- খোদা, মাবুদ যা আল্লাহ্ তা‘আলার সত্তাগত নাম হিসেবে স্মরণ করা হয়। যদিও এতে গুণবাচক অর্থ বিদ্যমান আছে। সে নিরিখে এটাকে আল্লাহ’র গুণবাচক নাম হিসেবে গণ্য করা উচিত, কিন্তু সকল ওলামায়ে কিরাম এটা আল্লাহ’র সত্তাগত নাম হওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে উক্ত নাম সত্তাগতভাবে উল্লেখিত হয়েছে। বিজ্ঞ ওলামায়ে কিরাম এর অর্থ এভাবে বর্ণনা করেছেন, هو ذات واجب الوجود المستجمع لجميع صفات الكمال ‘তিনি এমন সত্তা যার অস্তিত্ব অত্যাবশ্যকীয় এবং যার মধ্যে যাবতীয় সম্পূরক গুণাবলী সমষ্টিগত ও একীভূত ভাবে বিদ্যমান।’
الله‘‘ এই পবিত্র নামে এমন আশ্চর্যজনক ও বিস্ময়কর বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, যদি উক্ত নাম থেকে কোন একটি বর্ণ পৃথক করা হয়, তবুও আল্লাহ্ তা‘আলার পবিত্র সত্তাগত নাম বিদ্যমান থাকে। যেমন- الله থেকে الف কে বাদ দিলে لله অবশিষ্ট থাকে এবং প্রথম لام কে বাদ দিলে لَـهُ অবশিষ্ট থাকে। আর দ্বিতীয় لام টি পৃথক করলে هُ ‘‘ শব্দটি বাকী থাকে- যেমন هو الحى القيوم । প্রত্যেক অবস্থায় আল্লাহ্ তা‘আলার পবিত্র নামের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে।
سبحانه ما اعظم شانه পবিত্র সে মহান সত্তার যাঁর শান ও মর্যাদা অতীব মহান। আল্লাহ্ শব্দের তাহ্কীক-এর জন্য আমার লিখিত التوضيح الجميل بشرح حديث جبرئيل এবং تنزيه الجليل عن الشبه والمثيل গ্রন্থদ্বয় পাঠের অনুরোধ রইল।
(اللهُ) আল্লাহ্ তা‘আলার অস্তিত্বের আক্বীদা পোষণ করা মানব জাতির আবশ্যকীয় বিষয়। কেননা যতদিন মানবজাতি চিন্তা-চেতনা, গবেষণা ও যুক্তিযুক্ত দলিল উপস্থাপনের মাধ্যমে উপকৃত হবে, ততোদিন উক্ত আক্বীদা পোষণ করতে তারা বাধ্য। কারণ মানুষ এর জন্য স্বীয় অস্তিত্ব ও মূল সত্তা এবং এ বিশাল জগত ও এর সৃষ্টি রহস্য উদঘাটন করার নিমিত্তে উক্ত আক্বীদা পোষণ করা আবশ্যক। কেননা চিন্তা-গবেষণা ছাড়া তা সম্ভব নয়। এ অভাবনীয় বিষয়ে চিন্তা-গবেষণার প্রথম নীতিমালা হচ্ছে প্রত্যেক সৃজনশীল বস্তুর জন্যে অবশ্যই কোন না কোন প্রস্তুতকারক নির্মাতা রয়েছে। অনুরূপভাবে এই বিশ্বজগত দেখলে মানুষ সহজেই বুঝতে পারে যে, এর অবশ্যই একজন স্রষ্টা রয়েছেন। এ আক্বীদা মানব সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই নিঃসন্দেহে চলে আসছে।
এতে কারো সন্দেহ নেই যে, হযরত ঈসা (عليه السلام)-এর আগমনের ৬০০ বছর পূর্বে দর্শন শাস্ত্রের উদ্ভব হয়। তখন থেকে উক্ত আক্বীদা-বিশ্বাসে অনেক সন্দেহ-সংশয় ও মতবিরোধের সৃষ্টি হতে থাকে। যা আজো বিদ্যমান। হ্যাঁ! উক্ত আক্বীদায় কাল্পনিক সন্দেহ ব্যতীত অন্য কিছুর অবকাশ নেই। লোকেরা দর্শন শাস্ত্রের কাল্পনিক ও যুক্তি ভিত্তিক দলিল প্রমাণের মাধ্যমে আল্লাহর আকার-আকৃতি অনুমান করার চেষ্টা করেছে। পক্ষান্তরে আল্লাহ্ জওহর বা অণু, আরজ বা অস্থায়ী কিছুই নহেন। আর তিনি এমন বস্তুও নন যে, যা অন্তরে কল্পনা করা যায় এবং দৃষ্টিগোচর হয়। ফলে মানুষ তাঁর অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহে নিপতিত। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, মানুষ তার সৃষ্টিকর্তাকে মানতিক শাস্ত্রের মুকাদ্দামা ও দর্শন বিদ্যার মূলভিত্তি لماذا، كيف، اين অর্থাৎ কোথায়, কিভাবে, কেন- এর মাধ্যমে জানার ও বুঝার চেষ্টা করছে। আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, তারা যুক্তি বিদ্যার নীতিমালার মাধ্যমে তাঁকে এজন্যে জানার চেষ্টা করছে যে, তারা যেন তাঁর ইবাদত করে।
নিঃসন্দেহে একথা বলা যায় যে, উক্ত দলিল প্রমাণাদির মাধ্যমে অবশ্যই দুটি বিষয়ের যে কোন একটি অর্জিত হবে। এক. হয়তো তারা যুক্তির নিরিখে কাল্পনিক আকৃতি নির্ধারণ করবে এবং তাকে খোদা মনে করে তাঁর উপাসনা করবে। এভাবে তারা আজীবন ধারণা ও কল্পনাপ্রসূত উপাসনা করতে থাকবে। দুই. অথবা সে নীতিমালার মাধ্যমে কিছুই মিলবে না, ফলে তারা আল্লাহকে অস্বীকার করে বসবে।
প্রথম শ্রেণির অনুসারী লোক অনেক। তারা তাদের কাল্পনিক খোদার উপাসনা করছে। তাদের মাঝে দ্বীন-ধর্মের প্রভাব মাত্রই প্রথাগত প্রচলন ও অভ্যাসগত নিদর্শন ছাড়া আর কিছুই নেই।
আর দ্বিতীয় শ্রেণির লোক- যখন তারা নিজেদের প্রাধান্য ও আধিক্য দেখতে পায়, তখন তারা অবাধ্য, সীমালংঘন ও নাফরমানী আরও বেশি করে এবং কুফরীতে লিপ্ত হয়ে যায়। তবে আশ্চর্যের বিষয় যে, মানুষ যখন আল্লাহর ওপর আত্মবিশ্বাসের ইচ্ছে পোষণ করে, তখন গ্রীস দার্শনিক ও তাদের অনুসারীরা আরবীয় দার্শনিকদের নিকট জিজ্ঞেস করে এবং তর্কশাস্ত্রের জ্ঞান-বুদ্ধিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। বাহ! বাহ! এ কেমন জ্ঞানী-গুণীর কথা!
এ প্রচেষ্টা ও অনুসন্ধানের দ্বারা তাদের উপকার হবে যে, হয়তো তারা আল্লাহ’র কাল্পনিক আকৃতি নির্ধারণ করবে; না হয় মুলহিদ বা নাস্তিক হয়ে যাবে।
মানুষের একান্ত উচিত যে, নিজের অজ্ঞতা, অপারগতা, দুর্বলতা ও অসহায়ত্ব স্বীকার করতঃ যে আক্বীদা বিশ্বাস হযরাতে আন্বিয়া-ই কিরাম বিশেষ করে হুযূর ইমামুল আন্বিয়া সৈয়্যদুল মুরসালীন মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) আল্লাহ্ তা‘আলা সম্পর্কে যে আক্বীদা-বিশ্বাস ও ঈমান রাখার আদেশ দিয়েছেন তা দৃঢ়ভাবে আকড়িয়ে ধরে এবং ভ্রান্ত আক্বীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ পরিহার করে একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার প্রতি আন্তরিক ভাবে ফিরে আসা এবং এ বিশ্বাস স্থাপন করা যে,
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ ، لَا تُدْرِكُهُ الْأَبْصَارُ…….. وَلَا يُحِيطُونَ بِهِ عِلْمًا .
অতএব মানুষ যখনই সত্যিকার অর্থে আন্তরিকভাবে কখন, কিভাবে, কোথায় মহান আল্লাহ্ তা‘আলার প্রতি ফিরে যাবে, তখন কোন ধরনের আকার-আকৃতি বিহীন তাঁর প্রকৃত পরিচিতি সুস্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে পারবে, এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য অধম লিখকের লিখিত- تنزيه الجليل عن الشبه والمثيل গ্রন্থখানা অধ্যয়ন করার অনুরোধ রইল।
إِلَهٌ ‘ শব্দটি সাধারণত মাবুদ বা উপাস্যকে বুঝায়। তা সত্য হোক বা মিথ্যা হোক, হক্ব বা বাতিল- সকল উপাস্যকে বুঝায়। কেননা إِلَهٌ শব্দটি اسم جنس বা জাতি বাচক বিশেষ্য। যেমন- نجم বলতে যে কোন তারকাকে বুঝায়। কিন্তু পরবর্তীতে এর ব্যবহার ‘ছুরাইয়্যা’ তারকার জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়।
الهى‘: إِلَه শব্দটি আল্লাহ’র সত্তাগত নাম। ياء বর্ণটি متكلمএর সাথে সংযুক্ত হয়েছে। إِلَهٌ অর্থ- আল্লাহ্। দর্শনশাস্ত্রের তিন প্রকারের এক প্রকারের নামও এটা। এটা একটি ঐতিহাসিক নামও। যা সম্রাট জালালুদ্দীন আকবরের সিংহাসন আরোহণের বছর থেকে শুরু হয়। যাকে ‘ইলাহি বছর’ বলা হয়।
❏ প্রশ্ন-৮: তাওহীদ ও ‘তাওহীদে রাবুবিয়্যাত’-এর সংজ্ঞা কী? বিস্তারিতভাবে বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: هوالمستعان: তাওহীদের আভিধানিক অর্থ- কোন বস্তুকে একক জানা। পরিভাষায় আল্লাহ্ তা‘আলাকে পালনকর্তার গুণে একক, তাঁর একত্ববাদের স্বীকৃতি এবং যে কোন ধরনের মন্দ থেকে পবিত্র মনে করা।
তাওহীদের মাসআলা অত্যন্ত কঠিন ও সূক্ষ্ম। এটাকে যদি ইসলামের যাবতীয় বিষয়ের মূল কেন্দ্র বা সূতিকাগার বলা হয়, তা হবে যথার্থ ও সত্য। তাওহীদ এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, হযরত আদম (عليه السلام) থেকে সৈয়্যদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলকে যা বর্ণনা করার জন্যে প্রেরণ করেছেন। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল ধর্মে এটি ঐকমত্য বিষয়। তা হৃদয়ঙ্গম ও অনুধাবন করার জন্য সর্বপ্রথম আল্লাহর অস্তিত্বকে প্রমাণ করা আবশ্যক। এ প্রসঙ্গে الحقوق والفرائض নামক কিতাবের উদ্ধৃতিই যথেষ্ট।
‘পৃথিবীর এই বিশাল কারখানার প্রত্যেক অণু-পরমাণুতে সমুদ্রের প্রতিটি বিন্দুতে, গাছের পাতায় পাতায় আল্লাহর অস্তিত্বের সাক্ষ্য বিদ্যমান। এ জন্যে কোন বস্তু বড় হোক বা ছোট, পৃথিবীতে হোক বা আকাশে, জলে হোক বা স্থলে, প্রাণী হোক বা জড়পদার্থ ইত্যাদিতে এমন বস্তু আছে যা নিজে নিজে অস্তিত্ব লাভ করেছে? অবশ্যই কোন না কোন নির্মাতা এগুলো তৈরী করেছেন। আমরা ঐ প্রস্তুতকারীকে পৃথিবী থেকে আকাশ পর্যন্ত সকল স্থানে অনুসন্ধান ও বিচার-বিশেষণ করে কাউকে উহার উপযুক্ত পাইনি। যাকেই বিচার করি অনুপযুক্ত ও অপারগ পাওয়া যায়।
সুলতান মাহমুদ নিজের মর্যাদা ও যোগ্যতা সম্বন্ধে অবগত হয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হলে পরাজিত ও অক্ষমতা প্রকাশ করতে বাধ্য হন। অনন্যোপায় হয়ে আকাশের দিকে থাকালে হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-এর কাহিনী স্মরণ করে নিরব-নিস্তব্ধ হয়ে পড়েন। পরিশেষে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, যাকে তালাশ করছি তাঁকে তো দিব্যি চোখে বা কপালের চোখে দেখার বস্তু নয়। বনি ইসরাঈল অনিষ্টের চেষ্টা করলে فَأَخَذَتْهُمُ الصَّاعِقَةُ-এর শাস্তি পেল এবং আকাশ থেকে আওয়াজ এসে ধ্বংস করে দিল। হযরত মূসা (عليه السلام) অতি উৎসাহে এসে প্রভুকে দেখার সাহস করেন, অথচ তাজাল্লি দেখেই وَخَرَّ مُوْسٰى صَعِقًا ‘মূসা (عليه السلام) বেহুশ হয়ে লুটিয়ে পড়েন এবং লজ্জিত হন।’ আসল কথা হলো- আল্লাহ্ তা‘আলা হলেন আমাদের প্রকাশ্য অনুভূতির ঊর্ধ্বে এবং এটি আমাদের ইন্দ্রিয় ও বোধশক্তি দিয়ে জানা অক্ষম। যদি দুর্দান্ত ও নির্ভীক বাঘ চোখ দ্বারা পানির প্রস্রবণ দেখতে না পায় তাহলে সূর্যের কি দোষ?
হ্যাঁ! অন্তর—চক্ষু দ্বারা যদি দেখা যায়, তবে গোটা পৃথিবী আয়না ঘর বা দর্পনে পরিণত হবে। ঘরে-বাইরে যেদিকে তাকাই মহান আল্লাহ’র জ্যোতির্ময় নূর ঝলমল করতে দেখা যায়। অন্তরের আয়নাতে থাকে বন্ধুর প্রতিচ্ছবি।
دل كے آ ئينہ ميں ہے تصوير يار ٭ جب ذرا گردن جهكائى ديكھ لى
“অন্তরের আয়নাতে বন্ধুর রূপ নক্শা বিদ্যমান রয়েছে গ্রীবাদেশ একটু ঝুঁকিয়ে দেখে নিন।”
دوست نزديك شراز من عين است ٭ وايں عجب تركہ من اتردے مهجرام.
او دوست نزديك شراز من عين است ٭ وايں عجب تركہ من نزدوے بهجرم.
‘বন্ধু মন্দের নিকট আমার মতোই, এটি আশ্চর্যের বিষয় যে, আমি অপমানিত হলে তার নিকট পরিত্যক্ত হই।’
অথবা, ‘বন্ধু শত্রুর নিকট আমার মতোই, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে, আমি অপমানিত হলে তার নিকট পরিত্যক্ত হই।’
আমাদের ধারণা যে, মানুষ শুরু থেকেই আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে ভুল সংঘটিত হয়েছে এবং বর্তমানেও অধিকাংশ আল্লাহ’র বান্দা সে-ই ভুলে লিপ্ত রয়েছে। যারা আল্লাহ্ তা‘আলাকে প্রকাশ্য ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জানার চেষ্টা করছে। তারা যখন উক্ত লক্ষ্য অর্জনে সফলকাম হয়নি, তখন মনগড়া ও বানোয়াট খোদাকে মেনে নিল। أتخذ الهه هواه স্বীয় কুপ্রবৃত্তিকে নিজের প্রভু বানিয়ে নেয় এবং নিজের ভ্রান্ত ধারণা অনুপাতে প্রভু মান্য করার স্বভাব গড়ে নিতে কোন ধরনের দ্বিধাবোধ করে না। তাই একেবারে নিকৃষ্ট ও তুচ্ছ বস্তুকেও খোদার স্বীকৃতি দিতে দ্বিধা করে না। তাদের স্বভাব হলো, কোন বস্তুকে পরিপূর্ণ মনে করে এবং খোদা বিশ্বাস করে তাদের ভ্রান্ত ধারণা মতে আল্লাহ’র ইখতিয়ার তাঁর থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অযোগ্য ও অনুপযুক্তদের দায়িত্বভার দিয়ে দেয়। এভাবেও বলা যায় যে, আল্লাহ্ তা‘আলার পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দিয়ে অন্যকে স্থলাভিষিক্ত করে দিয়েছে। যেভাবে আল্লাহ’র বান্দারা তাঁর ব্যাপারে বেআদবী ও অবাধ্যতা মূলক আচরণ করেছে এবং করে আসছে। যা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনও কতিপয় বান্দা আছে যারা আল্লাহর পবিত্র সত্তার ওপরও আক্রমণ করছে, তারা দু’ খোদার প্রবক্তা এবং বলে যে, এক- জীবনদাতা, দুই- মৃত্যুদাতা। এক-ভাল ও কল্যাণের স্রষ্টা, দুই- মন্দ ও অকল্যাণের স্রষ্টা।
কারো মতে, তিন খোদা রয়েছে। মূলতঃ তিনি একজন। আবার কারো মতে, প্রত্যেক বস্তু স্বয়ং আল্লাহ’র স্থানে অভিষিক্ত। কারো ধারণা মতে, আল্লাহ্ এখন নিষ্ক্রীয় ও দায়িত্বমুক্ত ঘুমিয়ে আছেন এবং সকল উপকরণাদি সৃষ্টি করে রেখেছেন যার মাধ্যমে বিশ্বজগত পরিচালিত হচ্ছে। তাদের মতে, পৃথিবী এক ধরনের ঘড়ি এবং আল্লাহ্ হলেন এর কারিগর। যিনি এটি তৈরি করে সুসজ্জিত করেছেন এবং আওয়াজ ধ্বনি বড় করে দিয়েছেন। আর ঘড়ি অটোমেটিক চলতেছে। আল্লাহ’র জাত বা সত্তার ব্যাপারে তো এগুলো বলা হয়েছে। তাঁর সিফাত বা গুণাবলির ওপরও আক্রমণ চালানো হয়েছে। তারা এতো বেশি খোদা স্বীকার ও মান্য করে যে, প্রত্যেক খোদার ভাগে একজন করে বান্দা মিলানো বড় কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারা এটা বুঝতেছে না যে, দুটি পাত্র এক স্থানে রাখলে পরস্পর সংঘর্ষ হয়ে আওয়াজ উঠে, তাই এক খোদা ভিন্ন দুই বা ততোধিক খোদা হলে দ্বন্দ্ব ও মতানৈক্য অবশ্যই হবে। আর দ্বন্দ্ব ও মতভিন্নতা হলে পৃথিবী এক সেকেন্ডও স্থির থাকবে না।
মহান আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন,
لَوْ كَانَ فِيْهِمَا آلِهَةٌ إِلَّا اللهُ لَفَسَدَتَا
অর্থাৎ ‘যদি আল্লাহ্ ব্যতীত (আসমান ও জমীন) এদুভয়ের মধ্যে বহু উপাস্য থাকত তবে উভয়ই ধ্বংস হত।’ 4. সূরা আন্বিয়া, আয়াত: ২২
দু’ বাদশাহ যদি পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত থাকে, তাহলে দেশ ধ্বংস্তুপে পরিণত হয়ে যাবে। আর খোদা বা বহু স্রষ্টার যুদ্ধের পরিণামের কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। কোন ধরনের ব্যতিক্রম ছাড়া পৃথিবী একই নিয়মে পরিচালনা করা, এটা একথারই প্রমাণ যে, সমগ্র সৃষ্টি জগত এক আল্লাহরই নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে।
অন্যান্য জাতি আল্লাহর ব্যাপারে অনেক প্রকারের ধারণা পোষণ করছে, সেটা তাদের বিবেক-বিবেচনার ব্যাপার। আমাদের একান্ত চিন্তা হচ্ছে মুসলমানদের শৃঙ্খলা থাকার ব্যাপারে, যাদের মহান দাবী হচ্ছে তাওহীদ। কিন্তু মুশরিকদের এমন কোন চাল-চলন ও আচার-আচরণ নেই, যা তারা অবলম্বন করেনি।
আল্লাহ্ তা‘আলা সম্পর্কে মুসলমানদের আক্বীদা এতো সহজ-সরল যে, যার চেয়ে সহজ ও পরিষ্কার কোন আক্বীদা হতে পারে না। ইসলাম সৃষ্টি জগতের মাধ্যমে আল্লাহ’র সত্তাগত ও গুণগত পরিচয় লাভ করে থাকে।
ذات শব্দটি ذو-এর مؤنث (স্ত্রীলিঙ্গ) অর্থ- কোন বস্তুর হাক্বিক্বত বা মূলতত্ত্ব। আল্লাহ্ তা‘আলার নাম দু’প্রকার। এক. اسم ذات বা সত্তাগত নাম,
দুই. اسم صفت বা গুণগত নাম।
اسم ذات বা সত্তাগত নাম বলা হয়- যা শুধু তাঁর সত্তার ওপর دلالت করে। অর্থাৎ- একমাত্র ‘আল্লাহ্’ ছাড়া অবশিষ্ট সকল নাম গুণবাচক। এখানে তাঁর গুণবাচক নামের কোন অধিকার নেই। اسماء صفت বা গুণবাচক নাম বলা হয়- সত্তাগত নাম ছাড়া যেখানে সিফতের অর্থ বিদ্যমান। অর্থাৎ- কোন বিশেষ গুণাবলীর অর্থ অনুপাতে আল্লাহ’র সত্তার ওপর এর প্রয়োগ হয় যেমন- রহমান, রহীম, আলীম, কাদীর ইত্যাদি।
আল্লাহ্ তা‘আলার জাত বা সত্তা ও গুণাবলীর পরিচয় লাভ করার নিয়মকে موصل الى المطلوب বলে। সৃষ্টি জগতের মাধ্যমে আমরা অনুধাবন করতে পারি যে, বিশ্ব জগতের স্রষ্টা অবশ্যই আছেন। তিনি ওই সকল বস্তুর পর্যায়ে নহেন যা আমরা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানি। আমরা আল্লাহ’র সত্তার ব্যাপারে এর চেয়ে আর বেশি বলতে পারি না। কারণ মানুষের জ্ঞানের পরিধি এ পর্যন্ত (সীমিত)।
সিফাত বা আল্লাহ’র গুণাবলির ব্যাপারে বলা যায়, গোটা সৃষ্টি জগত তাঁর একক ব্যবস্থাপনা দ্বারা অত্যন্ত সুশৃংখল ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হওয়াই তার গুণসম্পন্নতা প্রকাশ পাচ্ছে। অর্থাৎ- তার নিকট ঐ পরিপূর্ণ গুণাবলি বিদ্যমান থাকা সিফতের মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে।
আল্লাহ্ তা‘আলার নিরানব্বই নাম রয়েছে। যা نُودنہ নামে প্রসিদ্ধ। এগুলোর মধ্যে ‘আল্লাহ্’ اسم ذات বা সত্তাগত নাম হিসেবে পরিচিত। যদিও মাবুদ হওয়ার বিবেচনায় আল্লাহকেও সিফত বলা যায়। কিন্তু যাঁর এতগুলো গুণবাচক নাম আছে, অবশ্যই তাঁর সত্তাগত নাম থাকা আবশ্যক। আর তা হলো ‘আল্লাহ্’; বাকী রইলো আটানব্বই নাম- যা কোন না কোন গুণের অর্থ প্রদান করে।
সিফাতি নাম সম্পর্কে আমরা একথা বলতে পারি যে, এ নাম সমূহের বাস্তবতা ‘আল্লাহ্’-এর মধ্যে বিদ্যমান থাকা আবশ্যক। সিফত সম্পর্কে আমরা এর বেশি কিছু বলতে পারি না। যেমন- আমরা বলি আল্লাহ্ سميع‘ সর্বশ্রোতা। এর অর্থ হলো- আল্লাহ্ শ্রবণ শক্তির গুণসম্পন্ন। যে জ্ঞান আমরা আদম সন্তানেরা শ্রবণ শক্তির মাধ্যমে অর্জন করি, ওই জ্ঞান আল্লাহ্ তা‘আলার জন্যও পরিপূর্ণরূপে বিদ্যমান এ নয় যে, আমাদের মতো তাঁর কান আছে। কিন্তু মানুষের কান থাকা প্রয়োজন যার মাধ্যমে শ্রবণ করা হয়। আল্লাহ্ তা‘আলার ক্ষেত্রে এমন নয়। আমাদের শ্রবণের প্রকৃতি হলো এই যে, কথা বর্ণনাকারী আওয়াজের মাধ্যমে বাতাসে ঢেউ সৃষ্টি করে, আর ওই ঢেউ শ্রবণ শক্তিসম্পন্ন কানের (রগের সাথে স্পর্শ হলে মানুষ) আবরণে (পর্দা) যখন আঘাত করে, তখন আমাদের আওয়াজ বা ধ্বনির জ্ঞান অর্জিত হয়। মহান আল্লাহ্ পাকেরও অনুরূপ পরিপূর্ণ জ্ঞান রয়েছে। কিন্তু তিনি কান, আওয়াজ বা ধ্বনি এবং কানের রগের মাধ্যমে শ্রবণ করা থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও মুক্ত।
আল্লাহ্ পাকের অন্যান্য সিফাত ও গুণাবলিকেও এর ওপর কিয়াস করে নিন। এ সিফাতগুলো আমরা নিজেদের ওপর কিয়াস করে তার জন্য প্রমাণ করছি। অথচ আমাদের সিফাত অসম্পূর্ণ, নগণ্য ও ক্ষুদ্র এবং মধ্যস্থতার প্রয়োজন হয়। পক্ষান্তরে আল্লাহর সিফাত পরিপূর্ণ। যেমন- অনু-কণার আলো এবং সূর্যের তীক্ষন্ড আলোকরশ্মির মধ্যেকার পার্থক্য।
তাওহীদ তিন প্রকার:-
১. আল্লাহ্ পাকের সত্তাগত নাম ও তাঁর সিফাতী নামসমূহ পরিপূর্ণভাবে জানা।
২. তাঁর প্রভুত্বের বৈশিষ্ট্য ও ইবাদতের উপযোগী জানা
এবং
৩. তাঁর সকল কার্যাবলি সম্পর্কে ভালভাবে জ্ঞান রাখা।
ইসলাম ধর্মের নাম তাওহীদ এ জন্যে রাখা হয়েছে যে, তার ভিত্তি তিনটি বিষয়ের পরিচিতির ওপর এর ভিত্তি স্থাপিত। এক. আল্লাহ্ পাক স্বীয় রাজত্ব ও কর্ম সম্পাদনে একক, তাঁর কোন শরীক নেই। দুই. স্বীয় সত্তায় তাঁর সমকক্ষ ও প্রতিপক্ষ কেউ নেই এবং তিন. স্বীয় প্রভুত্বে তিনি একক ও অদ্বিতীয়। সকল নবীগণের তাওহীদ এই তিন প্রকারের মধ্যে বিভক্ত। প্রত্যেক প্রকার পরস্পরকে আবশ্যক করে এবং পরস্পর পৃথক হতে পারে না। যে এই প্রকারত্রয় থেকে যে কোন একটিকে মানল, অন্যটিকে মানল না, সে তাওহীদের পরিপূর্ণ হক আদায় করেনি।
❏ প্রশ্ন-৯: ‘দ্বীন’ দ্বারা কী উদ্দেশ্য এবং দ্বীন ও মাযহাবের মধ্যে কী পার্থক্য? আলোচনা কর।
✍ উত্তর: দ্বীন দ্বারা ‘মাযহাব’ উদ্দেশ্য। যে সকল বিষয় মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা ও বোধশক্তির ঊর্ধ্বে যেমন- মৃত্যুর পর কি অবস্থা হবে, পৃথিবীর সূচনা কবে থেকে এবং এর স্থায়ীত্ব কতদিন থাকবে ইত্যাদি, এ জাতীয় বিষয়ে কোন নির্দিষ্ট ধারণা পোষণ করার নাম ‘মাযহাব’। এ নিরিখে দ্বীন শব্দটি সকল হক ও বাতিল মাযহাবের ওপর ব্যবহৃত হয়। মহান আল্লাহ্ তা‘আলা কোরআন মজিদে ইরশাদ করেন- إِنَّ الدِّيْنَ عِنْدَ اللهِ الْإِسْلَامُ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলাম।’ অর্থাৎ- দ্বীন তো অনেক রয়েছে। তৎমধ্যে হক ও সত্য ধর্ম হলো একটিই। যার নাম ইসলাম। يوم الدين -বা বিচার দিবস অর্থ- পরকাল ও আখিরাত।
দ্বীন ও মাযহাবের মধ্যে পার্থক্য এই যে, দ্বীনের সম্পর্ক মুজ্তাহিদগণের প্রতি হয় না, পক্ষান্তরে দ্বীনের সম্পর্ক মাযহাবের প্রতি হয়। দ্বীনের সম্পর্ক বিশেষ করে আন্বিয়া-ই কিরামের প্রতি হয়।
ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা ৭৩ দলে বিভক্ত হওয়ার বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-৯ঃ-ইসলামের ৭৩ দলদুলো কি কি?বর্ণনা করো।
✍ উত্তর:-
هو المستعان ইসলাম ধর্মে মোট ৭৩ দল রয়েছে। তম্মধ্যে একটি দল- আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত। বাকী ৭২ দল মূলতঃ ছয় দলে বিভক্ত:-
১. রাফেজী,
২. খারেজী,
৩. জবরিয়াহ,
৪. কদরিয়াহ,
৫. জাহমিয়াহ্
এবং
৬. মার্জিয়াহ্।
অতঃপর এদের প্রত্যেক দল ১২ দলে বিভক্ত হয়েছে।
রাফেজিয়া ফেরকার ১২ দল নিম্নরূপ:
১.উলুবিয়্যাহ: যারা হযরত আলীকে নবী বলে।
২.আজরিয়্যাহ: যারা হযরত আলীকে নবুয়তের শরীক মনে করে।
৩.শিয়া: তাদের মতে, যারা হযরত আলীকে সকল সাহাবার চেয়ে উত্তম মনে না করে, তারা কাফির।
৪.ইসহাকিয়্যাহ: যারা বলে নবুয়ত এখনো শেষ হয়নি।
৫.যাইদিয়্যাহ: যারা বলে, নামাযের ইমামতির জন্য হযরত আলীর বংশধর ছাড়া অন্য কেউ যোগ্য নহে।
৬.আব্বাসিয়াহ: যারা হযরত আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব ছাড়া অন্য কাউকে ইমাম মনে করে না।
৭.ইমামিয়্যাহ: যারা ইহজগতকে অদৃশ্য ইমাম থেকে শূন্য মনে করে না এবং তারা নামায কেবল হাশেমী বংশের পেছনেই পড়ে।
৮.নাদেসিয়্যাহ: যারা বলে, যে ব্যক্তি নিজেকে অন্যের চেয়ে উত্তম মনে করে সে কাফির।
৯.মুতনাসেহিয়্যাহ: যারা বলে, প্রাণ যখন দেহ থেকে বের হয়ে যায়, তখন অন্যের দেহে চলে যাওয়া জায়েয।
১০.লানিয়্যাহ: যারা হযরত তালহা (رضى الله تعالي عنه), হযরত যুবাইর (رضى الله تعالي عنه) এবং হযরত আয়েশা (رضى الله تعالي عنه) সহ সবাইকে অভিশাপ দেয়।
১১.রাজেইয়্যাহ: যারা বলে, হযরত আলী পুনরায় পৃথিবীতে আসবেন।
১২.মুরতাযিয়্যাহ: যারা বলে, মুসলিম বাদশাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জায়েয।
খারেজিয়্যাহ ফেরকার ১২ দল নিম্নরূপ:
১.আযরক্বিয়্যাহ: যারা বলে, স্বপ্নযোগে কোন ব্যক্তি নেকী বা ভাল কিছু দেখতে পারবে না, ওহী বা ঐশিবাণী বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে।
২.রিয়াযিয়্যাহ: যারা বলে, ভাল কথা, ভাল কাজ, সৎ নিয়্যত এবং সুন্নাতকেই ঈমান বলে।
৩.সা‘লাবিয়্যাহ: যারা বলে, আমাদের কাজ-কর্ম আল্লাহ্ তা‘আলার কল্পনায় অর্জিত হয়েছে। তাঁর কুদরত কিংবা ইচ্ছা শক্তিতে নয়।
৪.খাযেমিয়্যাহ: যারা বলে, ফরযিয়ত বা ফরয হওয়ার বিষয়গুলো জানা যায়নি।
৫.খল্ফিয়্যাহ: যারা বলে, কাফিরদের মোকাবিলায় যে কেউ পলায়ন করা কুফরী।
৬.কুযিয়্যাহ: যারা বলে, অধিক ঘষা-মাজা ও মালিশ ছাড়া শরীর পবিত্র হয় না।
৭. কন্যিয়্যাহ: যারা বলে, যাকাত দেয়া ফরয নয়।
৮.মু‘তাযিলাহ: যারা বলে- মন্দ কাজ আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত নয়। ফাসিক ইমামের পিছনে নামায জায়েয নয়। ঈমান মানুষের অর্জিত বিষয়। কোরআন মাখলুক বা সৃষ্ট বস্তু। সদ্কা ও দু‘আ দ্বারা মৃত ব্যক্তির নিকট কোন উপকার পৌঁছে না। মি‘রাজ বাইতুল মুকাদ্দাসের ঊর্ধ্বে প্রমাণিত নয়। কিয়ামত দিবসে হিসাব-নিকাশ, আমলনামা, মিযান, পাপ-পূণ্য ইত্যাদি কিছুই নেই। ফিরিশতারা মু’মিনদের চেয়ে উত্তম। কিয়ামত দিবসে আল্লাহর দিদার ও দর্শন লাভ হবে না। আউলিয়া-ই কিরামের কারামত বা অলৌকিকত্ব বলতে কিছুই নেই। জান্নাতবাসীদের জন্য ঘুম ও মৃত্যু আছে। হত্যাকৃত ব্যক্তি নির্ধারিত সময়ে মারা যায় না। কিয়ামতের আলামত সমূহ যেমন- দাজ্জাল ইত্যাদি বলতে কিছুই নেই।
৯.মাইমুনিয়্যাহ: যারা বলে, অদৃশ্যের ওপর ঈমান আনা বাতিল ও মিথ্যা।
১০. মুহকামিয়্যাহ: যারা বলে, সৃষ্টির মাঝে আল্লাহ্ তা‘আলার কোন কর্তৃত্ব নেই।
১১.সিরাজিয়্যাহ: যারা বলে, পূর্ববর্তী লোকদের অবস্থা আমাদের জন্য দলিল নয়, বরং তাদের অস্বীকার করা ওয়াজিব।
১২.আখ্তাসিয়্যাহ: যারা বলে, বান্দা স্বীয় কর্ম ও আমলের কোন বিনিময় পাবে না। উপরে বর্ণিত বার প্রকার খারেজী অনুসারীদের প্রকারসমূহ।
জবরিয়্যাহ ফেরকার ১২ দল নিম্নরূপ:
১.মুদ্ত্বারিবাহ: যারা বলে, ভাল-মন্দ সব আল্লাহর পক্ষ থেকে। এতে বান্দার কোন ইখতিয়ার নেই।
২.আফ‘আলিয়্যাহ: যারা বলে, বান্দা কাজ তো করে কিন্তু এতে তার কোন শক্তি ও ইখতিয়ার নেই।
৩.শা‘ঈয়্যাহ: যারা বলে, বান্দার জন্য কর্ম ও শক্তি আছে। কিন্তু এ শক্তি ও সামর্থ আল্লাহ’র পক্ষ থেকে নয়।
৪.তারেকিয়্যাহ: যারা বলে, ঈমানের পর আর অন্য কিছু ফরয নয়।
৫.বাহ্ছিয়্যাহ: যারা বলে, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের অংশ খেয়ে থাকে। সুতরাং কাউকে কিছু দেয়ার প্রয়োজন নেই।
৬.মুতমান্নিয়্যাহ: যারা বলে, আত্মা প্রশান্তি লাভ করে এমন সব বিষয় ভাল ও পূণ্য।
৭.কুসতারনিয়্যাহ: যারা বলে, পূণ্য ও শাস্তি আমলের হতে পারে না।
৮.হাবীবিয়্যাহ: যারা বলে, বন্ধু আপন বন্ধুকে কখনো শাস্তি দিবে না।
৯.খাউফিয়্যাহ: যারা বলে, বন্ধু কখনো ভয় প্রদর্শন করে না।
১০.ফিক্রিয়্যাহ: যারা বলে, আল্লাহ’র মা‘রিফতে ধ্যানমগ্ন থাকা ইবাদতের চেয়ে উত্তম।
১১.হাস্বিয়্যাহ: যারা বলে, ইহজগতে কোন ধরনের ভাগ্য বন্টন নেই।
১২.হুজ্জতিয়্যাহ: যারা বলে, আল্লাহ’র নির্ধারণে যখন কাজ সম্পাদন হয়ে থাকে, তখন বান্দার ওপর কোন কৈফিয়ত তলব নেই, যার ফলে সে পাকড়াও হবে।
ক্বদরিয়া ফেরকার ১২ দল নিম্নরূপ:
১.আহ্দিয়্যাহ: যারা বলে, ফরয তো আমরা মানি কিন্তু সুন্নাতকে অস্বীকার করি।
২.ছনবিয়্যাহ: যারা বলে, পূণ্য আল্লাহ’র পক্ষ হতে এবং পাপাচার শয়তানের পক্ষ থেকে হয়।
৩.কীসানাহ: যারা বলে, আমাদের কর্মসমূহ মাখলুক বা সৃষ্ট।
৪.শয়তানিয়্যাহ: যারা বলে, শয়তানের কোন অস্তিত্ব নেই।
৫.শরীকিয়্যাহ: যারা বলে, ঈমান মাখলুক নয়। তা কখনো হয় আবার কখনো হয় না।
৬.ওহমিয়্যাহ: যারা বলে, আমাদের কর্মের কোন বিনিময় পাওয়া যাবে না।
৭.রুয়াইদিয়্যাহ: যারা বলে, পৃথিবী নশ্বর বা ধ্বংসশীল নয়।
৮.নাকিসিয়্যাহ: যারা বলে, ইমামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জায়েয।
৯.মুতবর্রিয়্যাহ: যারা বলে, গুনাহগারের তাওবা কখনো কবুল হবে না।
১০.কাসিতিয়্যাহ: যারা বলে, ইলম, ধন-সম্পদ, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং রিয়াযত বা সাধনা করা ফরয।
১১.নিত্বামিয়্যাহ: যারা বলে, আল্লাহ্ তা‘আলাকে বস্তু বলা জায়েয।
১২.মুতওয়াক্কিয়্যাহ: যারা বলে, আমরা জানি না যে মন্দ নির্ধারিত বিষয় কি-না।
জাহমিয়্যাহ ফেরকার ১২ দল নিম্নরূপ:
১.মু‘আত্তলিয়্যাহ: যারা বলে, আল্লাহ্ তা‘আলার গুণাবলি মাখলুক বা সৃষ্ট।
২.মুতরা‘ঈয়্যাহ: যারা বলে, ইলম, শক্তি ও ইচ্ছা মাখলুক কিন্তু সৃষ্টি মাখলুক নয়।
৩.মুতরাক্বিবিয়্যাহ: যারা বলে, আল্লাহ্ তা‘আলা নির্দিষ্ট স্থানে সমাসীন।
৪.ওয়ারিদিয়্যাহ: যারা বলে, যারা দোযখে যাবে, তারা আর সেখান থেকে বের হতে পারবে না। আর মু’মিন দোযখে যাবে না।
৫.হরক্বিয়্যাহ: যারা বলে, দোযখীরা এমনভাবে জ্বলবে যে, তাদের কোন চিহ্নও সেখানে অবশিষ্ট থাকবে না।
৬.মাখলুক্বিয়্যাহ: যারা বলে, কোরআন, তাওরাত, ইনজিল ও যাবুর আসমানি কিতাবসমূহ মাখলুক।
৭.ইবরিয়্যাহ: যারা বলে, মুহাম্মদ একজন বিচক্ষণ জ্ঞানী ও দার্শনিক ছিলেন কিন্তু রাসূল ছিলেন না।
৮.ফানিয়্যাহ: যারা বলে, জান্নাত ও দোযখ উভয়টি ধক্ষংস হয়ে যাবে।
৯.যানদক্বিয়্যাহ: যারা বলে, মি‘রাজ রূহানীভাবে সংঘটিত হয়েছিল, শারীরিক ভাবে নয়। আল্লাহ্ তা‘আলাকে দুনিয়াতে দেখা সম্ভব। ইহজগত অবিনশ্বর। কিয়ামত বলতে কিছুই নেই।
১০.লফ্যিয়্যাহ: যারা বলে, কোরআন পাঠকের কথা, আল্লাহ’র কালাম নয়।
১১.ক্ববরিয়্যাহ: যারা বলে, কবরে কোন শাস্তি হবে না। তারা কবরের আযাবকে অস্বীকার করে।
১২.ওয়াক্বিফিয়্যাহ: যারা বলে, কোরআন মাখলুক হওয়ার ব্যাপারে আমরা নিরব।
মারজিয়্যাহ ফেরকার ১২ দল নিম্নরূপ:
১.তারেকিয়্যাহ: যারা বলে, ঈমানের পর আর অন্য কোন বস্তু ফরয নয়।
২.শানিয়্যাহ: যারা বলে, যে ব্যক্তি لا اله الّا الله বলল, সে যা ইচ্ছা তা করতে পারবে তার কোন শাস্তি হবে না।
৩.রাজিয়্যাহ: যারা বলে, বান্দা আল্লাহ’র আনুগত্যের দ্বারা মাকবুল বা গ্রহণযোগ্য এবং অবাধ্যতার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হবে না।
৪.শাকিয়্যাহ: যারা বলে, রূহ বা আত্মাই ঈমান এবং তারা নিজের ঈমান নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে।
৫.নাহমিয়্যাহ: যারা বলে, জ্ঞানের নাম ঈমান। যে ব্যক্তি আদিষ্ট ও নিষিদ্ধ সকল বিষয়াদি সম্পর্কে অজ্ঞ সে কাফির।
৬.আমলিয়্যাহ: যারা বলে, আমলের নাম ঈমান।
৭.মান্কুসিয়্যাহ: যারা বলে, ঈমান কখনো কম হয় আবার কখনো বেশি হয়।
৮.মুস্তাছনিয়্যাহ: যারা বলে, আমরা ইন্শাআল্লাহ্ মু’মিন।
৯.আশ্রাবাহ: যারা বলে, কিয়াস বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য এবং দলিল হওয়ার গ্রহণযোগ্যতা রাখে না।
১০.বদঈয়্যাহ: যারা বলে, বাদশাহর আনুগত্য পোষণ করা ওয়াজিব, যদিও সে গুনাহর নির্দেশ দেয়।
১১.মুশাব্বিহিয়্যাহ: যারা বলে, আল্লাহ তা‘আলা হযরত আদম (عليه السلام)কে স্বীয় আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন।
১২.হস্বিয়্যাহ: যারা বলে, ওয়াজিব, সুন্নাত এবং মুস্তাহাব সবারই হুকুম এক।
5. আল্-ফরকুল ইসলামিয়াহ্।
মোস্তফা (ﷺ) এর ফযিলত ও বৈশিষ্ট্যাবলীর বর্ণনা-
❏ প্রশ্ন-১১: মোস্তফা (ﷺ) এর ইচ্ছানুযায়ী তিন ওয়াক্ত নামায না পড়ার অনুমতি সাপেক্ষে ইসলাম কবুল করা কিভাবে হলো? আলোচনা কর।
✍ উত্তর: মুসনদে ইমাম আহমদে সকল বর্ণনাকারী সেক্বাহ ও গ্রহণযোগ্য এবং বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত আছে যে,
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ جَعْفَرٍ حَدَّثَنَا شُعْبَةُ عَنْ قَتَادَةَ عَنْ نَصْرِ بْنِ عَاصِمٍ عَنْ رَجُلٍ مِنْهُمْ أَنَّهُ أَتَى النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَسْلَمَ عَلَى أَنَّهُ لَا يُصَلِّي إِلَّا صَلَاتَيْنِ فَقَبِلَ ذَلِكَ مِنْهُ .
এক ব্যক্তি মোস্তফা (ﷺ) এর দরবারে এসে এই শর্তে ইসলাম কবুল করল যে, সে কেবল দুই ওয়াক্ত নামাযই পড়বে। হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম (ﷺ) তার এই আবেদন গ্রহণ করলেন। 6. মুসনদে ইমাম আহমদ।
অথচ উম্মতে মুহাম্মদী এর ফযিলত ও বিশেষত্ব সমূহের অন্যতম হচ্ছে পাঁচ ওয়াক্ত নামায। পাঁচ ওয়াক্ত নামায এই উম্মতের জন্য নির্দিষ্ট, যা অন্য কোন উম্মতের জন্য ছিল না।
এই দুই ওয়াক্ত নামাযের অনুমতি প্রদান করা হুযূর মোস্তফা (ﷺ) এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব। হুযূর দুই ওয়াক্ত নামায পড়ার শর্তে ইসলাম গ্রহণ করার আবেদন মঞ্জুর করেন। এটা ছিল উক্ত ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ, অন্য কারো জন্য নয়। এমনি তো সামগ্রিকভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায়ের মাধ্যমে ইসলাম কবুল হয়।
❏ প্রশ্ন-১২: হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)-এর আসরের নামায ও সূর্য পুনরায় উদিত হওয়ার প্রমাণ সম্পর্কে মতামত কি? অর্থাৎ- এক বর্ণনা মতে, ‘হুযূর হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه) এর কোলে মাথা রেখে আরাম করছিলেন। এমতাবস্থায় হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)’র আসরের নামায সূর্যাস্ত যাওয়ার কারণে ছুটে যায়। হুযূর জাগ্রত হয়ে হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)কে নামায আদায় করেছে কিনা জিজ্ঞেস করেন। তিনি উত্তরে না বলেন। একথা শুনে হুযূর দু‘আ করলেন, ফলে সূর্য পুনরায় আছর ওয়াক্তে ফিরে আসলে হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه) আসরের নামায আদায় করেন।’, উক্ত রিওয়ায়েত শুদ্ধ কিনা?
✍ উত্তর: এই রেওয়ায়েতটি হযরত ইমাম তাবরানী (رحمه الله تعالي ) স্বীয় গ্রন্থ ‘আল-মু‘জমুল কবীর’ গ্রন্থে হযরত আসমা বিনতে উমাইস (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণনা করেন।
7. ইমাম তাবরানী রচিত, আল-মু‘জামুল কবীর, খন্ড-২৪, পৃষ্ঠা-১৪৫।
হযরত ইমাম আবু জাফর ত্বাহাবী ‘মুশকিলুল আছার’ গ্রন্থে এবং কাযী আয়াজসহ অন্যান্য মুহাদ্দিসীনগণ উক্ত হাদীস শরীফ বিশুদ্ধ বলেছেন। আর তাবরানী বর্ণিত হাদীসের রেওয়ায়েতকেও বিশুদ্ধ বর্ণনাসূত্রে গণ্য করেছেন।
সৈয়্যদ মাহমুদ আলুসি (رحمه الله تعالي ) فطفق يخصفان আয়াতের তাফসীরে উক্ত হাদীস শরীফ বিশুদ্ধ হওয়া সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
8. রুহুল মা‘আনি, খন্ড-২৩, পৃষ্ঠা-১৯৪।
কিন্তু ইবনে জওযী, ইবনে তাইমিয়া এবং আহমদ বিন হাম্বল (رحمه الله تعالي ) উক্ত হাদীসকে ‘মওজু‘আত’-এর মধ্যে গণ্য করেছেন। তবে উক্ত হাদীস দিরায়ত বা রেওয়ায়েতের দিক দিয়ে সুদৃঢ় ও বিশুদ্ধ মনে হয়। কেননা মুহাক্কিক ওলামাই কিরাম উক্ত হাদীস সম্পর্কে অভিমত পেশ করেছেন, যদিও রেওয়ায়েত সম্পর্কে কিছু কথা রয়েছে কিন্তু নবী-রাসূলগণের শানে রিসালতে, মু‘জিযা ও অলৌকিকত্বের এক মহান বাস্তব অধিকার রয়েছে। বিশেষ করে সৈয়্যদুল আম্বিয়া (ﷺ)-এর ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে মন্তব্য ও সমালোচনা করার কারো কোন অধিকার নেই।
❏ প্রশ্ন-১৩: মি‘রাজ কতবার হয়েছে? কখন এবং কোন তারিখে সংঘটিত হয়েছে?
✍ উত্তর: মি‘রাজ সর্বমোট ৩৪ বার সংঘটিত হয়েছে। তন্মধ্যে কেবল একবার সশরীরে, বাকী সব রূহানীভাবে। যা নবুয়্যতের পূর্ব থেকে শুরু হয় এবং বিছাল শরীফের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে। সশরীরে মি‘রাজ ২৭ রজব সোমবার রাত্রে সংঘটিত হয়- অধিকাংশ ওলামাই উম্মত একথার ওপর একমত। সোমবারের হাক্বিকত, ফযিলত, মহত্ত্ব, বুযূর্গী ও শরাফত মহান আল্লাহর নিকট উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। যার প্রমাণ হচ্ছে হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম (ﷺ)-এর মি‘রাজ হয়েছিল সোমবার রাত্রে, পবিত্র মক্কা মুয়ায্যমা থেকে হিজরত করেছিলেন সোমবার দিন, ওহীর ধারক ও বাহক হুযূর সোমবার মদিনায় প্রবেশ করেন, হুযূর-এর বেলাদত ও ওফাত শরীফ হয় সোমবার এবং পবিত্র রমযানে কোরআন শরীফ নাযিল হয় সোমবার ইত্যাদি। এখানে মোস্তফা (ﷺ) এর জন্য দ্বিতীয় স্থানে নির্দিষ্ট হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেহেতু সোমবারকে يوم الاثنين বলা হয়। الف (আলিফ) এবং يوم الاحد দ্বারা ذات বা সত্তা নির্দিষ্টকরণের মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আর باء (বা) يوم الاثنين দ্বারা صفت বা গুণাবলীর মর্যাদাকে মান্য করা হয়।
فافهم ولاتكن من الجاهلين
অর্থাৎ- ‘এ বিষয়ে তোমরা চিন্তা-গবেষণা কর, অজ্ঞদের অন্তভুর্ক্ত হয়ো না।’
❏ প্রশ্ন-১৪: মি‘রাজ শরীফ রাত্রে কেন হয়েছে? রাতের পরিবর্তে যদি দিনে হতো, তাহলে কারো সমালোচনা করার সুযোগ থাকত না।
✍ উত্তর: রাত সৃষ্টি করা হয়েছে বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর মিলনের ও সাক্ষাতের নিমিত্তে। তাই রাত হলো মিলন ও একত্রিত হওয়ার উপযুক্ত সময়। আর দিন হলো বিচ্ছেদ ও দূরে থাকার। অথবা এভাবে বলা যায়, রাত হলো গোপন বিষয় সমূহের প্রকাশস্থল এবং দিন হলো প্রকাশ্য বিষয়সমূহের প্রকাশস্থল। সুতরাং মি‘রাজের জন্য রাতই উপযুক্ত সময়।
❏ প্রশ্ন-১৫: হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)’র জন্য রদ্দুস শামস বা সূর্য পুনরায় উদিত হওয়া সংক্রান্ত ইমাম ত্বাহাবী (رحمه الله تعالي )-এর বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদীস শরীফের ইবনে তাইমিয়া কর্তৃক সমালোচনা করার মূল কারণ কী? রদ্দুস শামস-এর বাস্তব ঘটনা কী? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: রদ্দুস শামস বা সূর্য পুনরায় উদিত হওয়ার মূল ঘটনা সম্পর্কে মুহাদ্দিস আনওয়ার শাহ্ কাশ্মিরী বলেছেন, নবী করীম হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)কে কোন প্রয়োজনীয় কাজে আসরের পূর্বে পাঠিয়েছিলেন। তিনি প্রয়োজন সেরে আসতে আসতে আসরের নামায পড়ার আগে সূর্য ডুবে যায়। হুযূর কে এ খবর দেয়া হলে তিনি দু‘আ করেন। ফলে তাঁর দু‘আর বদৌলতে আল্লাহ্ তা‘আলা সূর্যকে পুনরায় উদিত করেন। হাদীসের বর্ণনা সূত্রের ভিন্নতার কারণে উক্ত ঘটনা সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায় যা মূল ঘটনার সাথে সংশিষ্ট নয়।
হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه) আসরের নামায কেন আদায় করেন নি এ প্রসঙ্গে মুহাদ্দিস আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী বলেন, আমার মতে এর কারণ হচ্ছে এই যে, হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)-এর নিকট দু’টি হুকুম একই সময় একত্রিত হয়েছিল।
প্রথমতঃ সকলের জন্য সাধারণ হুকুম- সময় মতো নামায আদায় করা,
দ্বিতীয়তঃ বিশেষ হুকুম- নবী করীম (ﷺ)-এর পক্ষ থেকে তাঁকে যে প্রয়োজনে পাঠানো হয়েছিল তা সূর্যাস্তের পূর্বে সম্পাদন করে ফিরে আসা।
যেমন- বুখারী শরীফে বনু কুরাইযার ঘটনা বর্ণিত আছে যে, রাসূলে করীম সাহাবা-ই কিরামকে বনু কুরাইযায় পৌঁছে আসরের নামায আদায় করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু আসরের সময় পথিমধ্যে হয়ে যাওয়াতে কিছু সংখ্যক সাহাবা আল্লাহ তা‘আলার সাধারণ হুকুমের প্রতি লক্ষ্য করে পথিমধ্যে সময় মতো নামায আদায় করে নেন। আর কতিপয় সাহাবী বিশেষ হুকুমের প্রতি লক্ষ্য করে আদায় করেননি। তাঁরা হুযূর (ﷺ)-এর বিশেষ নির্দেশনাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। অতএব বুঝা গেল, স্পষ্টতঃ কারো থেকে আল্লাহর সাধারণ হুকুম আবার কারো থেকে বিশেষ হুকুম ছুটে গেল। এ ঘটনা হুযূর (ﷺ) জানার পর কোন দলকে কিছুই বলেন নি।
باب مرجع النبىﷺ من الاحزاب
অর্থাৎ- খন্দকের যুদ্ধ হতে হুযূর-এর ফিরে আসার সময় উক্ত ঘটনা সম্পর্কিত বর্ণনা বুখারী শরীফের ৫৯১ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছে। অতঃপর শাহ সাহেব বলেন, এটা বড় কঠিন ইজতিহাদী মাসআলা, যার সমাধান সহজ নয়। কারণ বিশেষ হুকুমকে অগ্রবর্তী করা হলে সাধারণ হুকুম ছুটে যায়। আর সাধারণ হুকুমের ওপর আমল করলে বিশেষ হুকুম এড়িয়ে যেতে হয়।
তিনি আরো বলেন, রদ্দুস শামস বা সূর্য পুনরায় উদিত হওয়া এটা খাইবার যুদ্ধের ঘটনা। কতেক ওলামা ভুলবশতঃ এটাকে খন্দকের যুদ্ধ সম্পর্কে মনে করেছেন। অথচ খাইবরেই রদ্দুস শামস সম্পর্কিত ঘটনা ঘটে; আর খন্দকে গুরুবুশ শামস অর্থাৎ- সূর্য অস্ত যাওয়া সম্পর্কিত ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। সেখানে হুযূর ও হযরত ওমর (رضى الله تعالي عنه) সূর্য অস্ত যাওয়ার পর আসরের নামায আদায় করেছিলেন। এ ঘটনাটি বুখারী শরীফের ১৮৪ ও ৫৯০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে।
ইমাম ত্বাহাবী (رضى الله تعالي عنه)-এর বিশুদ্ধ হাদীস রদ্দুস শামস সম্পর্কে হাফিয ইবনে তাইমিয়ার সমালোচনার কারণঃ বিজ্ঞ ওলামায়ে কিরামের নিকট একথা অস্পষ্ট নয় যে, এটা একটি সুপ্রসিদ্ধ ঘটনা। এ প্রসঙ্গে যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা কাউসারী রচিত গ্রন্থ ‘সীরাতে ত্বাহাবী’ এবং আল্লামা সৈয়দ আহমদ রেযা বজনূরী নকশবন্দী রচিত ‘আনওয়ারুল বারী’ গ্রন্থ থেকে কতিপয় উত্তর দেয়ার প্রয়াস পাব। হাফিয ইবনে তাইমিয়া ইমাম ত্বাহাবী (رحمه الله تعالي )’র রদ্দুস শামস সম্পর্কে বর্ণিত হাদীস বিশুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে কঠোর সমালোচনা করেছেন। এমন কি একথাও বলেছেন যে, ইমাম ত্বাহাবী বড় মাপের মুহাদ্দিস, ফকীহ ও আলিম হলেও অন্যান্য মুহাদ্দিস ও আলিমের ন্যায় ইসনাদে হাদীস সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল না।
মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী ইমাম ত্বাহাবী (رحمه الله تعالي )-এর বিশুদ্ধতা ও নির্ভরযোগ্যতার ওপর বিশ্বাস করে বর্ণিত মূল ঘটনা চিহ্নিত করেন। তিনি এর চেয়ে বেশী আর কিছু বলেননি। হাফিয ইবনে তাইমিয়ার সমালোচনার কথাও উল্লেখ করেছেন। যার বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু কতেক ওলামা বলেন, এর বড় একটি কারণ এটাও হতে পারে যে, ইমাম ত্বাহাবী (رحمه الله تعالي )-এর প্রতি হাফিয ইবনে তাইমিয়ার উপরোক্ত সমালোচনা গ্রহণযোগ্য মনে করেন না। কারণ হাফিয ইবনে তাইমিয়া অবশ্যই একজন বড় হাফিযে হাদীস এবং তাঁর অধিক জ্ঞান, মর্যাদা এবং জ্ঞানের গভীরতা সম্পর্কে সকল ওলামা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ এবং তাঁকে সবাই সমর্থন করতেন। স্বয়ং মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরীও তাঁর প্রশংসাকারী ছিলেন। কিন্তু ইমাম ত্বাহাবী (رحمه الله تعالي )এর মতো উচ্চ পর্যায়ের মুহাদ্দিসের মোকাবিলায় ইবনে তাইমিয়ার সমালোচনা এমন পর্যায়ের যেরূপ আল্লামা শওকানী ইমাম বুখারী (رحمه الله تعالي ) এর সমালোচনা করেছিলেন।
মুহাদ্দিস আল্লামা কাউসারী (رحمه الله تعالي ) অবস্থার প্রেক্ষাপটে সমসাময়িক ওলামায়ে কিরামের মধ্যে যাদের অনুভূতি শক্তি কম তাদের পথ নির্দেশনা ও আলোর পথ দেখানোর উদ্দেশ্যে ইতিহাস ও রিজাল শাস্ত্র সম্পর্কিয় বিষয়ের ভুল-ভ্রান্তি দূরীকরণ সংশোধনকল্পে অপরিসীম পরিশ্রম করছেন।
جزاه الله خيرا عنا وعن المسلمين .
মুহাদ্দিস আল্লামা কাউসারী (رحمه الله تعالي ) তাঁর ‘সীরাতে ত্বাহাবী’ গ্রন্থে লিখেছেন, ইমাম ত্বাহাবী (رحمه الله تعالي ) সম্পর্কে হাফিয ইবনে তাইমিয়ার এতো বড় গুজব ছড়িয়ে দেয়ার মূল কারণ হচ্ছে, তিনি রদ্দুস শামসের হাদীস শরীফটি বিশুদ্ধ প্রমাণ করে দিয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه) এর কৃতিত্ব, বুযূর্গী, শরাফত ও উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ পাচ্ছে। ফলে ইবনে তাইমিয়ার গঠনকৃত থিউরির ওপর এক বিরাট প্রভাব পড়ছে, যা তিনি হযরত আলী মরতুযা (رضى الله تعالي عنه)কে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কেননা তার দৃষ্টিভঙ্গি খারেজী দলের চিন্তাধারায় প্রভাবিত ছিল। কারণ মুসলমানদের মধ্যে দলাদলি ও দ্বিধা-বিভক্তি খারেজী ফেরকা থেকেই শুরু হয়েছিল। মুসলমানদেরকে কাফির, মুশরিক ও বিদ‘আতী হিসেবে তৈরী করার বিশাল কারখানা ও ইন্ডাষ্ট্রী উআইনা ও দরিনা নামক স্থানে প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে নজদ হিসেবে প্রসিদ্ধ। উক্ত ফ্যাক্টরী থেকে শিরক ও বিদআত তৈরী হয়ে বের হয়, যা ক্রমান্বয়ে মুসলমানদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে বিস্তৃতি লাভ করছে।
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে- كل اناء يترشح بما فيه ‘প্রত্যেক পাত্র কিংবা কারখানা ও ফ্যাক্টরী থেকে ওটাই বের হয়, যা এতে তৈরী হয়।’ পরবর্তীতে উক্ত ইন্ডাষ্ট্রীর ম্যানেজার ক্রমান্বয়ে ইবনে হাযম হয়ে ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে কাইয়ুম পর্যন্ত এবং পরিশেষে জেনারেল ম্যানেজার হন ইবনে আবদুল ওহাব নজদি। তাই তাদের অনুসারীদেরকে ওহাবী বলা হয়। যারা হিজায শরীফের নাম পরিবর্তন করে তাদের পূর্বপুরুষদের নামে নামকরণ করেন। এভাবে প্রত্যেক কিছুর পরিবর্তন করতে থাকে। অথচ প্রত্যেক ভাল কাজ সব সময় ভালই থাকবে আর মন্দ কাজ সব সময় মন্দই থাকবে। মন্দ মন্দই আর ভাল ভালই।
হাফিয ইবনে তাইমিয়া মূল আক্বীদা ও ফরঈ শাখা-প্রশাখাগত একক মাসআলাসমূহে মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করেছেন। আর তিনি কোন ধরনের মুসলমান?
যখন যেখানে জাতির মধ্যে মৌলিক আক্বীদাগত মাসআলায় মতানৈক্য সৃষ্টি হয়, আল্লাহ্ তা‘আলার বিধান ও নিয়মানুসারে সেখানে নবী-রাসূল প্রেরণ করে থাকেন। যাতে ওই জাতিকে সরল ও সঠিক পথের দিক নির্দেশনা দিতে পারেন। হতে পারে এই দৃষ্টিকোণে হাফিয ইবনে তাইমিয়া গোপনে ও অপ্রকাশ্যভাবে নিজেকে নবী দাবী করেছেন। তাই শাস্তিও কম পেতে হয়নি তাকে। হিজায শরীফ যা জামাতার মিরাছ হিসেবে ওহাবীরা পেয়েছিল সে সুবাদে হারামাইন শরীফাইনেরও নাম পরিবর্তন করে সাউদিয়া নামে তারা নামকরণ করে দেয়।
সারকথা এই যে, ইবনে তাইমিয়া খারেজী সম্প্রদায়ের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হওয়ার প্রমাণ তার লিখিত ইবারত থেকেই বুঝা যায়। কেবল বিষয় অনুপাতে নয়।
রদ্দুস শামস-এর হাদীসকে কখনো বাতিল ও প্রত্যাখ্যাত বলা যাবে না। যে বিষয়ের মাসআলা সে বিষয়ের উসূল বা নীতিমালার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে বাতিল প্রমাণ করা সম্ভব নয়। অবশ্য হাদীস শাস্ত্রের উসূল মতে বেশী জোর একথা বলা যাবে যে, উক্ত হাদীসের মান-মর্যাদা ও মরতবা অন্যান্য বিশুদ্ধ হাদীসে আহাদের সমপর্যায়ের।
হযরত ইমাম ত্বাহাবী (رحمه الله تعالي ) ইলালে হাদীস তথা হাদীস শুদ্ধ-অশুদ্ধ হওয়ার কারণসমূহ বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। অযথা রায় প্রদানের মতো ব্যক্তিত্ব তিনি ছিলেন না। সুতরাং তাঁর প্রদানকৃত বিশুদ্ধ রায় বাতিল প্রমাণ করা সহজ ব্যাপার নয়।
এমনকি অন্যান্য ওলামায়ে কিরাম এবং হাফিযে হাদীসগণের মতো মহান ব্যক্তিবর্গ প্রত্যেক যুগে উক্ত হাদীসের সনদ একত্রিত করেছেন। উক্ত হাদীসকে সহীহ বিশুদ্ধ ও তার ওপর আস্থা রেখেছেন এবং তা গ্রহণ করেছেন। যথা- হাফিযে হাদীস হুজ্জত হাকিম নিশাপুরী (رحمه الله تعالي ) এবং হাফিয সুয়ূতী (رحمه الله تعالي ) উক্ত বিষয়ের ওপর স্বতন্ত্র একটি রিসালা রচনা করেছেন। কাজী আয়ায শাফেঈ (رحمه الله تعالي )ও তাঁর শিফা শরীফে উক্ত হাদীস বিশুদ্ধ, সুদৃঢ় ও মজবুত বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। (বাতিলপন্থী লোকেরা বিপর্যয় ও ধ্বংস হোক।)
হাদীসসমূহের ওপর গভীর আলোচনা ও চিন্তা-গবেষণা করতে গিয়ে সৈয়্যদুনা ইমাম ত্বাহাবী (رحمه الله تعالي ) বিশেষ করে রিজালে হাদীস তথা হাদীসের বর্ণনা সূত্রের সমালোচনা ও বিশুদ্ধতার বর্ণনা করেছেন। তাঁর বহু কিতাবে রিজাল শাস্ত্রের সমালোচনার সুস্পষ্ট নিদর্শন ও প্রমাণ পাওয়া যায়। কারাবিসী লিখিত ‘কিতাবুল মুদালিস’ গ্রন্থের ভুল-ভ্রান্তি বিষয়ক আলোচনা ও সমালোচনা শুধু ইমাম ত্বাহাবী (رحمه الله تعالي ) ছাড়া আর কে করেছেন, বলুন তো? একমাত্র ইমাম ত্বাহাবীই (رحمه الله تعالي ) ‘কিতাবুল মুদালিসীন’ গ্রন্থের বর্ণনা সূত্রের বিশুদ্ধতার ওপর কঠোর সমালোচনা করেছেন। এত বড় হাদীস বিষয়ের খিদমত যিনি আঞ্জাম দিয়েছেন, তিনি রিজাল শাস্ত্রের ওপর অনভিজ্ঞ হলে কিভাবে কার্য সম্পাদন করতে পারেন? তা কখনো হয় না। এতদ্সত্ত্বেও ইমাম ত্বাহাবী (رحمه الله تعالي )কে রিজাল শাস্ত্র সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ছিলেন একথা বলা যাবে? কিংবা তাঁকে যার ধারাবাহিক ভুল-ভ্রান্তির ওপর হাফিয আবু বকর আস্-সামিত হান্বলীকে পুরো একটি কিতাব লিখতে হয়েছে।
9. আনওয়ারুল বারী, খন্ড-৬, পৃষ্ঠা-২১।
হাফিয ইবনে তাইমিয়ার দলিল পেশ করার ওপর একটি সমীক্ষা বা দৃষ্টিভঙ্গি:
এখানে একথাটিও উল্লেখ করার মতো যে, হাফিয ইবনে তাইমিয়া ও অন্যান্য উগ্র স্বভাবের লোকদের ন্যায়, যখন কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করতেন, তখন তার বিপরীতে অন্যান্যদেরকে সরাসরি না-হক্বের ওপর দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করতেন এবং তা নাকচ করতে প্রয়োজনাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করতেন। অর্থাৎ নিজের সামর্থ যোগ্যতা অভিজ্ঞতার পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করে তার বিপরীত অভিমত অশুদ্ধ প্রমাণ করার প্রাণপণ চেষ্টা করতেন। যার পরিণাম এ দাঁড়ায় যে, পাঠকবৃন্দ চিন্তাবিদ ও গবেষকগণ প্রকৃত সঠিক তত্ত্ব ও তথ্য অনুসন্ধানে ব্যর্থ হয় এবং বাস্তব অনুধাবন করা থেকে অনেক দূরে চলে যায়। ফলে ভুল বুঝাবুঝি ও অশুদ্ধতার শিকার তো অবশ্যই হবে।
❏ প্রশ্ন-১৬: যদি হুযূর(ﷺ)কে স্বপ্নযোগে শরীয়ত বিরোধী কোন হুকুম প্রদান করতে দেখলে এর হুকুম কী?
✍ উত্তর: হুযূর মোস্তফা (ﷺ) কে স্বপ্নযোগে দেখা সত্য ও বরহক। সৈয়্যদুনা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত আছে যে, হুযূর মোস্তফা (ﷺ) ইরশাদ করেন,
مَنْ رَآنِي فِي الْمَنَامِ فَقَدْ رَآنِي فِي الْيَقَظَةِ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ لَا يَتَمَثَّلُ عَلَى صُورَتِي.
যে ব্যক্তি আমাকে স্বপ্নে দেখল, সে মূলতঃ আমাকে জাগ্রত অবস্থায়ই দেখল। কেননা শয়তান আমার আকৃতি ধারণ করতে পারে না।
10.
১.ইবনে মাজাহ শরীফ।
২.সহীহ বোখারী শরীফ; হাদিস ৬৫৯২,
৩.মুসলিম ২২৬৬
অতএব, যে ব্যক্তি মোস্তফা (ﷺ) কে তাঁর পবিত্র দৈহিক গঠন (হুলিয়া শরীফ) ও আকৃতি মুবারক অনুযায়ী দেখেছে যা হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে তার স্বপ্ন হক্ব ও সত্য। নিঃসন্দেহে সে তাকেই দেখেছে, কেননা অভিশপ্ত শয়তানের এই শক্তি নেই যে, সে মোস্তফা (ﷺ)-এর আকৃতি ধারণ করবে।
স্মরণীয় যে, স্বপ্নে দেখা প্রত্যেক বিষয় জাগ্রত অবস্থায় দেখার মতো নয়। যেমন হুযূর(ﷺ)কে স্বপ্নে দেখলে কেউ সাহাবী হতে পারবে না। অনুরূপ স্বপ্নযোগে তাঁকে শরীয়ত বিরোধী কোন বিষয়ের হুকুম দিতে দেখলে তা শরীয়তের দলিল হবে না। শরীয়তের অনুসরণ বাধ্যতামূলকভাবে অবশ্যই করণীয়। যেমন- কোন ব্যক্তি হুযূর(ﷺ)কে দেখল তাকে মদ পান করার হুকুম করছেন। সে জাগ্রত হয়ে আশ্চযান্বিত হয়ে গেলেন। সে একজন আলিমে দ্বীনের নিকট গিয়ে তার স্বপ্নের বর্ণনা দিল। তিনি উত্তরে বলেন, এটা তোমার ভুল হচ্ছে, তিনি তোমাকে মদ পান করতে নিষেধ করেছেন কিংবা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, আগামীতে তোমার আক্বীদা বা আমলে শরীয়ত বিরোধী কোন কর্ম বা ফিৎনা-ফ্যাসাদ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, সে ব্যাপারে হুশিয়ারী সংকেত দেয়া হয়েছে। এটা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে অনেক বড় দয়া ও মেহেরবানী যে, তাকে সতর্ক করে দিচ্ছে। অনুরূপ ওলামায়ে কিরাম বিশদভাবে বর্ণনা দিয়েছেন যে, যদি কেউ হুযূর(ﷺ)কে অন্য কোন আকৃতি বা অবস্থায় দেখতে পায় যেমন- দাড়ি মুন্ডানোবস্থায়, মূলতঃ সে তাঁকে কে দেখেনি এবং তার এ স্বপ্ন ও ধারণা ভুল প্রমাণিত হবে।
মুহাদ্দিস সৈয়দ মুহাম্মদ জামাল উদ্দিন বলেছেন, হুযূর (ﷺ)কে যেকোন অবস্থায় দেখুক না কেন সে অবশ্যই তাঁকে দেখেছে। কেননা আকৃতি হচ্ছে উদাহরণ বা উপমা। কারণ তাঁর রূহে মুকাদ্দাসের আকৃতি ধারণ করার দুঃসাহস শয়তানের নেই যে, সে যে কোন আকৃতি ধারণ করে মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ(ﷺ)বলে দাবী করবে। তবে এ ব্যাপারে ওলামায়ে ইসলাম একমত যে, স্বপ্নযোগে প্রকাশ্য শরীয়ত বিরোধী কোন হুকুম করতে দেখলে তা আমল করা জায়েয নেই। আর একথা বলতে হবে যে, উক্ত স্বপ্নে দর্শকের ভুল হয়েছে এবং সে প্রতারিত হয়েছে। শয়তান মানুষকে যখন জাগ্রত অবস্থায় এভাবে ধোকা দিচ্ছে, তাহলে স্বপ্নযোগে তাকে ধোকা দেয়া আরো সহজতর হবে।
11. মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান হায়দারাবাদী।
❏ প্রশ্ন-১৭: عيد (ঈদ) অর্থ কী? ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা ছাড়া অন্য কোন ঈদ হতে পারে? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: عيد (ঈদ) অর্থঃ লোকজন একত্রিত হওয়ার দিন। মুসলমানদের উৎসবের দিন। বহুবচনে اعياد ।
عيد الشعانين অর্থাৎ- عيد الفضح، عيد القيامة: খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের ধারণা মতে হযরত ঈসা (عليه السلام)কে ক্রুশবিদ্ধ বা সুলিতে চড়ানোর দিন।
عيد الفطير: ইহুদীদের একটি ধর্মীয় ঈদ।
عيد الميلاد: খ্রীস্টানদের উৎসবের দিন (ঈযৎরংসধং উধু)। হযরত ঈসা (عليه السلام)এর জন্মদিন।
12. মিফতাহুল লুগাত, মাওলানা আবুল ফাতাহ সংকলিত। কোরআন মহল, মৌলভী মুসাফিরখানার বিপরীতে, করাচি।
عيد: খুশী, আনন্দ। খুশী, উৎসব ও ছুটির দিন। বহুবচেন اعياد ।
عيد الفى: হাজার বছর বর্ষপূর্তি।
عيد الفضح: খ্রীস্টানদের ধর্মীয় উৎসবের দিন।
عيد مِئوِىْ: শত বর্ষপূর্তি।
عيد الميلاد: জন্মোৎসব, জন্মবার্ষিকী, ইরৎঃয উধু ।
عيد وطنى: জাতীয় উৎসব দিবস।
13. অহিদুজ্জামান কিরানবী, শিক্ষক, দারুল উলুম দেওবন্দ। কুতুবখানা হোসাইনিয়া দেওবন্দ।
عيد: যা বারংবার আসে, মানুষের জমায়েত ও একত্রিত হওয়ার দিন, মুসলমানদের উৎসবের দিন। বহুবচনে اعياد ।
عيد : اصله من عود المسرة ورجوعها . وياؤه منقلبة عن وج-
عه اعياد . وانما جمع بالياء واصله الواؤ للزومها فى الواحد، وقيل للفرق بينه وبين اعواد الخشب . والعيد اسم للموسم المعهود يحتفل به الناس سنويًا . قال الله تعالٰى: تَكُونُ لَنَا عِيْدًا لِأَوَّلِنَا وَآخِرِنَا وَآيَةً مِنْكَ . (سورة مائدة)
عيد المائدة الّتى انزلها الله تعالٰى على عيسىٰ عليه السلام اكلها قومه منه ونحن المسلمون ولنا عيدان هما: عيد الفطر وعيد الاضحٰى.
عيد(ঈদ): আনন্দের দিন। খুশীর দিন। বহুবচনে اعياد । এটা عيد হতে উৎকলিত। যার অর্থ- ফিরে আসা। কথিত আছে যে, ঈদকে এজন্য ঈদ বলা হয়- যেহেতু ওটা প্রত্যেক বছর ফিরে আসে। ‘ইযহার’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, আরবে প্রত্যেক আনন্দের জন্য আয়োজিত সমাবেশকে ঈদ বলে থাকতো। কারণ উহা ফিরে আসাতে আনন্দও ফিরে আসে। এটাও বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা ঈদের দিন যেহেতু তাঁর প্রিয় বান্দাদের ওপর অসংখ্য রহমত ও বরকত নাযিল করেন, তাই এটাকে ঈদ নামকরণ করা হয়েছে।
অতএব হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه) বলেন-
ليس العيد لمن لبس الجديد، انما العيد لمن أمن الوعيد .
‘ঈদ ওই ব্যক্তির জন্যে নয় যে নতুন কাপড় পরিধান করে, প্রকৃত ঈদ সে ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহ তা‘আলার শাস্তি, আযাব ও গজব থেকে পরিত্রাণ লাভ করেছে।’ প্রত্যেক জাতির মধ্যে ঈদ প্রথা বিদ্যমান আছে এবং তা নিজ নিজ সংস্কৃতি অনুযায়ী পালন করে থাকে। রাসূলুল্লাহ যখন মদীনা মুনাওয়ারায় তাশরীফ আনেন, তখন মদিনাবাসীরা ইরানীদের অনুসরণে নাইরোজ ও মেহেরজান নামে দু’টি ঈদ উদযাপন করতেন। রহমতে ‘আলম নূরে মুজাস্সাম মুহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ) ইরশাদ করেন, আল্লাহ্ তা‘আলা উক্ত দু’দিনের পরিবর্তে, এর চেয়ে আরো উত্তম দুটি দিন ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা আমাদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন।”
14. সুনানে আবু দাউদ শরীফ, হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত।
ইসলাম দুই ঈদের দিনকে পানাহার ও আনন্দের দিন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে একদিকে শারীরিক আনন্দ উপভোগের মাধ্যম বানিয়েছেন, অন্যদিকে উভয় দিনে নামায, সদকা, দান-খয়রাতকে ওয়াজিব করে আত্মিক উৎকর্ষ সাধনের উসিলাও বানিয়ে দিয়েছেন। ইসলাম ধর্মে দু’ঈদের সূচনা দ্বিতীয় হিজরীতে হয়। পবিত্র কোরআনে কারীমে ‘ঈদ’ শব্দটি হযরত ঈসা (عليه السلام)-এর দু‘আতে এসেছে। যা তিনি তাঁর বিশ্বস্ত সহচর ও সাহায্যকারীদের জন্যে তাদের দাবীর প্রেক্ষিতে আসমান থেকে খাদ্য ভর্তি দস্তরখান অবতরণ করার জন্য দু‘আ করেছিলেন। অতএব তিনি বলেন,
اَللَّهُمَّ رَبَّنَا أَنْزِلْ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِنَ السَّمَاءِ تَكُونُ لَنَا عِيدًا لِأَوَّلِنَا وَآخِرِنَا
অর্থাৎ- ‘হে আল্লাহ্! আমাদের জন্য খাদ্য ভর্তি দস্তরখান আসমান থেকে নাযিল করুন। যা আমাদের ও পরবর্তী প্রজন্মদের জন্য ঈদের (উৎসবের) দিন হিসেবে নির্ধারণ করতে পারি।’
অতএব তার দু‘আ মোতাবেক রবিবার আসমান থেকে খাদ্য নাযিল হতে শুরু করলো, খ্রীস্টানগণ সে দিনটিকে ঈদের দিন হিসাবে নির্ধারিত করেন। কতিপয় রেওয়ায়েত থেকে জানা যায় যে, চলিশ দিন যাবত সর্ব সাধারণের জন্য অনুমতি ছিল, ফলে তারা সকলেই উপকৃত হয়। চলিশ দিন পর আমীর-ওমরা ও ধনীদের জন্য নিষিদ্ধ করা হলে তারা তা অমান্য করার দরুন তাদের ওপর আসমানী খাদ্য অবতরণ বন্ধ হয়ে যায় এবং তাদের ওপর আল্লাহর পক্ষ হতে শাস্তি অবতীর্ণ হয়।
অন্য বর্ণনা মতে, আল্লাহ্ তা‘আলা মায়িদা বা আসমানী খাদ্য এ শর্তে নাযিল করেন যে, এরপরও যদি কেউ কাফির হয়ে যায়, তাহলে আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের ওপর এমন শাস্তি নাযিল করবেন, যা অন্য কারো ওপর নাযিল করা হয়নি। এতে হাওয়ারীগণ ভীত হয়ে তাদের দাবী প্রত্যাহার করেন। ফলে মায়িদা অবতরণ বন্ধ হয়ে যায়।
15. কামুসুল কোরআন, কাজী জয়নুল আবেদীন রচিত।
ঈদ ওই নিয়ামত ও আনন্দকে বলা হয় যা প্রত্যেক বছর বারংবার ঘুরে ফিরে আসে। এমন বিষয়ের ওপর খুশি ও আনন্দ যা আল্লাহ তা‘আলার রহমত, করুণা ও অনুগ্রহ দ্বারা অর্জিত হয়। প্রত্যেক বছর রহমত, ফযিলত ও অনুগ্রহের দ্বারা যে আনন্দ হাসিল হয় তাকে ঈদ বলে এবং এটাকে প্রকৃত খুশী বলা হয়। এ কারণে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা খুশী উদযাপন করার নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ্ বলেন-
قُلْ بِفَضْلِ اللهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُوا الخ .
এ সকল বিষয় প্রাপ্তির ওপর আনন্দ উৎসব পালন করাকে ‘কোরআনী ঈদ’ বলা হয়। যেমন সৈয়্যদুনা হযরত ঈসা (عليه السلام)-এর দু‘আতে এর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেমন- عِيْدًا لِأَوَّلِنَا وَآخِرِنَا. ইত্যাদি কুরআনের আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয়। আর এগুলো এক একটি নিয়ামত ও বরকতের বিনিময়ে হয়েছে বিধায় একে ঈদ বলা হয় এবং এটা প্রকৃত কোরআনী ঈদ বলা হয়েছে অথবা প্রচলিত পারিভাষিক বলা হয়।
দ্বিতীয়ত: শরয়ী ঈদ। যা বাৎসরিক দু’ঈদ হিসেবে প্রসিদ্ধ। এটা হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত। আর প্রকৃত প্রচলিত ঈদ যা পূর্বে উল্লেখিত আল্লাহর নিয়ামত ও ফযল অর্জনের দরুন পালন করা হয়। এটা পবিত্র কোরআন দ্বারা প্রমাণিত। যেমন হযরত ঈসা (عليه السلام) আসমানী খাবার ‘মান্না ও সালওয়া’ অর্জন করার ওপর যে আনন্দ উৎসব হাসিল করেছিলেন, এটাকেই কোরআনী পরিভাষায় ঈদ বলা হয়েছে।
অন্ধকার যুগ থেকে হিদায়তের যুগের সূচনালগ্ন হুযূর (ﷺ)-এর দুনিয়াতে আগমন মুসলমানদের জন্য অনেক বড় ঈদ। এর চেয়ে উত্তম দুনিয়াতে আর কোন ঈদ হতে পারে না। এটি এমন এক অতুলনীয় ও অপরিসীম নিয়ামত যার কোন তুলনা ও নজীর নেই। এর চেয়ে বড় দয়া, মেহেরবানী ও পুরস্কার সৃষ্টি জগতের প্রতি অন্য কোন বস্তু নেই। এটা আল্লাহর একত্ববাদের পর অমূল্য ও অতুলনীয় নিয়ামত। অতএব এ নিয়ামত অর্জনের ওপর খুশী উদযাপন করা সুন্নাতে ইলাহি ও ইসলামী কানুন মোতাবেক পূণ্যের কাজ। শরয়ী উভয় ঈদের সঙ্গে এই ঈদের সম্পর্ক হচ্ছে نوعى তথা এক প্রকারের সম্পর্ক, كلى বা পূর্ণাঙ্গ নয়। একে বিদ‘আত বলা এক নতুন অজ্ঞতা বৈ কিছু নয়। শরয়ী ঈদ হচ্ছে সাময়িক আনন্দ, যা ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর হিসেবে কোরবানী ও রোযা দ্বারা পরিচিত স্পষ্টতঃ যা বছরে একবার অনুষ্ঠিত হয়।
চিরস্থায়ী নিয়ামত, শাশ্বত দয়া অনুগ্রহকে ও কোরআনি পরিভাষায় ঈদ বলা হয়। সুতরাং একে বিদ‘আত বলা একটি নতুন আবিষ্কার, যা কোন জ্ঞানী ও বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তির জন্য সমীচীন নয়। আল্লাহ্ পাক সবাইকে বুঝার তৌফিক দান করুন।
বিদ‘আত হচ্ছে পূর্বের কোন প্রকারের নমুনা ও নিদর্শন ব্যতীত শরয়ী বিধান মনে করা। অতএব এটা শরয়ী বিদ‘আত কখনো হতে পারে না এবং এখানে تشبه বা তুলনামূলক কোন মাসআলা সংযুক্ত করা কোন ভাবেই উচিত নয়। কেননা এমন কোন বিষয় পাওয়া যাবে না যা কাজে-কর্মে কিংবা আকৃতি-প্রকৃতির দিক দিয়ে অন্যের সঙ্গে তুলনাবিহীন হবে। বিশেষতঃ এটাকেই বিদআতে শরয়ী আখ্যায়িত করা মানে আল্লাহর প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ(ﷺ)এর ইহ জগতে তাশরীফ আনয়নে তাদের অসন্তুষ্টি ও বিরুদ্ধাচারিতার বহিঃপ্রকাশ। আর বিদআতের সাথে সম্বোধিত বস্তু, তা খুবই খারাপ ও মন্দ যা আল্লাহ্ তা‘আলার দয়া, ফযল ও অনুগ্রহের বিপরীত বিষয় বলে গণ্য। যে সকল বিষয় হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর প্রতি সম্বোধিত, সেগুলো শরয়ী বিদআত হতে পারে না। যেমন- মিলাদুন্ নবী ও উরশুন্ নবী । তবে পদ্ধতিগত ও বাস্তবতায় কোন অসংযত ও অশোভনীয় কিছু পরিলক্ষিত হলে তা অবশ্যই সংশোধন করা যেতে পারে। মূল বিষয়কে পরিবর্তন ও সংশোধন করার কোন মু’মিন মুত্তাকির অধিকার নেই। তাই এগুলোকে অযথা বিদআতে শরয়ী বলা মানে মুসলমানদের মাঝে দ্বিধাবিভক্তি ও ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা। এটা কোন ইসলামী খিদমত নয়, বরং ইসলামকে ধ্বংস করা বৈ আর কিছু নয়। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,
مَا كَانَ لِبَشَرٍ أَنْ يُؤْتِيَهُ اللهُ الْكِتَابَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ ثُمَّ يَقُولَ لِلنَّاسِ كُونُوا عِبَادًا لِي مِنْ دُونِ اللهِ وَلَكِنْ كُونُوا رَبَّانِيِّينَ بِمَا كُنْتُمْ تُعَلِّمُونَ الْكِتَابَ وَبِمَا كُنْتُمْ تَدْرُسُونَ .
‘কোন ব্যক্তি আল্লাহ্ তা‘আলার কিতাব, হিকমত ও নবুওয়ত প্রাপ্তির পর একথা বলতে পারে না যে, ‘তোমরা আল্লাহকে পরিহার করে আমার বান্দা হয়ে যাও’ এটা সম্ভব নয়। বরং তারা বলবে যে, ‘তোমরা আল্লাহওয়ালা হয়ে যাও, যাতে তোমরা কিতাব শিখাতে পার এবং তোমরা নিজেরাও পড়তে পার।’
16. সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৭৯।
এই আয়াতের একান্ত জরুরী শব্দাবলীর অর্থ ও মর্ম নিম্নে প্রদত্ত হলো,
بشر (বশর) শব্দের অর্থ:আল্লামা মজদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইয়াকুব ফিরোজাবাদী (মৃত্যু- ৮১৭ হিজরী) বলেন, বশর মানুষকে বলা হয়। এটি একবচন হোক কিংবা বহুবচন হোক, বহুবচনে ابشار আসে। بشر অর্থ মানুষের বাহ্যিক চামড়া। আর চামড়ার সাথে চামড়া মিলানোকে মুবাশারাত বলে। বাশারত ও বাশরী শব্দের অর্থ- সুসংবাদ দেয়া।
17. ক্বামূসুল মুহীত, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-২৯৮।
বশর, ইনসান ও আদমী- এই শব্দগুলোর মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান আছে। প্রকাশ্য ও বাহ্যিক চামড়া এবং মুখমন্ডলের দিক বিবেচনাকে বশর বলা হয়, হাকীকত বা প্রকৃত মূলতত্ত্বকে ইন্সান বলে এবং জাতি ও বংশ পরিক্রমাকে আদমী বলা হয়।
আল্লামা হুসাইন বিন মুহাম্মদ রাগেব ইস্পাহানী (মৃত্যু-৫০২ হিজরী) লিখেছেন, চামড়ার বাইরের অংশকে بَشْرَةٌ (বশরাহ) এবং চামড়ার ভেতরের অংশকে أدَمَةٌ (আদামাহ্) বলা হয়। মানবজাতিকে তাদের বাহ্যিক চামড়ার দিক বিবেচনায় বশর বলে। কেননা জীব-জন্তুর চামড়া বড় পশম যুক্ত ও বিভিন্ন রং বিশিষ্ট হয়ে থাকে। কোরআন মজিদে যখন মানবজাতির দেহ ও বাহ্যিক অবস্থার বিবেচনা করা হয় তখন বশর শব্দ ব্যবহার করা হয়।
মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন- وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْمَاءِ بَشَرًا ‘তিনিই সে সত্তা যিনি পানি থেকে মানব আকৃতি সৃষ্টি করেছেন।’
18. সূরা ফোরকান, আয়াত-৫৪।
আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন, إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ طِينٍ ‘নিশ্চয়ই আমি মাটি দ্বারা মানব সৃষ্টি করব।’
19. সূরা ছোয়াদ, আয়াত: ৭১।
কাফিররা যখন নবী-রাসূলগণের প্রতি হেয়পতিপন্ন করা উদ্দেশ্য হতো তখন তাঁদেরকে ‘বশর’ শব্দ বলে আখ্যায়িত করতো। যেমন,
إِنْ هَذَا إِلَّا سِحْرٌ يُؤْثَرُ . إِنْ هَذَا إِلَّا قَوْلُ الْبَشَرِ .
‘কাফির বললো, এ কোরআন তো আগের লোকদের থেকে প্রাপ্ত যাদু ছাড়া আর কিছুই নয়। এ তো মানুষের কথা ছাড়া আর কিছুই নয়।’
20. সূরা মুদ্দাস্সির, আয়াত: ২৪-২৫।
সূরা হুদে আছে,
مَا نَرَاكَ إِلَّا بَشَرًا مِثْلَنَا
‘আমরা তো আপনাকে আমাদের মতো একজন মানুষ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।’
21. সূরা হুদ, আয়াত-২৭
সূরা বনি ইসরাঈলে উল্লেখ আছে-
قَالُوا أَبَعَثَ اللهُ بَشَرًا رَسُولًا
‘কাফিররা বলতো, আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের মতো একজন মানুষকেই কি নবী করে পাঠালেন।’
22. সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত-৯৪
সূরা মারইয়ামে আছে, فَتَمَثَّلَ لَهَا بَشَرًا سَوِيًّا
‘হযরত সৈয়্যদুনা জিবরাইল (عليه السلام) যখন হযরত মরিয়ম (عليه السلام)-এর নিকট মানবীয় আকৃতি ধারণ করে তাঁর সামনে আসলেন তখন বলেন।’
23. সূরা মরিয়ম, আয়াত-১৭
হযরত জিবরাইল (عليه السلام) বশরী আকৃতিতে আসলেন এখানে এটাই উদ্দেশ্য। আর মিসরের মহিলারা হঠাৎ যখন হযরত ইউসুফ (عليه السلام)কে আবরণ বিহীন দেখতে পেল, তৎক্ষাণাৎ বলে উঠল-
حَاشَ لِلهِ مَا هَذَا بَشَرًا
‘আল্লাহ’র শপথ! কখনোই নয়- এ ব্যক্তি মানব নয়’।
24. সূরা ইউসুফ, আয়াত-৩১
এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে, মিসরের মহিলারা হযরত ইউসুফ (عليه السلام)কে অনেক উঁচু পর্যায়ের মনে করে তাঁর সত্তাগত বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃত অবস্থাকে মানবোর্ধ্ব ধারণা পোষণ করেছিলেন। বাশারত, মুবাশারাতও উক্ত শব্দ থেকে নির্গত।
মানুষ যখন কোন সুসংবাদ শুনতে পায় তখন তার চেহারায় খুশীর আলামত ও চিহ্ন প্রস্ফুটিত হয়, সে জন্য তাকে বাশারত বলা হয়। মুবাশারাত মানে নারী-পুরুষ নিজেদের দেহের চামড়াকে পরস্পর মিলানো এবং একে অপরের মধ্যে সংযুক্ত ও মিলিত হওয়া। কোরআন মজিদ ও হাদীস শরীফে এ দু’টি শব্দের ব্যবহার এসেছে।
25. আল-মুফরাদাত, পৃষ্ঠা-৪৭-৪৮, মাকতাবা-ই ইরান।
ইমাম মুসলিম (رحمه الله تعالي ) সৈয়্যদুনা হযরত আবু হুরায়রা (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেন, আমাকে সকল নবী-রাসূলগণের ওপর ছয়টি বিষয়ে ফযিলত দেয়া হয়েছে:-
১.جوامع الكلم অর্থাৎ- স্বল্প কথায় ব্যাপক অর্থবোধক শব্দাবলী দান করা হয়েছে।
২.رعب অর্থাৎ-আমাকে ভীতি-আতঙ্ক ও প্রভাব-প্রতিপত্তি দ্বারা সম্মানিত করা হয়েছে।
৩. যুদ্ধলব্ধ সম্পদ আমার জন্য হালাল করা হয়েছে।
৪.সমগ্র জমিনকে আমার জন্যে পবিত্রকারী, তায়াম্মুমের উপকরণ এবং মসজিদে পরিণত করে দিয়েছেন।
৫.আমাকে সমগ্র সৃষ্টির প্রতি রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন এবং
৬. আমার ওপর সমগ্র নবীগণের আগমন সমাপ্ত করেছেন।
হযরত জাবের (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, প্রত্যেক নবীকে বিশেষতঃ তাঁর নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরণ করেছেন। কিন্তু আমাকে প্রত্যেক শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ তথা সমগ্র বিশ্বের প্রতি প্রেরণ করা হয়েছে।
26. মুসলিম শরীফ, খন্ড-১, হাদীস নং-৫২১, ৫২৩; জামে তিরমিযী, খন্ড-৩, হাদীস নং-১৫৫৯
কুরআনের আয়াত এবং হাদীস শরীফ একথার প্রতি ইঙ্গিত বহন করে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا
‘আমি আপনাকে কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল লোকদের জন্য ভীতি প্রদর্শনকারী ও সুসংবাদ দানকারী হিসেবে প্রেরণ করেছি।
27. সূরা: সাবা, আয়াত-২৮
উপরিউক্ত কুরআনের আয়াত ও হাদীস শরীফ দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, হুযূর মুহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ) কে কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন। এর মর্মার্থ হচ্ছে, তাঁর শরীয়ত কিয়ামত পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। তাই আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন,
إِنَّ الدِّيْنَ عِنْدَ اللهِ الْإِسْلَامُ
অর্থাৎ-‘ইসলাম ধর্ম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না।’
28. সূরা: আলে-ইমরান, আয়াত-১৯
নিশ্চয়ই একথা স্পষ্ট বুঝা গেল যে, পূর্ববর্তী সকল ধর্ম নিজ নিজ যুগে পরিপূর্ণ কার্যকর ছিল। কিন্তু যখন ইসলাম ধর্ম কিয়ামত পর্যন্ত পরিপূর্ণ ধর্ম হিসেবে আল্লাহ্ তা‘আলা অনন্য বৈশিষ্ট্যের ঘোষণা দিলেন,
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ الخ
‘আমি আজ তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি।’(যা আমার একমাত্র মনোনীত ধর্ম- ইসলাম)।
29. সূরা মায়েদা, আয়াত-৩
ইমাম আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জারীর তাবারী (ইন্তিকাল ৩১০ হিজরী) (رحمه الله تعالي ) বলেছেন, উক্ত আয়াত হুযূর-এর বিদায় হজ্বের বছর আরাফাত দিবসে জুমাবার অবতীর্ণ হয়। এরপর হালাল-হারাম সম্পর্কিত আহকামের আর কোন আয়াত নাযিল হয়নি। বরং উক্ত আয়াত নাযিলের পর মাত্র ৯১দিন পর্যন্ত তিনি ইহজগতে তাশরীফ ফরমা ছিলেন।
ইবনে জারীর (رحمه الله تعالي ) থেকেও অনুরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। 30. জামেউল বয়ান, খন্ড-৬, পৃষ্ঠা-১০৬, বৈরুত।
ইমাম তিরমিযী (رحمه الله تعالي ) (ইন্তিকাল-২৭৯) হযরত আম্মার ইবনে আবি আম্মার (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণনা করেন যে, প্রখ্যাত সাহাবী হযরত ইবনে আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) এক ইহুদীর সামনে,
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ الخ
আয়াতটি তিলাওয়াত করলে ইহুদী লোকটি বলল, উক্ত আয়াত যদি আমাদের ওপর নাযিল হতো, আমরা ওই দিন ঈদ উদযাপন করতাম। ইবনে আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) বলেন, এই আয়াত আমাদের দুই ঈদের দিন নাযিল হয়েছে, জুমার দিন ও আরাফাতের দিন।
31. জামে তিরমিযী, খন্ড-১, হাদীস নং-৩০৫৫।
উক্ত হাদীস দ্বারা বুঝা গেল যে, জুমার দিন মুসলমানদের জন্য ঈদ এবং আরাফাতের দিনও মুসলমানদের জন্য ঈদ। মিলাদুন্-নবী কে ঈদ মানতে যারা নারাজ তারা বলে, মুসলমানদের শুধু দু’টি ঈদ রয়েছে। তারা উক্ত বিশুদ্ধ হাদীসের প্রতি গভীর দৃষ্টিপাত করেনি। হ্যাঁ! অবশ্য একথা বলা যেতে পারে যে, ঈদ বলতে প্রসিদ্ধ দু’টি, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহাকে বুঝায়। যার সম্পর্কে শরীয়তের নির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। যেমন- ঈদুল ফিতরের দিন সকালে মিষ্টিমুখ করা হয়, এরপর ঈদগাহে দুই রাকাত নামায আদায় করা এবং পরে খুৎবা পাঠ করা ইত্যাদি। অনুরূপ ঈদুল আযহায় প্রথমে নামায পড়া এবং এরপর খুৎবা পাঠ করা হয়। অতঃপর সাহেবে নেসাব কুরবানী করা ইত্যাদি।
জুমার দিন হচ্ছে মুসলমানদের জমায়েত ও একত্রিত হওয়ার দিন। এ সময় জোহরের পরিবর্তে দু’রাকাত জুমার নামায ফরয এবং খুতবা পাঠ করা আবশ্যক। আরাফাতের দিন হাজীগণ ছাড়া অন্য লোকদের রোযা পালন করাতে অসংখ্য ফযিলত রয়েছে এবং দু’বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়ার ঘোষণাও রয়েছে।
ইমাম রাগেব ইস্পাহানী (رحمه الله تعالي ) (ইন্তিকাল-৫০২) বলেছেন, যা বারবার ফিরে আসে ওই দিনকে ঈদের দিন বলা হয়। শরীয়তে ফিতরের দিন ও কোবরনাীর দিন ঈদের জন্য নির্ধারিত। শরীয়তে এই দিনে খুশী উদযাপনের কথা বলা হয়েছে। যেমন- শরীয়ত প্রবক্তা সরকারে দো’আলম সতর্ক করে বলেছেন, ঈদের দিন হচ্ছে, পানাহার এবং মিলন ও আনন্দের দিন। অতএব ঈদ শব্দটি ওই সকল দিনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, যেদিন কোন খুশী অর্জিত হয়। এর স্বপক্ষে কোরআনে কারীমের এই আয়াতটি দলিল
قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ اللهم رَبَّنَا أَنْزِلْ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِنَ السَّمَاءِ تَكُونُ لَنَا عِيدًا الخ .
‘হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (عليه السلام) আরয করলেন, হে আল্লাহ্! হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের প্রতি আসমান হতে খাঞ্চাভর্তি খাদ্য অবতরণ করুন। তা আমাদের পূর্বাপর সবার জন্যে আনন্দোৎসব হবে এবং আপনার পক্ষ থেকে হবে একটি নিদর্শন।’
32. সূরা মায়েদা, আয়াত: ১১৪
এমনও বলা যায় যে, শরয়ী ও পারিভাষিক ঈদ হচ্ছে কেবল দু’টি- ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। আর জুমা এবং আরাফার দিন হচ্ছে প্রথাগত ঈদ। কেননা যেদিন কোন প্রকারের নিয়ামত এবং খুশি-আনন্দের সুসংবাদ আসে সেদিনকে প্রথাগত ঈদ বলে।
সকল নিয়ামতের মূল হচ্ছে- সৈয়্যদুনা মুহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ) এর পবিত্র সত্তা। অতএব যেদিন এ মহান নিয়ামত অর্জিত হয়েছে (অর্থাৎ- যেদিন তিনি ইহজগতে তাশরীফ এনেছেন) সেদিন সকল ঈদের সেরা ঈদ এবং এটাও প্রথাগত ঈদ, শরয়ী ঈদ নয়। বরং উদ্দেশ্য ও অন্তর—নিহিত মর্মের দিক দিয়ে প্রকৃত ঈদ হচ্ছে হুযূর মোস্তফা (ﷺ) এর সত্তা। সুতরাং মু’মিনদের জন্য শরয়ী ঈদের সাথে, প্রথাগত ঈদেও অত্যন্ত খুশী ও আনন্দ এবং অসংখ্য নিয়ামত নিহিত রয়েছে। এ কারণে মুসলমানেরা সর্বদা আক্বা ও মাওলা পরম দয়ালু নবী রাসূলে করীম (ﷺ)-এর ১২ই রবিউল আউয়াল বেলাদতের দিন ঈদে মিলাদুন্ নবী দিবস অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে উদযাপন করে আসছে।
প্রশ্ন হলো ১২ই রবিউল আউয়াল রহমেত ‘আলম (ﷺ)-এর বেলাদত শরীফ পালন করা হয়, অথচ অন্য বর্ণনা মতে একই তারিখে তাঁর ওফাত শরীফও। অতএব তোমরা ওই দিন রাসূল (ﷺ)-এর জন্মোৎসব পালন করে থাক অথচ প্রথাগত নিয়ামনুযায়ী উক্ত তারিখে তোমরা শোক দিবস পালন কর না কেন?
উক্ত প্রশ্নের শরয়ী উত্তর হলো শরীয়ত আমাদেরকে নিয়ামত প্রাপ্তির ওপর আনন্দ প্রকাশের এবং তা বয়ান করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর কোন নিয়ামত চলে যাওয়াতে শোক প্রকাশ করতে নিষেধ করেছেন। প্রথাগত ও যুক্তিসংগত উত্তর হলো আমরা দুঃখ-বেদনা ও শোক কেন প্রকাশ করব?
হুযূর (ﷺ) ইরশাদ করেন, حياتى خيرلكم ومماتى خيرلكم অর্থাৎ- ‘আমার জীবদ্দশায় তোমাদের যেমন মঙ্গল নিহিত আছে আমার ইন্তিকালেও অনুরূপ তোমাদের মঙ্গল নিহিত রয়েছে।’ তিনি ইহকালে যেভাবে জীবিত ছিলেন তেমনি বর্তমানেও জীবিত আছেন। প্রথমে কষ্ট জগত পৃথিবীতে জীবিত ছিলেন, এখন প্রতিদান জগত পরকালে ও জান্নাতে জীবিত আছেন। পৃথিবীর জীবনে হুযূর মোস্তফা (ﷺ) পথভ্রষ্ট লোকদের হিদায়ত ও সঠিক পথের নির্দেশ এবং শিক্ষা-দীক্ষা ও ধর্ম-কর্ম প্রচারণার দায়িত্ব পালন করেন; বর্তমানে গুনাহগার পাপী ও অবাধ্য লোকদের মাগফিরাতের জন্য দু‘আ করছেন। তাঁর নিকট উম্মতের আমল পেশ করা হয়। তখন নেক ও পূণ্য আমলের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার প্রশংসা করেন এবং পাপ ও মন্দ আমলের কারণে তিনি উম্মতের জন্য মাগফিরাত কামনা করেন। তিনি যিয়ারতকারীদের সালামের জবাব প্রদান করেন, যেমনি পার্থিব জীবনে সালাম প্রদানকারীদের সালামের জবাব দিতেন। শাফাআত তথা সুপারিশ প্রার্থনাকারীদের জন্য সুপারিশ করেন। আল্লাহ্ তা‘আলার তাজালিয়াত বা জ্যোর্তিময় আলোকরশ্মির দর্শন ও পর্যবেক্ষণে সদা নিমগ্ন থাকেন। لايفارق حضرة الله تعالٰى ابدًا তাঁর উচ্চ মর্যাদা ও সুমহান সম্মান-প্রতিপত্তি প্রতি মুহূর্তে উন্নত হচ্ছে। এতে চিন্তিত ও শোক প্রকাশ করার কী কারণ থাকতে পারে?
হুযূর স্বয়ং একথা যখন বলেছেন, “আমার ইহকাল এবং পরকাল উভয়ই তোমাদের জন্য কল্যাণকর।”
33. আল-ওয়াফা বে-আহ্ওয়ালিল মুস্তফা , খন্ড-১০, পৃষ্ঠা-৮১০।
___________________________
[টিকা সংযোজনঃ মাসুম বিল্লাহ সানি, উক্ত হাদিস ভিন্ন সনদে বর্ণিত সূত্রসমূহঃ
১) আনাস বিন মালিক (রাঃ)
২) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রাঃ)
৩) আউস ইবনে আউস (রাঃ)
৪) বকর ইবনে আব্দুল্লাহ আল-মাজিনী (রহঃ)
তথ্যসূত্রঃ
► ইমাম ইবনে সা’দঃ তাবাকাত-আল-কুবরাতে (2: 194)
► ইমাম ইবনে হিব্বান, কিতাব আল-মাজরুহিন, ২/160।
► ইমাম কাজী আয়াজঃ আশ-শিফা (1:19)
► ইমাম বাজ্জারঃ আল-মুসনাদঃ1/397 : ইবনে মাসউদের হাদীস থেকে সহীহ সনদে।
► ইমাম শাশীঃ আল মুসনাদঃ খন্ড 2, পৃষ্ঠা: 253, হাদীস: 826
► ইমাম জুহদামীঃ ফজল আস সালাহ আন নাবী (ﷺ)
: 1, পৃষ্ঠা: 38-39, হাদীস: 25-26
► ইমাম সুবকীঃ আস শিফাউস-সিকাম ফী জিয়রতে খায়রুল আনম। [সর্বোত্তম সৃষ্টির জিয়ারতে রোগীদের রোগ নিরাময়], যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, এটিঃ
১) বকর ইবনে আব্দুল্লাহ আল-মাজিনী এবং
২) ইবনে আল-জাওযী তা বকরের মাধ্যমে এবং
৩) আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) সূত্রেও বর্ণিত।
► ইমাম দায়লামিঃ মুসনাদ আল ফিরদাউসঃ 1, পৃষ্ঠা: 183, হাদীস: 686
► ইমাম ইবনে আল-জাওজীঃ আল-ওয়াফায়ঃ আউস ইবনে আউস (রাঃ) সূত্রে।
► ইমাম ইবনে কাসীরঃ তফসীরে ইবনে কাসীরঃ 3 : পৃ 516
► ইমাম ইবনে হাজর আসকালানীঃ ফতহুল বারী শরহে বুখারীঃ 10: 415,
► ইমাম মুনযিরীঃ আত তরগিব ওয়া আল-তরহিব 3: 343,
► মুসনাদ আল-হারিস,
► ইমাম আবু হাতিমঃ আল-জারহ ওয়াত তা’আদিল, 26/64,
► ইমাম হাফিজ আল-হায়তামিঃ মাজমা আল-জাওয়ায়েদঃ2/884 (# 953)
► ইমাম ইবনুল ইরাকীঃ তারহুত-তাথরীব ফী শারহে-তাকরীব (3: 297)
► ইমাম ইবনে হাজর আসকালানীঃ তাকরীব ওয়াহেদ তাহাদিব, 1/478
► ইমাম ইবনে হাজর আল-আসকালানী মাতালিব আল-আলিয়াঃ 4/22,
► ইমাম যাহাবীঃ আল মুগনি, 1/571 (# 3793) (নুরুদ্দীন এর ৩য় সংস্করণে)
► ইমাম যাহাবীঃ সিয়ার আল আলম আন নুবালাঃ 17, পৃষ্ঠা: 106
► ইমাম সুয়ূতীঃ খাসায়েসুল-কুবরা, 2/281
► ইমাম সুয়ূতীঃ মানাহিল আল-সাফা ফী তাখরিয় আহাদীদ আল-শিফাঃ পৃ .3 (# 8)
► ইমাম মিয্যিঃ তাহযীব আল কামালঃ 14, পৃষ্ঠা: 558
► ইমাম জুরকানিঃ শরহ্ আল মাওয়াহিবঃ 7
পৃষ্ঠা: 373
► ইমাম আল-মানাভি, ফয়জুল কাদির, 3/401
► ইমাম হিন্দিঃ কাঞ্জুল উম্মালঃ 31903-31904
► শাইখ শুয়ায়ব আল-আরনাউতঃ তাহরির আল-তাহরীবঃ 2/379 (# 4160) এ আবু দাউদ, আহমাদ ইবনে হাম্বল, ইবনে মাঈন, আন-নাসায়ী ও ইবনে সা’দের থেকে।
কিতাব আল-হজ (# 179)
► আল বুরকানীঃ তরিক আল-দাওরী, ২/370; পৃ .317;
► শায়খ আব্দুল্লাহ আল-তালিদীঃ তাহযিব আল খাসায়েসুল কুবরাঃ পৃ: 458-459 (# 694)]
___________________________
মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ শফি দেওবন্দি (ইন্তিকাল-১৩৯৬ হিজরী) লিখেছেন, ‘খ্রীস্টানরা হযরত ঈসা (عليه السلام)-এর জন্ম দিবসকে ঈদে মিলাদ পালন করে। তাদের দেখে কিছু মুসলমান রাসূলে করীম-এর জন্মদিনকে ঈদে মিলাদুন্নবী নামে আরেকটি ঈদ উদযাপন করছে। ওই দিন বাজারে মাঠে-ময়দানে জুলুস বের করে এবং এতে বিভিন্ন প্রকারের অযথা ও অপ্রত্যাশিত কর্মকান্ডকে ও রাতে আলোকসজ্জা করাকে ইবাদত মনে করছে। যার কোন মূলভিত্তি ও প্রমাণ সাহাবা-ই কিরাম, তাবেঈন এবং পরবর্তী বুযূর্গানে দ্বীনের আমলে ও কর্মকান্ডে পাওয়া যায়নি।’
34. মুআরেফুল কোরআন, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-৩৫, করাচি থেকে প্রকাশিত।
সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী (মৃত্যু ১৩৯৩ হিজরী) এক সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নোত্তরে বলেন, সবার আগে আপনাকে একথা জানতে চাওয়া উচিত ছিল যে, ইসলামে ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ)-এর অস্তিত্ব বিদ্যমান আছে কিনা? ওই জশন যাকে ইসলামের হিদায়তকারী ’র প্রতি সম্বোধন করা হয়, বাস্তবিকপক্ষে ওটা ইসলামী উৎসবই নয়, এর কোন প্রমাণ ইসলামে পাওয়া যায়নি। এমনকি সাহাবা-ই কিরামগণও এটি পালন করেন নি।
আফসোস! পরিতাপের বিষয় উক্ত জশন ও উৎসবকে দেওয়ালী বা দীপমালা ও টোপর এর আকৃতি দেয়া হয়েছে, যেখানে লক্ষ লক্ষ টাকা অপচয় করা হয়। (দেওয়ালী-লাইটিং বা আলোকসজ্জা আর টোপর মুক্তাগাঁথা টুপি যা বর-কনের মাথায় পরানো হয়)।
35. হাপত্ রোযাহ্ কিন্দিল, ৩রা জুলাই-১৯৬৬ইং।
সাধারণত মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাবের অনুসারী এবং দেওবন্দী ওলামারা একথা বলে প্রভাবিত করে যে, ১২ই রবিউল আউয়াল ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের তরিকা এবং তাদের নব আবিষ্কৃত ও উদ্ভাবিত প্রথা। যা তাদের বর্ণনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় এবং হচ্ছে। কিন্তু একথা আদৌ সত্য নয়। বরং বাস্তবতা হচ্ছে মুসলমানগণ সব সময় রবিউল আউয়াল মাসে রাসূল (ﷺ)-এর জন্মোৎসব উপলক্ষে খুশী ও ঈদ উদযাপন করে আসছে।
আল্লামা আহমদ কুস্তলানী (رحمه الله تعالي ) (ইন্তিকাল ৯১১ হিজরী) লিখেছেন, সর্বদা মুসলমানগণ রাসূল পাক (ﷺ)-এর মিলাদের মাসে মাহফিলসমূহ উদযাপন করে আসছেন এবং দাওয়াত দেন। তারা এ মাসের রাতগুলোতে বিভিন্ন প্রকারের দান-সদকা এবং আনন্দ উৎসব পালন করতেন। পূণ্যের কাজ অধিকহারে করতেন। রাসূল পাক (ﷺ)-এর মিলাদ সম্পর্কীয় আলোচনা করতেন, যার বরকতে তাদের ওপর আল্লাহ’র ফযল ও অনুগ্রহ অধিকহারে বর্ষিত হতো।
মিলাদ শরীফ উদযাপন করার ফলে এই অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে যে, এতে মানুষের সৎ উদ্দেশ্য পূরণ হয়। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা ওই ব্যক্তির ওপর স্বীয় রহমত নাযিল করেন, যিনি পবিত্র বরকতময় বেলাদত শরীফের রাতে ঈদ পালন করেন।
36. আল মাওয়াহিবুল লুদুনিয়া, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৭৮, দারুল কুতুব লাইব্রেরী, বৈরুত।
হযরত আল্লামা কুসতলানী (رحمه الله تعالي ) আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ আল-জয্রী (ইন্তিকাল ৮৩৩ হিজরী) (رحمه الله تعالي )-এর উদ্ধৃতি উল্লেখ পূর্বক বর্ণনা করেন যে, আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল বাকী যুরকানী মালিকী (ইন্তিকাল ১১৬৬ হিজরী) এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন, এই কাজে কতিপয় দুনিয়া পিপাসু লোকজন অসৎকর্ম অন্তভুর্ক্ত করে দিয়েছে। আল্লামা ইবনুল্হাজ্ব মালিকী ‘মদখল’ গ্রন্থে এর খন্ডন করেছেন এবং স্পষ্ট ভাষায় ব্যাখ্যা করে বলেন, এই মাসে পূণ্যের কাজ, সদকা-খায়রাত, ইসালে সওয়াব, খানা-মেজবানী ও যিয়াফত ইত্যাদি অধিকহারে করা উচিত। এটাই মিলাদ শরীফ পালনের উত্তম পন্থা।
আল্লামা ইবনে কাছীর (رحمه الله تعالي ) স্বীয় তারিখ গ্রন্থে লিখেছেন যে, ইরবিলের বাদশাহ কিং মুজাফ্ফর আবু সাঈদ (ইন্তিকাল ৬৩০ হিজরী) সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করেন। তিনি অত্যন্ত সাহসী, সৎ, গভীর জ্ঞানী ও পূণ্যবান বাদশাহ ছিলেন। তিনি তিনশত দিরহাম ব্যয় করে অত্যন্ত জাঁকজমক ও শানদার ভাবে মিলাদুন্নবী মাহফিল ও মেহমান নাওয়াযীর ব্যবস্থা করতেন।
37. শরহে আল-মাওয়াহিবুল লুদনিয়্যাহ, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১৩৯, দারুল মা‘আরিফ লাইব্রেরী, বৈরুত।
আল্লামা সুয়ূতী (رحمه الله تعالي ) মিলাদুন্নবী কে বিদ‘আতে মুস্তাহিব্বাহ্ ও হাসনা বলেছেন। আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمه الله تعالي ) এবং হযরত আল্লামা গোলাম রাসূল সাঈদী হানাফী (رحمه الله تعالي ) মুসলিম শরীফ ৩য় খন্ড বিস্তারিতভাবে মিলাদুন্নবী পালনের বর্ণনা করেছেন। তিব্য়ানুল কোরআন ৩য় খন্ড ৬৮ পৃষ্ঠায় لايحب الله পারায় দলিল ও তথ্যসহ বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অন্যান্য হানাফী মাযহাবের ওলামায়ে কিরাম কোরআন ও সুন্নাহ থেকে মিলাদুন্নবী এর স্বপক্ষে যে দলীল উপস্থাপন করেছেন এবং বিরোধী সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর দলিল প্রমাণাদিসহ বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। কোনো কোনো শহরে মিলাদুন্নবীর জুলুসে গান-বাজনা, বাদ্যযন্ত্র এবং শরীয়ত বিরোধী কর্মকান্ড করে থাকে। আমাদের আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ওলামায়ে কিরাম সব সময় এগুলো থেকে নিষেধ করে আসছেন। অধিকাংশ শহরে সম্পূর্ণ পূত-পবিত্রতার সঙ্গে শরীয়তসম্মত জুলুস পালন করা হয়।
আল্লামা মুহাদ্দিস গোলাম রাসূল সাঈদী (رحمه الله تعالي ) বলেছেন, আমি দু’বার লন্ডন গিয়েছিলাম এবং আমি সেখানে উক্ত মাসে বিভিন্ন মাহফিলে অংশগ্রহণ করি। এতে শুধু হামদ-না’ত শরীফ পাঠ ও যিকির-আযকার ব্যতীত অন্য কোন প্রকারের শরীয়ত বিরোধী কোন কাজ করতে দেখিনি। জুলুসের আয়োজনকারী সকল সদস্য জামাআতের সাথে নামায আদায় করেন এবং অতঃপর মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে নবী কারীম (ﷺ) রাউফুর রাহীম এর বিভিন্ন ফযিলত ও গুণগান এবং মর্যাদা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।
প্রথমে দেওবন্দ ও জামায়াতে ইসলামীর আলিমরা ঈদে মিলাদুন্নবী এবং জুলুস উদযাপনের ঘোর বিরোধী ছিলেন কিন্তু আজ হতে ১৫,২০ বছর ধরে দেওবন্দ ও জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় ওলামারাও ঈদে মিলাদুন্নবী-এর জুলুস বের করেছেন এবং এতে শরীক হচ্ছেন।
সিপাহ-ই সাহাবা সংগঠনের শীর্ষ ওলামায়ে কিরাম হযরত আবু বকর (رضى الله تعالي عنه), হযরত ওমর (رضى الله تعالي عنه) এবং হযরত ওসমান (رضى الله تعالي عنه)- এই খলিফাত্রয়ের জন্মদিবস পালন করে আসছে। উক্ত দিবসগুলোতে তারা জুলুস বের করে এবং সরকারের কাছে ওই দিবসগুলোতে সরকারী ছুটিরও দাবী করছেন।
মুফতি মুহাম্মদ শফি দেওবন্দি ঈদে মিলাদুন্নবী খন্ডন করতে গিয়ে লিখেছেন, কোথাও জাতির শীর্ষ ব্যক্তির জন্ম-মৃত্যু কিংবা সিংহাসন আরোহন দিবস পালন করা হয়। কোথাও কোন রাষ্ট্র বা শহরের স্বাধীনতা দিবস কিংবা ঐতিহাসিক ঘটনা দিবস পালন করা হয়। যার সারগর্ভ কথা হচ্ছে, এতে ব্যক্তি বিশেষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন বৈ আর কিছু নয়। ইসলাম ব্যক্তি পূজার পক্ষে নয়। ইসলাম অন্ধকার যুগের কুপ্রথাসমূহ এবং ব্যক্তি বিশেষের স্মরণ বাদ দিয়ে মৌলিক ও লক্ষ্যণীয় বিষয়াবলী স্মরণের মৌলিক নিয়ম-নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
38. মুআরেফুল কোরআন, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-৩৪, করাচি থেকে মুদ্রিত।
কিন্তু বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, দেওবন্দি ওলামারা শুধু সাহাবা দিবস পালন করছেন না বরং তারা তাদের আকাবির শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কিরাম যেমন- শায়খ আশরাফ আলী থানভী, শায়খ শাব্বির আহমদ ওসমানী প্রমূখ আলিমদেরও জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন করছেন এবং দেওবন্দ মাদ্রাসার শতবর্ষ পূর্তি উদযাপন করা হয়েছে। এখানকার নামকরা হাটহাজারী খারেজী মাদ্রাসার শতবর্ষ পূর্তি পালন করা হয়েছে। যা এক নব আবিষ্কার তথা বিদ‘আত। আমরা প্রথমে ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ)-এর জুলুসের ব্যাপারে দেওবন্দি শীর্ষ ওলামাদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে উদ্ধৃতিসহ আলোচনা করব। অতঃপর ‘সাহাবা দিবস’ এবং ‘শীর্ষ ওলামায়ে দেওবন্দ দিবস’ তাদের ওলামায়ে কিরামদের পালন করা সম্পর্কে আলোচনা করব।
জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র ‘রোজনামা-ই জেসারত’ পত্রিকায় লিখা হয়েছে যে, পাকিস্তান কওমী ইত্তেহাদের মহাব্যবস্থাপক মাওলানা মুফতি মাহমুদ বলেছেন, দেশে ইসলামী আইনের পাশাপাশি কওমী ইত্তেহাদ যে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করেছে, তার জন্য তারা অবিরাম ও ধারাবাহিক সংগ্রাম করেছে। তারা আজ নীলা গম্বুজ মসজিদে জোহরের নামাযের পর কওমী ইত্তেহাদের নেতৃত্বে ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ)-এর আজিমুশ্শান জুলুসে উপস্থিত অংশগ্রহণকারী সদস্যদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেন। সে সময় কওমী ইত্তেহাদের সহ-সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খাঁন, পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর মিয়া মুহাম্মদ তোফায়েল ওফাতী, অর্থমন্ত্রী ওসায়েল চৌধুরী, রহমত ইলাহী এবং মুসলিম লীগ ৬ গ্রুপের সেক্রেটারী মালিক মুহাম্মদ কাসিমও বক্তৃতা করেন। বক্তৃতা শেষে মুফতি মাহমুদ ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ নীলা গম্বুজ মসজিদে নামায আদায় করেন। এরপর ওই সকল নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে এক বিশাল জুলুস বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে মসজিদে শোহাদায় গিয়ে শেষ হয়। সেখানে জুলুসে অংশগ্রহণকারী সবাই মুফতি মাহমুদের ইমামতিতে মাগরিবের নামায আদায় করেন।
39. রোজনামা জাসারত, ১১ ফেব্রুয়ারী ১৯৭৯ ইং
জামায়াতে ইসলামী ও দেওবন্দি সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত ‘কওমী ইত্তেহাদ’-এর শাসনামলে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনকালে ‘রোজনামা জঙ্গ’ পত্রিকার একটি সংবাদ পর্যালোচনা করে দেখুন,
‘আজ জশনে ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) অত্যন্ত জাঁকঝমকপূর্ণভাবে পালিত হবে। অনুষ্ঠানের শুরুতে ২১ বার তোপ ধ্বনির মাধ্যমে গার্ড অব অনার বা রাজকীয় সংবর্ধনা প্রদান করা হবে। গভর্নরের সভাপতিত্বে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। গোটা শহর জুড়ে জুলুস বের করা হবে। তশতর পার্ক, আরামবাগ এবং আরো অন্যান্য এলাকায় সমাবেশ হবে।
40. রোজনামা জঙ্গ, ৯ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৯ইং, করাচি।
‘রোজনামা হুর্রিয়্যাহ’ পত্রিকার আরো একটি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখুন, ইসলামী কানুনসমূহের ভাল-মন্দ নিরীক্ষা করার পর কওমী ইত্তিহাদের আন্দোলন প্রতিষ্ঠার মহান উদ্দেশ্য সফল হবে। মুফতি মাহমুদ বলেন, সমাজে পুরোপুরিভাবে ইসলামী কালচার ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হবে। মুফতি মাহমুদের নেতৃত্বে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন উপলক্ষে এক আজিমুশ্শান জুলুস বের হবে।
41. রোজনামা হুর্বিয়্যত, ১লা ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৯ইং
রোজনামা মশরিক-এর একটি সংবাদ পর্যালোচনা করে দেখুন (লাহোর ৯ই ফেব্রুয়ারী পি পি আই) ‘কওমী ইত্তেহাদের সভাপতি মওলানা মুফতি মাহমুদ এবং সহ-সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান আগামীকাল ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ)-এর জুলুসে নেতৃত্ব দিবেন। উক্ত জুলুস নীলা গম্বুজ থেকে বের হয়ে শুহাদা মসজিদে গিয়ে শেষ হবে।’
42. রোজনামায়ে হুর্রিয়্যাত, ১লা ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৯ইং
জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মওলানা মুহাম্মদ আজমল খান ‘খোলাফা-ই রাশেদীন দিবস’কে সরকারীভাবে উদযাপন করার দাবী জানান।
43. রোজনামা জঙ্গ, ২০ জুন, ১৯৯২ইং, লাহোর।
সিপাহ-ই সাহাবা-এর মহাপরিচালক জিয়াউর রহমান ফারূকী ঘোষণা করেন যে, মুহররম মাসের প্রথম তারিখ ফারূকে আযম হযরত ওমর (رضى الله تعالي عنه)-এর শাহাদত দিবস পালন করা হবে এবং জুলুস বের করা হবে।
44. নাওয়ায়ে ওয়াক্ত, ১৭ জুন, ১৯৯৪ ইং, লাহোর।
সিপাহ-ই সাহাবা পার্টির কেন্দ্রীয় সভাপতি শেখ হাকিম আলী ১লা মুহররমুল হারামকে হযরত ফারূকে আযম ওমর (رضى الله تعالي عنه)-এর শাহাদত দিবস উপলক্ষে সরকারী ছুটি ঘোষণার দাবী জানিয়ে বলেন, আজ ঈদের দিন।
45. নওয়ায়ে ওয়াক্ত, ২৩ ফেব্রুয়ারী-১৯৯৫ ইং, লাহোর
সিপাহ-ই সাহাবা’র তত্ত্বাবধানে গত ২২শে ফেব্রুয়ারী গোপুর রাজ্যে মওলানা হক্ব নাওয়ায জিঙ্গয়ী শহীদ-এর শাহাদত দিবস অত্যন্ত ভাবগাম্ভির্য ও মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হয়। সিপাহ-ই সাহাবা জঙ্গ-এর তত্ত্বাবধানে হক্ব নাওয়ায শহীদ মহল্লার ইহ্তিরার পার্কে এক ঐতিহাসিক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়।
কনফারেন্সে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সিপাহ-ই সাহাবার অন্যতম শীর্ষ তত্ত্বাবধায়ক মওলানা মুহাম্মদ আযম তারেক এম এন আই বলেন, ২২ ফেব্রুয়ারী হযরত জঙ্গুয়ী শহীদের শাহাদত দিবস এবং ২১ রমযানুল মুবারক শের-ই খোদা হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)-এর শাহাদত দিবস।
46. নওয়ায়ে ওয়াক্ত ২১ ফেব্রুয়ারী ১৯৯২ইং, লাহোর
সিপাহ-ই সাহাবা’র প্রতিষ্ঠাতা মওলানা হক্ব নওয়ায জঙ্গুয়ীর দ্বিতীয় বার্ষিকীতে ২৩ ফেব্রুয়ারীকে পাকিস্তানসহ অন্যান্য রাষ্ট্রে মওলানা জঙ্গুয়ী স্মরণে সিপাহ-ই সাহাবা সভা, সেমিনারসহ অন্যান্য অনুষ্ঠান পালন করবে এবং তাদের সকল কেন্দ্র ও অফিসগুলোতে সকাল ৯টায় ইসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে কোরআন খতম হবে। জঙ্গ-এ মওলানা জঙ্গুয়ীর মসজিদে খতমে কোরআনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান আরম্ভ হবে এবং পরে আজিমুশ্শান মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এতে শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখবেন।
47.[নওয়ায়ে ওয়াক্ত ২১ ফেব্রুয়ারী ১৯৯২ইং, লাহোর]
হযরত ফারূকে আযম (رضى الله تعالي عنه)-এর শাহাদত দিবসে সরকারী বন্ধ ঘোষণা না করার বিরুদ্ধে সিপাহ-ই সাহাবা’র বিক্ষোভ প্রদর্শন।
করাচিতে মুহাম্মদ আহমদ মাদানী বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, ‘খোলাফা-ই রাশেদীন-এর শাহাদত দিবস সরকারী ব্যবস্থাপনায় পালন না করার বিষয় বোধগম্য নয়’। সিপাহ-ই সাহাবা’র তত্ত্বাবধানে হযরত ফারূকে আযম (رضى الله تعالي عنه)-এর শাহাদত দিবস অত্যন্ত জাঁকজমক ও মর্যাদাপূর্ণভাবে পালিত হয়। এ ধারাবাহিকতায় জামিয়া সিদ্দীকে আকবর নাগন সুরঙ্গীতে সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে বিভাগীয় প্রধান আল্লামা মুহাম্মদ ওয়াইসী হযরত ওমর ফারূক (رضى الله تعالي عنه) এর সার্বিক অবদান ও কর্মকান্ড সম্পর্কে আলোচনা করেন এবং ফারূকে আযম (رضى الله تعالي عنه)-এর শাহাদত দিবস উপলক্ষে সরকারী ছুটি ঘোষণা না করার বিরুদ্ধে সিপাহ-ই সাহাবার নেতৃত্বে যুক্তি ও প্রমাণ সাপেক্ষে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।
বিক্ষোভকারী নেতৃবৃন্দ একথার ওপর অঙ্গীকার করেছিলেন যে, খোলাফা-ই রাশেদীন দিবস সরকারী তত্ত্বাবধানে পালন করা, ওই দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা এবং সাহাবাই- রাসূল-এর শানের বিরুদ্ধে অপমান সূচক বক্তব্যের প্রতিরোধ করা, নেতৃবৃন্দের নৈতিক চরিত্র এবং শ্রমিকদের দাবী-দাওয়া সম্বলিত বিশদ আলোচনা এর অন্তভুর্ক্ত ছিল। আঞ্চলিক পরিষদের সেক্রেটারী জেনারেল মওলানা মুহাম্মদ আহমদ মাদানী বিক্ষোভকারীদের সম্বোধন করে বলেন, দেশে জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতিবিদ ও নেতৃবৃন্দের দিবস পালন করা হয়। কিন্তু মুসলিম রাষ্ট্রে খোলাফা-ই রাশেদীন দিবস পালন না করা এবং উক্ত দিন ছুটি ঘোষণা না করার কারণ বোধগম্য নয়।
এ সুবাদে একটি প্রস্তাবের মাধ্যমে মওলানা আলী শের-ই হায়দারী, মওলানা আজম তারেক, হাফিয আহমদ বক্স, এডভোকেট মওলানা আবদুল গফুর নদীম এবং আরো অন্যান্যদের মুক্তির দাবী করা হয়। এমতাবস্থায় সিপাহ-ই সাহাবা স্টুডেন্ট করাচি বিভাগের জেনারেল সেক্রেটারী হাফিয সুফিয়ান আইয়্যাসি, সফিকুর রহমান, আবু আম্মার, জি.আই কাদের এবং এম.আই কাশ্মিরী প্রমুখ বিক্ষোভকারী ছাত্রদেরকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও বিক্ষোভ করার জন্য শুকরিয়া জ্ঞাপন করেন।
48.রোজনামা জঙ্গ, ১৫ মে- ১৯৯৭ইং, করাচি।
হাকীমুল উম্মতের আশরাফি দিবস:
হাকীমুল উম্মত মওলানা আশরাফ আলী থানভীর স্মরণীয় দশ কর্মদিবস তাঁর কর্ম দক্ষতার স্বীকৃতি স্বরূপ পালন করা হবে। ‘সুন্নী মজলিসে আমল পাকিস্তান’-এর নেতা মওলানা মুফতি মুহাম্মদ নঈম বলেছেন, মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর শিক্ষা বিষয়ক কিতাব রচনায় এবং সংস্কারমূলক কর্মকান্ড আমাদের জন্য পথনির্দেশক। যা কোন আশেকে রাসূল, পাকিস্তান প্রেমিক তথা আমাদের দেশ (বাংলাদেশ) প্রেমিক কখনো ভুলতে পারবে না। তিনি সমবেত জন সাধারণকে লক্ষ্য করে আরো বলেন, বুযূর্গানে দ্বীনের সাথে আমাদের সম্পর্ক দ্বিপ্রহরের সূর্যের চেয়েও উজ্জ্বল। উক্ত সমাবেশে ‘সুন্নী মজলিসে আমল পাকিস্তান’-এর তত্ত্বাবধানে ‘হাকিমুল উম্মতের দশ কর্মদিবস’ পালনের ঘোষণা করতে গিয়ে মুফতি মুহাম্মদ নাঈম বলেন, করাচির প্রতিটি জেলায় মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর স্মরণে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
49. রোজনামা জঙ্গ করাচি, ৩০ জুন-১৯৯৭ইং।
‘সুন্নী মজলিসে আমল পাকিস্তান’ করাচির নেতা মুফতি মওলানা মুহাম্মদ নাঈম জামে মসজিদ সিদ্দীক আওরঙ্গী টাউনে হাকিমুল উম্মতের দশ কর্মদিবস উপলক্ষে আয়োজিত মাহফিলে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, আমাদের উচিৎ হাকিমুল উম্মত মওলানা আশরাফ আলী থানভী রচিত কিতাবসমূহ পাঠ করে নিজেদের জীবনের পরিবর্তন সাধিত করা। তিনি আরো বলেন, আমাদের মাযহাবে কারো ব্যাপারে যাচাই-বাছাই ও প্রকৃত প্রমাণ ছাড়া কোন কথা বলার অনুমতি দেয়নি। তাই মিথ্যা, বানোয়াট ধোঁকা ও গীবত থেকে বেঁচে থাকা একান্ত প্রয়োজন। সমাবেশে মওলানা গোলাম রাসূল, মওলানা আনছুর মাহমুদ ও মাওলানা মুহাম্মদ সিদ্দীকও বক্তব্য রাখেন।
50. রোজনামা জঙ্গ, ৪ জুলাই-১৯৯৭ ইং, করাচি।
তিবয়ানুল কোরআনের গ্রন্থকার মুহাদ্দিসে যমান মুহাক্কিকে দওরান আল্লামা গোলাম রাসূল সাঈদী (رحمه الله تعالي ) বলেছেন, আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন যে- ‘যদি কেউ অধিক ক্ষুধার তাড়নায় বাধ্য হয়ে কোন হারাম বস্তু ভক্ষণ করে। পক্ষান্তরে সে উক্ত খাবারের প্রতি আগ্রহী নয়। নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা ক্ষমাশীল ও মেহেরবান।’
51. সূরা মায়েদা, তিব্য়ানুল কোরআন, আল্লামা গোলাম রাসূল সাঈদী (رحمة الله), খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-৭২।
উপরোক্ত আয়াতের অর্থ ও শানে নুযূল: উক্ত আয়াতের মর্মার্থ হচ্ছে, হে আল্লাহর মহান রাসূল! সাহাবা-ই কিরামরা আপনাকে প্রশ্ন করছে যে, তাদের জন্য কোন শ্রেণির প্রাণী হালাল ? তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, হে হাবীব! আপনি বলে দিন, সে সকল প্রাণী আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাদের জন্য হালাল করেছেন, তা তোমরা জবাই করে খেতে পারবে এবং তোমাদের শিকারী জন্তুগুলো শিকার করে, যে সকল জন্তু আহত অবস্থায় তোমাদের জন্য নিয়ে আসে, তাও তোমরা খেতে পারবে।
উক্ত আয়াতে এটাও ইরশাদ হয়েছে, তোমাদের জন্য সকল প্রকারের পবিত্র খাদ্য হালাল করা হয়েছে। তাইয়্যেবাত বা পবিত্র বলতে বুঝায় যে, যাকে সুষ্ঠু স্বভাবসম্পন্ন ব্যক্তি ঘৃণা করে না এবং ঘৃণিত ও হিংস্র না হবে। এটা ইমাম বলখী (رحمه الله تعالي ) এর উক্তিও।
অন্য একটি বর্ণনা মতে, ওই সকল বস্তু যার সম্পর্কে হারামের কোন দলীল অবতীর্ণ হয়নি এবং ইজমা ও কিয়াসের মাধ্যমেও যা হারাম প্রমাণিত হয়নি। প্রথমোক্ত উক্তি বর্ণনার উদ্দেশ্য হচ্ছে, সুস্বাদু বস্তু এবং দ্বিতীয় উক্তির মর্মার্থ হচ্ছে, হালাল বস্তুসমূহ। এমনও বলা হয়েছে যে, এর দ্বারা হালাল এবং সুস্বাদু বস্তু উদ্দেশ্য।
মওলুদ শরীফ তথা হুযূর (ﷺ) এর জন্মোৎসব কী বিদআত? কোরআন-হাদীসে এর কোন প্রমাণ আছে কী? মানবজাতির গৌরব বিশ্ব জগতের সরদার সরওয়ারে ‘আলম হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)-এর বেলাদত শরীফের যিকির ইহকাল ও পরকালের মঙ্গল ও কল্যাণের অন্যতম উসিলা।
52. রেসালা হাফত্ মাসআলা, হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (رحمة الله)।
কেননা হুযূর আক্বদাস (ﷺ) হচ্ছেন, আল্লাহর নিয়ামত। কোরআনে কারীম(ﷺ) তাঁর নাম নিয়ামতুল্লাহ (نعمة الله) আখ্যায়িত করেছে। মহান আল্লাহর বাণী, اِنَّ الَّذِينَ بَدَّلُوا نِعْمَتَ اللهِ كُفْرًا আয়াতের তাফসীরে হযরত সৈয়্যদুনা আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) বলেন, নিয়ামাতুল্লাহ (نعمة الله) হলেন- মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) । সুতরাং তাঁর শুভাগমনের আলোচনা করা পক্ষান্তরে আল্লাহ তা‘আলার আদেশ পালন এবং তাঁর হুকুম মান্য করা। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ
‘আপনার পালনকর্তার নিয়ামতের খুব বেশি চর্চা করো।
53. সূরা আদ-দোহা, আয়াত-১১।
হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম (ﷺ) হচ্ছেন সকল নিয়ামতের মধ্যে সর্বোত্তম নিয়ামত। তাঁর শুভাগমনের বদৌলতে দুনিয়া, আখিরাত, কবর, হাশর, বরযখ, এমনকি প্রতিটি সময়, কাল ও মুহূর্ত প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নিয়ামত এবং আমাদের শরীরের সূক্ষ্ম পশম ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উপকৃত হচ্ছে এবং হবে।
আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে তাঁর নিয়ামতরাজির চর্চা ও আলোচনা মিলাদুন্নবী (ﷺ)-এর অনুষ্ঠানেই হয়ে থাকে। মিলাদ-মাহফিল মূলতঃ এমন একটি বিষয়, যেটি পালনের হুকুম স্বয়ং রাব্বুল আলামীন দিয়েছেন- وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ এবং হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে। অতএব প্রখ্যাত ইমাম, অত্যন্ত খ্যাতিসম্পন্ন ধর্মনিষ্ঠ ফকীহ মুহাদ্দিস আবুল লাইস নসর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম সমরকন্দি হানাফী (رحمه الله تعالي ) ‘তান্ভীহুল গাফিলীন’ গ্রন্থের ২৬৩ পৃষ্ঠায় বলেছেন, যখন সূরা নসর হুযূর আক্বদাস-এর বিছাল শরীফ তথা ইন্তিকালের রোগে আক্রান্তের সময় অবতীর্ণ হয়। হুযূর তাড়াতাড়ি বের হয়ে এসে মিম্বর শরীফে তাশরীফ রাখলেন। বার ছিল বৃহস্পতিবার। তিনি হযরত বেলাল (رضى الله تعالي عنه)কে হুকুম দিলেন যে, মদিনা মুনাওয়ারায় ঘোষণা করে দাও যে, লোকেরা! রাসূল (ﷺ)-এর শেষ অসিয়ত শুনার জন্য চলে এসো। উক্ত আওয়াজ ধ্বনি শুনা মাত্র ছোট-বড় আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলই ঘরের দরজা এমনিতেই খোলা রেখে ছুটে আসলো। এমনকি কুমারী মহিলারাও বেরিয়ে আসলো। মসজিদে নববী শরীফ অধিক লোকের সমাগমে তিল পরার জায়গাও ছিল না। তাই হুযূর (ﷺ) একথা বলতে লাগলেন, তোমরা পেছনে আগতদের জন্য জায়গা উন্মুক্ত করে দাও, পেছনে আগতদের জন্য জায়গা উন্মুক্ত করে দাও। অতঃপর হুযূর (ﷺ) পবিত্র মিম্বর শরীফে দাঁড়িয়ে আল্লাহ্ তা‘আলার হামদ ও ছানা আদায় করেন এবং হযরাত আম্বিয়া-ই কিরামের ওপর দরূদ শরীফ পাঠ করেন। অতঃপর ইরশাদ করেন, আমি মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম আরবী এবং মর্যাদাবান হেরম ও মক্কা শরীফের অভিভাবক হই। আমার পর আর কোন নবী আসবেন না।
এমন একদিন ছিল যে, মদিনা তাইয়্যেবায় হুযূর মোস্তফা (ﷺ) -এর শুভাগমনের আনন্দ-উৎসবের ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে আসমান জমিন মুখরিত হয়ে উঠেছিল মদিনার ছোট ছোট শিশুরা পর্যন্ত আল্লাহ’র প্রিয় মাহবুবের সাক্ষাৎ ও দর্শন লাভের অধীর আগ্রহ নিয়ে গান করতে করতে বেরিয়ে এসেছিল যেমন কবির ভাষায়,
طلع البدر علينَا * من ثنيات الوداع
وجب الشكر علينَا * ما دعىٰ للهِ داع
‘সানইয়াতুল বিদা’ হতে আমাদের ওপর পূর্ণিমার চাঁদ উদিত হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত প্রার্থনাকারী প্রার্থনা করতে থাকবে আমাদের ওপর ওয়াজিব তাঁর প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করা।’
নাজ্জার গোত্রের কঁচি মেয়ে শিশুরা মদিনার অলি-গলি দিয়ে সুরেলা মধুর কন্ঠে গান পরিবেশন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
نحن جوار من بنى النجار * يا حبذا محمد من جار
‘আমরা বনু নাজ্জার গোত্রের প্রতিবেশীরা কতই না ভাগ্যবান, মুহাম্মদ হলেন আমাদের প্রতিবেশী।’
আজকের দিন মাহবুবে খোদা (ﷺ)এর বিদায়ের দিন এবং শেষ অসিয়তের মজলিস। আজকের জমায়েতেও ওই সব নারী-পুরুষ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা এবং পর্দার আড়ালের মহিলারা সকলই একত্রিত হয়ে ভীড় জমায়েছেন।
মুসলমানগণ! খোদা জানে মজলিসে মিলাদ কী? মূলতঃ এটা হচ্ছে সাধারণ দাওয়াত, পরিপূর্ণ জমায়েত এবং মিম্বর ও ক্বিয়াম। আর ওটাই সৈয়্যদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)-এর মিলাদ মাহফিলের ফযিলত ও মর্যাদার বর্ণনা বৈ আর কিছু নয়। কিন্তু নজদি ওহাবীদের কাজ হচ্ছে মাহবুবে খোদার যিকির মিটিয়ে দেয়া।
54. ইফাদাতে ওলামা।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের পবিত্র মিলাদ মাহফিলের হাক্বিক্বত হচ্ছে, সমস্ত মুসলমানদেরকে হুযূর আক্বদাস (ﷺ)-এর শুভাগমনের মর্যাদাপূর্ণ ফযিলত এবং সর্বোত্তম চরিত্রের আলোচনা করার নামই মিলাদ মাহফিল। মিলাদ শরীফ হচ্ছে, যিকিরে রিসালত । যা সলফে সালেহীনের যুগ থেকে এক সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে এখনো পর্যন্ত প্রচলিত এবং এটা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নিদর্শন। সারকথা হচ্ছে, আল্লাহর যিকির এবং হুযূর আকরাম মুহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ)কে স্মরণ করাই মিলাদ মাহফিল।
শিফা শরীফে হযরত ইবনে ‘আতা (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত আছে যে,
جعلتك ذكرًا من ذكرى فمن ذكرك ذكرنى .
‘সকল আন্বিয়া (عليه السلام) এবং আউলিয়া-ই কিরামের যিকির প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই যিকির।’ মুসলমানেরা! তোমাদের আর কিসের প্রয়োজন। فاستبقوا الخيرات ‘কল্যাণের প্রতি অগ্রসর হও এবং নিজের খালি থলে ভর্তি করে নাও।’ যেহেতু হুযূর পাক সাহেবে লাওলাক (ﷺ)-এর পবিত্র বেলাদত বা জন্ম হচ্ছে, সমস্ত নিয়ামতের উৎস। তাই এর বিশদ বর্ণনা এবং প্রকাশ করার অকাট্য দলীল কোরআন মজীদের মাধ্যমে আমাদেরকে হুকুম দেয়া হয়েছে। অতএব মিলাদ মাহফিল কোরআনে কারীম দ্বারা প্রমাণিত।
55. মুফতি আল্লামা মুহাম্মদ খললি (رحمة الله)-এর ‘ইফাদাত’ গ্রন্থ থেকে চয়িত।
প্রত্যেক নব আবিষ্কৃত বস্তুকে বিদআতে সায়্যিয়াহ বা মন্দ বিদআত-এর অন্তভুর্ক্ত মনে করে ওটাকে গোমরা ও পথভ্রষ্টদের মধ্যে শামিল করা, এটা সাধারণ মুসলমানদের ওপর বিরাট যুলুম। কোন বস্তুকে বিদআতে সায়্যিয়াহ বলার জন্য, তাকে দু’টি বিষয়ের একটি দ্বারা প্রমাণ করা অপরিহার্য।
১. উক্ত বস্তু সত্তাগতভাবে খারাপ,
২. অথবা শরীয়ত একে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
শরীয়ত যাকে নিষিদ্ধ করেনি এবং উক্ত বস্তু স্বয়ং মন্দও নয় বরং কোরআন মজিদের হুকুম এবং রাসূলে কারীম (ﷺ) -এর নির্দেশ মোতাবিক জায়েয ও বৈধ। ইমাম দারে কুতনী হযরত আবু ছা‘লাবা হাসানী (رضى الله تعالي عنه) হতে রেওয়ায়েত করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ইরশাদ করেন,
انّ الله فرض فرائض فلا تضيعوها وحرم حرمات فلا تنهكوها وحدّ حدودًا فلاتعيدوها وسكت عن اشياء من غير نسيان فلا تبحثوا عنها
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা কতিপয় বিষয় ফরয করেছেন, এগুলো তোমরা কখনো ছাড়বে না। আর কতিপয় বিষয়কে হারাম করেছেন, তোমরা সেগুলোতে দুঃসাহস দেখাইও না। আর কিছু সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তোমরা উক্ত সীমা লংঘন করো না। আর কতিপয় বিষয় সম্পর্কে স্বেচ্ছায় কোন হুকুম উল্লেখ করেন নি, তোমরা সেগুলোর সন্ধান করো না। অর্থাৎ- এগুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। হতে পারে তোমাদের অনুসন্ধানের কারণে এগুলো হারাম করে দিতে পারে।
জামে তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ শরীফে হযরত সালমান ফার্সী (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ্ তা‘আলা যে সব বিষয় সম্পর্কে স্বীয় কিতাবে হালাল ঘোষণা করেছেন, তা হালাল এবং যেগুলো সম্পর্কে হারাম ঘোষণা দিয়েছেন, সেগুলো হারাম। আর যেগুলো সম্পর্কে কিছুই বলেননি, তা মাফকৃত।
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন,
مَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
‘রাসূলে পাক (ﷺ) তোমাদেরকে যা কিছু দিয়েছেন তা গ্রহণ করো এবং যা কিছু সম্পর্কে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকো।’
এখানে انتهوا আমর বা নির্দেশ সূচক শব্দ ব্যবহার করেছেন, যা (আমর) ওয়াজিবের জন্য আসে। অতএব প্রথম প্রকার হচ্ছে শরয়ী ওয়াজিবাত-যা অবশ্যই করণীয়। আর দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে নাহী শরয়ী নিষিদ্ধতা- যা দ্বারা বিরত থাকা আবশ্যক প্রমাণিত হয়।
অতএব বুঝা গেল, যে সকল বিষয় সম্পর্কে শরীয়তের পক্ষ থেকে কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি এবং নিষেধও করা হয়নি, তা ওয়াজিবও নয় এবং গোনাহও নয়। অর্থাৎ এগুলো করা ওয়াজিব নয় এবং না করাতে গুনাহও হবে না। বর্তমানে কোরআনে কারীম(ﷺ)র প্রতিক্রিয়ায় দ্বীন পূর্ণতা লাভ করেছে, এখন নতুন কোন হুকুম আসার অবকাশ নেই। অতএব যে সকল বিষয়ে শরীয়ত কোন হুকুম করেনি এবং নিষেধও করেনি তা মাফ ও নাজাতপ্রাপ্ত হিসেবে প্রমাণিত হল। যাতে এখন পরিবর্তনের কোন অবকাশ নেই।
নজদি ওহাবীরা আল্লাহ্ তা‘আলার ক্ষমাকৃত বিষয়ে অভিযোগ করছে, যা গ্রহণযোগ্য নয় বিধায় তা অগ্রাহ্য ও প্রত্যাখ্যাত। এ পর্যন্ত জায়েয না-জায়েয সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বাকী রইলো মুস্তাহাব হওয়া সম্পর্কে আলোচনা।
মিলাদুন্নবী (ﷺ) এমন কাজ যা সত্তাগতভাবে ভাল এবং মু’মিন মুসলমানগণ যাকে পূণ্য ও প্রশংসনীয় মনে করে সম্পাদন করে আসছেন, তা রাসূলে পাক (ﷺ)-এর ইরশাদ মোতাবিক সুন্নাতের মধ্যে পরিগণিত হয়। যদিও উক্ত কাজ ইতিপূর্বে এভাবে কেউ না করে। সুবহানাল্লাহ্!
প্রত্যেক বিদআত, বিদআতে সাইয়্যিয়া নয়। প্রত্যেক নব আবিষ্কৃত বস্তু খারাপ ও মন্দ নয়। অবশ্য যদি দ্বীনের পরিপন্থী নতুন কোন কাজ আবিষ্কার করা হয়, তা বিদআতে সাইয়্যিয়া হিসেবে গণ্য হবে। যেমন- নামাযের জামাতে ইকামত বলার সময় দাঁড়িয়ে থাকা এবং জামাতের পর ঠিক ওই জায়গায় যেখানে ফরয আদায় করেছে, স্থান পরিবর্তন না করে সেখানে সুন্নাত ইত্যাদি নামায আদায় করা। এসব নব আবিষ্কৃত যা সুন্নাত ও শরীয়তে অনুপ্রবেশ করেছে, তাই এটা বিদআতে সাইয়্যিয়াহ। যা পালন করা নিষিদ্ধ ও না-জায়েয।
হাদীসসমূহ পাঠ করলে একথা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বিদআতে সাইয়্যিয়া হচ্ছে যা সুন্নাতের পরিপন্থী এবং যে প্রথা চালু করার দরুণ সুন্নাত বিলুপ্ত হয়ে যায়।
সাইয়্যেদুনা আরিফ বিল্লাহ ইমাম আবদুল গণি নাবিলুসী হানাফী (رحمه الله تعالي ) ‘হাদিকাতুন নাদিয়্যাহ শরহে তরিকায়ে মুহাম্মদিয়া’ গ্রন্থে বলেছেন, যদিও বিদআত নতুন আবিষ্কৃত হয়, এর সম্পাদনকারীকে সুন্নীই বলা হবে, কখনো বিদ‘আতী বলা যাবে না। কেননা রাসূলে পাক ভাল কাজের আবিষ্কারককে ‘সুন্নাত উদ্ভাবনকারী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেহেতু তারা প্রত্যেক পূণ্যের কাজ যদিও নতুন আবিষ্কৃত হয় এবং প্রত্যেক ভাল ও উত্তম বিদ‘আতকে সুন্নাতের অন্তভুর্ক্ত করেছেন। এই পবিত্র বাণীতে কিয়ামত পর্যন্ত নতুন নতুন পূণ্যময় কাজ আবিষ্ককারের অনুমোদন প্রমাণিত হলো। অতএব, সে সকল লোক এ জাতীয় নতুন কাজ আবিষ্কার করবেন তারা সওয়াব পাবেন। আর কিয়ামত পর্যন্ত যত লোক এর ওপর আমল করবে, সকলের সওয়াবের একটি অংশ সে পাবে। প্রত্যেক ভাল বিদআত সুন্নাতই।
ইমাম নববী (رحمه الله تعالي ) বলেছেন যে, যত লোক উক্ত আমল করবে, সবার সওয়াব সে পাবে। সে ব্যক্তি উক্ত কাজ আবিষ্কার করুক কিংবা তার দিকে সন্বোধন করা হোক। তা সওয়াবের কাজ হোক কিংবা অন্য কোন ভাল কাজ কিংবা অন্য কোন কিছু।
56. আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ খলিল কাদেরী’র ‘ইফাদাত’ গ্রন্থ থেকে।
❏ প্রশ্ন-১৮: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)
(فداه ابى وامى-যাঁর ওপর আমার পিতা-মাতা কোরবান হোক)-এর পবিত্র জীবনী সম্পর্কে প্রত্যেক মুসলমানের অবগত হওয়া অতীব জরুরী। তাই হুযূর মোস্তফা (ﷺ)
এর পবিত্র জীবনী ও বংশধারা নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলীর উদ্ধৃতিসহ বিশুদ্ধরূপে বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: اقول وبالله التوفيق وهو المستعان তবকাতে কোবরা, সিক্বাতে ইবনে হিব্বান, উসদুল গাবাহ্ এবং তারিখে তাবারিসহ অন্যান্য গ্রহণযোগ্য কিতাবসমূহের বরাত পর্যালোচনা পূর্বক বর্ণনা করা হলো:-
তাঁর পবিত্র বংশধারা:
সাইয়্যেদুনা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম ইবনে কা’ব ইবনে লুওয়াই ইবনে গালিব ইবনে ফিহার ইবনে মালিক ইবনে নাদর ইবনে কিনানাহ ইবনে খুযাইমাহ ইবনে মুদরিকাহ ইবনে ইলিয়াস ইবনে মুদার ইবনে নায্যার ইবনে মা‘আদ ইবনে আদনান ইবনে উদ্দ ইবনে উদাদ ইবনে মুকাওয়াম ইবনে নাহুর ইবনে ইয়ারজ ইবনে জর্ব ইবনে ইয়াসহব ইবনে সাবিত ইবনে ক্বাইযার ইবনে ইসমাইল ইবনে ইবরাহীম ইবনে আযর ইবনে নাখুর ইবনে শারুখ ইবনে বাক্কু ইবনে ফাতিহ ইবনে ‘আইবর ইবনে শালুখ ইবনে আরকহস ইবনে সাম ইবনে নূহ ইবনে লামিক ইবনে মুতাওয়াশ্শিলাহ ইবনে আখনুখ ইবনে ইদ্রিস ইবনে ইয়ারদ ইবনে মাহলাঈল ইবনে ক্বাইনান ইবনে ইয়ালুশ ইবনে শীশ ইবনে আদম আলাইহিমুস সালাম।
উক্ত বংশধারা আদনান পর্যন্ত ঐকমত্যের ভিত্তিতে সন্দোহীত সূত্রে বর্ণিত আছে। এরপর ক্বীদার থেকে হযরত ইবরাহীম পর্যন্ত মতানৈক্য সূত্রে বর্ণিত। এরপর কিছু মতৈক্য সূত্রে আবার কিছু মতানৈক্য সূত্রে বর্ণিত আছে। হযরত নূহ (عليه السلام) থেকে হযরত সৈয়্যদুনা আদম (عليه السلام) পর্যন্ত ঐকমত্যের সূত্রে বর্ণিত আছে। হুযূর রহমতে ‘আলম (ﷺ) নিজেকে আদনান পর্যন্ত সম্বন্ধযুক্ত করতেন।
❏ প্রশ্ন-১৯: হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম (ﷺ)-এর সম্মানিত মাতা-পিতার মধ্যকার বিশেষ বংশীয় সম্পর্ক কি ছিল? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: هوالمستعان হুযূর এর সম্মানিত মাতার নাম আমিনা বিনতে ওহাব বিন আবদু মুনাফা। যেমন তাঁর বংশানুক্রম তৃতীয় স্তর ও খান্দানে গিয়ে হুযূর (ﷺ)-এর বংশের সাথে মিলে যায়। তাঁর (رضى الله تعالي عنها) নানীর নাম মুবারক উম্মে হাবীবা বিনতে আসাদ।
❏ প্রশ্ন-২০: হুযূর তাঁর সম্মানিত পিতার ইন্তিকালের কতদিন পর এ ধরাধামে তাশরীফ আনেন?
✍ উত্তর: হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম (ﷺ) তাঁর পিতার ইন্তিকালের কতো দিন বা কতো মাস পর ইহজগতে তাশরীফ এনেছেন, এ বিষয়ে ওলামায়ে কিরামের মাঝে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে।
কতিপয় ওলামা বলেন, হুযূর (ﷺ) তাঁর পিতা ইন্তিকালের সময় মাতৃগর্ভে মাত্র দু’মাস বয়সের ছিলেন। কিছু ওলামা আরো কম-বেশি বলে থাকেন। আবার কারো মতে, তখন তিনি দেড় বছর বয়সী ছিলেন। কেউ বলেন, তখন তিনি একুশ মাস বয়সের ছিলেন। কারো মতে, ছয় বছর বয়সী ছিলেন। কিন্তু বিশুদ্ধতম অভিমত হচ্ছে, তিনি পবিত্র মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায়ই তাঁর সম্মানিত পিতা ইন্তিকাল করেন।
❏ প্রশ্ন-২১: হুযূর ইহ জগতে তাশরীফ আনয়নের মাস, দিন ও বছর কী ছিল? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: হুযূর ১২ রবিউল আউয়াল ৪২ কিসরওয়ায় এ পার্থিব জগতে তাশরীফ আনেন। হুযূর (ﷺ)-এর ইহজগতে শুভাগমন এবং হযরত আদম (عليه السلام) এর অবতরণের মাঝে ৬১১৩ বছরের ব্যবধান রয়েছে। যেদিন তাঁর পূণ্যময় বিলাদত শরীফ হয় সেদিন পৃথিবীতে আনন্দের শোর-গোল ও হৈ-হুলোর পড়ে যায়।
বর্ণিত আছে যে, ওইদিন পৃথিবীর সকল মূর্তি উপড়ে পড়ে গিয়েছিল এবং যত সব অগ্নিকুন্ড ছিল সব নিভে গিয়েছিল। পারস্য রাজ-প্রাসাদের ইট-পাথর-কংকর অবলিলায় এমনিতেই খসে পড়েছিল। হযরত শেখ সাদী (رحمه الله تعالي ) বলেন,
زلزله در ديوان كسرىٰ افتاد ‘
পারস্য সম্রাটের রাজ-প্রাসাদে কম্পন সৃষ্টি হয়।’
❏ প্রশ্ন-২২: হুযূর মোস্তফা (ﷺ) -এর মুরদি‘আ বা দুধপানকারীনী মাতাগণের বরকতময় নাম কি কি? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: হুযূর কে তাঁর সম্মানিত মাতাসহ আটজন সৌভাগ্যবান রমণী দুধপান করিয়েছেন
১. তাঁর মহিমান্বিত মাতা আমিনা বিনতে ওহাব (رضى الله تعالي عنها)।
২. আবু লাহাবের দাসী সুয়াইবা (رضى الله تعالي عنها)।
৩. খোয়াইলিদ বিনতুল মুন্যির।
৪. জনৈকা রমণী সা‘দিয়া হালিমা।
৫,৬,৭. তিনজন রমণী যাদের সবার নাম আতিকা।
৮. হালিমা সা‘দিয়া (رضى الله تعالي عنها)।
❏ প্রশ্ন-২৩: হুযূর (ﷺ) রেযায়ী বা দাইমাগণের তত্ত্বাবধানে কতো দিন ছিলেন?
✍ উত্তর: হুযূর (ﷺ)-এর সম্মানিত মাতা সাত দিন এবং সুয়াইবা আট দিন দুধপান করিয়েছেন। আর মধ্যবর্তী রমণীদের অবস্থা জানা নেই। যখন হযরত হালিমা সা‘দীয়া হুযূর (ﷺ) কে নিয়ে যান, তখন তিনি প্রায় একমাস বয়সের শিশু ছিলেন। যখন তাঁর বয়স দু’বছর হয় তখন হযরত হালিমা তাকে নিয়ে মক্কা শরীফ আসেন। হযরত আমিনা (رضى الله تعالي عنها)কে বলেন, আপনি যদি তাঁকে আরো কিছু দিন আমার কাছে রাখেন, এতে তাঁর শক্তি ও তেজস্বীতা আরো মজবুত হবে। অন্যদিকে আজকাল মক্কায় পেগ ও মহামারির প্রাদুর্ভাবও দেখা যাচ্ছে। তাই আমার কাছে আরো কিছু দিন থাকলে মক্কার এই মহামারী থেকেও নিরাপদ থাকার আশা করা যায়।
এখানে থাকলে মহামারি রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। তাই মা আমিনা (رضى الله تعالي عنها) তার এই অনুরোধ মঞ্জুর করলেন।
হযরত হালিমা সা‘দিয়া তাঁকে পুনরায় নিয়ে গেলেন। তাঁর বয়স যখন চার বছর হয় ফিরিশতারা তাঁর বক্ষ মুবারক বিদীর্ণ করেন এবং এতে নূর ও রহমত দ্বারা পরিপূর্ণ করে দেন। উক্ত ঘটনা হযরত হালিমার সন্তানেরা দেখে তাদের মায়ের নিকট গিয়ে বলেন, তা শুনে তিনি ভীত হয়ে পড়েন এবং তাঁকে তাঁর মায়ের নিকট পৌঁছে দেন। তিনি চার বছরের কিছু কম সময় হযরত হালিমার তত্ত্বাবধানে ছিলেন।
❏ প্রশ্ন-২৪: হুযূর (ﷺ)-এর শৈশবকাল কীভাবে অতিবাহিত হয়?
✍ উত্তর: হুযূর (ﷺ)-এর শৈশবকাল খুবই ব্যাপক ও বিস্তৃত। সংক্ষেপে হচ্ছে, তিনি শিশুকালে অত্যন্ত খোদাভীরু, দয়ালু, বীর-বাহাদুর, গম্ভীর, সত্যবাদী, লজ্জাশীল, বিশ্বস্ত, আমানতদার এবং সকল প্রশংসনীয় গুণের অধিকারী ছিলেন। সকল ধরনের অন্যায়, অবিচার, অপরাধ ও নিন্দনীয় কর্মকে ঘৃণা করতেন। তিনি কখনো বিবস্ত্র হননি। এক সময়ের ঘটনা কুরাইশ গোত্রের লোকেরা কা’বা শরীফ পুনঃনির্মাণ করছিল, এতে তিনিও পাথর কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। যদ্দরুন তাঁর কাঁধ মুবারকে পাথরের ঘষা লেগে কাঁধের চামড়া উঠে যাচ্ছিল, তা দেখে তাঁর চাচা হযরত আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) কাঁধের ওপর পরনের লুঙ্গি রাখার জন্য বললে তিনি রাজি হননি। তিনি জোর করে তাঁর কাঁধের ওপর লুঙ্গি রাখলে তিনি নগ্ন হয়ে যান। বিবস্ত্র হয়ে যাওয়ার কারণে তিনি তৎক্ষণাৎ বেহুশ হয়ে পড়েন।
57. মাহবুবে আলম রচিত ‘ইসলামী মা’লুমাত’ গ্রন্থ থেকে চয়নকৃত।
❏ প্রশ্ন-২৫: হুযূর (ﷺ)-এর কফীল বা অভিভাবক কে কে ছিলেন এবং তাদের নিকট কতো দিন ছিলেন?
✍ উত্তর: হযরত হালিমা সা’দিয়া (رضى الله تعالي عنها)-এর নিকট চার বছর, তাঁর সম্মানিতা মাতা হযরত আমিনা (رضى الله تعالي عنها)-এর নিকট দু’বছর দু’মাস দশ দিন। অতঃপর হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)-এর সম্মানিত পিতা এবং হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম (ﷺ) এর চাচা খাজা আবু তালেবের তত্ত্বাবধানে ছিলেন।
❏ প্রশ্ন-২৬: হযরত সায়্যিদাতুনা খাদিজাতুল কুবরা (رضى الله تعالي عنها) সঙ্গে বিবাহ এবং তাঁর সিরিয়া সফর কখন হয়?
✍ উত্তর: হুযূর (ﷺ) তিনবার সিরিয়া সফর করেন। প্রথমবার তাঁর ১৩ বছর বয়সে চাচা আবু তালেব যখন সিরিয়া সফরের উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিলেন, তখন দু’জাহানের বাদশাহ হুযূর তার উটের লিগাম ধরে বলতে লাগলেন যে, আমাকে একা রেখে কেন চলে যাচ্ছেন? এখানে আমার মা-বাবা তো কেউ নেই। আবু তালেব দয়া পরবশ হয়ে তাঁকে সফরে সঙ্গে নিয়ে যান। পথিমধ্যে বুহাইরা নামক একজন পাদ্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়।
মোদ্দাকথা, হযরত খাদিজাতুল কুবরা (رضى الله تعالي عنها)-এর সাথে চার শত দিনার মোহর নির্ধারণ করে তাঁর বিবাহ সম্পন্ন হয়। তখন হুযূর-এর বয়স ২৫ বছর এবং খাদিজাতুল কুবরা (رضى الله تعالي عنها)-এর বয়স ৪০ বছর।
❏ প্রশ্ন-২৭: ওহি নাযিল কখন থেকে আরম্ভ হয়?
✍ উত্তর: যখন হুযূর (ﷺ)-এর পবিত্র বয়স ৪০ বছরে উপনীত হয় এবং রিসালতকাল নিকটবর্তী হয়। তখন তিনি যে গাছ-পালা ও পাথরের পার্শ্ব দিয়ে যেতেন, সেগুলো তাঁকে সম্বোধন করে বলতো, اَلسَّلَامُ عَلَيْكَ يَا رَسُوْلَ اللهِ (আস্-সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ) হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনাকে সালাম। তারা তাঁকে সিজদা করতো এবং তিনি যা যা স্বপ্ন দেখতেন তা বাস্তবে সত্য প্রমাণিত হত।
পরিশেষে তাঁর বয়স যখন ৪০ বছর সাত মাস হয়, তখন তিনি হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন ছিলেন। এমতাবস্থায় হযরত সৈয়্যদুনা জিবরাইল (عليه السلام) ওহী নিয়ে আসেন। সূরা ‘আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত,
اِقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ . خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ . اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ . الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ . عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ.
পর্যন্ত আয়াতগুলো পড়ান এবং সত্য রিসালত ও পরিপূর্ণ নবুওয়াত দ্বারা তাঁকে অনুকম্পা করা হয়। অধিকাংশ অস্বীকারকারী যখন তাঁকে দেখত তৎক্ষণাৎ নির্দ্বিধায় বলে উঠতো لَيْسَ هَذا وَجْهُ الْكَاذِبِيْنَ ‘এটা কোন মিথ্যাবাদীর চেহারা নয়।’ তাৎক্ষণিক মু‘জিযা তালাশ না করে তারা ঈমান নিয়ে আসতেন। পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضى الله تعالي عنه), মহিলাদের মধ্যে হযরত খাদিজাতুল কুবরা (رضى الله تعالي عنها) এবং বালকদের মধ্যে হযরত আলী শের-ই খোদা (رضى الله تعالي عنه) ঈমান গ্রহণ করেন।
তাঁদের পর হযরত ওসমান (رضى الله تعالي عنه), হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (رضى الله تعالي عنه), হযরত সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (رضى الله تعالي عنه), হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়াম (رضى الله تعالي عنه), হযরত তালহা ইবনে ওবাইদুল্লাহ (رضى الله تعالي عنه) এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضى الله تعالي عنه) ঈমান গ্রহণ করেন।
হুযূর সৈয়্যদুল আন্বিয়া (ﷺ) ইসলামের দাওয়াত অব্যাহত ভাবে অত্যন্ত গোপনে দিতে থাকেন। সুতরাং তিন বছরে ইসলাম গ্রহণকারীর সংখ্যা মাত্র ৩৯ জনে উপনীত হয়। অতঃপর হযরত ওমর (رضى الله تعالي عنه) ইসলাম গ্রহণ করেন, ফলে ইসলাম ধর্ম অনেক শক্তিশালী হয় এবং মুসলমানের সংখ্যাও চলিশে উপনীত হয়। কিন্তু কাফিররা মুসলমানদের ওপর অমানবিক নির্যাতন করতেই থাকে।
❏ প্রশ্ন-২৮: হুযূর মোস্তফা (ﷺ) -এর মি‘রাজ কখন সংঘটিত হয়?
✍ উত্তর: নবুওয়াতের একাদশ বৎসর ২৭শে রজব মি‘রাজ শরীফ সংঘটিত হয়। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنه) সর্বপ্রথম মি‘রাজ শরীফের ঘটনা সত্যায়ন করেন এবং ‘সিদ্দীক’ উপাধি লাভ করেন।
❏ প্রশ্ন-২৯: হুযূর মোস্তফা (ﷺ) -এর হিজরতের বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: যখন মক্কার কুরাইশ কাফিররা মুসলমানদের ওপর সীমাহীন ও অবর্ণনীয় নির্যাতন যুলুম করতে থাকে, তখন হুযূর আকরাম (ﷺ) সাহাবা-ই কিরামদেরকে হিজরত করার অনুমতি প্রদান করেন। অধিকাংশ মুসলমান আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। তাঁদের মধ্যে হুযূর (ﷺ)-এর চাচাতো ভাই হযরত সৈয়্যদুনা জাফর তাইয়্যার ইবনে আবি তালিব (رضى الله تعالي عنه), তাঁর জামাতা হযরত ওসমান ইবনে আফ্ফান (رضى الله تعالي عنه) এবং তাঁর শাহজাদী হযরত রুকাইয়া (رضى الله تعالي عنها)ও ছিলেন।
আর কাফিরদের অত্যাচার, নিপীড়ন ও জোরজুলুম যখন সীমাহীন আরো বেড়ে গেল। তখন তিনি সাহাবা-ই কিরামদেরকে মদিনা মুনাওয়ারা হিজরত করার অনুমতি প্রদান করেন। একে একে সবাই হিজরত করে সেই ইবরাহীমী সুন্নাতকে আলোকিত করেন।
শুধুমাত্র স্বয়ং হুযূর মোস্তফা (ﷺ) রহমতে ‘আলম , হযরত সৈয়্যদুনা আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنه) ও তাঁর পরিবারবর্গ এবং হযরত সৈয়্যদুনা আলী মরতুজা (رضى الله تعالي عنه) মক্কায় থেকে যান। একদা অভিশপ্ত আবু জাহল হুযূর কে হত্যা করার পরামর্শ করল। (নাউযুবিল্লাহ) হুযূর (ﷺ) যখন এই সংবাদ পেলেন, তখন তাড়াতাড়ি হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنه)-এর নিকট গিয়ে তাকে বলেন, আবু জাহল আমাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে আমি আজ রাতই হিজরত করার ইচ্ছে পোষণ করছি, তুমিও আমার সঙ্গে চলো। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنه) আরয করলেন, আমি এ উদ্দেশ্যে দু’টি উট আগে থেকেই ক্রয় করে রেখেছি। হুযূর (ﷺ) একটি উটের মূল্য সিদ্দীকে আকবরকে দিলেন, যদিও তিনি তা গ্রহণে অনেক ওযর-আপত্তি করেছেন। তিনদিন পর্যন্ত তারা ছাওর গুহার আত্মগোপনে অবস্থান করেন। অতঃপর সেখানে থেকে মদিনা শরীফের দিকে রওয়ানা হন।
❏ প্রশ্ন-৩০: হুযূর মোস্তফা (ﷺ) পবিত্র মক্কায় কতোদিন অবস্থান করেন এবং কখন মদিনায় হিজরত করেন?
✍ উত্তর: হুযূর (ﷺ) যখন হিজরত করেন সে সময় তাঁর পবিত্র বয়স ৫৩ বছর এবং তাঁর নবুওয়াত প্রকাশের ১৩তম বছর। তিনি রবিউল আউয়াল শরীফের ১২ কিংবা ১৩ তারিখ রবি অথবা সোমবার মদিনা শরীফে প্রবেশ করেন। অন্য একটি বর্ণনা মতে, তিনি ১৬ রবিউল আউয়াল শরীফ নবুওয়াতের ১৩তম বছর মোতাবেক ২ জুলাই ৬২২ খ্রীষ্টাব্দে হিজরত করেন।
❏ প্রশ্ন-৩১: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: হুযূর (ﷺ)-এর চরিত্র এত উঁচু পর্যায়ের ছিল যে, এ প্রসঙ্গে হযরত আনাস (رضى الله تعالي عنه) বলেন, আমি দশ বছর হুযূর (ﷺ)-এর খিদমতে ছিলাম, ভুলবশতঃ আমার কোন কথা বা কাজে অসন্তুষ্ট হলেও তিনি কখনো আমাকে একথা বলেননি যে, তুমি এ কাজটি ভুল করেছ এবং কেন করেছ? আমরা যখন কোন ভাল কাজ করতাম, তিনি দু‘আ করতেন। আমাদের কোন কাজে যখন অসন্তুষ্ট হতেন, তখন বলতেন,
كَانَ اَمْرُ اللهِ قَدْرًا مَقْدُوْرًا
হুযূর (ﷺ) ঘরের কাজ সবার সাথে মিলেমিশে করতেন। মূর্খতাবশতঃ কেউ তাঁকে কোন কাজের জন্য বললে, তিনি নিষেধ করতেন না। সফরের সময় বাহন যেটা পেতেন সেটাতে সন্তুষ্ট থাকতেন। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضى الله تعالي عنها)কে তাঁর স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে কেউ জিজ্ঞেস করলে তিনি (رضى الله تعالي عنها) উত্তরে বলেন, كَانَ خُلُقُهُ اَلْقُرْآن ‘তাঁর পুরো চরিত্রই ছিল কোরআনে কারীম(ﷺ) ’। অর্থাৎ- পবিত্র কোরআনে যে সকল প্রশংসনীয় স্বভাব-চরিত্রের কথা উল্লেখ আছে, সে সকল চরিত্রে তিনি ছিলেন চরিত্রবান ও প্রশংসিত। কোরআন মজিদই তাঁর প্রকৃত স্বভাব ও মহানূভবতার দলিল।
মদীনার দাস-দাসীরা তাদের অকৃত্রিম ই‘তিকাদ ও ভক্তি বিশ্বাস নিয়ে বরকত হাসিলের উদ্দেশ্যে হুযূর (ﷺ)-এর নিকট পানির পাত্র নিয়ে আবেদন করতেন যে, আপনি এতে আপনার হাত মুবারক ডুবিয়ে দিন। তিনি তীব্র শীতের মৌসুমেও তাদের প্রত্যাশা পূরণের জন্য পাত্রে হাত মুবারক ডুবিয়ে দিতেন।
❏ প্রশ্ন-৩২: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর জীবদ্দশায় যুদ্ধের সংখ্যা কত ছিল ?
✍ উত্তর: হুযূর (ﷺ)-এর জীবদ্দশায় যুদ্ধের সংখ্যার ব্যাপারে ঐতিহাসিক এবং ওলামায়ে কিরামের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। কেউ বলেন, ১৯টি; কেউ বলেন, ২৬টি; কেউ বলেন, ২৭টি এবং কেউ বলেন, ৩৬টি। উক্ত যুদ্ধসমূহের মধ্যে মাত্র ৯টি যুদ্ধে হত্যাকান্ড ও সংঘর্ষ সংঘটিত হয়েছে, অন্যগুলোতে সংঘর্ষ হয়নি। যে সকল যুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে সেগুলোর নাম নিম্নরূপ:
১. বদর যুদ্ধ,
২. উহুদ যুদ্ধ,
৩. খন্দকের যুদ্ধ,
৪. বনু কুরাইযার যুদ্ধ,
৫. বনি মুসতলকের যুদ্ধ,
৬. খাইবরের যুদ্ধ,
৭. মক্কা বিজয়,
৮. হুনাইনের যুদ্ধ এবং
৯. তায়েফ যুদ্ধ।
কতিপয় ওলামায়ে কিরাম বলেন, ১২টি যুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ ও সংঘর্ষ হয়েছে, বাকীগুলোতে হয়নি।
হুযূর পাক (ﷺ)-এর সৈন্যবাহিনীর সংখ্যা সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণের বিভিন্ন উক্তি পাওয়া যায়। সরিয়্যাহ সংখ্যা মতান্তরে ৩৫টি কিংবা ৪৮টি। প্রত্যেক সারিয়্যাতে ৪০০ জন সৈন্য থাকে। এ হিসেবে হুযূর (ﷺ)-এর সৈন্য সংখ্যা ১৯,২০০ জন দাঁড়ায়।
হযরাত সাহাবা-ই কিরামের সংখ্যা সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, মক্কা বিজয়ের সময় হুযূর (ﷺ)-এর সঙ্গে ১০,০০০ (দশ হাজার) সৈন্যবাহিনী ছিলেন, হুনাইনের যুদ্ধে ছিলেন ১২,০০০ (বার হাজার) এবং তাবুক যুদ্ধে ছিলেন ৭০,০০০ হাজার। বিদায় হজ্বের দিন মুসলমানের সংখ্যা ছিল ৮০,০০০ হাজার, তম্মধ্যে ৪০,০০০ হাজার তাঁর সঙ্গে ছিলেন। সর্বশেষ হুযূর আক্বদাস-এর ইন্তিকালের সময় ১,২৪,০০০ (এক লক্ষ চব্বিশ হাজার) ছিলেন হযরাত সাহাবা-ই কিরাম (رضى الله تعالي عنه) এর সংখ্যা।
❏ প্রশ্ন-৩৩: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর সম্মানিত বিবিগণের সংখ্যা এবং তাঁদের নাম মুবারক কি ছিল? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর সম্মানিত স্ত্রীগণের সংখ্যা ছিল ১১ জন। সর্বপ্রথম হুযূর(ﷺ),
১. উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ (رضى الله تعالي عنها)কে শাদী করেন। তখন তাঁর পবিত্র বয়স হয়েছিল ২৫ বছর এবং হযরত খাদিজার বয়স ৪০ বছর।
২. উম্মুল মু’মিনীন হযরত সাওদাহ বিনতে যাম‘আহ্ ইবনে কাইস ( رضى الله تعالي عنها )।
৩. উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা বিনতে আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنها)।
৪. উম্মুল মু’মিনীন হযরত হাফসা বিনতে ওমর ইবনুল খাত্তাব (رضى الله تعالي عنها)।
৫. উম্মুল মু’মিনীন হযরত যয়নব বিনতে খুযাইমা ইবনে হারিস (رضى الله تعالي عنها)।
৬. উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালমা বিনতে আবি উমাইয়া মাখযুমী (رضى الله تعالي عنها)।
৭. উম্মুল মু’মিনীন হযরত যয়নব বিনতে জাহাশ (رضى الله تعالي عنها)।
৮. উম্মুল মু’মিনীন হযরত জুওয়াইরিয়্যাহ বিনতুল হারিস ইবনে আবি জারারাহ (رضى الله تعالي عنها)।
৯. উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে হাবীবা বিনতে আবি সুফিয়ান ইবনে হারব (رضى الله تعالي عنها)।
১০. উম্মুল মু’মিনীন হযরত সফিয়্যাহ বিনতে হুয়াই ইবনে আখতব (رضى الله تعالي عنها) এবং
১১. উম্মুল মু’মিনীন হযরত মাইমুনা বিনতুল হারিস আল হালালিয়াহ (رضى الله تعالي عنها)।
❏ প্রশ্ন-৩৪: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর বাঁদী বা ক্রীতদাসী কতজন ছিলেন এবং তাঁদের নাম কি ছিল ?
✍ উত্তর: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর চারজন ক্রীতদাসী ছিলেন। যথা:
১. মারিয়াহ কিব্তিয়াহ (رضى الله تعالي عنه)। তাঁর গর্ভে হযরত ইবরাহীম (رضى الله تعالي عنه) জন্মগ্রহণ করেন।
২. রাইহানা (رضى الله تعالي عنه)।
৩. জামিলা (رضى الله تعالي عنه) এবং
৪. চতুর্থ জনের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
বর্ণিত আছে যে, তবে উক্ত ক্রীতদাসীকে হযরত যয়নব বিনতে জাহাশ (رضى الله تعالي عنها) হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম (ﷺ)কে হাদিয়া দিয়েছিলেন।
❏ প্রশ্ন-৩৫: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর আওলাদ বা সন্তান-সন্ততি কতজন ছিলেন?
✍ উত্তর: হুযূর মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পাঁচজন শাহজাদা (ছেলে) এবং চারজন শাহজাদী (মেয়ে) ছিলেন। তাঁদের মধ্যে মাত্র হযরত ইবরাহীম (رضى الله تعالي عنه) হযরত মারিয়াহ কিব্তিয়াহ (رضى الله تعالي عنها)-এর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। বাকী সকল সন্তান-সন্ততি হযরত খাদিজাতুল কুবরা (رضى الله تعالي عنها) এর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের পবিত্র নামসমূহ নিম্নরূপঃ
১. হযরত ইবরাহীম (رضى الله تعالي عنه),
২. হযরত কাসেম (رضى الله تعالي عنه),
৩. হযরত তৈয়ব (رضى الله تعالي عنه),
৪. হযরত তাহির (رضى الله تعالي عنه),
৫. হযরত আবদুল্লাহ (رضى الله تعالي عنه),
৬. হযরত যয়নব (رضى الله تعالي عنها),
৭. হযরত রুকাইয়াহ (رضى الله تعالي عنها),
৮. হযরত উম্মে কুলসুম (رضى الله تعالي عنها) এবং
৯. হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা (رضى الله تعالي عنها)।
তাঁর সকল ছেলে সন্তান শৈশবেই ইন্তিকাল করেন কিন্তু মেয়ে সন্তানেরা বড় হয়েছিলেন এবং বিবাহ-শাদীও দেয়া হয়েছিল।
❏ প্রশ্ন-৩৬: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর ঘোড়াগুলোর নাম কি ছিল?
✍ উত্তর: হুযূর মোস্তফা (ﷺ) মদিনা মুনাওয়ারায় ফুযারা গোত্রের এক বেদঈন থেকে ‘সাকাব’ নামী একটি ঘোড়া দশ আউকিয়া মূল্যে ক্রয় করেছিলেন এবং উহুদ যুদ্ধে তিনি উক্ত ঘোড়ায় আরোহন করেছিলেন। হুযূর মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর ‘মালাদাহ’ নামক আরো একটি প্রসিদ্ধ ঘোড়া ছিল, যা প্রথমে আবু বুরদাহ ইবনে আবি নিয়ারের নিকট ছিল। হুযূর (ﷺ)-এর ‘আল-মুর্তাজিয্’ নামক আরো একটি ঘোড়া ছিল যা বনি মুর্রাহ গোত্রের এক বেদুঈন ক্রয় করেছিলেন। তাঁর আরো তিনটি ঘোড়া ছিল। এগুলোর একটির নাম ছিল লায্যায্, দ্বিতীয়টির নাম ত্বারব এবং তৃতীয়টির নাম ছিল লুখাইফ।
❏ প্রশ্ন-৩৭: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর যুদ্ধাস্ত্রের নাম কি ছিল?
✍ উত্তর: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর একটি তরবারির নাম ছিল ‘যুল-ফিক্বার’। যা বদর যুদ্ধে পেয়েছিলেন। কাইনুকার যুদ্ধে তিনটি তরবারি পেয়েছিলেন। সেগুলো হচ্ছে ক্বিলাঈ, বতার ও হতফ। তাঁর নিকট আরো দু’টি তরবারি ছিল। একটি হচ্ছে মিহযাম, অপরটি রাসূব।
❏ প্রশ্ন-৩৮: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর ধনুকের সংখ্যা কত ছিল?
✍ উত্তর: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর তিনটি ধনুক ছিল। প্রথমটির নাম রাউহা, দ্বিতীয়টি বায়দা এবং তৃতীয়টির নাম সাফারা ছিল।
❏ প্রশ্ন-৩৯: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর যুদ্ধের পোশাক সংখ্যা কত ছিল?
✍ উত্তর: হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর তিনটি যুদ্ধের পোশাক ছিল। তন্মধ্যে প্রথমটির নাম সা‘দিয়াহ, দ্বিতীয়টির নাম ফচ্ছাহ এবং তৃতীটির নাম যাতুল ফুযূল।
তাঁর নিকট ঢালও ছিল (তলোয়ারের ফলা)। যার ওপর ছাগল এবং মূর্তি অংকিত ছবি ছিল। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত তাঁর নিকট ছিল না।
❏ প্রশ্ন-৪০: হযরত যয়নব বিনতে জাহাশের নাম পরিবর্তন করার কারণ কি ছিল?
✍ উত্তর: যয়নব বিনতে জাহাশ (رضى الله تعالي عنها) ছিলেন হুযূর (ﷺ)-এর আপন ফুফু হযরত উমাইয়া বিনতে আবদুল মুত্তালিবের কন্যা। তাঁর নাম প্রথমে ছিল বুর্রাহ। হুযূর (ﷺ) উক্ত নাম পরিবর্তন করে যয়নব রাখেন। কারণ ‘বুররাহ শব্দের অর্থ অতীব পবিত্র ও পূণ্যবতী মহিলা। যেহেতু উক্ত অর্থে অহংকার ও আত্মগরিমার গন্ধ পাওয়া যায়, তাই শরীয়তের দৃষ্টিতে তা নিষিদ্ধ।
58. আহকামে শরীয়ত।
এমনকি উক্ত শব্দ ব্যবহারেও অনেক ক্ষেত্রে খারাপ অর্থের সৃষ্টি হয়। যেমন, যদি কেউ বলে ‘বুর্রাহ ঘরে নেই’। তখন বাহ্যিকভাবে এর অর্থ দাড়াবে, কোন পূণ্যবতী মহিলা ঘরে নেই। তাই হুযূর (ﷺ) তাঁর নাম পরিবর্তন করে দিয়েছেন। এ জাতীয় অন্যান্য নাম যেমন রহমত বরকত ইত্যাদি রাখাও সমীচীন নয়।
فلا تزكوا انفسكم الخ ‘তোমরা নিজেদেরকে পবিত্র মনে করো না’ আয়াত দ্বারা দলিল উপস্থাপন করেন।
❏ প্রশ্ন-৪১: হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম (ﷺ) -এর শাহজাদীগণের মাঝে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ কে ছিলেন?
✍ উত্তর: শাহজাদীগণের মাঝে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন হযরত যয়নব বিনতে মুহাম্মদ ।ইবনে ইসহাক মতে, তাঁর জন্ম হুযূর পাক(ﷺ)-এর বিলাদত শরীফের ত্রিশতম বৎসরে হয়েছিল। যুবতী হওয়ার পর লক্বীত আবুল আস ইবনুর্ রবী’র সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। পরবর্তীতে হযরত হযরত যয়নব (رضى الله تعالي عنها) মদিনা শরীফে হিজরত করেন। আবুল আস্ কাফির থাকার কারণে তারা পৃথক হয়ে যান। কয়েক বছর পর আবুল আস মদিনা মুনাওয়ারায় গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাই মোস্তফা (ﷺ) তাঁদের পূর্বের বিবাহ বহাল রেখে কিংবা নতুন করে নিকাহ দ্বারা হযরত আবুল আস (رضى الله تعالي عنه)-এর নিকট সোপর্দ করেন। অতঃপর তাঁদের সংসারে আলী নামক এক পুত্র এবং উমামাহ নামী এক কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। আলী ইবনে যয়নব বাল্যকালে ইন্তিকাল করেন এবং উমামাহ জীবিত ছিলেন। খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমা যাহরা (رضى الله تعالي عنها)-এর ইন্তিকালের পর তাঁর অসিয়ত মোতাবেক হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه) তাঁকে বিবাহ করেন এবং তাঁর গর্ভে মুহাম্মদ আওসত নামে এক পুত্র জন্মগ্রহণ করেন কিন্তু জীবিত ছিলেন না। হযরত যয়নব (رضى الله تعالي عنها) ৮ম হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। হযরত সওদা বিনতে যাম‘আহ (رضى الله تعالي عنها), উম্মে সালামা (رضى الله تعالي عنها), উম্মে আইমন (رضى الله تعالي عنها) এবং উম্মে আতিয়াহ আনসারী (رضى الله تعالي عنها) প্রমূখ তাঁকে গোসল দেন। পবিত্র হাদীস দ্বারা একথা স্পষ্ট যে, হুযূর ধৌতকারী মহিলাদেরকে সন্বোধন করে বলেন, তাঁকে তিনবার কিংবা পাঁচবার ধৌত কর। হাদীস বর্ণনাকারী উম্মে আতিয়া বলেন, গোসল শেষে আমি খবর দিলাম যে, গোসল সম্পন্ন হয়েছে। তখন হুযূর (ﷺ) নিজের লুঙ্গী মুবারক দিয়ে বললেন যে, এটা কাফনের সঙ্গে বরকতের উদ্দেশ্যে দিয়ে দাও। অতঃপর তাঁকে কাফনের ব্যবস্থা এবং জানাযার নামাযের পর দাফন করা হয়। হুযূর মোস্তফা (ﷺ) স্বয়ং নিজেই তাঁকে কবরে রাখেন। তখন যয়নব-এর বয়স বিশ কিংবা একুশ বছরের কাছাকাছি হয়েছিল।
❏ প্রশ্ন-৪২: দু’জাহানের সরদার হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর সম্মানিতা মাতা কখন এবং কোথায় ইন্তিকাল করেন?
✍ উত্তর: হুযূর রহমতে ‘আলম(ﷺ)-এর সম্মানিতা মাতা হযরত আমিনা বিনতে ওহাব (رضى الله تعالي عنه) এবং হুযূর-এর সম্মানিত পিতা হযরত আবদুল্লাহ (رضى الله تعالي عنه) উভয়ের মাঝে বংশীয় আত্মীয়তার সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। যা নিম্নোক্ত শজরা থেকে প্রকাশ পায়।
হুযূর(ﷺ)-এর সম্মানিত পিতা হযরত খাজা আবদুল্লাহ তাঁর জন্মের কিছুদিন পূর্বে ইন্তিকাল করেন। কিন্তু হযরত আমিনা অত্যন্ত সাহসিকতা ও দৃঢ়মনোবল নিয়ে আল্লাহর প্রিয় মাহবুবকে লালন-পালন শুরু করেন। আরবের প্রথানুযায়ী হালিমা সা‘দিয়া নামক এক গ্রাম্য দাইমার নিকট তাঁকে লালন-পালন ও দুধপান করানোর দায়িত্ব অর্পন করেন। দু’বছর পর দুধপান শেষ হলে তাঁকে তাঁর মাতা আমিনার নিকট নিয়ে আসেন। বিচক্ষণ গুণবতী ও জ্ঞানী মাতা সন্তানের সু-স্বাস্থ্য দেখে চিন্তা করলেন যে, হয়তো মক্কার আবহাওয়া তাঁর অনুকূলে নাও হতে পারে, তাই হালিমা সা‘দিয়ার সঙ্গে তাঁকে পুনরায় পাঠিয়ে দিলেন। অতএব একথা প্রতীয়মান হয় যে, অধিকাংশ সম্মানিত ও শরীফ খান্দান ভদ্রলোকদের মাতা শিক্ষিত, মার্জিত ও বিচক্ষণ হয়ে থাকেন, রহমতে ‘আলম (ﷺ)-এর মাতাও সেই প্রশংসনীয় গুণসম্পন্না বিদূষী মহিলা এবং দূরদর্শী জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। আমাদের দেশের অনেক মহিলারা নিজ সন্তানের সুস্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রাখেন না।
হুযূর মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ(ﷺ)এর বয়স যখন ছয় বছরে উপনীত হয়, তখন হযরত আমিনা তাঁকে সঙ্গে নিয়ে মদিনা শরীফের বনু নাজ্জার গোত্রে খাজা আবদুল মুত্তালিবের মাতুলালয়ে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে মর্বুয়া কিংবা আব্ওয়া নামক স্থানে বিশ কিংবা একুশ বছর বয়সে তিনি ইন্তিকাল করেন।
কতিপয় ওলামার মতে, তিনি মক্কা শরীফে ইন্তিকাল করেন। তাঁর পবিত্র ঔরসে শুধুমাত্র আল্লাহর প্রিয় হাবীব মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জন্মলাভ করেন। তিনি একজন প্রখ্যাত কবিও ছিলেন।
❏ প্রশ্ন-৪৩: ‘আহমদ’ এটা কার নাম ? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: ‘আহমদ’ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর অন্যতম দ্বিতীয় নাম। যার অর্থ হচ্ছে, নির্বাচিত, মনোনীত ও প্রশংসনীয় গুণাবলী। হুযূর-এর পূর্ববর্তী নবীগণের ওপর অবতীর্ণ আসমানী কিতাবসমূহে হুযূর মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর নবুওয়াতে সুসংবাদ লিপিবদ্ধ ছিল এবং সেখানে তাঁর ‘আহমদ’ নামই এসেছিল। পার্থক্য শুধুমাত্র ভাষার। হুযূর মুহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ) ছিলেন আরবী এবং তাঁর ভাষাও আরবী। তাই তাঁর নামও আরবী হওয়া উচিৎ। অন্যদিকে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহ ছিল অনারবী ভাষায়। তাই উক্ত কিতাবসমূহে ‘আহমদ’-এর স্থলে قارقليط (কারে-কলীত্ব) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যা অর্থের দিক দিয়ে আহমদ শব্দের সমার্থক এবং একই ওযনের। কোরআন মজিদে উক্ত সুসংবাদের বর্ণনা এভাবে এসেছে।
وَإِذْ قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَمُبَشِّرًا بِرَسُولٍ يَأْتِي مِنْ بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ .
‘হে হাবীব আপনি স্মরণ করুন, যখন মরিয়ম পুত্র ঈসা (عليه السلام) বললেন, হে বনি ইসরাইল! আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর প্রেরিত রাসূল, আমার পূর্ববর্তী তাওরাতের আমি সত্যায়নকারী এবং আমি এমন একজন রাসূলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে তাশরীফ আনবেন। তাঁর নাম আহমদ।’
❏ প্রশ্ন-৪৪: মাওলাদ বা জন্মস্থান ও জন্ম তারিখ দ্বারা উদ্দেশ্য কি বর্ণনা কর?
✍ উত্তর: কোন নবী-রাসূল কিংবা বুযূর্গের জন্মদিবস। সাধারণত এর দ্বারা রবিউল আউয়াল শরীফের ১২ তারিখ উদ্দেশ্য, যা হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর বেলাদত শরীফের দিন। এটাকেই মাওলুদুন্ নবী (ﷺ) বলা হয়। হিন্দুস্তান ও মিশরে এর অধিক প্রচলন বিদ্যমান আছে কিন্তু মধ্য এশিয়াতে এর প্রসিদ্ধি কম। উক্ত দিবসে হিন্দুস্তানে হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর বিভিন্ন অবস্থা সম্পর্কে আলোচনার বিশেষ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। হুযূর (ﷺ)-এর প্রশংসা ও মর্যাদা সম্বলিত না’তে রাসূল পাঠ করা হয় এবং দরূদ শরীফের খতম ও যিকিরের ব্যবস্থা করা হয়।
কিন্তু ওহাবী সম্প্রদায় যারা আহলে হাদীস হিসেবে প্রসিদ্ধ তারা এ জাতীয় মাহফিলকে বিদ‘আত ও সুন্নাত পরিপন্থী বলে বিশ্বাস করে।
বেলাদত বলতে ১২ রবিউল আউয়াল শরীফ উদ্দেশ্য। ১২ রবিউল আউয়াল সমগ্র মুসলিম বিশ্বে অতীব সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ দিবস হিসেবে প্রসিদ্ধ এবং ওই দিন রাষ্ট্রীয়ভাবে সরকারী ছুটি ঘোষণা করা হয়। মসজিদ সমূহে এবং বিভিন্ন ঘরে মিলাদ শরীফের মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে হুযূর (ﷺ)-এর মর্যাদাপূর্ণ জীবনী আলোচনা করে লোকজনকে নবী প্রেমে উজ্জীবিত করা হয় এবং মর্মস্পর্শী ও হৃদয়গ্রাহী না‘ত শরীফ পাঠ করার মাধ্যমে এ মুহাব্বতে আবেগের সৃষ্টি হয়।
কিন্তু ওহাবী তথা আহলে হাদীসরা এ জাতীয় কর্ম সম্পাদনকে বিদ‘আত ও সুন্নাত পরিপন্থী কাজ বলে আক্বীদা পোষণ করে। হুযূর (ﷺ)-এর বেলাদত শরীফের তারিখ ১২ রবিউল আউয়াল শরীফ এবং ওফাত শরীফের তারিখও মতান্তরে ১২ রবিউল আউয়াল শরীফ। অতএব মুসলমানদের জন্য ১২ রবিউল আউয়াল শরীফ অত্যন্ত তাৎপর্যমন্ডিত ও মর্যাদাপূর্ণ দিন, যাতে তাঁর বিলাদত ও ওফাত উভয়ের স্মরণ করা হয়।
১৩২৭ হিজরীতে সিরিয়া ও আরব দেশে এ আন্দোলন ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয় যে, ওই দিনকে সকল ইসলামী মহান ও স্মরণীয় দিনগুলোর চেয়ে অধিক শানদার মর্যাদাপূর্ণ ও বরকতময় দিন হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। উক্ত আন্দোলনের প্রতিধ্বনি হিন্দুস্তানসহ বিভিন্ন ইসলামী দেশগুলোতেও পৌঁছে যায়। ফলে ১৩২৮ হিজরীতে হিন্দুস্তানের মুসলমানেরা বিভিন্ন শহরে উক্ত দিন ঈদে মিলাদুন্ নবী উদযাপন করেন। হুযূর (ﷺ)-এর ওফাত শরীফের বিশুদ্ধ তারিখ সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। সাধারণত প্রসিদ্ধ যে, ১২ তারিখ তাঁর মাওলুদ শরীফ। শিক্ষিত গুণিজন এবং প্রখ্যাত ওলামা ও বুযূর্গানে দ্বীন সম্মিলিতভাবে মাহফিল করেছেন এবং হুযূর মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পবিত্রতা ও মহত্ব সম্পর্কে জোরালো বক্তব্য পেশ করেন। উক্ত সমাবেশের নাম ‘১২ই ওফাত দিবস’-এর পরিবর্তে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী ’ নামে স্বীকৃতি লাভ করে। বিভিন্ন পত্রিকা ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ)-এর খুশিতে রঙ্গীণ ক্রোড়পত্র এবং বিলাদতে মোস্তফা (ﷺ)-এর ওপর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী প্রকাশ করে। প্রত্যেক বছর এবং প্রতিটা মুহূর্তে একবার স্বীয় প্রিয় মাওলা নবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর স্মরণে মাহফিল করা এবং তাঁর নবুওয়াতের বিশুদ্ধ ঘটনাবলীকে গদ্য ও পদ্যের বিভিন্ন পদ্ধতিতে বর্ণনা করা, এমন এক মুস্তাহসন বা পূণ্যময় প্রশংসনীয় বিষয় যে, যা বর্ণনা ও যুক্তির নিরিখে অস্বীকার করা যাবে না।
من احب شيئًا اكثر ذكرهُ এটি স্বতঃসিদ্ধ ও সর্বজনস্বীকৃত নীতিমালা। অর্থাৎ- যে যাকে ভালবাসে সে তার স্মরণ অধিকহারে করে থাকে। কোন ব্যক্তি মুসলমান হতে পারবে না যতক্ষণ তার মাঝে স্বীয় আক্বা মাওলা মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মুহব্বত নিজ প্রাণ ও সন্তান-সন্ততি থেকে অধিক প্রিয় না হবে। মুহব্বতের চাহিদা হচ্ছে, বন্ধুর স্মরণে সর্বদা ব্যাপৃত থাকা। বর্তমানে প্রত্যেক জাতি তাদের দলীয় নেতৃবৃন্দ ও পথপ্রদর্শকদের জন্মবার্ষিকী ও শাহাদত বার্ষিকী অত্যন্ত জাঁকজমক ও ধুম-ধামের সাথে পালন করছে। অতএব মুসলমানগণ তাদের সত্য নবী ও প্রিয় রাসূল (ﷺ)-এর বছরের এই মুবারক দিনে যে নূর ইহজগতে প্রকাশিত হয়েছেন এবং ওই দিন আল্লাহ তা‘আলার মাহবুব তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর সঙ্গে মিলিত হয়েছেন, সে পূণ্যময় দিনে ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) করে উক্ত অনুপম পূণ্যময় দিনকে স্মরণীয় করে রাখবে না কেন?
59. সূরা আছ্-ছফ্, আয়াত: ৬
❏ প্রশ্ন-৪৫: সিদরাতুল মুন্তাহা ও সিদরাতুন নবী কাকে বলে এবং উভয়ের মধ্যে পার্থক্য কি?
✍ উত্তর: সিদরাতুল মুন্তাহা মি‘রাজ শরীফের হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। ‘সিদরা’ অর্থ- বরই গাছ বা কুল বৃক্ষ। সিদ্রাতুল মুন্তাহা ওই কুল বৃক্ষকে বলা হয়, যা সপ্ত আসমানের শেষ প্রান্তে অবস্থিত। ফেরেশতাকুল সরদার সৈয়্যদুনা জিবরাঈল (عليه السلام)-এর উর্ধ্বকাশের শেষ গমনস্থল, এর সামনে এক চুল পরিমাণও তিনি যেতে সক্ষম নন। পৃথিবী থেকে যা কিছু আকাশের দিকে উঠানো হয় এবং আসমান থেকে যা কিছু পৃথিবীতে অবতরণ করা হয় সব কিছু ‘সিদরাতুল মুন্তকাহা’য় গিয়ে থেমে যায়। অতঃপর সেখান থেকে ফেরেশতারা উপরে নিয়ে যায় এবং নীচে নিয়ে আসে।
60. মিশকাত শরীফ।
কোরআন মজিদের ‘সূরা আন-নাজমে’ এভাবে বর্ণিত হয়
أَفَتُمَارُونَهُ عَلَى مَا يَرَى . وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَى . عِنْدَ سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى . عِنْدَهَا جَنَّةُ الْمَأْوَى . إِذْ يَغْشَى السِّدْرَةَ مَا يَغْشَى .
‘তোমরা কি বিষয়ে তাঁর সঙ্গে যুক্তিতর্কে লিপ্ত হয়েছ? অথচ এটা তর্কের বিষয় নয়। কেননা তিনি তো মি‘রাজ রজনীতে সিদরাতুল মুন্তাহায় যা পূণ্যবানদের অবস্থান করার অনেক স্থান রয়েছে। সৈয়্যদুনা জিবরাইল (عليه السلام) তাঁর প্রকৃত আকৃতিতে আরো একবার তাঁর নিকট আসা অবস্থায় দেখেছিলেন। যখন ওই সিদ্রার ওপর নূরের ছায়া ছিল সিদ্রাতুল মুন্তাহার নিকটে। যার নিকট রয়েছে ‘জান্নাতুল মাওয়া’। যখন বৃক্ষটি আচ্ছন্ন করেছিল, যা আচ্ছন্ন করার ছিল।’
61. সূরা আন-নজম, আয়াত: ১২-১৬।
প্রশ্নোলিখিত ‘সিদরাতুল মুন্তাহা, যা কোরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত এবং ‘সিদরাতুন নবী’ যা সম্পর্কে হাদীস ও ইতিহাসে বর্ণনা আছে। ‘সিদরাতুল মুন্তাহা’ আসমানে এবং ‘সিদরাতুন্ নবী’ পৃথিবীতে অবস্থিত। ঘটনাটি এভাবে বর্ণিত আছে যে, একটি কুল বৃক্ষ হুযূর (ﷺ) -এর মু’জিযা স্বরূপ দ্বিখন্ডিত হয়ে গিয়েছিল। একদা হুযূর মোস্তফা (ﷺ) উটের ওপর আরোহন করে অন্ধকার রাত্রে সফর করছিলেন এবং তাঁর চোখে তন্দ্রারভাব এসেছিল। এমতাবস্থায় তিনি নিদ্রার জন্য ঘুমাতে গেলে সামনে একটি কুল বৃক্ষ এসে দ্বিখন্ডিত হয়ে তাঁর দু’পাশের্ব দু’ভাগ হয়ে তাকে পরিবেষ্টন করে নিল। তিনি কোন অসুবিধা ছাড়া অত্যন্ত নিরাপদে মাঝখানে ঢুকে ঘুমাচ্ছিলেন এবং সে অবস্থা ঘুম শেষ না হওয়া পর্যন্ত ছিল। তাই উক্ত গাছটি ‘সিদরাতুন নবী’ নামে প্রসিদ্ধ হয়।
62. ইসলামী মা‘লুমাত কা মাখযন, পৃষ্ঠা-৪০২।
❏ প্রশ্ন-৪৬: ‘বাহ্যিক দৃষ্টিতে হযরত আদম (عليه السلام) সৈয়্যদুনা মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর সম্মানিত পিতা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হুযূর মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ হযরত আদম (عليه السلام)-এর পিতা।’ উক্ত বাণীর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও মর্মার্থ কি? দলিলসহ বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: ‘সীরাতে মোস্তফা (ﷺ) ’-এর দ্বিতীয় খন্ডের ২৬৫ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে যে, হুযূর (ﷺ) হজ্বের সময় ঐতিহাসিক মহান খুৎবা প্রদানকালে ইরশাদ করেন, যার একাংশ এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে যেমন, ইমাম বায়হাকী (رحمه الله تعالي ) হযরত জাবের (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণনা করেন যে, হুযূর (ﷺ) হজ্বের ১২ জ্বিলহজ্বের খুৎবায় ইরশাদ করেন,
يَا ايها النّاسُ ان ربكم واحدٌ وَان اباكم واحد .
হে লোকসকল! তোমাদের প্রভু এক এবং তোমাদের পিতা এক অর্থাৎ হযরত আদম (عليه السلام)। উক্ত সময় তিনি তাঁকে নিজের পিতা সম্বোধন করেন নি। অথচ প্রকাশ্য জগতে নিশ্চয়ই তিনি হুযূর (ﷺ) এর পিতা। যদিও আত্মিক জগতে হুযূর আক্বদাস (ﷺ) হযরত আদম (عليه السلام) ও সমগ্র সৃষ্টিকুলের পিতা।
ইমাম ইবনুলহাজ্ব মক্কী (رحمه الله تعالي ) রচিত ‘মাদখাল’ কিতাবে বর্ণিত আছে যে, সৈয়্যদুনা আদম (عليه السلام) যখন হুজুর আক্বদাস (ﷺ)কে স্মরণ করতেন তখন এভাবে বলতেন, يا ابنى صورةً وابي معنًى ‘বাহ্যিক দৃষ্টিতে হে আমার সন্তান এবং আত্মিক দিক দিয়ে হে আমার পিতা’।
63. ফতওয়া আফ্রিকা, পৃষ্ঠা-২১:২৩।
অনুরূপ আরেকটি খুৎবায় বর্ণিত আছে, যা হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুযূর (ﷺ) আইয়ামে তাশরীকের মধ্যে বিদায় হজ্বে খুৎবা দিতে গিয়ে বলেন,
يَا ايها الناس ان ربكم واحدٌ واِنّ اباكم واحد، لافضل لعربى على عجمى ولا لعجمى على عربى، ولا لاحمر على الاسود ولا لاسود على الاحمر الا بالتقوىٰ، ان اكرمكم عند الله اتقاكم، الآهل بلغت قالوٰ بلى يا رسول اللهِ! قال فليبلغ الشاهد الغائب .
‘হে লোকসকল! নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক এক এবং তোমাদের পিতা এক। একথা ভালভাবে শুনে রাখো যে, অনারবীদের ওপর আরববাসীদের কোন ফযিলত নেই এবং আরববাসীদের ওপর অনারবীদের কোন ফযিলত ও শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কালো বর্ণের ওপর লাল বর্ণের এবং লাল বর্ণের ওপর কালো বর্ণের কোন ফযিলত ও বুযূর্গী নেই, কিন্তু তাকওয়া বা খোদাভীতির ওপর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট তোমাদের মাঝে সবচেয়ে মর্যাদাবান ওই ব্যক্তি, যিনি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী খোদাভীরু। তোমরা কী শুনতেছ? আমি কী আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ তোমাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছি? সাহাবা-ই কিরাম আরয করলেন, হ্যাঁ! আপনি অবশ্যই পৌঁছে দিয়েছেন হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)। অতঃপর ইরশাদ করেন, ‘যারা উপস্থিত আছ তারা অুনপস্থিতদের নিকট পৌঁছে দিবে’। তারপর মানুষের রক্ত, জান-মাল, ইজ্জত-সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাণী পেশ করেন।
64. সীরাতুল মোস্তফা (ﷺ), খন্ড-২, পৃষ্ঠা-২৬৬।
❏ প্রশ্ন-৪৭: সরকারে দু’আলম (ﷺ)-এর পবিত্র জানাযায় কোন নির্দিষ্ট ইমাম ছিলেন কি না? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: هو المستعان সরকারে দু’আলম (ﷺ)-এর পবিত্র জানাযায় কোন নির্দিষ্ট ইমাম ছিলেন না। তাবকাতে ইবনে সা’দ গ্রন্থে হযরত আমিরুল মু’মিনীন মাওলা আলী শের-ই খোদা (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে,
قال لما وضع رسول الله صلى الله عليه وسلم على السرير قال لايقوم عليه احد هوامامكم حيا وميتًا، فكان يدخل الناس رسلا رسلًا، فيصلون عليه صفًا صفًا ليس لهم امام الخ .
‘হুযূর মোস্তফা (ﷺ) কে গোসল শরীফ দেয়ার পর খাটের ওপর শোয়াইয়ে রাখা হলো। হযরত মাওলা আলী (رضى الله تعالي عنه) বলেন, জানাযায়ে আক্বদাসের কোন ইমাম ছিলেন না।
65. সীরাতুল মোস্তফা (ﷺ), খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৩১০।
সৈয়্যদুনা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنه) ও হযরত ওমর ফারূক (رضى الله تعالي عنه) সালাম আরয করেছেন। এটাই মূলতঃ স্পষ্ট, যা ইবনে সা’দ (رضى الله تعالي عنه)-এর হাদীস এবং ইমাম বায়হাকী (رحمه الله تعالي ) হযরত মুহাম্মদ ইবরাহীম তাইমী মাদানী (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন,
لمّا كفن رسول الله صلى الله عليه وسلم وضع على سريره دخل ابوبكر وعمر، فقال السلام عليك ايها النبى ورحمة الله وبركاته ومعهما نفر من المهاجرين والانصار .
‘যখন হুজুর আক্বদাস (ﷺ)কে গোসল ও কাফন মুবারক পরিয়ে পবিত্র খাটে রাখলেন, তখন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنه) ও হযরত ওমর ফারূক (رضى الله تعالي عنه) হাযির হয়ে সালাম পেশ করে বলেন, হে আল্লাহ’র নবী (ﷺ)! আপনার ওপর শান্তি এবং আল্লাহ’র দয়া মেহেরবানী বর্ষিত হোক। তাঁদের সঙ্গে মুহাজির ও আনসারগণের একটি দলও ছিলেন। হযরত জিবরাইল (عليه السلام) ও মিকাইল (عليه السلام) সালাত ও সালাম পেশ করেছেন।
বায্যার, হাকেম, ইবনে সা’দ, বায়হাকী এবং তাবরানীসহ অন্যান্য মুহাদ্দিসীনে কিরাম হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, হুযূর (ﷺ) ইরশাদ করেছেন,
فان اوّل من يصلى علّى جبرائيل ثم ميكائيل ثم اسرافيل ثم ملك الموت مع جنوده .
‘সর্বপ্রথম আমার ওপর সালাত ও সালাম পেশ করবেন হযরত জিবরাইল (عليه السلام), অতঃপর মিকাইল (عليه السلام), অতঃপর ইসরাফিল (عليه السلام), অতঃপর মালাকুল মাউত (عليه السلام) তাঁদের সকল সৈন্যবাহিনী সঙ্গে নিয়ে।
ثم دخلوا علّى فوجًا بعد فوجٍ فصلوا علّى وسلموا تسليمًا .
অতঃপর দলে দলে অন্যান্যরা প্রবেশ করবেন এবং সালাত ও সালাম পেশ করবেন।
উক্ত হাদীস শরীফ দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, হুযূর স্বয়ং নিজের পবিত্র জানাযার নামায সম্পর্কে এ রকম শিক্ষা দিয়েছেন যে, লোকজন দলে দলে উপস্থিত হয়ে সালাত ও সালাম পেশ করবেন।
হুযূর (ﷺ)-এর ওপর সালাত দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, একেক জামাত গিয়ে সালাত ও সালাম পেশ করতেছিলেন। হুযূর(ﷺ)-এর জানাযা প্রচলিত নিয়মে না পড়াও তাঁর অন্যতম বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য। হ্যাঁ! লোকজন এসে শুধুমাত্র দু‘আ (সালাতু সালাম পাঠ) করে করে চলে যাচ্ছিলেন।
66. ফতাওয়া রেজভীয়া, খন্ড-৪, পৃষ্ঠা-৪০:৪১; সীরাতুল মোস্তফা (ﷺ), খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৩১৩।
❏ প্রশ্ন-৪৮: হুযূর আক্বদাস (ﷺ)-এর পবিত্র জানাযায় ইমামতি না হওয়ার হিকমত কী ছিল? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: هو المستعان ইমাম আহমদ রেযা (رحمه الله تعالي ) বলেন, লাশ মুবারক রওজা শরীফের দিকে নিয়ে না যাওয়া, যেখানে রূহে আক্বদাস পরম বন্ধুর দিকে ঊর্ধ্বগমন করেছে, বিশেষ নির্দিষ্ট স্থানে দাফন হওয়া, গোসল দেয়ার সময় পবিত্র জামা শরীর মুবারক থেকে আলাদা না করা, সকল সাহাবা-ই কিরাম সাক্ষাৎ লাভের সুবিধার্থে জানাযা মুবারক পৌনে দু’দিন বিলম্ব করা এবং পবিত্র জানাযায় কাহারো ইমামতি প্রযোজ্য না হওয়া, হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব। বিশেষতঃ হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে যে, এ সকল কার্যক্রম হুযূর (ﷺ)-এর অসিয়ত মোতাবেক সংঘটিত হয়েছে।
জানাযার নামায এক মুসলমানের ওপর অন্য মুসলমানের হক্ব। রাসূলে কারীম(ﷺ) ইরশাদ করেন,
حق المسلم على المسلم خمس : ردُّ السلام وعيادة المريض واتباع الجنازة واجابة الدعوة وتشميت العاطس .
এক মুসলমানের ওপর অন্য মুসলমানের পাঁচটি হক্ব রয়েছে।
১. সালামের জবাব দেয়া,
২. রোগীর সেবা করা,
৩. জানাযার অনুসরণ করা,
৪. দাওয়াত কবুল করা এবং
৫. হাঁচির জবাব দেয়া।
অত্র হাদীসখানা সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আবু হুরায়রা (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত আছে।
সাধারণ মু’মিন মুসলমানের হক্ব এমন হওয়া সমীচীন যে, উপস্থিত লোকদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক আদায় করলে তা আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু মহান আল্লাহ তা‘আলার হক্বের পর সবচেয়ে বেশী হক্বের অধিকারী হচ্ছেন আল্লাহ প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ নিয়ামত দু’জাহানের বাদশাহ হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর হক্ব বা অধিকার। যদি উপস্থিত সকলের ওপর আবশ্যিক হয় তা হলে মহান উদ্দেশ্য দ্বারা উপস্থিত প্রত্যেক মুসলমানের সত্তাগতভাবে এ মহান সত্তার সাক্ষাৎ লাভ করা দূরের কথা নয়।
সীরাতে মোস্তফা (ﷺ) দ্বিতীয় খন্ডর ৩১৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে যে, রাসূল কারীম (ﷺ) ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্যবান বান্দা ইন্তিকালের পর তাঁর প্রথম পুরস্কার যা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে মিলে, তা হচ্ছে, যে সকল লোক তাঁর জানাযার নামায পড়ে, পরম করুণাময় আল্লাহ তা‘আলা সকলের গুনাহ ক্ষমা ও মাফ করে দেন। তা কোন নবীর কিংবা কোন রাসূলের কিংবা সৈয়্যদুল আন্বিয়া ওয়াল মুরসালীন-এর জানাযা হোক। তাঁর দয়ার পরিমাণ কে বা আছেন তা পরিমাপ করতে পারবেন? এখানে কোন্ ধরনের কিয়াস? এখানে রহমতে ‘আলম (ﷺ)-এর জোর তাগিদ এটাই ছিল যে, এখানে সাধারণ অনুমতি দেয়া হয়েছে।
হুজরা শরীফের জায়গাই বা কতো? আর উপস্থিত লোকের সংখ্যা ৩০,০০০ হাজার। যেমন হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, এখন যদি এমন হুকুম হতো যে, প্রথমবার যারা পড়ার তারা পড়ে নিন। তাহলে হাজার হাজার সাহাবার বঞ্চিত হওয়া এতে অন্যান্য সাহাবাগণ নিশ্চিতরূপে কঠিন বিবাদে লিপ্ত হতেন। যখন একথা জানা হতো যে, অন্যান্য জানাযার ন্যায় এখানেও একবারই অনুমতি মিলবে, তাহলে প্রত্যেকেই এটা কামনা করতো যে, আমিই পড়ব।
অতএব হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর মহাজ্ঞানের জোর তাগাদা হচ্ছে, স্বয়ং নিজের ক্ষেত্রে দলে দলে এসে হাযিরী দেয়ার অসিয়ত করেন। صلى الله عليه دائمًا ابدًا । এ মহান গোপন কথা ও অন্তঃরহস্য পবিত্র জানাযায় ইমামতি না হওয়ারও এক স্বচ্ছ হিকমত রয়েছে, যাতে উপস্থিত সবাই সত্তাগতভাবে কোন মাধ্যম ছাড়াই হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর থেকে ফয়েয ও বরকত দ্বারা সম্মানিত এবং উপকৃত ও মর্যাদাবান হয়।
প্রখ্যাত ইমাম সুহাইলী (رحمه الله تعالي ) এখানে ইমামতি না হওয়ার কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
اخبرالله تعالٰى انه وملائكتهُ يصلّون عليه صلّى اللهُ عليهِ وسلّم وامر كل واحدٍ من المؤمنين ان يصلّى عليه فوجب على كل واحد ان يباشر الصلواة عليه فى حياته والصلواة عليه صلّى اللهُ عليه وسلّم بعد موته من هذا القبيل .
‘মহান আল্লাহ সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি এবং তাঁর সকল ফিরিশতা মাহবুবে খোদা (ﷺ)-এর ওপর দরূদ প্রেরণ করেন এবং প্রত্যেক মুসলমানের ওপর হুকুম করেছেন যে, তাঁর (ﷺ) ওপর দরূদ প্রেরণ করার। তাই প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ওয়াজিব যে, মাহবুবে খোদা (ﷺ)-এর ওপর এমনভাবে দরূদ প্রেরণ করবে যে, অন্যের মাধ্যম ছাড়া স্বয়ং নিজের পক্ষ থেকে মাহবুবে খোদা (ﷺ)-এর দরবারে দরূদ প্রেরণ করবে।
صلّى اللهُ عليك يا رسول الله وسلّم عليك يا حبيب الله وعلى اٰلك واصحابك يا نبى الله .
মাহবুবুল্লাহ, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) , নবীয়ুল্লাহ (ﷺ)-এর ওপর বেছাল শরীফের পর সালাত ও সালামও সরাসরি কোন মাধ্যম ছাড়াই একাকী হওয়াই উচিত।
ইমাম শাহ্ আহমদ রেযা (رحمه الله تعالي ) জানাযায়ে আক্বদাসে ইমামতি না হওয়ার আরো একটি কারণের দিকে ইঙ্গিত করতে গিয়ে লিখেছেন যে, ইমাম শামসুল আইম্মা সারখ্সী (رحمه الله تعالي ) তাঁর ‘মাব্সুত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে,
ان ابابكر رضى الله عنه كان مشغولًا بتسوية الامور وتسكين الفتنة فكانوا يصلون عليه قبل حضوره . وكان الحق له لانه هو الخليفة فلمَّا فرغ صلّى عليه ثم لم يصلِّ عليه بعدهُ عليه .
সারকথা হচ্ছে এই যে, সৈয়্যদুনা আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنه) ফিৎনা-ফ্যাসাদ থেকে শান্তি এবং উম্মতের কর্মকান্ড সমূহ ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ছিলেন। যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর পবিত্র হাতে বাইআত গ্রহণ করেনি। মানুষ দলে দলে আসলেন এবং তাঁর পবিত্র জানাযার ওপর নামায পড়লেন। যখন পরিপূর্ণ বা’ইআত হলো, তখন ওলীয়ে শরয়ী বা হযরত সৈয়্যদুনা আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنه) শরীয়তসম্মত ওলী বা রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হন। তিনি জানাযা-ই মুকাদ্দাসার ওপর জানাযার নামায পড়েন এবং এরপর আর কেউ জানাযা পড়েননি।
ثم لم يصل عليه بعدهُ عليه
ওলী বা অভিভাবকের জানাযার নামায আদায় করার পর, জানাযার নাম পুনরায় পড়ার কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই। তাই ইমাম আহমদ রেযা বেরেলভী (رحمه الله تعالي ) জানাযার নামায পুনরুক্তি শরীয়ত সম্মত না হওয়ার সুস্পষ্ট বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন,
নূরুল ইযাহ গ্রন্থের পাদটীকায় সিরাজ, গুনিয়্যাহ ও ইমদাদ গ্রন্থের হুবহু শব্দ উল্লেখ করে বলেন,
ولايصلِّ على قبره الشريف الى يوم القيمة لبقائه صلّى اللهُ عليه وسلّم كما دفن طريًا بل هو حىّ يرزق ويتنعم سائراللذات والعبادات وكذا سائر الانبياء عليهم الصلواة والسلام ، وقد اجتمعت الامة على تركها .
‘এই জানাযার নামায যদি তাক্রার বা বারবার হতো, তাহলে পবিত্র মাযার শরীফে কিয়ামত পর্যন্ত নামায পড়া হতো। কেননা হুযূর আক্বদাস (ﷺ) সব সময় এভাবেই তরুতাজা ও প্রাণবন্ত আছেন যেমন দাফন মুবারকের সময় ছিলেন বরং তিনি স্বশরীরে জীবিত এবং তাঁকে রিযিক দেয়া হয়। সব ধরনের স্বাদ এবং সকল ইবাদতের মনোমুগ্ধকর নি‘য়ামতসমূহ বিদ্যমান এবং অনুরূপ অন্যান্য নবীগণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অথচ মুসলিম উম্মাহর সকলেই এ নামায না পড়ার ওপর ঐকমত্য পোষণ করেন।
67. সীরাতে মোস্তফা (ﷺ), খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৩১৭; ফতওয়া রেযভীয়া, খন্ড-৪, পৃষ্ঠা-৬৬।
❏ প্রশ্ন-৪৯: হুজুর আক্বদাস (ﷺ) পবিত্র অন্তিম রোগ শয্যায় কোন কোন বিষয়ে অসিয়ত করেছিলেন? বর্ণনা কর।
✍ উত্তর: وبالله التوفيق প্রখ্যাত ইমাম ফকীহ মুহাদ্দিস সৈয়্যদুনা ইমাম আবুল লাইছ নসর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম সমরকন্দি হানাফী (رحمه الله تعالي ) ‘তানবীহুল গাফিলীন’ গ্রন্থে বলেছেন যে, যখন সূরা নসর হুযূর সৈয়্যদুল মুরসালীন (ﷺ)-এর বেছাল শরীফের রোগাক্রান্ত অবস্থায় বৃহস্পতিবার অবতীর্ণ হয়, তখন হুযূর (ﷺ) কালবিলম্ব না করে মসজিদে নববীর মিম্বর শরীফে তাশরীফ রাখলেন এবং হযরত বেলাল (رضى الله تعالي عنه)কে নির্দেশ দিলেন যে, মদিনা শরীফে ঘোষণা করে দাও যে, হে মদিনাবাসীগণ! হাবীবে খোদা (ﷺ)-এর শেষ অসিয়ত শুনার জন্য এসো। উক্ত আহ্বান শুনামাত্র ছোট-বড় নারী-পুরুষ সবাই ঘরের দরজা এমনিতেই খোলা রেখে এসে পড়েন এবং কুমারী পর্দানশীন মহিলারাও বেরিয়ে আসেন। এমন কি অধিক সমাগমের কারণে মসজিদে জায়গা সংকুলান না হলে হুযূর (ﷺ) বলতে লাগলেন, তোমরা পিছনে আগতদের জন্য জায়গা উন্মুক্ত করে দাও। তোমরা পিছনে আগতদের জন্য জায়গা বিস্তৃত করে দাও।
والنبى يقول وسعوا وسعوا لمن وراءكم . ثم قال النبى صلى الله عليه وسلّم فحمدالله واثنى عليه .
অতঃপর হুযূর মিম্বর শরীফের ওপর দাঁড়িয়ে মহান আল্লাহ্ তা‘আলার মুহাব্বতে কাঁদেন এবং আল্লাহ্ সমীপে প্রত্যাবর্তিত হওয়ার কথা স্মরণ করে মহান আল্লাহ্ তা‘আলার হামদ-ছানা আদায় করেন এবং পূর্ববর্তী সকল আন্বিয়া আলাইহিমুস সালামের ওপর সালাত ও সালাম প্রেরণ করেন।
অতঃপর ইরশাদ করেন,
انّا محمد بن عبدالله بن عبد المطلب بن هاشم العربى الحرمى المكى لانبىّ بعدى .
‘আমি মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মত্তালিব ইবনে হাশিম আরবী মক্কা মুয়ায্যামার সম্মানিত হেরেমের মোতাওয়াল্লি, আমার পরে আর কোন নবী আসবেন না।’
দেখুন! মহান মর্যাদাশীল ও চিরস্থায়ী ক্ষমতার অধিকারী মহান আল্লাহ’র শান ও মর্যাদা। এমন একদিন ছিল যে, মদিনা মুনাওয়ারায় হুযূর মোস্তফা (ﷺ)-এর শুভাগমনের খুশি ও আনন্দের ধূমধাম উৎসবের ধ্বনি প্রতিধ্বনিতে আকাশ ও পৃথিবী গর্জে উঠেছিল। তাঁদের চেহারা আনন্দ উৎফুলতায় আনারের দানার ন্যায় ঝলমল করছিল। আরশ থেকে পরশ পর্যন্ত নূরের পূণ্য ভূমিতে পরিণত হয়েছিল। পর্দানশীন কুমারী মহিলারা আল্লাহর মাহবুব (ﷺ)-এর দর্শন লাভের অধির আগ্রহ ও উৎসাহ-উদ্দীপনার গান গাইতে গাইতে রাস্তায় বের হয়ে এসেছিল।
طلع البدر علينَا ٭ من ثنيات الوداع
وجب الشكر علينَا ٭ ما دعىٰ للهِ داع
‘সানইয়াতুল বিদা’ হতে আমাদের ওপর পূর্ণিমার চাঁদ উদিত হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত প্রার্থনাকারী প্রার্থনা করতে থাকবে আমাদের ওপর ওয়াজিব তাঁর প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করা।’ (অর্থাৎ কিয়ামত পর্যন্ত)
বনু নাজ্জার গোত্রের ছোট ছোট মেয়েরা মদিনার অলি-গলিতে আনন্দ সংগীত পরিবেশনে নিমগ্ন ছিলেন।
نحن جوار من بنى النجار ٭ يا حبذًا محمد من جار
‘আমরা বনু নাজ্জার গোত্রের প্রতিবেশীরা কতই না ভাগ্যবান, মুহাম্মদ হলেন আমাদের প্রতিবেশী।’