কিতাব: নবীগণ (আলায়হিমুস সালাম) স্বশরীরে জীবিত, লেখক: ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী (রহ) [পর্ব ১]
নবীগণ (আলায়হিমুস সালাম) স্বশরীরে রওযা শরীফে জীবিত; কিন্তু অন্য একটি বর্ণনায় দেখা যায়-
হাদিস ১ :
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন:
“যখন কোন ব্যক্তি আমার প্রতি সালাম প্রেরণ করে তখন আল্লাহ তা’আলা আমার প্রতি
আমার রূহকে ফিরিয়ে দেন যাতে আমি তার সালামের উত্তর দিই।”
এ হাদীসের বাহ্যিক অর্থ দ্বারা বুঝা যায় যে, প্রিয়নবীর রূহ মুবারক তাঁর নবীগণ দেহ মুবারক থেকে কখনও কখনও পৃথক ও বিচ্ছিন্ন হয় ।
সুতরাং এ উভয় হাদিসের মধ্যকার সমন্বয় সাধন কিভাবে হবে?
সশরীরে জীবিত ইমাম সুমুতী রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি এ প্রশ্নের উত্তরে বলছেন,
এটি খুব সুন্দর একটি প্রশ্ন, যা নিয়ে চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করা জরুরী ।
সুতরাং আমি বলছি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এবং অন্যান্য নবী-রাসূলগণের নিজ নিজ রওযা শরীফে জীবিত থাকার বিষয়টি আমাদের সকলের নিকট সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত ও সর্বজন স্বীকৃত । কেননা এ তত্ত্বের বিষয়ে আমাদের নিকট অনেক দলীল ও প্রমাণ বিদ্যমান এবং এ ক্ষেত্রে
প্রমাণিত দলীলগুলো মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের।অর্থাৎ যেগুলো এত অধিক সংখ্যক রাভী (বর্ণনাকারী) বর্ণনা করেছেন, যাতে কোন ধরনের সন্দেহের অবকাশ থাকে না।
আর ইমাম বাইহাকী রাহমাতুল্লাহি তাআলা আলায়হিও নবীগণ আলায়হিস এর নিজেদের রওযা শরীফে জীবিত থাকার প্রমাণ স্বরূপ একটি স্বতন্ত্র পুস্তিকা রচনা করেছেন। পুস্তিকাটির নাম হল:
(হায়াতুল আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামু ফী কুবুরিহিম)
নবীগণ (আলায়হিমুস সালাম) সশরীরে জীবিত
এ বিষয়ের প্রমাণ স্বরূপ বর্ণিত হাদিসগুলোর মধ্য থেকে নিমে কয়েকটি
উল্লেখ করা গেলঃ
হাদিস ২ :
ইমাম মুসলিম তার সহীহতে সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালেক থেকে বর্ণনা করেন,
তিনি বলেন,
“যে রাত্রিতে আমাকে ইসরা ও মি’রাজ করানো হলো, ওই রাত্রিতে আমি এলাম, অন্য এক বর্ণনায় আছে আমি, হযরত মূসা আলায়হিস সালাম-এর কবর শরীফের পাশ দিয়ে গেলাম । তখন আমি দেখতে পেলাম যে, হযরত মূসা আলায়হিস সালাম লাল বর্ণের।
টিলার পাশে স্বীয় কবর শরীফে দাড়িয়ে নামাজ আদায় করছেন।
হাদিস ৩ :
আবু নু’আয়ম ইস্পাহানী তার রচিত ‘হুলয়াতুল আওলিয়া’ নামক প্রসিদ্ধ।
হাদিসগ্রন্থে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসরাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন:
“নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম গমন করেছেন হযরত
মূসা আলায়হিস সালাম-এর কবর শরীফের পাশ দিয়ে । আর তিনি নিজ
কবর শরীফে দাড়িয়ে নামায আদায় করছিলেন ।”
হাদিস ৪ :
আবু ইয়ালা তার মুসনাদ’-এ এবং ইমাম বায়হাক্কী রাহমাতুল্লাহি তাআলা আলায়হি তার “হায়াতুল আম্বিয়া” নামক কিতাবে হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
“নবীগণ আলায়হিমুস সালাম নিজেদের কবর শরীফে জীবিত এবং তারা সেখানে
নামায আদায় করেন ।”
ইমাম আবু নু’আইম তার হুয়াতুল আউলিয়াতে ইউসুফ ইবনে আতিয়্যাহ থেকে বর্ণনা করেন,
↓
তিনি বলেন, “আমি হযরত সাবেত আল-বুনানী
রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে
↓
হুমাইদ আতত্বাভীলকে জিজ্ঞেস করতে শুনেছি: আপনার নিকট কি এমন কোন তথ্য আছে যা প্রমাণ করে যে,
নবীগণ আলায়হিমুস সালাম ব্যতীত অন্য কেউ নিজ কবরে নামায পড়েন?”
তিনি বললেন, “না”।
হাদিস ৫ :
ইমাম আবু দাউদ এবং ইমাম বাইহাক্কীরাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি।
হযরত আওস ইবনে আওস আস সাকাফীথেকে বর্ণনা করেন:
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
“নিশ্চয় তোমাদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হলো- জুমার দিন । সুতরাং এদিনে তোমরা
আমার প্রতি অধিক পরিমাণে দুরূদ শরীফ প্রেরণ কর । কেননা তোমাদের
দুরূদ শরীফগুলো আমার নিকট পেশ করা হয়। সাহাবীগণ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুম বললেন, “এয়া রাসুলাল্লাহ। আপনার নিকট আমাদের সালাত কিভাবে পেশ করা সম্ভব? কেননা আপনি তো ইন্তিকাল করবেন এবং আপনার দেহ মাটি খেয়ে ফেলবে?” তখন প্ৰিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাদের এ ভুল ধারণাকে সংশোধন করে দিয়ে বললেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা হারাম করে দিয়েছেন মাটির উপর নবীগণের দেহ মুবারককে গ্রাস করা ।”
হাদিস ৬ :
ইমাম বায়হান্ধী শু’আবুল ঈমান’ গ্রন্থে এবং ইমাম ইস্পাহানী “আত তারগীব” নামক কিতাবে হযরত আবু হোরাইরা রাদিয়াল্লাহুতা’আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন,
“হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
“যে ব্যক্তি আমার কবরের নিকট উপস্থিত থেকে আমার উপর সালাত পাঠ করে, আমি তার সালাত শুনতে পাই (ও জবাব দেই) । আর যে অনুপস্থিত থেকে আমার প্রতি সালাত (সালাম) প্রেরণ করে তা আমার নিকট পৌছানো হয়।
হাদিস ৭ :
ইমাম বোখারী তার ‘তারিখ-এ কাবীর’ গ্রন্থে হযরত আম্মার রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
“নিশ্চয় আমাকে আল্লাহ তা’আলা এমন একজন ফেরেশতা দিয়েছেন, যে আমার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে যখন আমি ইনতিকাল করবো তখন থেকে, অতঃপর যে কোন বান্দা আমার উপর সালাত পাঠ করবে, সাথে সাথে সে আমাকে তা বলে দেবে, ‘হে আল্লাহর মহা প্রশংসিত মাহবুব! অমুকের পুত্র অমুক,
আপনার প্রতি দুরূদ প্রেরণ করছে । ওই ফিরিশতা দুরূদ প্রেরণকারীর নাম
ও তার পিতার নামসহ উল্লেখ করবে, অতঃপর আল্লাহ তা’আলা সেটার বিনিময়ে দশটি রহমত নাযিল করবেন । আল্লাহ তার প্রতি সালাম নাযিল করুন।
হাদিস ৮ :
ইমাম বায়হাকী রাহমাতুল্লাহি তাআলা আলাইহি হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:
নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:
“নবীগণ আলায়হিমুস সালামকে তাদের ইত্তিকালের পর কবরে চল্লিশ রাতের বেশী রাখা হয়না, বরং তারা আল্লাহ তা’আলার কুদরতের সামনে নামায আদায় করতে থাকেন- কিয়ামতের পূর্বে শিঙ্গায় ফুক দেয়ার আগ পর্যন্ত ।
হাদিস ৯ :
হযরত সুফিয়ান সাওরী তার আল জামে তেলিখেন: একজন শায়খ আমার নিকট হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যাব থেকে বর্ণনা করে বলেন:
কোন নবী তাঁর কবরে চল্লিশ দিনের বেশী অবস্থান করেননি; বরং তারা তাদের কবর থেকে উত্তোলন পর্যন্ত জীবিতই থাকবেন ।”
ইমাম বায়হাকীবলেন,
“উপরোক্ত বর্ণনার পরিপ্রেক্ষিতে তারা ইন্তিকালের পরও অন্যান্য জীবিতদের ন্যায় জীবিত, আল্লাহ তাদেরকে যেখানে অবস্থানকরাবেন, তাঁরা সেখানে অবস্থান করতে থাকবেন।”
অত:পর ইমাম বায়হাকী রাহমাতুল্লাহি তাআলা আলায়হি বলেন,
নিশ্চয় নবীগণ আলায়হিমুস সালাম-এর ইন্তিকালের পরও জীবিত থাকার স্বপক্ষে অনেক প্রমাণ পাওয়া যায় ।”
প্রমাণ স্বরূপ তিনি ইসরা ও মি’রাজের ঘটনা
এবং এ রাতে নবীগণের সাথে তাঁর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কথা এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে তাদের আলায়হিস সালাম কথা বলার বিশুদ্ধ ঘটনা ও রেওয়ায়াতগুলো বর্ণনা করেন।
হাদিস ১০ :
ইমাম বায়হাকী রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি প্রিয় নবীর ইসরা ও মি’রাজের ঘটনাবর্ণনার ক্ষেত্রে হযরত আবু হোরাইরারাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহ-এর রেওয়ায়তটি উল্লেখ করেন। তাতে রয়েছে-
“আমি আমাকে দেখতে পেলাম একদল সম্মানিত নবীর দলে। আর হযরত মূসা
আলায়হিস সালামকে দেখলাম তিনি দাঁড়িয়ে নামায পড়ছেন দেখলাম তিনি উপমাযোগ্য ব্যক্তি। তার চুল কোকড়ানো দেখে মনে হচ্ছিল- তিনি শানুয়া সম্প্রদায়ের লোক।
আবার দেখলাম হযরত ঈসা আলায়হিস সালাম দাড়িয়ে নামায পড়ছেন ।
ওদিকে হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালামও দাড়িয়ে নামায আদায় করছেন। তিনি আলায়হিস সালাম দেখতে প্রায় আমার মতই । অতঃপর নামাযের সময় এল । আর আমি তাদের সকলের ইমাম হিসেবে নামায আদায় করলাম ।”
হাদিস ১১ :
ইমাম বায়হাকী রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আনহ নিমের হাদীসের আলোকে বলেছেন:
প্ৰিয় নবী সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
“কিয়ামতের দিনে মানুষ সংজ্ঞাহীন হয়ে যাবে। তখন আমিই সর্বপ্রথম সজাগ হবো ।”
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন- এ হাদীস শরীফে একথাও প্রমাণ করে যে,
“আল্লাহ তা’আলা নবীগণের প্রতি তাদের রূহ ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাই তারা মহান
আল্লাহর দরবারে জীবিত, শহীদগণের ন্যায় । অতপর যখন শিঙ্গায় প্রথম ফুক দেয়া হবে তখন তারাও অন্যান্যদের ন্যায় সংজ্ঞাহীন হয়ে যাবেন। এটি কোন দিক থেকেই মৃত্যু নয়; বরং শুধু অনুভূতি শক্তি লোপ পাওয়া মাত্র।
হাদিস ১২ :
ইমাম আবু ইয়া’লা তার মুসনাদে হযরত আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ
তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি- “নিশ্চয় যে মহান রবে কুদরতের হাতে আমার জীবন তার শপথ করে বলছি-
হযরত ঈসা আলায়হিস সালাম অবতরণ করবেন। অতপর তিনি যদি আমার কবরের
সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে “হে হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা! বলে আহবান করেন, তাহলে আমি নিশ্চয় তাঁর আহবানে সাড়া দেব ।
হাদিস ১৩ :
হযরত আবু নু’আয়ম ইস্পাহানী তার ‘দালায়েলুন নুবুয়্যাত”-এ হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যাব রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন-
‘হাররা-এর রাতগুলোতে আমি মসজিদে নবভী শরীফে আশ্রয় নিলাম। তখন মসজিদে নবভী শরীফে আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না । কিন্তু যখনই নামাযের সময় হতো, তখন আমি প্রিয়নবীর কবর শরীফ থেকে আযান শুনতে পেতাম ।
হাদিস ১৪ :
হযরত যুবাইর ইবনে বাকার তার ‘আখবারুল মাদিনাতে হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যাব থেকে বর্ণনা করেন : তিনি বলেন, আমি হারা- এর রাতগুলোতে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কবর শরীফে প্রতিটি নামাযের সময় আযান ও ইকামত শুনতে পেতাম ।যতদিন পর্যন্ত মানুষ মদিনায় ফিরে আসেনি ততদিন পর্যন্ত তা শুনতে পেয়েছি ।
হাদিস ১৫ :
ইমাম ইবনে সা’দ তার আত ত্বাবান্ধাত’ নামক কিতাবে হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যাব থেকে বর্ণনা করেন:
“তিনি হাররা এর দিনগুলোতে যখন অকাতরে মানুষ হত্যা করা হচ্ছিল তখন মসজিদে নববী শরীফে আত্মগোপন করেন। তিনি বলেন- যখনি নামাযের সময় উপস্থিত হতো তখন আমি কবর শরীফ থেকে আযানের শব্দ বের হতে শুনতাম।