যেসব ক্ষেত্রে সালাত-সালাম পাঠ করা বরকতময়
১. হানাফি মাযহাবের উলামায়ে কেরামদের মতে নামাযের শেষ তাশাহহুদের দরূদশরীফ পাঠ করা সুন্নত।
২. দোয়ার শুরুতে, মাঝখানে এবং শেষে দরূদশরীফ পাঠ করা অতিব প্রয়োজন। ইবনে আতা আলাইহির রহমত বলেন, দোয়ার আরকান, বাহু, সময় এবং উপকরণ রয়েছে। যদি দোয়ার আরকান উপযোগী হয় তবে এ দোয়া অতি শীঘ্র আসমানের দিকে উত্থিত হয়। যদি সময় উপযোগী হয়, তবে দোয়া তাড়াতাড়ি কবুল হয়। যদি উপকরণ উপযোগী হয় সে দোয়া মাকসুদ পর্যন্ত তাড়াতাড়ি পৌঁছে যায়।
ক) দোয়ার আরকান হল মনের একাগ্রতা ও একনিষ্টতা, বিনয় ও নম্রতা, চক্ষু বন্ধ করে কাকুতি মিনতি করা। খ) দোয়ার বাহু হল সিদ্ক বা সত্যনিষ্ট। গ) দোয়ার সময় হলো শেষ রাত্র। ঘ) দোয়ার উপকরণ হল নূরনবীর উপর দরূদ ও সালাম প্রেরণ করা।
হাদিস শরীফে রয়েছে যে দোয়ার প্রথম ও শেষে দরূদশরীফ থাকে সে দোয়া কখনো বাতিল হয় না। (মাদারিজুন নবুয়ত)
৩. জুমুয়ার নামাযের খুতবায় নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরূদ ও সালাম প্রেরণ করা প্রয়োজন। ইহা খুতবার একটি অংশ। খুতবা ইবাদতের অংশ, আল্লাহ আজ্জা ওয়াজাল্লাহর আলোচনা এতে শর্ত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত।
সুতরাং আযান ও নামাযের মধ্যে নূরনবীর প্রতি দরূদ ও সালাম যেমন ওয়াজিব, তেমনি জুমুয়ার খুতবায় ও নূরনবীর প্রতি দরূদ ও সালাম ওয়াজিব। (মাদারিজুন নবুয়ত)
৪. হযরত আলকামা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি যখনই মসজিদে প্রবেশ করি তখন বলি,
السلام عليك ايها النبى ورحمة الله وبركاته وصل الله وملائكته على محمد-
এর পরক্ষণেই পড়ে নিবেন,
اللهم افتح لى ابواب رحمتك
(মাদারিজুন নবুয়ত)
৫. হজ্জ্বের ইহরামের সময়ে, উমরার সময়ে, তালবিয়ার সময়ে, সাফা-মারওয়ায় দৌড়ানোর সময়েও নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি দরূদ পাঠের উল্লেখ রয়েছে। (মাদারিজুন নবুয়ত)
৬. সমাবেশ ও অনুষ্ঠানেও নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরূদ ও সালাম প্রেরণ করা অতিব প্রয়োজন। এতে আল্লাহর শাস্তি হতে রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিরমিজি শরীফে সংকলিত একটি হাদিসে হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নূরনবীর আলিশান ফরমান হলো, কোন ব্যক্তি যেন এমন কোন সমাবেশে না বসে যেখানে আল্লাহ তা’য়ালার হামদ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি সালাম ও দরূদশরীফ প্রেরণ না করা হয়। কেননা এসব লোক কিয়ামতের ময়দানে হাবিবে খোদার প্রতি দরূদ ও সালাম প্রেরণ না করার দরূন অনুতাপ ও অনুশোচনায় দগ্ধ হতে হবে। (মাদারিজুন নবুয়ত)
৭. তাবরানী হযরত আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে উসূলে হাদিসের পরিভাষায় মারফু হিসেবে বর্ণিত হাদিসে রয়েছে, যে নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি সকাল বেলায় দশবার এবং সন্ধ্যা বেলায় দশবার আমার প্রতি দরূদ পাঠ করে সে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন আমার শাফায়াত লাভে ধন্য হবে। (মাদারিজুন নবুয়ত)
৮. হাদিসশরীফে রয়েছে যে, নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যে কেউ নিজের রচিত গ্রন্থে আমার উপর দরূদ লেখবে তার সেই গ্রন্থ যতদিন অবশিষ্ট থাকবে, ততদিন ক্রমাগতভাবে ফেরেশতা লেখকের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে। (মাদারিজুন নবুয়ত)
৯. রাতের নামাযের উদ্দেশ্যে ঘুম হতে উঠার পর, অযু করার পর, তাহাজ্জুদ আদায়ের পর, জুমুয়ার দিন, সোমবার দিন, প্রভৃতি সময়ে দরূদশরীফ পাঠের বিধান হাদিসশরীফে উল্লেখ রয়েছে।
এছাড়া সুবহে সাদিকের সময়, কা’বাঘর দেখার পর, হাজরে আসওয়াদে চুমু খাওয়ার সময়, কা’বাঘর তাওয়াফ করার সময়, হজ্জ্ব পালনের নিমিত্তে বিভিন্নস্থানে গমনের সময় অর্থাৎ হজ্জ্ব এর পালনী অনুষ্ঠানসমূহে।
নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিদর্শনসমূহ প্রত্যক্ষ করার সময়, আল্লাহর হাবিবের অবস্থানের স্থান সমূহে যেমন মসজিদে কুবা, বদর প্রান্তর, ওহুদ পাহাড়, মসজিদে নববী প্রভৃতি স্থানে উপস্থিত হওয়ার সময় দরূদ পাঠ করা অতিব প্রয়োজন।
এতদ্ব্যতীত কোন কিছু বিক্রি করার সময়, ওসিয়তনামা লেখার সময়, সফরের ইচ্ছা করার সময়, বাজারে পৌঁছার পর, ব্যস্ততার সময়ে, অবসর সময়ে, অমনোযোগী অবস্থার সময়, দাওয়াতে যাওয়ার সময়, দাওয়াত রক্ষা করে ফিরে যাওয়ার সময়, কোন প্রকার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেওয়ার সময়, ভয়-ভীতি ও সন্ত্রস্ত অবস্থার সময়, গৃহপালিত পশু পালিয়ে গেলে, গৃহভৃত্য পালিয়ে গেলে, যে কোন জিনিস হারিয়ে গেলে, দুঃখ ও দুশ্চিন্তার সময়ে, রোগ-মহামারী দেখাদিলে, পা অবশ হয়ে গেলে, মুলা খাবার সময়ে, যেন খাওয়ার পর গন্ধযুক্ত ঢেকুর না আসে, দরূদশরীফ পাঠ করা প্রয়োজন।
পানি পান করার সময়, কোন মুসলমান ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের সময়, করমর্দনের সময়, ইসলামী সভা, অনুষ্ঠান বা সমাবেশে অংশগ্রহণের সময়, কোরআন শরীফ খতমের সময়, নির্দোষ আলাপ-আলোচনা শুরু করার সময়, দ্বীনি ইলিম শিক্ষা শুরু করার সময়, হাদিসের শিক্ষা গ্রহণ, ওয়াজ নসিহত শুরু করার সময়, হাদিস পাঠ করার সময়, শেষ করার সময়, কোন জিনিস ভাল লাগলে দরূদশরীফ পাঠ করতে হবে।
১০. নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি দরূদ-সালাম প্রেরণ বা লিখার সময়ে সালামও সঙ্গে মিলিয়ে লওয়া সমীচীন।
ইমাম নববী আলাইহির রহমত সালামবিহীন সালাত মিলানো মাকরূহ বলে উল্লেখ করেছেন। কেননা আল্লাহতা’য়ালা সালাত ও সালাম উভয়ের আদেশ প্রদান করেছেন। ফতহুলবারী গ্রন্থে রয়েছে যে, শুধুমাত্র সালাত প্রেরণ করা এবং সালাম প্রেরণ না করা মাকরূহ। তবে হ্যাঁ, যদি একবার সালাম প্রেরণ করে বিরতি ছাড়াই সালাম প্রেরণ করা হয়, তবে কোন ক্ষতি বা অসুবিধা নেই। মাওয়াহিবেও এরূপ লেখা রয়েছে।
উল্লেখ্য যে, দরূদ ও সালাম উচ্চারণ ও লেখার ক্ষেত্রে পূর্ণ শব্দ ব্যবহারই পছন্দনীয়। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং রাদিয়াল্লাহু আনহু, রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এভাবে উচ্চারণ লেখাই বাঞ্ছনীয় ও শোভনীয়। (মাদারিজুন নবুয়ত)
১১. নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি সবসময় দরূদ ও সালাম প্রেরণ করা মুস্তাহাব এবং উত্তম বন্দেগি। বিশেষত জুমুয়ার দিনে ও রাতে দরূদ প্রেরণ করা সর্বোত্তম। কেননা জুমুয়ার দিন সপ্তাহের সর্বোৎকৃষ্ট দিন এবং জুমুয়ার রাত সপ্তাহের সর্বোৎকৃষ্ট রাত।
কোন কোন আধ্যাত্মিক সাধকের মতে সুন্নি আক্বীদার বিশ্বাসী কামিল মুর্শিদ যদি না পাওয়া যায়, তাহলে সত্যসন্ধ ব্যক্তিকে দরূদশরীফ প্রেরণের অধিক মনোযোগী হতে হবে এবং দরূদশরীফ পাঠ করা নিজের জন্য অত্যাবশ্যক বলে গ্রহণ করতে হবে। এতে তার অভ্যন্তরীন পরিশুদ্ধি এবং তা’লিম তরবিয়ত সম্পন্ন হবে। ধীরে ধীরে সে ব্যক্তি আল্লাহর অধিক সান্নিধ্যে উন্নীত হতে সক্ষম হবে। অধিক পরিমাণে দরূদশরীফ পাঠ করলে মনের মধ্যে নূরের সৃষ্টি হয়, সে নূরের দ্বারা আধ্যাত্মিক সাফল্য অর্জন করা যায়। অতঃপর নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবার হতে সরাসরি সাহায্য সহযোগিতা ও পথ নির্দেশ লাভ করা যায়। (মাদারিজুন নবুয়ত)