হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বর্ণণা করেন রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা এই উম্মতের জন্য প্রতি শতাব্দীর শুরুতে এমন ব্যক্তিকে প্রেরণ করেন যিনি এ দ্বীনকে (ইসলাম) নতুনভাবে সংস্কার সাধন করেন। – [সুনানে আবু দাউদঃ হাদীস নং ৪২৯১, হাকেমঃ হাদীস নং ৮৫৯২, তিবরানীঃ হাদীস নং ৬৫২৭]
• মুজাদ্দিদের মমার্থঃ
মুজাদ্দিদের অর্থ সংস্কারক, তাজদ্বীন ক্রিয়ামূল। অর্থ নতুন সৃষ্টি করা। শরয়ী পরিভাষায় দ্বীনি বিষয়ে পুনরুজ্জীবন পুনর্গঠন ও সংস্কার সাধন করা। যে সংস্কার কর্মে দ্বীনি কল্যাণ নিহিত রয়েছে। দ্বীনি সংস্কার কর্ম যিনি সম্পাদন করেন ইসলামী পরিভাষায় তিনি মুজাদ্দিদ উপাধিতে ভূষিত।
• মুজাদ্দিদের গুণাবলীঃ
১/ উম্মতে মুহাম্মদীর সামগ্রিক কল্যাণকামী হওয়া।
২/ ইসলামী বিধান প্রয়োগে নিবেদিত প্রাণ হওয়া।
৩/ আত্মোত্সর্গে সর্বাবস্হায় অকৃপণ হওয়া ক্ষেত্রে বিশেষে কঠোর ও উদার হওয়া।
৪/ দ্বীনি শিক্ষার প্রবর্তন ও বিস্তৃতকরণ, জাতির সঠিক পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করা।
৫/ সত্কাজের আদেশ ও অসত্কাজের নিষেধে বাস্তব নমুনা হওয়া।
শর্তাবলীঃ
১/ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বিদায় বিশ্বাসী হওয়া ও সমসাময়িক সকল বাতিল সম্প্রদায়ের বিরোধিতায় অগ্রগামী হওয়া।
২/ কোরআন সুন্নাহর সঠিক জ্ঞান, দ্বীনি জ্ঞানে বিজ্ঞ হওয়া ও বৈষয়িক জ্ঞানে পারদর্শী হওয়া।
৩/ শরিয়ত তরিকতের পূর্ণ পাবন্দ হওয়া।
৪/ কোন প্রকার ভয়ভীতি ও সমালোচনার তোয়াক্কা না করা।
৫/ কোরআন সুন্নাহ ও শরিয়ত তরিকত বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদী ও এর মূলোত্পাটনে সর্বশক্তি নিয়োগে সচেষ্ট থাকা।
৬/ দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করা।
৭/ আহলে সুন্নাতের মতাদর্শী সমসাময়িক কালের প্রসিদ্ধ আলেমগণ দ্বীনি কর্মে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা দেখে মুজাদ্দিদের স্বীকৃতি দেয়া।
৮/ জাহেরী বাতেনী জ্ঞানের অধিকারী হওয়া।
আল্লামা হক্বী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহী) ‘র বর্ণনানুযায়ী মুজাদ্দিদের আগমন এক শতাব্দির সমাপ্তিলগ্নে দ্বিতীয় শতাব্দীর শুরুতে হওয়া আবশ্যক। আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহীও) তার প্রণীত “মিরকাতুস সাউদ শরহে সুনানে আবু দাউদ” গ্রন্হে একথা উল্লেখ করেন। যার বাস্তবতা শতাব্দীর মুজাদ্দিদগণের দ্বীনি খিদমত ও সংস্কার কর্ম বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। উপরিউক্ত হাদীসের আলোকে বিগত চৌদ্দশত বত্সরে আগত শতাব্দির সম্মানিত মুজাদ্দিদগণের তাজদ্বীদি কর্ম উল্লেখসহ নামের তালিকা উল্লেখ হলো।
• প্রথমঃ হিজরী প্রথম শতাব্দির মুজাদ্দিদঃ হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহী) যিনি ইতিহাসে খোলাফায়ে রাশেদার পঞ্চম খলিফা হিসেবে পরিচিত। যিনি পথভ্রষ্ট খারিজী সম্প্রদায়ের চক্রান্ত মূলোত্পাঠন করে ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করেন। তাঁর জন্ম ১৯ হিজরীতে, ওফাত ১১২ হিজরীতে। তিনি তার শতাব্দীর ১২ বত্সর পান। ,,,
• দ্বিতীয়ঃ হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দির মুজাদ্দিদঃ হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রাহমাতুল্লাহি আলাইহী) । তার বয়স ৭০ বত্সর, ২৩০ হিজরীতে ইন্তেকাল। তিনি মুতাজিলা সম্প্রদায়ের গোমরাহী থেকে মুসলমানদেরকে রক্ষা করেন। খলকে কোরআন তথা কোরআন সৃষ্ট বিষয়ক ভ্রান্ত আকিদা বিশ্বাস থেকে মুসলিম উম্মাহর ঈমান হেফাজত করেন।
• তৃতীয়ঃ তৃতীয় শতাব্দির মুজাদ্দেদঃ ইমাম আহমদ নাসায়ী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহী) যিনি জহমিয়া নামক বাতিল ফিরকার ভ্রান্ত আকিদার মূলোত্পাঠন করেন। জন্ম ২৭০ হিঃ, ইন্তেকাল ৩৪০ হিঃ। জহমিয়া ফিরকার উল্লেখযোগ্য আকিদা হলো- ১. কবরের আযাব বলতে কিছু নেই। ২. নাউযুবিল্লাহ! সৃষ্টিকর্তা দুইজন, একজন ভাল কাজের স্রষ্ট্র, অন্যজন মন্দকাজের স্রষ্টা। এ জগন্য কুফরী আকিদা সত্যেও তারা নিজেদেরকে মুসলমান দাবি করতো।
• চতুর্থ: চুতুর্থ শতাব্দীর মুজাদ্দিদঃ হযরত ইমাম বায়হাকী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহী) এবং হযরত ইমাম বাকিল্লানী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহী) এ দুইজন বুজুর্গ সমসাময়িক। এরা তৃতীয় শতাব্দীর ২০ বত্সর ২৪ বত্সর পেয়েছেন। উপরন্ত্ত চতুর্থ শতাব্দীর ৪২ বত্সর এবং ৫৫ বতসর পেয়েছেন। তাঁরা রাফেজী সম্প্রদায়ের কুফরী আকিদা থেকে মুসলিম মিল্লাতকে রক্ষা করেন। তেহরান ও লেবাননে ইসলামী সংস্কার আন্দোলন জোরদার করেন এবং ইসলামী পতাকা উড্ডীন করেন।
• পঞ্চম: বড়পীর হযরত গাউছুল আজম আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) ( জন্ম ৪৭১ ইন্তেকাল ৫৬২) হিজরী। তিনি পঞ্চম শতাব্দির মুজাদ্দেদঃ ইমাম মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ গাজ্জালী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহী) যিনি কদরিয়া ফিরকার বাতিল আকিদা থেক মুসলমানদের ঈমান রক্ষা করেন। জন্ম ৪৭০ হিঃ, ওফাত ৫৬০ হিজরী।
• ষষ্ঠ: ষষ্ট শতাব্দীর মুজাদ্দেদঃ হযরত খাজা মঈনউদ্দীন চিশতি আজমীরি (রহ:) (জন্ম ৫৩৬- ইন্তেকাল৬৩৩) হিজরি। তিনি ভারত বর্ষে প্রথম ইসলাম প্রচারক । ইমাম ফখরুদ্দীন রাযি (রাহমাতুল্লাহি আলাইহী), যিনি জহমিয়া ফিরকা এবং গ্রীক দর্শনের প্রভাব থেকে মুসলিম জাতিকে রক্ষা করেন। পৃথিবী শাশ্বস চিরন্তন হওয়া সম্পর্কিত ভ্রান্ত আকিদা বিষয়ক চিন্তাধারা খণ্ড়ন করেন। ইসলামী দর্শনের আলোকে পৃথিবী ধ্বংশীল হওয়া প্রমাণ করেন। ইসলামী আকিদার আলোকে গ্রীক দর্শনের অসারতা খণ্ড়ন করেন।
• সপ্তম: সপ্তম শতাব্দীর মুজাদ্দিদঃ ইমাম তকিউদ্দীন ইবনে দকীক আবদী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহী) । জন্ম ৬৭৫ হিঃ ইন্তেকাল ৭৭০ হিঃ। তিনি ভারত বর্ষের অনেক অঞ্চলে ইসলামের প্রচার ঘটান। তিনি সিরিয়া থেকে হিজরত করে ইসলাম প্রচারের জন্য ভারতে আগমন করেন।
• অষ্টম: অষ্টম শতাব্দীর মুজাদ্দিদঃ হাফেজ ইবনে হাযর আসকালানী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহী) । ওফাত ৮১৫ হিজরী। তিনি বাহায়ী ধর্মের তত্পরতার মূলোত্পাটন করেন। তিনি তাঁর শতাব্দির ১৫ বত্সর পেয়েছেন।
• নবম: নবম শতাব্দীর মুজাদ্দিদঃ ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ুতী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহী) তিনিও গ্রীক দর্শনের বিস্তৃত প্রভাব থেকে উপরন্ত্ত নাস্তিকতা ও খোদাদ্রোহীতার বহুমূখী চক্রান্ত প্রতিহত করেন। মুসলমানদের ঈমান আকিদা রক্ষা করেন। আবু দাউদ শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্হ অউনুল মাবুদ শরহে আবু দাউদ নামক কিতাবের ১৮১ পৃষ্ঠায় এ পর্যন্ত তালিক লিপিবদ্ধ হয়েছে।
• দশম: দশম শতাব্দীর মুজাদ্দিদঃ মোল্লা আলী ক্বারী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহী)। যিনি বাদশাহ আকবরের দ্বীনে এলাহীর সিংহাসন নিশ্চিহ্ন করেন।
• একাদশ: একাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদঃ হযরত মুজাদ্দেদে আল ফেসানি শেখ আহমদ ফারুকী সেরহিন্দি (রাহমাতুল্লাহি আলাইহী) । জন্ম ৯৭১ হিঃ, ওফাত ১০৩৪ হিজরী। যিনি বাদশাহ জাহাঙ্গীরের কুফরী শাসন ব্যবস্হার তীব্র বিরোধিতা করেন।
• দ্বাদশ: দ্বাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদঃ ইমাম মহিউদ্দীন আওরঙ্গজেব শাহেনশাহে হিন্দ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহী) । তাঁর গোটা জীবন নাস্তিক মুরতাদ খোদাদ্রোহী অপশক্তির মোকাবিলায় অতিবাহিত করেন। জন্ম ১০২৮ হিঃ, ওফাত ১১১৭ হিজরী।
• ত্রয়োদশ: ত্রয়োদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদঃ হযরত শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিস দেহলভী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহী)। জন্ম ১১৫৯ হিজরী, ওফাত ১২৩৯ হিজরী। তিনি ইলমে হাদিসের প্রচার প্রসার ঘটান, খোদাদ্রোহী কুফরী শক্তির মূলোত্পাটন করেন।
• চতুর্দশ: চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদঃ আ’লা হযরত শাহ আহমদ রেযা খান ফাযেলে বেরলভী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহী) । জন্ম ১২৭২ হিজরী, ওফাত ১৩৪০ হিজরী। তিনি ত্রয়োদশ শতাব্দীর ২৮ বত্সর ২ মাস ২০ দিন পেয়েছেন এবং চতুর্দশ শতাব্দীর ৩৯ বত্সর ১ মাস ২৫ দিন পেয়েছেন। মুজাদ্দিদের মহান গুণাবলী ও শর্তাবলী তার সত্তায় পূর্ণমাত্রায় সন্নিবেশিত হয়েছে। তাঁর তাজদ্বীদে দ্বীনের খিদমত সমূহ আরব- অনারব সহ বিশ্বের খ্যাতিমান শীর্ষ ওলামা মাশায়েখ কর্তৃক স্বীকৃত। তিনি আজীবন ইসলামের মূলধারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অবিকৃত রূপরেখার আলোকে মুসলিম মিল্লাতকে সঠিক পথের দিশা দেন। পক্ষান্তরে ইসলাম নামধারী ওহাবী- নাজদী, খারেজী, রাফেজী, শিয়া ও কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের কুফরী আকিদা সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক করেন। আরব বিশ্বের বিখ্যাত আলেমেদ্বীন শায়খুল আরব ওয়াল আজম আল্লামা সৈয়্যদ ইসমাঈল বিন খলীল আ’লা হযরত প্রণীত হুস্সামুল হারামাঈন গ্রন্হে ১৩২৪ হিজরিতে প্রদত্ত এক অভিমতে নিম্মোক্ত মন্তব্য করেন- বরং আমি বলছি তাঁর ব্যাপারে (ইমাম আহমদ রেযা) যদি বলা হয়। তিনি এ যুগের মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক তা অবশ্যই বাস্তব এবং সত্য।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে এসব তাৎপর্যপূর্ণ ইসলামী পরিভাষার অপপ্রয়োগ ও ব্যাপকহারে অপব্যবহার করা হচ্ছে। আজকে অজ্ঞ ও মূর্খকেও মুজাদ্দিদে জমান, মুজাদ্দিদে দ্বীনো মিল্লাত, মুজাদ্দিদে ইসলাম ইত্যাদি বিশেষণে আখ্যায়িত করতে দেখা যায়। অথচ যাদেরকে পীরে কামেল, মুজাদ্দিদে জমান উপাধীতে ভূষিত করা হচ্ছে তারা উপরোক্ত গুণাবলীর অধিকারী হওয়ার কথা দূরে থাক, বাস্তবিক অর্থে ইসলামী শরীয়তে পারদর্শী আলেমেদ্বীন কিনা তাও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আর এসব উপাধিধারী ভণ্ড় প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে প্রতিনিয়ত সাধারণ মুসলমানা বিভ্রান্ত হচ্ছে। এদের কর্মকাণ্ড়ের কারণে সত্যিকার নায়েবেনবী, পীরে কামেল, মুজাদদিদে জমানদের ব্যাপারে সররপ্রাণ মুসলমানদের অন্তরে নানাবিধ সৃষ্টি হচ্ছে। ভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ মুসলিম মিল্লাতের এ নাজুক সন্ধিক্ষণে ঈমান আকিদা সংক্ষণে উপরিউক্ত গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যাবলীর আলোকে মুজাদ্দিদে দ্বীনের সঠিক পরিচয় জানা ও তদানু আমল করা নিতান্ত অপরিহার্য।
সূত্রঃ মাসিক তরজুমান, সফর সংখ্যা ১৪৩৬ হিজরী।