আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। ভারত উপমহাদেশের এই স্বাধীন দেশটির শতকরা নব্বই জনই আজ মুসলমান। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয় (১২০১খ্রি:) এর অনেক আগে থেকেই এখানে পীর-আউলিয়াদের আগমন হয়েছে এবং ইসলামের দাওয়াতী কাজ শুরু হয়েছিল। তবে, বঙ্গবিজয় এতে এনে দেয় চুড়ান্ত সফলতা। যা, প্রমাণ করে যে, বখতিয়ারের তলোয়ার নয়, বরং পীর-আউলিয়া-সুফি দরবেশের আধ্যাত্মিক শক্তি ও ইসলামের অন্তর্নিহিত সামাজিক সাম্য উদারতা ও শান্তির বাণী স্থানীয় বৌদ্ধ-হিন্দু ও অন্যান্য অমুসলিমদের ইসলামের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিল। বখতিয়ার খিলজি মাত্র ষোলজন ঘোরসেনা নিয়ে বঙ্গবিজয় করেছিল। লক্ষণসেন তাঁর আগমনের সংবাদ পেয়েই ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। বিনাযুদ্ধেই বাংলা দখল হয় মুসলমানদের হাতে। লক্ষণসেন প্রতিরোধের কোন চেষ্টা করতে সাহস না পাওয়ার কারণ আজ সকলেরই জানা আছে। আর সেটা হলো-
১. ইসলামের অপ্রতিরোধ্য আধ্যাত্মিক শক্তির ধারক আউলিয়া কেরামের নেতৃত্বের ধারাবাহিক সফলতা ও বিজয়ের সংবাদে আগে থেকেই আতঙ্কিত ছিল লক্ষণসেন। এর আগেই দুর্ভেদ্য আজমীর দখল হয়ে যায় মুসলমানদের।
২. ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন শাসকের অসাম্য, শ্রেণী-বর্ণের সামাজিক বিভাজন ও জুলুমে নিস্পেষিত হিন্দু জনগণের অনাস্থা ও অসহযোগিতার আশংকা।
৩. যেহেতু, এ অঞ্চলে পীর-আউলিয়ারা আরো কয়েকশ বছর ধরে ইসলামের বাণী প্রচার করে আসছিলো, তাই স্থানীয় মজলুম হিন্দু এবং বৌদ্ধরা স্বধর্মের চেয়েও ইসলামকে সর্বজনীন গতিশীল সাম্য-মৈত্রীর ধর্ম হিসেবে ইতোমধ্যেই গ্রহণ করে নিয়ে একটি বিপ্লব ঘটানোর অপেক্ষায় প্রহর গুনছিল- আর অপেক্ষার রাত পোহাল বখতিয়ার খিলজির আগমনের সংবাদে। যা ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজা লক্ষণ সেনের টের না পাওয়ার কোন কারণ ছিলনা। মোট কথা, মুসলমানদের রাজনৈতিক বিজয়ের অনেক আগেই সূফি দরবেশের প্রভাবে চট্রগাম থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেকাংশেই ইসলামের সামাজিক বিজয় সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল- যা রাজা লক্ষণ সেনের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। তিনি বিদ্রোহী হিন্দুদের রোষানলে পতিত হবার আশংকা থেকে মুক্ত ছিলেন না। তাই, এতো সহজে রণে ভঙ্গ দিয়ে বখতিয়ার খিলজিকে দেশ ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে বাঁচেন তিনি।
উল্লেখ্য, এদেশটিতে হাজার বছর ধরে ইতোপূর্বে যারা শাসন করেছে এবং যে সব ধর্ম-জাতি সম্প্রদায়ের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিরাজিত ছিল তাতেও পরধর্ম সহিষ্ণুতা বা বিজাতীয়দের সহ্য করে নেওয়ার মতো মানসিকতা বা আচরণ কখনো দেখা যেতো না। আর্যরা এসে দ্রাবিড়দের অস্তিত্ব বিপন্ন করে দিয়েছিল। হিন্দু-ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকের সময়ে বৌদ্ধদের দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল-যা লক্ষণ সেনের সময়ে ছিল আরো বেশি তীব্রতর। ‘বৌদ্ধদের বহুসংখ্যক ব্রহ্মণ্যবাদীদের হাতে প্রাণ হারায় এবং কিছু সংখ্যক পন্ডিত যথাসম্ভব তাদের ধর্ম গ্রন্থাদি নিয়ে নেপাল, তিব্বত ইত্যাদি দুর্গম এলাকায় গিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন। আর হীনযান- মহাযান নাথপন্থীরা যারা যেতে পারেননি তাঁরা তাদের বশ্যতা স্বীকার করে কোন মতে আত্মরক্ষা করেন।’ ১. ব্রাহ্মণ্যবাদীরা নিজেদের ছাড়া বাকি সকল মানুষকে নিন্ম জাত দাবী করে ঘৃণা করতো এবং অমানবিক নির্যাতন চালাতো। তারা এদেশের স্থানীয় বাঙ্গালিদের অসভ্য, অস্পৃশ্য, স্লেচ্ছ বলতো এবং শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে নিজেদের জাত্যাভিমানের প্রকাশ ঘটাতো। এ সম্পর্কে ডঃ নীহার রঞ্জন রায় বলেন, একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দিতে এসে দেখি ‘অসভ্য বঙ্গালদের মানুষ করার জন্য কনোজ থেকে পাঁচজন ব্রাহ্মণ এনে এদেশে ব্রাহ্মণ সভ্যতার রক্ত বিস্তারের সুযোগ গ্রহণ করা হয়। ‘ষান্ড্যন্যায়ের মাধ্যমে’ এদেশে কৌলিন্য প্রথার চালু হয়।’-২
আর্য-ব্রাহ্মণ মানুষকে নিজেদের দুবিধামত চার শ্রেণীতে বিভক্ত করে নিয়েছিল- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র। এই চতুর্থ শ্রেণীর মানুষ শুদ্রদের পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট গণ্যকরা হতো। “আর তথাকথিত স্থানীয় ‘দাস’ ‘শূদ্র’ ও ‘অন্ত্যজ’- এক কথায় ‘অনার্য’ শ্রেণীর জীবন ছিল বিড়ম্বিত। ব্রাহ্মণরা তাদের পৌরোহিত্য পর্যন্ত করতনা। তাদের অন্ন গ্রহণ ছিল ব্রাহ্মণদের জন্য নিষিদ্ধ। এ বিধান অমান্য করলে ব্রাহ্মণদের প্রায়শ্চিত্য করতে হতো। অনার্যরা ছিল অস্পৃশ্য। তাদের ছায়া মাড়ালে ও পবিত্র হওয়ার জন্য ব্রাহ্মণদের ¯ স্নান করতে হতো। তাদের চেষ্টায় কঠোর শাস্ত্রীয় অনুশাসন শূদ্রদের চেয়ে নীচ আরো কয়েকটি অন্ত্যজ শ্রেণীর উদ্ভব ঘটেছিল। এদের শূদ্রের চেয়েও নিকৃষ্ট মনে করা হতো। তাদেরকে মাণুষই মনে করা হতো না। তাদের জীবন ছিল পশুর চেয়েও অধম। এই চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর অথার্ৎ শূদ্র ও তার নীচ শ্রেণীর লোকেরা লোকালয়ের বাইরে হীন জীবন-যাপন করতে বাধ্য হতো। কোনক্রমে পথ অতিক্রম কালে অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজের অজ্ঞাতসারে যদি শাস্ত্র বাণী শুনে ফেলত, তবে তাদের ‘কর্ণকুহরে’ গলিত শীসা ঢেলে দিয়ে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা ছিলো। স্বঘোষিত কিছু সংখ্যক উচ্চ বর্ণীয় হিন্দু ছাড়া বাকি সব হিন্দু-বৌদ্ধদের উপর আর্য-ব্রাহ্মণ-সেনদের নির্যাতনের কাহিনী এখনো বাংলা সাহিত্যে পাতায়-পাতায় স্বাক্ষী হয়ে আছে।
এই প্রসঙ্গে ড: আরবিন্দ পোদ্দার বলেন, ‘সুতরা হিন্দু সমাজের বিধানদাতাদের নিকট থেকে যারা শুধু উৎপীড়ন ছাড়া আর কিছুই লাভ করেনি; সূফি সাধক ও পীর- দরবেশগণ তাদের দিলেন মুক্ত মানুষের অধিকার, শুধু তাই নয়, তারা ব্রাহ্মণদের উপরেও প্রভুত্ব করার ক্ষমতা দিলেন । সামাজিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে এই উদারতা এবং সমানাধিকারের আদর্শ ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান।’
পীর-আউলিয়াদের আগমনের ফলেই এদেশে নির্যাতিত অবহেলিত মানুষ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা লাভ করলো। তারা নিজেদের মানুষের মত মানুষ হিসেবে রুপান্তরিত করার সাহস সঞ্চয় করতে সক্ষম হলো। ড: গোলাম সাকলায়েন বলেন, এদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ সমাজ মননে ও চিন্তায় মুসলিম সূফী-সাধক-পীর দরবেশদের নিকট এমন অনাড়ম্বর সহজ, সরল জীবনাচরণের আদর্শ লাভ করল যা তাদের কাছে সম্পূর্ণ অভিনব এবং বিস্ময়কর। প্রকৃত প্রস্তাবেমুসলিম পীর- ফকিরগণ ইসলামের মহিমা ও ঐশ্বর্য অনাড়ম্বরভাবে তুলে ধরার এবং জনসাধারণের ব্যাথা-বেদনা ও বিষাদের অংশ নিজেরা বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করায়, বাংলাদেশে হাজার হাজার মানুষ অসংকোচে ইসলাম বরণ করে; ফলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক নতুন সমাজ ব্যবস্থার পত্তন হয়।৫ ইতোপূর্বে ব্রাহ্মণ্যধর্ম সকল মানুসের ধর্ম হয়ে উঠতে সেখানে ব্যর্থ হয়েছিল, সেখানে ইসলাম হয়ে উঠে সর্বজনীন। সমগ্র সৃষ্টিকুলের কল্যাণের বার্তা নিয়েই ইসলামের আগমন হয়েছে। স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে বলা হয়েছে- সমগ্র সৃষ্টির কল্যাণ’ – ‘ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতাল্লিল আলামীন’ (আল কুরআন)। যার সত্যতা বাস্তবায়িত হয় এই বাংলা-ভারত উপমহাদেশে সূফী দরবেশদের আগমনের ফলে। গোপাল হালদার বলেন- “ইসলামে নেই পুরোহিততন্ত্রের ও জাতিভেদের স্থান ……. ইসলাম দেশগত বা জাতিগত ধর্ম নয়, সকল মানুষের একমাত্র ধর্ম হবার অধিকার রাখে। ইসলাম প্রচারশীল ধর্ম। উহা অন্যকে জয় করেই ক্ষান্ত হয়না, কোলেও টেনে নেয়। তাই ইসলামের বিজাতীয় ও বিজেতা প্রচারকের দল ভারত বর্ষের অমুসলমান জনসাধারণকে বিন্দুমাত্রও ঘৃণা করল না। তাই, স্থানীয় মানুষদের কাছে পীর আউলিয়ার আগমন ছিল ত্রাণকর্তা রূপে-ঈর্শ্বর কর্তৃক প্রেরিত যারা তাদের কে আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুতন্ত্রের নির্যাতন থেকে রক্ষা করেছিল। গোপাল হালদার বলেন, ‘বৌদ্ধদের প্রতি ব্রাহ্মণেরা অত্যাচার করাতে নিরঞ্জন রুষ্ট হয়ে ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে দেবতাদের নিয়োজিত করলেন; দেবতারা এলেন মুসলামনরূপে।
শুধু বৌদ্ধরা নয়-অন্যান্য সকল তথাকথিত নিন্ম জাতের হিন্দুরাও মুসলমানদের দেবতারূপেই পেয়েছিল এব্ং তাদের আশ্রয়ে ইসলামের ছায়াতলে এসে ইহ ও পর জীবন ধন্য করার সুযোগ সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে শুরু করেছিল। আর এমন এক পরিস্থিতিতেই খিলজির আগমনী সংবাদের অত্যাচারী লক্ষণ সেনের পলায়ন ছাড়া অন্য কোন গত্যন্তর আর বাকি থাকলোনা। যা হোক বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয় পরবর্তিকালে নির্বিঘ্নভাবে এবং ব্যাপকভাবে পীর- আউলিয়া ইসলাম প্রচারক ও মুয়াল্লিমগণ এখানে আগমন করে জনগণের প্রতীক্ষিত এবং কাঙ্খিত সুযোগের সদ্ধ্যবহারের ব্যবস্থা করা হয় এবং তারা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে এই অঞ্চলকে মুসলিম অধ্যুষিত এবং গুরুত্বপূর্ণ জনপদে উন্নীত করে দেয় বলে আজ বাংলাদেশে’র অধিকাংশ মানুষই মুসলামান দাবীদার। তবে বঙ্গবিজয়ের পরে আগত সূফীগণের আগমনের ধারা ইসলাম প্রচারের দ্বিতীয় পর্যায় হিসেবেই বিচেতি হয়েছে ইসলামের ইতিহাসে। যারা আরো শত শত বছর আগে থেকে প্রতিকুল পরিবেশে এই জুলুমের সমাজে শান্তির বাণী নিয়ে এসে মুসলমানদের হাতে বঙ্গবিজয়ের সুফল তুলে দিয়েছিলেন, তাদেরকে প্রথম পর্যায়ের ইসলাম প্রচারক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যাঁদের আগমন ঘটে ইসলামের সেই প্রথম যুগেই। যদিওবা এই সময়ে আগত আহলে বাইত (নবী বংশ) এবং পীর-আউলিয়ার নাম ঠিকানা বা বিস্তারিত কোথাও তেমনটা সংরক্ষিত না পাওয়ায় ইতিহাসে তাদের পরিচিত খুব একটা নেই, যদিওবা তাদের আগমনের অনেক মূল্যবান নিদর্শন ও চিহ্ন আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে আজো বিদ্যমান, এবং মাঝে মাঝে প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের ফলে উম্মেচিত হচ্ছে।
ডঃ মুহাম্মদ এনামুল হক, পূর্ব পাকিস্তানে ইসলাম গ্রন্থের ১০ পৃষ্ঠায় বলেন, ‘রাজশাহী জেলার অন্তর্গত পাহাড়পুরের বৌদ্ধ বিহারের (প্রকৃত নাম সোমপুর বিহার) ধ্বংসস্তুপে আবিষ্কৃত একটি প্রাচীন আরবী মুদ্রা পাওয়া যায়। এই মুদ্রাটি আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশিদ (৭৮৬-৮০৯ খ্রি.) এর শাসনামলে ৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে (১৭২ হিজরি) আল মুহাম্মদীয়া টাকশালে মুদ্রিত হয়েছিল।” তাছাড়া, ড: গোলাম সাকলায়েন তাঁর বাংলাদেশের সূফী সাধক গ্রন্থে বলেন, ‘সম্প্রতি কুড়িগ্রাম জেলায় এমন একটি মসজিদ আবিষ্কৃত হয়েছে যা সপ্তম শতাব্দিতে (৬৮৯ খ্রিষ্টাব্দে) তৈরি করা হয়েছিল। তিনি দৈনিক বাংলা, ২৩ এপ্রিল বুধবার ১৯৮৬ সংখ্যার সংবাদ তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে জানান যে, এই মসজিদটির ধ্বংসাবশেষের গম্বুজ থেকে প্রাপ্ত ইটগুলোতে নানা প্রকার ফুল, নকশা ও আরবী হরফে কলেমা তাইয়্যেবা সহ হিজরী ৬৯ সন লেখা আছে।
উক্ত দুই তথ্য প্রমাণ করে যে, এই বাংলাদেশে ইসলাম আগমনের বয়স তেরশ বছরেরও বেশি। অথচ বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয় হয়েছে আটশ বছরের মতো মাত্র। অথার্ৎ আরো পাঁচশ বছর আগে থেকে এখানে পীর-আউলিয়া-দরবেশ ও নবী-বংশধরদের আগমন ঘটেছে। তাঁরা এখানে ইসলাম প্রচার ও ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন, এবং অনেকেই পরবর্তি সময়ে ঘর-সংসার পেতে স্থায়ী ভাবে বসবাস করেছেন- বিশেষত: বঙ্গবিজয়ের পরে অনুকুল পরিবেশে। হিজরি ৬৯ সনের উক্ত মসজিদ নির্মিত হবার অব্যবহিত পূর্বেই এখানে ইসলাম প্রচারে বুজুর্গ ব্যক্তিদের আগমন ঘটতে পারে। আগে ইসলামের প্রচার এরপর নবদীক্ষিত মুসলমানদের ইবাদতের জন্য মসজিদ নির্মিত হওয়াটা স্বাভাবিক। আমরা জানি, ৬১ হিজরির ১০ মুহরম কারবালায় শহীদ হন ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সহ আহলে বায়ত এবং তাঁদের সঙ্গী-সাথী ঈমানদার-মুজাহিদগণ। এজিদ এবং তার পরবর্তি উত্তরসূরি শাসকগণের হাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের বংশধরগণ এবং তাঁদের সমর্থকগণের জান-মাল নিরাপদ ছিল না বিধায় তাঁরা মদীনা মুনাওয়ারা থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েন এবং সেখানে ইসলাম প্রচারে লেগে যান। এটা অসম্ভব নয় যে, ৬১ হিজরির কারবালার পরে মাতৃভূমি ত্যাগকারী উক্ত শা’নদার বুজুর্গ ব্যক্তিদের কোন কাফেলা এই অঞ্চলে এসে ইসলাম প্রচার ও মসজিদ নির্মাণ করেছেন। তাছাড়া হাদীস শরীফে হিন্দুস্থান বিজয়ীদের জন্য সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে- যা কার্যকরণের তৎপরতা সাহাবাদের যুগ থেকেই শুরু হওয়া অস্বাভাবিক নয়। হযরত সাওবান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীস শরীফে আছে, রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যে, “আসাবাতানি মিন উম্মতি আখরাজাহুল্লাহু মিনান্নারি আসাবাতুন তাগযুল হিন্দ ওয়া আসাবাতুন তাকুনুমাক’আ ঈসা ইবন মারয়ামা আলায়হিস্ সালাম।” অথার্ৎ ‘আমার উম্মতের মধ্যে দুইটি সেনাদলকে আল্লাহ্ পাক জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেবেন, তার মধ্যে একটি হলো হিন্দ (হিন্দুস্থান) অভিযানকারী সেনাদল আর অপরটি হলো ঈসা আলায়হিস্ সালাম এর সহযোগি সেনারা।’ উক্ত ঘোষণা অনুসরণকারী সাহাবা তাবেয়ীদের কাফেলার ভারত (হিন্দ) অভিযান’র ফসলও হতে পারে এই মসজিদ। যেভাবে হোন না কেন, যে সব পরবর্তি ইসলাম প্রচারকদের কল্যাণে সেই প্রথম যুগেই আমরা ইসলাম পেয়েছি- তাদের নাম ‘আউলিয়া’। এই আউলিয়া তাবেয়ী-তবেতাবেয়ীও হতে পারেন- এমনকি সাহাবীও। ড: কাজী দীন মুহাম্মদ তাঁর ‘বাংলাদেশে ইসলামের আবির্ভাবও ক্রমবিকাশ’ এ বলেন হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর খেলাফতকালে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারকরা এসেছিলেন। তিনি আরো বলেন-‘আরব বণিক ও প্রচারকদের চেষ্টায় হিজরি প্রথম শতকেই (খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দি) ভারতের পশ্চিম ও দক্ষিণ উপকুলীয় অথার্ৎ বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় বন্দর সমূহে ইসলামী ভাবধারার আমদানী হয়।
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারক আউলিয়া-দরবেশদের আগমন সমুদ্রপথে হয়েছে বেশি। তই চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের কল্যাণে এ অঞ্চলে ইসলামের আবির্ভাব আদি যুগেই হয়েছে। এখানে আরব জাতির আগমনের সাক্ষী হয়ে আছে চট্টগ্রামের মানুষ। যাদের মুখের ভাষার (উপভাষা) অধিকাংশ আরবী শব্দজাত। চট্টগ্রামের অনেক জায়গার নামই আরবী শব্দ। এমনকি এখানকার মানুষের নৃতাত্ত্বিক গঠনেও আরবীয়দের সাথে মিল রয়েছে। এখানকার অনেকেই আরব বংশোদ্ভূত। আরব থেকে সে আদি যুগে আগত আউলিয়া-সূফীগণের অনেকেই এখানে বিয়ে-শাদী করে থেকে গেছেন- যাদের বংশধর মুসলমানদের হাতে নবাগত ইসলামের বাগান ধীরে ধীরে প্রসারতা ও দৃঢ়তা লাভ করেছে নিঃসন্দেহে। শুধু সমুদ্রপথে নয়, স্থলপথেও ইসলাম এসেছে এ দেশে। ‘স্থলপথে সাধারণত আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান, ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মাধ্যমে ভারতবর্ষে ইসলামের প্রবেশ ঘটে।” “মুহাম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু বিজয় (৭১২ খ্রি.) স্থলপথে ইসলামের প্রচার সহজ করে দেয়- যা সকলের জানা আছে। অষ্টম শতাব্দির মধ্যে সিন্ধু ও পাঞ্জাবের বিভিন্ন এলাকায় মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে। ধর্মীয় ও সামাজিক দিক থেকে নির্যাতিত বহু বৌদ্ধ ও হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে”
সুতরাং হিজরি প্রথম শতকেই ইসলাম ভারতের মূলভূখন্ডে প্রবেশ ও প্রতিষ্ঠা লাভ করার প্রমাণ পাওয়া যায়। তাছাড়া, পরবর্তিতে সুলতান মাহমুদ গজনবী (৯৯৭-১০৩০ খ্রি.) সাতের বার ভারত অভিযান চালিয়ে- ইসলামের জন্য বড় এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন (এই মহাবীর ও বুজুর্গ ব্যক্তিত্ব)। অবশ্য, তাঁর সামরিক অভিযানের ধারাবাহিক সফলতার নেপথ্যে ছিলেন আধ্যাত্মিক ক্ষমতাধর পীর-দরবেশ ও আহলে বায়তগণ। যাদের একজন ছিলেন খাজা আবু মুজহাম্মদ চিশতী (ওফাত ৩০২ হিজরি)। তাছাড়া রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের ১২তম অধঃস্তন পুরুষ গাজী সৈয়্যদ মুহাম্মদ হোসাইনী গীসুদারাজ (ওফাত :৪২০/৪২১ হিজরি) এই সময় সুলতান মুহাম্মদ গজনবীর অনুরোধে তাঁর সেনাদের আধ্যাত্মিক ও জাগতিক শক্তির উৎস হয়ে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন এই অভিযানে। বিশেষত: পাঞ্জাব ও পেশওয়ারের হিন্দু শাসক জয়রাম (জয়পাল)’র বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে তিনি সরাসরি অংশ নেন বলে জানা যায়। “ সুলতান মাহমুদ ১০০১ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাব রাজ্যের বিরুদ্ধে দশ হাজার অশ্বারোহী বাহিনী সহ এক বিশাল বাহিনী নিয়ে পাঞ্জাবের পেশওয়ার অঞ্চলে অভিযান শুরু করেন। পাঞ্জাব রাজা (জয়রাম) এ অভিযান ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য অগ্রসর হন কিন্তু ব্যর্থ হয়ে গন্ডুগড় (এধহফমযধৎ) পার্বত্য অঞ্চলে বিতান্ডুা দুর্গে আশ্রয় নেন। সুলতান মাহমুদের বাহিনী এই পার্বত্য দুর্গ অবরোধ করেন। সুলতান মাহমুদের অশ্বারোহী বাহিনীর একজন প্রধান আহলে বায়ত (নবী বংশধর) সৈয়্যদ ওমরের পৌত্র সৈয়্যদ মুহাম্মদ গীসুদারাজ রাহমাতুল্লাহি আলায়হির ক্ষিপ্রতা ও কৌশল বিতান্ডুা দুর্গের পতন ঘটে। পাঞ্জাব রাজ জয়রাম ১৫ জন আমত্য ও অনুচর সহ বন্দি হন। সুলতান মাহমুদ সর্বদাই এই অশ্বারোহী বাহিনীর প্রধানের সাথে নম্রতা, বিনয় ও সম্ভ্রমের সাথে আরচণ করতেন। তিনি তাঁর আগে কখনো স্বীয় অর্শ্বে আরোহন করতেন না। গজনী ফিরে গিয়ে তিনি এই আহলে বায়তকে গজনীতে ফিরে যাওয়ার ও আমত্য পদ গ্রহণ করার অনুরোধ জানান।
হযরত সৈয়দ গীসুদারাজ সুলতান কর্তৃক প্রদত্ত সোলায়মান পার্বত্য অঞ্চল কোহে ‘সোলায়মান’ লাখেরাজ সম্পত্তি হিসাবে পেয়ে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। প্রসংঙ্গত, সৈয়্যদ মুহাম্মদ গেসুদারাজ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র পুত্র ইমাম জয়নুল আবেদীন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র ৯ম অধঃস্তন পুরুষ। তাঁর বংশধারা হলো ইমাম জয়নুল আবেদীন – ইমাম বাকের – ইমাম জাফর সাদেক – সৈয়দ ইসমাঈল – সৈয়দ রেজাল আল জালাল -সৈয়দ কায়েম (কায়েন)-সৈয়দ জাফর (আল মাজফ আলকা’ব) – সৈয়দ ওমর – সৈয়দ গফফার – সৈয়দ গাজী মুহাম্মদ হোসাইনী গেসুদারাজ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি।
উল্লেখ্য ইতোপূর্বে সবুক্তগীন ও গোরাসান বাহিনীর হাতেও পাঞ্জাবের হিন্দুরাজ জয়রাম পরাজিত হয়ে আত্মসর্মপণ করেন এবং সন্ধিপত্র করে রাজ্য ও আত্মরক্ষা করেন। আর মুসলমানদের এ জয়ের মূলে ছিলেন উক্ত সৈয়দ কা’ব (জাফর) এর দোয়া এবং তাঁর পুত্র ওমরের নেতৃত্ব। তাদেরই সুযোগ্য উত্তরসূরী সৈয়্যদ গেসুদারাজের হাতে পরবর্তীতে আফগান থেকে মূলতান পর্যন্ত বিশাল অঞ্চলে ইসলাম প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর পুত্র সৈয়্যদ মাসুদ মাসওয়ানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি একজন বিখ্যাত ইসলাম প্রচারক এবং তাঁর বংশধরগণ সমগ্র ভারত উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে ছড়িয়ে পড়েন এবং এই বংশে জন্ম নেন শত শত পীর-আউলিয়া যারা ইসলামের জন্য রাখেন বিশাল অবদান।
তারই ১১তম অধঃস্তন পুরুষ সৈয়্যদ গফুর শাহ্ ওরফে আল মারূফ কাপুর শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’ হাতে পরবর্তিতে বিজিত হয় সমগ্র ‘কোহে গঙ্গার’ বা গঙ্গর পার্বত্য অঞ্চল। পরবর্তীতে যার কেন্দ্র সিরিকোট হিসেবে পরিচিত লাভ করে। গফুর শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হিকে বলা হয় ফাতেহ সিরিকোট বা সিরিকোট বিজয়ী। আর সিরিকোট বিজয়ী গফুর শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র ১৪তম অধঃস্তন পুরুষ হলেন শাহেন শাহে সিরিকোট আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি (১৮৫৬-১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে) রাহমাতুল্লাহি আলায়হি যিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সফল ইসলাম প্রচারক ও প্রথম জামে মসজিদ (১৯১১ খ্রি:) নির্মাতা (১৫) এবং রেঙ্গুন (১৯২০-৪১ খ্রি.) ও চট্টগ্রাম সহ বাংলাদেশের নোয়াখালী, সিলেট, ঢাকা সহ বিভিন্ন অঞ্চলে কাদেরিয়া ত্বরিকা ও ইসলামের মূলধারা সুন্নিয়াতের প্রচার-প্রসারকারী। তিনি এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম ষোলশহরস্থ ‘জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসার (১৯৫৪ খ্রি.) প্রতিষ্ঠাকারী। তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরী ও সাহেবজাদা গাউসে জমান আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বাংলাদেশে কাদেরিয়া ত্বরিকার ব্যাপক প্রচলনকারী, ঢাকা মুহাম্মদপুরস্থ কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলীয়া মাদ্রাসা (১৯৬৮ খ্রি.) সহ অসংখ্য দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের জনক, বিশেষত বাংলাদেশে ১২ রবিউল আউয়াল তারিখের বহুল পরিচিত ‘জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম- এর প্রবর্তক ও রূপকার।
যা হোক, স্থলপথে ইসলাম আগমের যে কেন্দ্রের কথা ইতোপূর্বে বর্ণিত হয়েছে সে আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিমে সীমান্ত প্রদেশে ছিল হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ গেসুদারাজ (ওফাত ৪২১ হি.) যিনি গেসুদারাস আউলিয়া নামেও পরিচিত ছিলেন- তারঁই আবাদকৃত অঞ্চল। তিনি হযরত দাতা গঞ্জেবখশ আলী হাসবিরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র আগে এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন। এমনকি হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র ভারত আগম এবং আজমীর দখলের ঘটনা ছিল আরো প্রায় দুইশো বছর পরের কথা। এই বিজয়ের ইতিহাসে শেহাবুদ্দীন মুহাম্মদ ঘুরীর জাগতিক নেতৃত্ব (১১৯২ খ্রিস্টাব্দে) আলোচিত হয়ে থাকলেও মূলত নেপথ্যে ছিলেন অধ্যাত্মিক সম্রাট, সুলতানুল হিন্দ খাজা মঈনুদ্দীন হাসান চিশতি সানজরী রাহমাতুল্লাহী আলায়হি’র অবদান। ১১৯১ এ অনুষ্ঠিত তারাইনের প্রথম অভিযানে এই সুলতান শেহাবুদ্দীন মুহাম্মদ ঘুরী পরাজিত হয়েছিলেন। কিন্তু আজমির অধিপতি পৃথ্বিরাজের বাড়াবাড়ি চরম সীমা অতিক্রম হবার পরিপ্রেক্ষিতে খাজা গরীবে নওয়াজ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেছিলেন- ‘হে আজমীর অধিপতি (পৃথ্বিরাজ)! আমি তোমাকে জীবন্ত পাকড়াও করে মুসলিম সেনাপতির হাতে তুলে দিলাম। সেই রাতেই মুহাম্মদ ঘুরী স্বপ্নযোগে দিল্লী-আজমীর অভিযানের এক আধ্যাত্মিক নির্দেশ লাভ করেন এবং কালবিলম্ব না করে সে অভিযানে ঝাপিয়ে পড়ে বিজয় ছিনিয়ে আনেন এবং পরবর্তিতে তিনি আজমীর শরীফ গিয়ে খাজা সাহেব রাহমাতুল্লাহি আলায়হিকে দেখে বিস্ময়ভিভূত হয়েছিলেন এ জন্য যে এই ব্যক্তিকেই তো তিনি সেদিন স্বপ্ন নির্দেশ দিতে দেখেছিলেন।
উল্লেখ্য, সুলতান মাহমুদ গজনবী, শেহাবুদ্দনি মুহাম্মদ ঘুরী- তাঁরা শুধুমাত্র মুসলিম বিজয়ী বা সুলতান ছিলেন তা নয়- তারা সবাই ব্যক্তিগত জীবনে উন্নত চরিত্রের অধিকারী অধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব এবং বিজ্ঞ আলেমও ছিলেন। বিশেষত তাদের উত্তরসূরি শাসকগণের অনেকেই ছিলেন মহান বুজুর্গ ও সাধক ব্যক্তিত্ব। দিল্লী বিজয়ের পরের দুই শাসক কুতুব উদ্দীন আইবেক এবং শামসুদ্দীন আলতামাশ উভয়েই ছিলেন খাজা গরীব নওয়াজ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র প্রধান খলিফা হযরত কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র বিশিষ্ট মুরীদ এবং বুজুর্গ ব্যক্তিত্ব। আর তাদেরই একজন সামসায়িক এবং দলভুক্ত বখতিয়ার খিলজি বঙ্গবিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশকে নিয়ে আসেন ইসলামের অধিকারে। আর এদেশের ইসলাম বখতিয়ারের বিজয়ের ফলে লাভ করে নতুন জীবন ও যৌবন। তবে সেই হিজরি প্রথম শতক থেকে যে সব মহান বুজুর্গ এখানকার সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশে ইসলাম প্রচারে ব্রতী হন তাদের সঠিক পরিচয়, সংখ্যা কিংবা ইতিহাস কিছুই আজ সংরক্ষিত নেই বিধায় তারা আজ আমাদের আলোচনার বাইরে রয়ে গেছেন। শুধু এতোটুকু জানা যায়- ‘হিজরি প্রথম শতাব্দিতে (খ্রিস্টীয় সপ্তম) হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু-এর খেলাফতকালে কয়েকজন মুসলমান প্রচারক বাংলাদেশে আসেন।
হযরত মাহমুদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ও হযরত মুহায়মিন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন এ দলের নেতা। তারপর এদেশে ইসলাম প্রচার করতে আসেন যথাক্রমে হযরত হামেদুদ্দীন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ও হযরত হুমায়নুদ্দীন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, হযরত র্মুতাজা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, হযরত আব্দুল্লাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, হযরত আবু তালিব রাহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রমুখ। এভাবে একে একে পাঁচটি দল ইসলাম প্রচারের জন্য এদেশে আসেন। তাঁদের সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র বা কিতাব কিছুই থাকতো না। তাঁরা কোন রাজশক্তির সাহায্য গ্রহণের আশা করতেন না। তাদের প্রচার পদ্ধতির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো যে, তারা বাংলাদেশের চলিত ভাষার মাধ্যমে ইসলামের বাণী আখলাক, সালাত সিয়াম ও যাকাত ইত্যাদির কথা বলতেন এবং নিজেরা পালন করে তা দেখিয়ে দিতেন। এছাড়া বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের (১২০১-১২০৪) আগে দশম শতাব্দি থেকে দ্বাদশ শতাব্দি পর্যন্ত আগত আওলিয়া কেরামের মধ্যেও সবার বিষয়ে খুব একটা ইতিহাস পাওয়া যায় না। যাদের নাম পাওয়া যায়, তারা হলেন-
০১. হযরত শাহ্ সৈয়ধ সুলতান মাহমুদ ‘মাহী সাওয়ার,
০২. হযরত শাহ্ সৈয়দ সুলতান রুমি,
০৩. সৈয়্যদ শাহ্ সুরখুল আনতিয়াহ্
০৪. বাবা আদম শাহ্ শহীদ.
০৫. মাখদুম শাহ দৌলা শহীদ,
০৬. শায়খ জালালুদ্দীন তাবরিজি,
০৭. শাহ্ নিয়ামুতুল্লাহ বুতশিকন,
০৮. শাহ মাহমুদ রুপোশ ওরফে সৈয়্যদ সনদ শাহ্ দরবেশ,
০৯. বায়েজিদ বোস্তামী,
১০. ফরীদুদ্দীন শকর গঞ্জ,
১১. মাখদুম শাহ্ গজনবী ওরফে রাহী পীর (সাথে আরো ১৭ জন),
১২. সৈয়্যদ শাহ্ তাজুদ্দীন,
১৩. খাজা দ্বীন চিশতি,
১৪. শাহ্ হাজী আলী,
১৫. শাহ সিরাজুদ্দীন,
১৬. শাহ ফিরোজ,
১৭. পীর পাঞ্জাতন,
১৮. পীর ঘোড়া শহীদ (সঙ্গে আরো ১১ জন)।
এসব পীর-আউলিয়া স্থানীয় হিন্দু-বৌদ্ধদের মধ্যে ইসলামের মর্মকথা ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন। লোকজন তাদের দেখে, তাদের কথাগুলো আবার কখনো তাদের অত্যাশ্চর্য অলৌকিক কর্মকা- দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়ে তাদের প্রতি এবং ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। পীর আউলিয়াদের সাদাসিধে জীবনাচার, উদারতা ও সাম্য শান্তির বাণী এবং এর সাথে তাদের জীবন ধারার সাদৃশ্য দেখে ও স্থানীয় অমুসলিমরা ইসলামের অর্ন্তনিহিত সর্বজনীন ক্ষমতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। কখনো-কখনো এসব পীর-ফকিরগণ তলোয়ার দিয়ে ও যুদ্ধ করেছেন এবং শহীদ হয়েছেন ইসলামের জন্য। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের আধ্যাতিœক ক্ষমতার হাতেই ধরাশায়ী হয়েছে বিধর্মী স্থানীয় লোকজন। অলি আল্লাহদের কেউ মাছের পিঠে, কেউ জায়নামাযে ভেসে, কেউ বা পাথরে ভেসে, কেউ বা কুমিরে চড়ে নদীর সমুদ্র পাড়ি দিয়েছেন, আবার কেউ বা হিংস্র বাঘ-সিংহে আরোহন করে চলাচল করতেন। জলচর-স্থলচর এসব প্রাণীর আনুগত্য এবং সমুদ্র প্রকৃতি তথা সৃষ্ট বস্তুর উপর আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বদের এরুপ প্রভাব-প্রতিপত্তি আবিশ্বাসীদের অন্তরের কালিমা দূর করে দিতে সক্ষম হয়। ফলে, তারা দলে দলে এসে আনুগত্য স্বীকার করে নেয় পীর দরবেশদের। এসব পীর-আউলিয়ার মধ্যে বঙ্গবিজয়ের (১২০১) আগে আগত যে কয়জনের পরিচয় পাওয়া যায়-তাদের কালানুক্রমিক তালিকা হলো নিন্মরুপ-
৮৭৪ খ্রিস্টাব্দ: হযরত সুলতান বায়েজিদ বোস্তামী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি। তিনি চট্রগ্রামে ইসলাম প্রচার করেন এবং অন্যদেশে চলে যান।
১০৪৭ খ্রিস্টাব্দ: শাহ্ সৈয়্যদ সুলতান বলখি মাহী সাওয়ার রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। প্রথমে সন্দ্বীপে এবং পরে বগুড়া মহাস্থানগড়ে অবস্থান নিয়ে ইসলাম প্রচার করেন।
১০৫৩ খ্রিস্টাব্দ: শাহ্ মুহাম্মদ সুলতান রুমী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি। ময়মনসিংহ জেলায় নেত্রকোণায় ইসলাম প্রচার করেন।
১১৫৮-১১৮৯ খ্রিস্টাব্দ: বাবা আদম শহীদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি। তিনি বল্লাল সেনের রাজত্বকালে এদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন। বিক্রমপুর ছিল তাঁর প্রচারের কেন্দ্র।
১১৭৭-১২৬৯ খ্রিস্টাব্দ: বাবা ফরিদুদ্দীন গঞ্জেশকর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি। যিনি শেখ ফরিদ নামেও পরিচিত। চট্রগামে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্য এসেছিলেন এবং কাজ শেষে ফিরে যান।
১১৮৪ খ্রিস্টাব্দ: হযরত শাহ্ মাখদুম রুপোশ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি। তিনি হযরত গাউসুল আ’যম আবদুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র পৌত্র। রাজশাহী জেলায় ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার করেন।
বঙ্গবিজয়ের পর আগমন বিশিষ্ট কয়েকজন সূফী-আউলিয়ার পরিচিতি নিন্মরুপ:
১২৪০-৭০ খ্রিস্টাব্দ: শাহ্ মাখদুম দৌলা শহীদ, পাবনা জেলায় ইসলাম প্রচারক।
১২৭৮ খ্রিস্টাব্দ: হযরত শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এবং তাঁর শিষ্য ইয়াহইয়া মানিরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি সোনার গাঁ এ ইসলামের প্রচার এবং বিশেষ করে দ্বীনি শিক্ষার প্রতিষ্ঠানিক রুপ দান করেন ব্যাপকভাবে।
চতুর্দশ শতাব্দি:
সৈয়্যদ নাসির উদ্দীন শাহ্ নেকমর্দন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ঠাকুর গাঁও এ শায়িত আছেন। তিনি বরেন্দ্র অঞ্চলে ইসলাম প্রচারক। চতুর্দশ শতাব্দিতেই তিনি এখানে প্রচার কাজ চালান বলেন মনে হয়।
১৩০৩ খ্রিস্টাব্দ: হযরত শাহ্ জালাল ইয়ামেনী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এবং তাঁর ৩৬০ জন আউলিয়ার আগমন এবং সিলেট সহ পূর্ববঙ্গ আসামে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার করেন। এই সময় হযরত সৈয়্যদ আহমদ তান্নুরী রাহমাতুল্লাহি আলইহি নোয়াখালীতে ইসলাম প্রচার করেন।
১৩০৭ খ্রিস্টাব্দ: সৈয়্যদ আব্বাস আলী মক্কী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, ও তাঁর বোন রওশন আরা রাহমাতুল্লাহি আলায়হা খুলনা, চব্বিশ পরগনা অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন।
১৩৪০ খ্রিস্টাব্দ: হযরত বদরশাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তিনি বদরূদ্দীন আল্লামা হিসেবে পরিচিত। চট্রগ্রামের শীর্ষস্থানীয় ইসলাম প্রচারক এই সময়ে চট্টগ্রামেই ইসলাম প্রচারকারী অলি আল্লাহরা হলেন হযরত কাতালপীর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, শাহবান্দা রিজা শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, শাহ্ মোবারক আলী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রমুখ।
১৩৪২ – ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দ: সৈয়্যদ রিজা ইয়েমেনী, উত্তর বঙ্গে ইসলাম প্রচারক।
১৩৫১ – ১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দ: হযরত রাসতি শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, নোয়াখালী ও কুমিল্লায় ইসলাম প্রচার করেন।
১৩১৯ – ১৪১০ খ্রিস্টাব্দ: শাহ্ নূর কুতুবে আলম রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, শেখ আনোয়ার শহীদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, শেখ জাহিদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, প্রমুখ বাংলাদেশ ইসলাম প্রচার করেন।
পঞ্চদশ শতাব্দি
১৪৩৭ – ৫৮ খ্রিস্টাব্দ: হযরত খাঁন জাহান আলী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এবং তার শিষ্যগণ খুলনা, যশোর ও বরিশাল অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন।
১৪৪০ খ্রিস্টাব্দ: শাহ বদরে আলম রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এ দেশে এবং শাহ্ মজলিশ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বর্ধমানে ইসলাম প্রচার করেন।
১৪৮২ – ১৫০৬ খ্রিস্টাব্দ: শাহ্ সাল্লাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি সোনারগাঁতে ইসলাম প্রচার করেন।
১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দ: হযরত শাহ্ আলী বাগদাদী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ঢাকা ও ফরিদপুরের বিশিষ্ট ইসলাম প্রচারক। ঢাকার মিরপুরে মাযার শরীফ রয়েছে।
ষোড়শ শতাব্দি: সুলতান নাসির উদ্দীন নুশরাত শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি (১৫১৯-৪৫) সময়ে শাহ্ মুয়াজ্জেম দানেশমন্দ রাজশাহীতে ইসলাম প্রচার করেন।
১৫৫৬ – ১৬০৬: হযরত শাহ্ জামাল রাহমাতুল্লাহি আলায়হি জামালপুরে একই সময়ে ঢাকায় ইসলাম প্রচার করেন হযরত খাজা শরফুদ্দীন চিশতী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি।
সপ্তদশ শতাব্দি:
সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি নিজেই ছিলেন মুজাদ্দিদ এবং জিন্দাপীর। তাই তাঁর আমলে এদেশে ইসলামের প্রচার-প্রসার বৃদ্ধি এবং আউলিয়া-দরবেশগন উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। কাজী মুয়াক্কিল রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ও শাহ্ নেয়ামতুল্লাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এই সময় বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করেন। বিশেষত এই সময় চট্টগ্রামেও প্রচার কাজ চাঙ্গা হয়ে ওঠে। উল্লিখিত পীর-আউলিয়াগণ ছাড়াও বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন অসংখ্য বুজুর্গানে দ্বীন যাদের সবার পরিচিতি এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। বিশেষত বার আউলিয়ার চট্টগ্রাম খ্যাত অঞ্চলের শহর বন্দর গ্রাম সর্বত্র পীর-আউলিয়ার দরগাহ্ মাযার অহরহ দেখা যায় যারা বিভিন্ন কালে এদেশে এসে ইসলাম প্রচার করে এখানেই ওফাত বরণ করেন।
হযরত গরীব উল্লাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, শাহ্চান্দ আউলিয়া রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, শাহ্ আমানত রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, হযরত শাহ্জাহান শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, হযরত শাহ্ মনোহর শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, হযরত জয়নুল্লাহ্ মোখন শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হিসহ অসংখ্য বুজুর্গ-পীর দরবেশগনের কল্যালেণই এদেশে ইসলাম এসেছে। চট্টগ্রামে আগত এসব পীর-আউলিয়াগনের মধ্যে কেউ আদিকাল থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে সমুদ্রপথে আবার কেউ বা স্থলপথে এসেছিলেন। আবার কেউ পরবর্তী সময়ে উনবিংশ-বিংশ শতব্দিতেও এখানে সফর করে তাঁদের পূর্বসূরিদের প্রতিনিধি ইসলামের বাগানকে পরিচর্যা করেছেন-ভ্রান্তমতবাদ ও ভেজালমুক্ত করেছেন। উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দির সে সব আউলিয়া ব্যক্তিত্বের মধ্যে হযরত গাউসুল আযম শাহ্ সৈয়্যদ আহমুদুল্লাহ্ মাইজভান্ডারী (১৮৪৪-১৯০৬ খিস্টাব্দ) রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এবং তার ভ্রাতুষ্পুত্র হযরত সৈয়্যদ গোলামুর রহমান মাইজভান্ডারী প্রকাশ বাবা ভান্ডারী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এবং তাদের খেলাফত ও ফয়েজপ্রাপ্ত মাইজভান্ডারী মাশায়েখগণও রয়েছেন। প্রায় একই সময়ে মির্জাখিলের হযরত মাওলানা আবদুল হাই জাহাগিরি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি সহ আরো অনেক বুজুর্গানে দ্বীনের উদ্ভব হয়েছে এ চট্টগ্রামের মাটিতে-যারা ইসলামের শরিয়তের কাননে ত্বরিকতের চারা রোপন করে এর সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করে গেছেন। এ ছাড়াও পরবর্তীতে বিংশ শতাব্দিতে আরো কিছু ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব চট্টগ্রামে ইসলামের মূলধারা সুন্নিয়ত ও ত্বরিকতের উন্নয়নে সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেন- যাদের মধ্যে ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা গাজী আজিজুল হক শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এবং আল্লামা সফিরুর রহমান হশেমী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি র নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য।
একই সময়ে সেখিানে যাদের আগমন শরিয়ত -ত্বরিকতের জন্য ছিল মহা আশীর্বাদস্বরূপ- তাদের মধ্যে চট্টগ্রাম শাহী জামে মজিদের খাতিব হযরত সৈয়্যদ আব্দুল হামিদ বাগদাদী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এবং একই সময়ে আগত শাহেন শাহে সিরিকোট আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ও গাউসে জমান র্আরামা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হির নাম সবিশেষে উল্লেখযোগ্য। উনবিংশ-বিংশ শতাব্দির উক্ত সব বুজুর্গানে দ্বীনের তৎপরতা প্রভাব আজো সামনে বিদ্যমান। বিশেষত মাইজভান্ডারী ত্বরিকা এবং সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এবং আল্লামা ত্যৈয়ব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কর্তৃক প্রচারিত সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়া আজ চট্টগ্রামের জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদরাসা এবং ঢাকা মুহাম্মদপুর কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া মাদরাসা ইসলামের শরিয়ত শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে মূলধারার নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে।
বিংশ শতাব্দি থেকে বর্তমান একবিংশ শতাব্দি পর্যন্ত আউলিয়ায়ে কেরামের অবদানে প্রাপ্ত ইসলামি বাগানের পরিচর্যার আত্মনিবেদিত অনেক উরামা মাশায়েক বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইসলামের মূলধারা তথা সূফিবাদী – সুন্নিমতাদর্শ সংরক্ষণ ও ভ্রান্ত মতবাদী -উগ্র- জঙ্গীবাদীদের মোকাবেলায় সমগ্র জীবন নিরন্তর প্রয়াস চালিয়েছেন অনেকেই। হযরতুল আল্লামা সৈয়দ আবিদ শাহ্ মুজাদ্দেদী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, আল্লামা ফজলুল করিম নক্সবন্দী, হাফেজ আব্দুল বারী শাহ্ সাহেব রাহমাতুল্রাহি আলায়হি, আল্লামা হাফেজ মুহাম্মদ আব্দুল জলিল রাহমাতুল্রাহি আলায়হি, আল্লামা খাজা আবু হাতের রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, মাওলানা নঈমুদ্দীন আলকাদেরী রাহমাতুল্রাহি আলায়হি, আল্লামা বাকিবিল্লাহ্ জালালী রাহমাতুল্লাহি সহ বহু ওলামা-মাশায়েখবৃন্দ এক্ষেত্রে বিশেষভাবে স্মরণীয়। পীর – আউলিয়া ও সাচ্চা আলেম – ওলামার এ ধারার নিরন্তর উপস্থিতিই আমাদের শরিয়ত ত্বরিকতের সতেজতা একমাত্র অবলম্বন। আল্লাহ আমাদেরকে সত্যিকারের পীর আউলিয়ার সান্নিধ্য দিয়ে ধন্য করুন। আমি বেহুরমতি সৈয়্যদিল মুরসালিন সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম।