ওলি আরবী শব্দ। আরবী ভাষায় “আউলিয়া” শব্দটি “ওলি’র বহুবচন। ওলি’ অর্থ বন্ধু, মিত্র বা অনুসারি, মুরব্বী, অভিভাবক ।
কখনো শব্দটির অর্থ হয় শাসক, অভিভাবক
বা কর্তা। (তথ্যসূত্রঃ আরবী-বাংলা অভিধান, প্রকাশনায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)।
প্রসিদ্ধ আরবী-ইংরেজী অভিধান
“আল-মাওয়ারিদ” অনুসারে ওলি শব্দের
অর্থঃ guardian, patron, friend, companion ইত্যাদি।
পবিত্র কোরআনে “ওলি” এবং “আউলিয়া” এ উভয় শব্দটির ব্যবহার হয়েছে অসংখ্য বার।
* ওলীগন কি সত্যি বিদ্যমান আছেন?
হযরত মালিক বিন আনাস (রঃ) বর্ণনা করেন যে, “হযরত রসূলে করিম (সঃ) ফরমায়েছেন যে, আমাদের জন্য ৪০ জন ওলী আছেন। এঁদের মধ্যে ১২ জন সিরিয়ায় এবং ১৮ জন ইরাকে রয়েছেন”।
ইবনে আসাকির (রহ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে মারফু হাদীসটি বর্ণনা করেন। হাদীসের মর্ম মতে, “নিশ্চয়ই আল্লাহতালার ৩০০ জন ওলি আল্লাহ রয়েছেন যাদের ক্বলব হযরত আদম (আঃ)-এর ক্বলবের ন্যায়, ৪০ জন মুসা (আঃ)-এর কলবের ন্যায়, ৭ জন ওলী ঈসা (আঃ)-এর কলবের ন্যায়, ৫ জন ওলী জিব্রাইল (আঃ)-এর কলবের ন্যায়, ৩ জন ওলী মিকাইল (আঃ)-এর কলবের ন্যায় এবং ১ জন ওলী ইস্রাফীল (আঃ)-এর কলবের ন্যায় সৃষ্টি করেছেন। যখন তাদের মধ্যে একজন পরলোক গমন করেন, তখন তাদের তিনজনের দলের একজনতাঁর স্থানে, পাঁচজনের দলেন একজন তিনজনের দলে, সাতজনের দলের একজন পাঁচজনের দলে, চল্লিশ জনের দলের একজন সাতজনের দলে এবং তিনশত জনের দলের একজন চল্লিশজনের দলে এবং কোন একজন সৎকর্ম পরায়ন মুসলমানকে সেই তিনশত দলের মনোনয়ন দান করে তাঁদের সংখ্যা পরিপূর্ণ রাখা হয়”। তাঁদের ওছিলায় রাসূল করিম (সঃ)-এর উম্মতদেরকে আল্লাহতালা বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করেন।
ইমাম হাকিম তিরমিজি বর্ণনা করেছেন যে, হযরত রাসূলে করিম (সঃ) মানুষের মধ্যে ৪০ জন সিদ্দিক রেখে যান যাঁরা এ পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখেন। এদের একজনের মৃত্যু হলে আর একজন তাঁর জায়গায় আসেন। এঁদের মেয়াদ শেষ
হয়ে গেলে আল্লাহতালা মোহর দিয়ে একজন ওলীকে পাঠিয়ে দেন। কিতাবে খতম-আল আউলিয়া, Reference :
(হাকিম তিরমিজি, ৮৯৮ খৃঃ) (কাসফ আল মাহজুব : আল-হুজবেরী, ১০৬৩ খৃঃ)।
“ইহুদী ও খৃষ্টানদের ধর্মগ্রন্থেও ওলীদের প্রশাসনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এদের ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী ধার্মিক লোক
হচ্ছে এ পৃথিবীর ভিত্তি। ধার্মিক লোক না থাকলে পৃথিবীর কল্যাণ লোপ পাবে। পৃথিবীতে কমপক্ষে ত্রিশজন
ধার্মিক লোক আছেন, তাঁরা না থাকলে এ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। এ সকল ধর্মগ্রন্থের কোন সংস্করণে দেখায়
যায় যে, পৃথিবীতে ৪৫ জন ধার্মিক লোক আছেন যাঁরা এ পৃথিবীকে টিকে থাকতে সাহায্য করেন। এঁদের মধ্যে
বেবিলোনে রয়েছেন ত্রিশজন, প্যালেষ্টাইনে ১৫ জন। পরবর্তীতে এ সকল ধর্মের বিশেষজ্ঞগণ এসকল ধার্মিক
ব্যক্তির সংখ্যা ৩৬ জন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। এ সকল ধর্মীয় পন্ডিতগণ মনে করেন যে, এ সকল ধার্মিক লোক না থাকলে পৃথিবী থাকবে না এবং এঁদের কেউ মৃত্যু বরণ করলে তাঁর জায়গায় অন্যজন চলে আসবেন।
(আদি পুস্তক: ৯; Old Testament (Midas Version)।
জুন্নুন মিশরী (রঃ)-এর মতে, পৃথিবীতে ৩০০ জন ওলী আছেন। এঁদের মধ্যে একজন হচ্ছেন গাউছ বা মূল খুঁটি। তাঁকে একটি বৃত্তের কেন্দ্র বিন্দুর সঙ্গে তুলনা করা
যায়। তিনিই আকর্ষণ ও বিকর্ষণের কেন্দ্র।
হযরত মুহীউদ্দিন ইবনুল আরবী (রঃ) বলেন, “হযরত রাসূলে করিম (সঃ)-এর প্রতিনিধি ছাড়া এ পৃথিবীর অস্তিত্ব থাকতে পারে না। প্রতিনিধিদের মধ্যে একজন
থাকেন যাঁকে কুতুব বা খুঁটি বলা যায়। কোন এক যুগে এবং কোন এক নির্দিষ্ট স্থানে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর মধ্যে
আধ্যাত্মিক গুণাবলীর পরিপূর্ণতা থাকে এবং তাঁকে সাধারণত ছাহেবে জমান বলা হয়।”
হযরত মুহীউদ্দিন আরবী (রঃ)-এর মতে, “গাউছ হলেন বিশ্বব্রহ্মান্ডের প্রাণকেন্দ্র। তাঁর নিকট থেকে চতুর্দিকে আলো বিচ্ছুরিত হয়ে সমস্ত জীবের প্রাণে প্রবেশ করে। গাউছকে দু’জন ইমাম প্রতিনিয়ত সাহায্য করেন। গাউছের পরে হলেন চারজন আউতাদ বা স্তম্ভ। আউতাদের অধীনে আছেন সাতজন আবদাল। এঁদের কাজ হলো আবহাওয়া নিয়ন্ত্রন করা। এঁদের পরে রয়েছেন বারজন নুকাবা বা মনোনত পরহেজগার ব্যক্তি। এসকল নুকাবাগণ মানুষের অন্তর্নিহিত চিন্তসমূহ সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারেন। এদের পরে আরওআটজন নুকাপ আছেন যাঁদের মধ্যে মহান আল্লাহতালা আট রকমের গুণ দিয়েছেন। সবার শেষে আছেন হুয়ারী বা শিষ্যগণ এবং তাঁদের পশ্চাতে রয়েছেন আরও ৪০ জন লোক”।
হযরত মুহীউদ্দিন ইবনুল আরবী (রঃ)-এর মতে, “পয়গম্বারদের মধ্যে যেমন শেষ পয়গাম্বর আছেন, ওলীদের মধ্যেও তেমনি শেষ ওলী রয়েছেন যার কাছে সীলমোহর রয়েছে”। তাঁর মতে “দুটি সীল মোহর রয়েছে- একটি হযরত ঈসা (আঃ)- এর সঙ্গে এবং অপরটি সর্বশ্রেষ্ঠ ওলীর সঙ্গে”।
প্রখ্যাত সুফী আশ শাধিলী বলেন, “প্রত্যেক পীর হলে নিজ নিজ ত্বরিকার কুতুব, খুঁটি বা গাউছ হলেন একজন”। (Alnafakhir al-Aliya Fi-Alma-Atnir-Osh-Shadhiliya by Ahmad-Ibu-Ayas)
পল বি, ফেন্টনের মতে, “বহু সুফী সাধক তাঁদের পীরকে গাউছুল আযম বা মূল খুঁটি বলে দাবী করেছেন। যেহেতু অনেক সময় গাউছুল আযম দৃশ্যমান নহেন। এ অবস্থায় একটি সময়গত মূল খুঁটি (কুতুবুজজ্বমান) ধারণার সৃষ্টি হয়েছে”। (Journal of the Muhiddin-Ibu-Arabi Society, Vol.X, 1991, Oxford University Press Ltd.)