কূফাথেকে দুই মঞ্জিলদূরত্বে কারবালার প্রান্তরে যখনতারা পৌঁছলেন, তখনহুর বিন ইয়াযীদ রিয়াহী একহাজার সৈন্য নিয়েহযরত ইমাম হুসাইন(রাঃ)এর সাথেমোলাকাত করলেন এবংবললেন- জনাব ইমামেআ’লা (রাঃ)! আমি আপনাকে গ্রেফতার করারজন্য এসেছি। তিনি(রাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, কেন ? সে বললো, ‘তা আমি জানিনা, তবে কূফারগভর্নর ইবনে যিয়াদের নির্দেশ দিয়েছে আপনাকেযেখানে পাওয়া যায়, গ্রেফতার করে তারকাছে যেন পৌঁছেদেয়া হয়। তিনি(রাঃ) ফরমালেন, আমারকি অপরাধ ? সে বললো, আপনি ইয়াযীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন, ইয়াযীদের বিরুদ্ধে এখানেজনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টিকরেছেন এবং জনগণেরবাইয়াত করিয়েছেন। তিনি(রাঃ) বললেন, ‘আমিকোন জন অসন্তোষ সৃষ্টিকরিনি এবং ক্ষমতাদখলেরও কোন ইচ্ছাআমার নেই। কূফাবাসী আমারকাছে চিঠি লিখেছে, যার ফলে শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকেবিচার করে আমিএখানে আসতে বাধ্যহয়েছি । তবেযদি কূফাবাসী বেঈমানী করেএবং অবস্থার যদিপরিবর্তন হয়, তাহলেআমি ফিরে যেতেরাজি আছি। যখনহযরত ইমাম হুসাইন(রাঃ) হুরের সঙ্গেআলোচনা করলেন এবংহুরকে সমস্ত বিষয়অবহিত করলেন, তখনসে খুবই দুঃখিতহলো।হুর বললো, এইমুহূর্তে যদি আমিআপনাকে চলে যেতেদেই, আমার সঙ্গী-সাথীদের মধ্যেকেউ হয়তো ইবনেযিয়াদের কাছে গিয়েআমার বিরুদ্ধে অভিযোগকরবে এবং ইবনেযিয়াদ আমার উপরযুলুম করবে ।সে বলবে, ‘তুমিজেনে শুনে দুশমনকে ছেড়েদিয়েছ, আপোষে যাওয়ার সুযোগকরে দিয়েছ।’ ফলেআমার উপর মুছীবতের পাহাড়নাযিল হবে। তাইআপনি একটা কাজকরতে পারেন- এভাবেআমার সঙ্গে সারাদিন কথাবার্তা চালিয়ে যেতেথাকেন, যখন রাতহবে, আমার সৈন্যরা শুয়েপড়বে এবং চারিদিকে অন্ধকার নেমেআসবে, তখন আপনিআপনার আপনজনদের নিয়েএখান থেকে চলেযাবেন।সকালে আপনাকে খোঁজকরব না, আপনারপিছু নেব না। সোজাইবনে যিয়াদের কাছেগিয়ে বলব, উনিরাতের অন্ধকারে আমাদেরঅজান্তে চলে গেছেনএবং উনি কোন্ দিকে গেছেনকোন খোঁজ পাইনি। এরপরযা হওয়ার আছে, তাই হবে। হযরতইমাম হুসাইন (রাঃ) বললেন, ‘ঠিক আছে’।
যখনরাত হলো, চারিদিকে অন্ধকার ঘণীভূতহলো এবং সৈন্যরা প্রায়ঘুমিয়ে পড়লো, তখনহযরত ইমাম হুসাইন(রাঃ) নিজের সঙ্গীসাথীদেরকে যাত্রা করারনির্দেশ দিলেন ।সবাই বের হয়েগেলেন। সারারাত একাফেলা পথ চলতেথাকল, সারারাত হযরতইমাম হুসাইন (রাঃ)এর কাফেলাপথ চললো, কিন্তুভোরে তারা তাদেরকে ঐজায়গায়তেই দেখতে পেলেন, যেখান থেকে যাত্রাশুরু করেছিলেন। এইঅবস্থা দেখে সবাইআশ্চর্য হয়ে গেল, এটা কিভাবে হলো ! আমরা সারারাত পথচললাম, কিন্তু সকালেআবার একই জায়গায়। একেমন কথা! হুরতাঁদেরকে দেখে জিজ্ঞাসা করলো, আপনারা কি যাননি ? ইমাম হুসাইন (রাঃ) বললেন, আমরা ঠিকইচলে গিয়েছিলাম, কিন্তুযাওয়ার পরওতো যেতেপারলাম না, দিকহারা হয়ে আবারএকই জায়গায় ফিরেআসলাম। হুর বললো, ঠিক আছে, চিন্তার কিছুনেই। আজ আমরাপুনরায় দিনভর আলোচনাকরতে থাকব এবংআমার সৈন্যদেরকে বলব, আমাদের মধ্যে এখনওকোন ফায়সালা হয়নি, আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। আজরাতেই আপনি চলেযাবেন।হযরত ইমাম হুসাইন(রাঃ) দ্বিতীয় রাত্রিতেও সঙ্গীদেরকে নিয়েবের হলেন। সারারাত তিনিও উনার সফরসঙ্গীগণ পথচললেন। ভোর যখনহলো, তখন পুনরায় উনারাউনাদেরকে সেই একইজায়গায় পেলেন, যেখানথেকে উনারা বেরহয়েছিলেন। উপর্যুপরি তিনরাত এ রকমহলো। সারারাত তারাপথ চলতেন, কিন্তুভোর হতেই তাঁদেরকে ঐজায়গায় পেতেন, যেখানথেকে উনারা বেরহতেন।
চতুর্থদিন জনৈক পথিকতাঁদের পার্শ্ব দিয়েযাচ্ছিল, তিনি (রাঃ) ওকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভাই, যে জায়গায় আমরাদাঁড়িয়ে আছি, এইজায়গাটার নাম কি? লোকটি বললো, জনাব! এই জায়গাটার নাম‘কারবালা’। কারবালা শব্দটিশুনার সাথে সাথেইহযরত ইমাম হুসাইন(রাঃ) আঁতকে উঠলেনএবং বললেন, ‘আমারনানাজান (ছল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) ঠিকইবলেছেন, ‘হুসাইন কারবালার ময়দানে শহীদহবে।’ এটাতো আমারশাহাদাতের স্থান। আমিএখান থেকে কিভাবেচলে যেতে পারি ? পরপর তিন রাত্রিপ্রস্থান করার পরপুনরায় একই জায়গায় প্রত্যাবর্তন একথাই প্রমাণিত করেযে, এটা আমারশাহাদাতের স্থান। এখানথেকে আমি কিছুতেই বেরহতে পারব না।
তিনিতাঁর প্রিয়জনদের বললেন, ‘সওয়ারী থেকে অবতরণকরে তাবু খাটাও। নির্দেশ মততাঁর (রাঃ) সঙ্গীসাথীরা সওয়ারী থেকেঅবতরণ করে তাবুখাটাতে শুরু করলেন।কিন্তু যেখানেই তাবুরখুঁটি পুঁততে গেলেন, সেখান থেকেই টাটকারক্ত বের হতেলাগলো। এই দৃশ্যদেখে সবাই হতভম্বহয়ে গেলেন। হযরতসৈয়দা যয়নাব (রাঃ) যখন দেখলেন যে, মাটিতে যেখানেই খুঁটিপুঁততে চাইলেন, সেখানথেকে রক্ত বেরহয়ে আসছে, তখনহযরত হুসাইন (রাঃ)কে বললেন, প্রিয় ভাইজান! চলো, আমরা এখান থেকেসরে যাই। এইরক্তাক্ত ভূমি দেখেআমার খুব ভয়করছে, আমার খুবইখারাপ লাগছে। এইরক্ত ভূমিতে অবস্থান করোনা। চলো, আমরাএখান থেকে অন্যত্র চলেযাই। হযরত ইমামহুসাইন (রাঃ) বললেন,
ওগোআমার প্রাণ-প্রিয়বোন ! এখান থেকেআমি বের হতেপারব না। এটাআমার ‘শাহাদাত গাহ’ । এখানেই আমাকেশাহাদাত বরণ করতেহবে। এখানেই আমাদেররক্তের নদী প্রবাহিত হবে। এটা সেইভূমি, যেটা আহলেমুস্তাফা (ছল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) এররক্তে রঞ্জিত হবে।এটাই সেই জায়গা, যেখানে ফাতিমাতুয যাহরা(রাঃ)-এর বাগানের বেহেশতী ফুলটুকরো টুকরো হয়েপতিত হবে এবংতাঁদের রক্তে এইভূমি লালে লালহয়ে যাবে। তাইসবাই অবতরণ করো, ছবর, ধৈর্য এবংসাহসের সাথে তাবুতেঅবস্থান করো। আমরাএখান থেকে কখনওযেতে পারব না।এখানেই আমাদেরকে ধৈর্যও সাহসিকতার পরাকাষ্টা দেখাতেহবে এবং এখানেইশাহাদাত বরণ করতেহবে।
মোটকথাহলো মদীনাবাসী মদিনাথেকে মক্কায় গিয়েছিলেন এবংমক্কা থেকে বেরহয়ে কারবালায় এসেগেছেন । তকদিরতাঁদেরকে কারবালায় নিয়েএসেছে । কেননাকিয়ামত পর্যন্ত সবাইযেন তাঁদেরকে কারাবালাবাসী বলেঅভিহিত করেন ।যা হোক, তাবু খাটিয়ে তারাকারবালায় অবস্থান নিলেন।
তাঁরাঅবস্থান নেয়ার পরথেকে ইবনে যিয়াদও ইয়াযীদের পক্ষথেকে সৈন্যবাহিনী একদলেরপর একদল আসতেলাগল। যেই দলইআসে, সবাই ইয়াযীদের পক্ষথেকে হযরত ইমামহুসাইন (রাঃ)এরকাছে এ নির্দেশটাই নিয়েআসল- ‘হযরত ইমামহুসাইন (রাঃ) কেগিয়ে বলো, তিনিযেন ইয়াযীদের কাছেবাইয়াত গ্রহণ করেন।যদি তিনি বাইয়াত গ্রহণকরতে রাজী হন, তখন তাঁকে কিছুবলোনা, তাঁকে ধরেআমার কাছে নিয়েএসো। আর যদিবাইয়াত গ্রহণ করতেঅস্বীকার করেন, তখনতাঁর সাথে যুদ্ধকরো এবং তাঁরমস্তক কর্তন করেআমার কাছে পাঠিয়ে দাও।’ এভাবে সৈন্য বাহিনীর যেইদলটিই আসতে লাগল, তারা একই হুকুমনিয়ে আসল। হযরতইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামবললেন, ‘এটাতো হতেইপারে না যে, আমি ইয়াযীদের হাতেবাইয়াত গ্রহণ করি।
আফসোসের বিষয়, আমাকে আহ্বান করাহয়েছে আমার হাতেবাইয়াত গ্রহণ করারজন্য। আর এখনআমাকে বাধ্য করাহচ্ছে ইয়াযীদের হাতেবাইয়াত হওয়ার জন্য! এই বায়াত নাকরার জন্যইতো আমিমদীনা ছেড়ে মক্কাচলে গিয়েছিলাম। তাহলেকি আমি এখনমক্কা থেকে এখানেএসেছি ইয়াযীদের হাতেবাইয়াত হওয়ার জন্য? এটা কিছুতেই হতেপারে না। আমিইয়াযীদের হাতে কখনোবাইয়াত গ্রহণ করবনা।’ ওরা বলল, আপনি যদি ইয়াযীদের হাতেবাইয়াত গ্রহণ করতেরাজী না হন, তাহলে যুদ্ধের জন্যপ্রস্তুত হোন ।তিনি (রাঃ) বললেন, আমিতো যুদ্ধের জন্যওআসিনি। যুদ্ধের কোনইচ্ছাও পোষণ করিনা। ওরা বলল, এরকমতো কিছুতেই হতেপারে না। হয়তোবাইয়াত গ্রহণ করতেহবে নতুবা যুদ্ধকরতে হবে। হযরতইমাম হুসাইন (রাঃ) যখন দেখলেন, এদেরউদ্দেশ্য খুবই খারাপ, তখন তিনি তাদেরসামনে তিনটি শর্তপেশ করলেন। তিনিবললেন, ‘শোন! কূফাবাসী আমারকাছে চিঠি লিখেছেএবং চিঠিতে এমনকথা লিখা ছিল, যার জন্য শরীয়তমতে আমি এখানেআসতে বাধ্য হয়েছি। এখন যখনতারা বেঈমানী করেছে, আমি তোমাদের সামনেতিনটা শর্ত পেশকরছি; তোমাদের যেটাইচ্ছা সেটা গ্রহণকরো এবং সেইঅনুসারে কার্য সম্পাদন করো-
১। হয়তোআমাকে মক্কায় চলেযেতে দাও। সেখানেগিয়ে হেরেম শরীফেঅবস্থান করে ইবাদত-বন্দেগীতে নিয়োজিত থেকেবাকী জীবনটা অতিবাহিত করব
২। যদিমক্কায় যেতে নাদাও, তাহলে অন্যকোন দেশে যাওয়ার সুযোগদাও, যেখানে কাফিরবা মুশরিকরা বসবাসকরে। ঐখানে আমিআমার সমস্ত জীবনদ্বীনের তবলীগে ব্যয়করবো এবং ওদেরকেমুসলমান বানানোর প্রচেষ্টা চালাতেথাকবো আর
৩। যদিঅন্য কোন দেশেওযেতে না দাওতাহলে এমন করতেপার যে, আমাকেইয়াযীদের কাছে নিয়েচলো। আমি তারসাথে বসে আলোচনাকরব। হয়তঃ কোনসন্ধিও হয়ে যেতেপারে, এই নাজুকঅবস্থার উন্নতিও হতেপারে এবং রক্তপাতের সম্ভাবনাও দূরীভূত হতেপারে।
ইয়াযীদ বাহিনীএ তিনটি শর্তকূফার গভর্নর ইবনেযিয়াদের কাছে পাঠিয়ে দিল।সে এ শর্তগুলোর কথাশুনে তেলে বেগুনেজ্বলে উঠল এবংআমর বিন ইবনেসা’আদ’ যেসেনাপতি ছিল তাকেলিখল যে, আমিতোমাকে সালিশকার বাবিচারক বানিয়ে পাঠাইনি যে, তুমি আমার এবংহযরত ইমাম হুসাইন(রাঃ)এর মধ্যেসন্ধি করার ব্যবস্থা করবে; আমি তোমাকে পাঠিয়েছি হযরতইমাম হুসাইন (রাঃ)কে বাইয়াত গ্রহণকরতে বলার জন্যঅথবা উনার সাথেযুদ্ধ করে তাঁরমস্তক আমার কাছেপাঠিয়ে দেয়ার জন্য।অথচ তুমি সন্ধিরচিন্তা-ভাবনা করছোএবং এর জন্যবিভিন্ন তদবীর করছো।আমি আবার তোমাকেশেষবারের মতো নির্দেশ দিচ্ছি, ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুযদি বাইয়াত গ্রহণকরতে অস্বীকার করেন, তাঁর সঙ্গে যুদ্ধকরো এবং মস্তককেটে আমার কাছেপাঠিয়ে দাও। যখনহযরত ইমাম হুসাইনআলাইহিস সালামকে এইনির্দেশের কথা শুনানোহলো, তখন তিনিবললেন, ‘আমার পক্ষথেকে যা প্রমাণকরার ছিল, তাপ্রমাণিত হয়েছে এবংযা বলার ছিলতা বলা হয়েছে। এখনতোমাদের যা মর্জিতা করো। আমিইয়াযীদের হাতে কিছুতেই বাইয়াত গ্রহণকরব না।’ ওরাবলল, তাহলে যুদ্ধের জন্যপ্রস্তুত হোন। তিনিবললেন, ‘তোমাদের পক্ষথেকে যা করারতোমরা কর। আমারপক্ষ থেকে যাকরার আমি করব।
তথ্যসূত্র
1.
কারবালা প্রান্তরে(লেখকঃ খতিবে পাকিস্তান হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ শফী উকাড়বী(রহঃ))