উপরের বক্তব্যের উপর কারো প্রশ্ন হতে পারে যে- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বিনা মাধ্যমে সরাসরি আল্লাহর নিকট হতে সব কিছু লাভ করতে পারেন- তাহলে জিবরাঈলের প্রয়াজন হলো কেন? এখানে তো দেখা যায়- ওহীর ক্ষেত্রে হযরত জিবরাঈলকে আল্লাহ পাক মাধ্যম বানিয়েছেন। বুঝা গেল- মানব রাসূলগণ জিবরাঈল নামক ফেরেস্তা রাসূলের মুখাপেক্ষী ছিলেন। (ওহাবী ও মউদূদীবাদীদের দাবী)।
জবাব
===
রাসূলে পাকের দরবারে জিবরাঈলের আগমন ছিল একটি কানুন বা নিয়মের অনুসরণ মাত্র। রাসূলে পাকের দরবারে ফিরিস্তার এই আগমন হুযুরের এলেমের জন্য ছিল না। আল্লাহ পাক প্রথমেই সব কিছু শিক্ষা দিয়ে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ কর্তৃক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রথমেই “তালীম” দেয়া হয়েছে- কিন্তু “নুযুল বা তানযীল” হয়েছে পরে। শরিয়তের বিধি বিধান নবীজীর পূর্ব-এলেম -এর উপর নির্ভরশীল নয় -বরং তানযীলের উপরই শরিয়তের বিধি বিধান নির্ভরশীল। মোদ্দা কথায়- রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়েই তাশরীফ এনেছেন- কিন্তু ঐসব শিক্ষা বাস্তবায়ন হয়েছে ফেরেস্তা কর্তৃক নুযুল বা তানযীলের মাধ্যমে। এটা অতি সুক্ষ্ম বিষয়। আল্লাহ পাকের ইচ্ছা- শরিয়তের বিধি-বিধান ঐ সময় চালু হবে- যখন জিবরাঈলের মাধ্যমে তা প্রেরণ করা হবে। এর স্বপক্ষে কয়েকটি দলীল রয়েছে। যেমন- আল্লাহ পাক সূরা আর-রাহমান-এ এরশাদ করেছেন –
الرحمان علم القران – “তিনিই রহমান- যিনি শিক্ষা দিয়েছেন -আল কুরআন”।
এখানে ফেল, ফায়েল ও একটি মাফউল উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য একটি মাফউল (রাসূল) উহ্য রয়েছে। কেননা, বাবে তাফঈলের দুইটি মাফউল হওয়া বাধ্যতামূলক। সেই উহ্য মাফউলটি হলো “মোহাম্মাদান”। অর্থাৎ ”তিনিই রহমান- যিনি মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শিক্ষা দিয়েছেন আল কুরআন”।
অত্র আয়াতে علم শব্দটির কর্তা হচ্ছেন আল্লাহ। এটা সাধারণ অতীত কাল (ماضي مطلق) বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে- যার অর্থ ”সুদূর অতীতকালে আল্লাহ্ তাঁকে কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন”। তাইতো আমাদের প্রিয় নবী জন্ম হয়েই নামায আদায় করেছেন এবং কালেমা শাহাদাত পাঠ করেছেন। (খাসায়েসে কুবরা- আল্লামা জালালুদ্দীন সুযুতি)।
অথচ কালেমা পরে নাযিল হয়েছে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ৪০ বৎসর বয়সে- আর নামাযের বিধান নাযিল হয়েছিল শবে মি’রাজে- যখন হুযুরের বয়স ছিল সাড়ে ৫১ বৎসর। কোরআন নাযিলের বহু পূর্বে তিনি কালেমা ও নামায শিখলেন কখন? বুঝা গেল- তিনি ঐসব আল্লাহ হতেই শিখে এসেছেন- জিবরাঈলের (عليه السلام) মাধ্যমে নয়।
(২) আল্লাহ পাক কোরআন সম্পর্কে এরশাদ করেছেন- هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ অর্থাৎ- এই কোরআন মুক্তাকীনদের জন্য পথ প্রদর্শনকারী। হুযুরের জন্য পথ প্রদর্শনকারী হলে বলা হতো هُدًى لك অর্থাৎ- আপনার জন্য পথ প্রদর্শনকারী। প্রকৃত পক্ষে নবীগণের পথ প্রদর্শনকারী হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ – কুরআন নয়।
(৩) জিবরাঈলের মাধ্যমে কোরআন নাযিলের পূর্বে ৪০ বৎসর পর্যন্ত হুযুরের জিন্দেগী ছিলো সততা, বিশ্বস্ততা, সত্যবাদিতা, সরলতা ও মানবসেবার অতি উত্তম আদর্শ। ফলে কাফেরগণও তাকে আল-আমীন ও সাদিকুল ওয়াদ (অঙ্গীকার রক্ষাকারী) লক্ববে ভূষিত করেছিল। হুযুরের হেদায়াতপ্রাপ্তির শিক্ষা যদি কোরআন নাযিলের উপর নির্ভরশীল হতো, তাহলে হয়তো অন্যান্য আরবদের মতই হতো তাঁর জীবন। (নাউযুবিল্লাহ)।
এবার বলুন- এসব হেদায়াত বা গুণাবলী তিনি কোন ফেরেস্তার মাধ্যমে পেয়েছিলেন?
(৪) প্রথম অহী নাযিলের পূর্বে ছয় মাস যাবৎ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হেরা গুহায় ইতিকাফ, নামায, রুকু-সিজদা, মোরাকাবা, মোশাহাদা- ইত্যাদি ইবাদতে মশগুল ছিলেন। কে তাকে এসব শিক্ষা দিয়েছিলেন?
(৫) নামায ফরয হয় মি’রাজ রজনীতে সরাসরি আল্লাহর দরবারে। মি’রাজে যাওয়ার পথে বাইতুল মোকাদাসে তিনি সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরামের ইমাম হয়ে নামায আদায় করেছিলেন। হযরত জিবরাঈল ছিলেন মোয়াযযিন -আর নবীগণের মধ্যে হয়েছিলেন মুকাব্বির।
বলুন- এই নামায কে শিক্ষা দিয়েছিলেন- জিবরাঈল- নাকি আল্লাহ? নামায পড়াতে হলে ইমামতির নিয়ম কানুন আগে শিখতে হয়। তাঁর পিছনে এমন সব অভিজ্ঞ মোক্তাদী ছিলেন- যারা পূর্বে ইমামতি করে নিজ নিজ উন্মতকে নামায পড়াতেন। এমন সুশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ নবীগণের ইমামতি করা চাট্টিখানি কথা নয়। নামায সম্পর্কে ইমামকে মোক্তাদী থেকে বেশী মাসআলা জানতে হয়। আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কার নিকট থেকে এসব মাসআলা শিখেছিলেন এবং কখন শিখেছিলেন? উত্তর নিম্প্রয়োজন- তারাই বলুক।
৬। অহী সাত প্রকার। সব অহী জিবরাঈলের মাধ্যমে নাযিল হয়নি। শুধু কোরআন নাযিল হয়েছে জিবরাঈলের মাধ্যমে। কিন্তু এর মর্মবাণী সবগুলো জিবরাঈলও জানতোনা। সূরা মরিয়মের শুরুতে ঐ كهيعص -এই খন্ড হরফগুলো যখন জিবরাঈল (عليه السلام) পাঠ করছিলেন- তখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন- (علمت) “আমি পূর্বেই এর মর্ম জেনেছি” (রূহুল বয়ান)।
বুঝা গেল- আয়াত নাযিল হয়েছে জিবরাঈলের মাধ্যমে – কিন্তু মর্মবাণী ইলকা হয়েছে সরাসরি। আল্লাহর পক্ষ হতে (তাফসীরে রুহুল বয়ান)। কোন কোন অহী জিবরাঈল ছাড়াই অবতীর্ণ হয়েছে। যেমন আল্লাহ পাক বলেন –
ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى فَأَوْحَى إِلَى عَبْدِهِ مَا أَوْحَى –
অর্থাৎ- “আমার বন্ধু নিকট থেকে আরো নিকটে আসলেন- যেমন দুই ধনুকের মুখামুখী –বরং তার চেয়েও কাছে। অতঃপর আল্লাহ আপনি প্রিয় বান্দার প্রতি গোপন অহী নাযিল করলেন”। (সূরা আন-নাজম, ৮-১০ আয়াত)। এখানে সরাসরি ওহী নাযিলের উল্লেখ রয়েছে- যার খবর জিবরাঈলও জানেন না। (মতান্তরে ৯০ হাজার কালাম)।