একজন ইমানদার ব্যক্তির মৌলিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম হলো ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের বর্ণনাগুলো অধ্যয়ন করলে বোঝা যায়, অঙ্গীকার রক্ষা করা ইমানের দাবি। মুমিন ওয়াদা ভঙ্গ করতে পারে না। ‘মুমিন ব্যক্তি ওয়াদা করলে তা পূরণ করে।’ আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের বেশ কয়েকটি আয়াতে ওয়াদা পূরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করো। নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩৪)। তোমরা যখন পরস্পর আল্লাহর নামে কোনো ওয়াদা করো তা পূর্ণ করো। (সুরা নাহ্ল, আয়াত ৯১)। ‘হে ইমানদাররা! তোমরা ওয়াদাগুলো পূরণ করো।’ (সুরা মাইদা, আয়াত ১)।
মানুষের পারস্পরিক ওয়াদা-অঙ্গীকার বা চুক্তি হতে পারে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির, ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির বা সমষ্টির সঙ্গে সমষ্টির। একাধিক ব্যক্তি সম্মিলিত হয়ে যদি কোনো অঙ্গীকার বা চুক্তি করে, তাহলে প্রত্যেকেই চুক্তি বাস্তবায়নে দায়বদ্ধ থাকবে। চুক্তির অপর পক্ষ তাদের যেকোনো ব্যক্তির কাছেই চুক্তিবদ্ধ অধিকার দাবি করতে পারবে এবং সে তা পূরণে বাধ্য থাকবে। কম্পানি এবং সরকারি চুক্তিও আলোচ্য অঙ্গীকারের আওতাভুক্ত। চুক্তির ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য দায়বদ্ধ থাকবেন। কম্পানি বা সরকারি নীতিমালা অনুযায়ীই তাকে চুক্তি সম্পাদন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা ভঙ্গ করে কোনো চুক্তি সম্পাদন করলে তার দায়-দায়িত্ব নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বহন করতে হবে এবং সে জন্য প্রতিষ্ঠান কোনো ক্ষতির শিকার হলে সেটা ওই কর্মকর্তাকেই বহন করতে হবে। হজরত ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সাবধান! তোমরা সবাই দায়িত্বশীল, আর সবাইকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)।
যেকোনো ধরনের ওয়াদা-অঙ্গীকার বা চুক্তি পূরণ করা ওয়াজিব এবং এটা ইমানের পরিপূর্ণতার জন্য একটি অপরিহার্য শর্ত। আর ওয়াদা ভঙ্গ করা বা চুক্তিবিরোধী কাজ করা ইমানের পরিপন্থী, যাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) মুনাফেকির আলামত বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তির মধ্যে চারটি গুণ একত্রে পাওয়া যাবে, সে খাঁটি মুনাফিক আর যার মধ্যে চারটির কোনো একটি পাওয়া যাবে, সেও মুনাফিক হিসেবে গণ্য হবে যতক্ষণ না সে তা পরিত্যাগ করে। গুণ চারটি হলো_(ক) তার কাছে কোনো আমানত রাখা হলে সে তার খিয়ানত করে। (খ) সে কথা বললে মিথ্যা কথা বলে। (গ) সে অঙ্গীকার করলে তা ভঙ্গ করে। (ঘ) সে কারো সঙ্গে বিরোধ হলে অশ্লীলতার আশ্রয় নেয়।’ (বুখারি ও মুসলিম)। রাসুলে করিম (সা.) অঙ্গীকার রক্ষা করার বিষয়ে অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন। নবুয়তপ্রাপ্তির আগেও কোনো দিন তিনি কারো সঙ্গে ওয়াদা ভঙ্গ করেননি। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আবু হাসমা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে তাঁর নবুয়তপ্রাপ্তির আগে আমি কিছু কেনাবেচা করেছিলাম। তাতে ক্রয়কৃত বস্তুর মূল্যের কিছু অংশ বাকি রয়ে গেল। তখন আমি তাকে বললাম, আপনি এখানে অপেক্ষা করুন, আমি অবশিষ্ট মূল্য নিয়ে এখানে আসছি। কিন্তু আমি বাড়িতে যাওয়ার পর সে ওয়াদার কথা ভুলে গেলাম। তিন দিন পর বিষয়টি আমার স্মরণ হলো। অতঃপর আমি গিয়ে দেখি, তিনি সেখানেই আছেন। আমাকে দেখে তিনি বললেন, তুমি আমাকে কষ্ট দিলে, আমি তিন দিন ধরে এখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। (আবু দাউদ)।
ইসলামে ওয়াদা পূরণের বিষয়টিকে অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। সে কারণে কোনো ব্যক্তি যদি কারো সঙ্গে ওয়াদা করার পর সে ওয়াদা পূরণ করার আগেই মারা যায়, তাহলে তার ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারীদের ওপর সে ওয়াদা পূরণ করা ওয়াজিব। ফকিহরা এ বিষয়ে একমত যে যদি কেউ কোনো আর্থিক বিষয়ে কারো সঙ্গে কোনো ওয়াদা করে তা পূরণ না করে মারা যায়, তাহলে তার পরিত্যক্ত সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ দিয়ে সেটা পূরণ করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) কিছু ওয়াদা করেছিলেন, যা পূরণ করার আগেই তাঁর ওফাত হয়ে যায়। অতঃপর হজরত আবু বকর (রা.) খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সেসব ওয়াদা পূরণ করেন। বুখারি ও মুসলিম উভয় সহিহ গ্রন্থে সংকলিত একটি হাদিস হজরত জাবের (রা.) বর্ণনা করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পর হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর যখন বাহরাইনের গভর্নর আলা ইবনে হাজরামির কাছ থেকে কিছু সম্পদ এলো, তখন আবু বকর (রা.) ঘোষণা করলেন, যার কাছে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কোনো ঋণ আছে অথবা রাসুল (সা.) কাউকে কোনো ওয়াদা করে থাকলে, সে যেন আমার কাছে আসে। তখন আমি বললাম, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে এভাবে, এভাবে, এভাবে দেবেন বলে ওয়াদা করেছিলেন। তিনি (সা.) তিনবার তাঁর দুই হাত প্রসারিত করে এটা বলেছিলেন। অতঃপর আবু বকর (রা.) এ পুঁটলি ভরে আমাকে দিলেন আর আমি গুণে দেখলাম তাতে ৫০০ দিনার আছে। তারপর হজরত আবু বকর (রা.) বললেন, তুমি আরো দ্বিগুণ (এক হাজার দিনার) নিয়ে নাও।’ ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে মিথ্যা প্রলোভন দেওয়াও ওয়াদা ভঙ্গের শামিল। ইমাম বুখারি (রহ.)-এর জীবনী থেকে জানা যায়, তিনি দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে কারো কাছে হাদিস সংগ্রহ করার জন্য গিয়ে দেখলেন, তিনি খাবার দেওয়ার মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে ঘোড়াকে ডাকছেন। তিনি তার কাছ থেকে হাদিস গ্রহণ না করে ফিরে এসেছেন এ আশঙ্কায়, যে ব্যক্তি একটা প্রাণীকে মিথ্যা প্রলোভন দেখাতে পারে, তার দ্বারা রাসুলের হাদিস সম্পর্কে মিথ্যা বলা কোনো অসম্ভব বিষয় নয়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমের (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের ঘরে বসা ছিলেন, এমন সময় আমার মা আমাকে এ বলে ডাকলেন, এদিকে এসো, আমি তোমাকে কিছু দেব। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি তাকে কী দিতে চেয়েছিলে? উত্তরে মা বললেন, খেজুর। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, এ ধরনের প্রলোভন দেখানোর ব্যাপারে সাবধান। যদি তুমি তাকে কিছুই না দিতে, তাহলে তোমার আমলনামায় একটা মিথ্যা লেখা হতো।’ (আবু দাউদ)।
ওয়াদা পূরণ করা ইমানের দাবি
পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।




Users Today : 8
Users Yesterday : 1258
This Month : 11933
This Year : 151410
Total Users : 267273
Views Today : 22
Total views : 3223387