খলিফা হারুনুর রশীদের শাসনকালে বাহলুল (রাঃ) নামক এক বুযুর্গ ছিলেন। হারুনুর রশীদ এই বুযুর্গের সঙ্গে প্রায়ই হাসি-মযাক করতেন । হযরত বাহলুল (রাহঃ) অনেকটা মাজুর তথা আত্মভোলা প্রকৃতির বুযুর্গ ছিলেন। তবে আত্মভোলা প্রকৃতির বুযুর্গ হলেও তাঁর কথাবার্তা ছিল অত্যন্ত গভীর জ্ঞান সম্পন্ন। অত্যধিক সাধনা ও গোটা জীবনের লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি লোকদেরকে এমন এমন মূল্যবান কথা ও উপদেশ দান করতেন, যা ছিল স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো। তাঁর কথাগুলো ছিল মুক্তার মতোই দামী
খলীফা হারুনুর রশীদ প্রহরীদের বলে রেখেছিলেন, এই বুযুর্গ আমার সঙ্গে সাক্ষাত করতে আসলে কেউ তোমরা বাধা দিবে না। তাকে সসম্মানে আমার দরবারে নিয়ে আসবে। ফলে বাহুলুল (রাহঃ)-এর যখনই ইচ্ছে হতো, তখনই খলীফার দরবারে নির্বিঘ্নে চলে যেতেন।
একদিনের ঘটনা
খলীফা হারুনুর রশীদ তাঁর রাজ দরবারে বসা। তাঁর হাতে একটি সুন্দর কারুকার্যময় লাঠি। তিনি বারবার ঘুরে ফিরে লাঠিখানা দেখছিলেন। ঠিক এমন সময় হযরত বাহলুল (রাহঃ) দরবারে প্রবেশ করলে খলীফা কিছুটা হাস্যচ্ছলে বললেন-
বুযুর্গ বাহলুল! আপনার নিকট আমার একটি অনুরোধ। পারবেন কি সেই অনুরোধ রক্ষা করতে?
হযরত বাহলুল (রাহঃ) হাসিমুখে বললেন, আগে আপনার অনুরোধের
কথাটি শুনতে দিন। তারপর না হয় একটা ব্যবস্থা করা যাবে ।
খলীফা বললেন, আমি এই লাঠিখানা আপনাকে আমানতস্বরূপ দিচ্ছি। যদি আপনি আপনার চেয়ে বোকা ও নির্বোধ কোন লোককে দুনিয়াতে খুঁজে পান, তবে এটা আমার পক্ষ থেকে তাকে হাদিয়া স্বরূপ দান করবেন।
বাহলুল (রাহঃ) বললেন, ও সে কথা! ঠিক আছে আমি আপনার এ অনুরোধটুকু রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করব। এ কথা বলে তিনি লাঠি হাতে নিয়ে বের হয়ে চলে গেলেন।
মুহতারাম পাঠক! এখানে খলীফা কৌতুক করে এ কথাই বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, দুনিয়াতে আপনিই সবচেয়ে বড় নির্বোধ। আপনার চেয়ে বোকা পৃথিবীতে আর কেউ নেই। কেননা আপনি স্বেচ্ছায় দুনিয়ার আরাম- আয়েশকে পদদলিত করে ফকীরী জীবন যাপন করছেন। বিলাসী জীবন পরিত্যাগ করে সাধারণ জীবনকে বেছে নিয়েছেন যা কেবল একজন নির্বোধ ব্যক্তির পক্ষেই শোভা পায়। এ ঘটনার পর কয়েক বছর অতিক্রান্ত হল। একদিন হযরত বাহলুল (রাহঃ) জানতে পারলেন খলীফা হারুনুর রশীদ ভীষণ অসুস্থ। মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু শয্যায় শায়িত । যে কোন সময় তার জীবন প্রদীপ চির দিনের জন্য নিভে যেতে পারে। সমাপ্তি ঘটতে পারে বিলাস বহুল আয়েশী জীবনের। অনেক চিকিৎসা করা হচ্ছে কিন্তু কোনো উপকার হচ্ছে না।
এ সংবাদ শুনতে পেয়ে হযরত বাহলুল (রাহঃ) যুবদ্রুত খলীফার দরবারে উপস্থিত হলেন। অতঃপর তাকে সম্বোধন করে বললেন-
আমীরুল মুমেনীন। কেমন আছেন? খলীফা বললেন- কেমন আর থাকব! সামনে তো লম্বা সফর।
বাহলুল (রাহঃ) অনেকটা না বুঝার ভান করে বললেন, কোথাকার সফর? আগে সুস্থ হোন। তারপর না হয় প্রয়োজন হলে সফর করবেন।
খলীফা বললেন, আমি আপনাকে দুনিয়ার কোনো সফরের কথা বলছি না। অমি তো সফর বলতে আখেরাতের দীর্ঘ সফরকেই বুঝাতে চাচ্ছি। কেননা আমার মনে হয়, আমি আর বেশি সময় বাঁচব না। এটাই বোধ হয় আপনার সাথে আমার জীবনের শেষ সাক্ষাত ।
হযরত বহলুল (রাহঃ) বললেন- জনাব! এ সফর থেকে কতদিন পর ফিরে আসবেন? হারুনুর রশীদ বললেন, ভাই! এটা আখেরাতের সফর। এ সফর থেকে কেউ ফিরে আসে না।
হযরত বাহলুল (রাহঃ) আশ্চর্য হওয়ার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন,
তাহলে আপনি এ সফর থেকে ফিরে আসেবন না? আচ্ছা, তাহলে এ সফরের আরাম ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনার জন্য কতজন সৈন্য সামন্ত আগে প্রেরণ করেছেন ?
বাদশাহ বললেন, ভাই! আপনি আবার নির্বোধের মতো কথা বলছেন । এ তো আপনি ভাল করেই জানেন যে, আখেরাতের সফরে কেউ সাথে যায় না। কোনো দেহরক্ষী, কোনো সৈন্য, কোনো লোক লশকর সাথে নেওয়া যায় না। ঐ সফরে তো মানুষকে একাই যেতে হয়।
হযরত বাহলুল (রাহঃ) বললেন, এত দীর্ঘ সফর, তারপর সেখান থেকে আর ফিরেও আসবেন না, তা সত্ত্বেও আপনি কোনো সৈন্য-সামন্ত পূর্বে পাঠালেন না! অথচ এর আগে আপনি যত সফর করেছেন সকল সফরেই যাবতীয় ব্যবস্থা সম্পাদনের জন্য পূর্বেই বিরাট সৈন্য বাহিনী প্রেরণ করতেন, আরাম আয়েশের হরেক রকম ছামানাদি আগেই পাঠিয়ে দিতেন। এ সফরে কেন সেগুলো পাঠাচ্ছেন না?
বাদশাহ বললেন না ভাই, এ সফরই এমন যে, সেখানে পূর্বে কোনো সৈন্য-সামন্ত, লোক-লস্কর ও আরাম-আয়েশের দুনিয়াবী কোনো
আসবাবপত্র প্রেরণ করা যায় না।
হযরত বাহলুল (রাহঃ) বললেন, জনাব বাদশাহ। অনেকদিন থেকে আপনার একটি আমানত আমার নিকট রক্ষিত আছে। আর তা হলো একটি লাঠি। আপনি এ লাঠিখানা আমার নিকট আমানত স্বরূপ দেওয়ার পূর্বে বলেছিলেন, যদি দুনিয়াতে তোমার চেয়ে বোকা ও আহমক কাউকে পাও তাহলে এটা আমার পক্ষ থেকে তাকে হাদিয়া স্বরূপ দিয়ে দিও।
এ আমানত গ্রহণের পর থেকে, আজ পর্যন্ত আমি আমার চেয়ে বোকা লোক অনেক তালাশ করেছি গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে খুঁজে ফিরেছি, পাহাড়-জঙ্গল চষে বেরিয়েছি কিন্তু আমার চেয়ে বোকা একমাত্র আপনাকে ছাড়া আর অন্য কাউকে পাইনি।
একথা শুনার পর বাদশাহ হারুনুর রশীদ হযরত বাহলুল (রাহঃ) এর দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন এবং বললেন সত্যি কি তাই?
হযরত বাহলুল (রাহঃ) বললেন, হ্যাঁ, আমি যা বলেছি সত্যিই বলেছি। এতটুকু মিথ্যেও বলিনি ।
বাদশাহ বললেন, আমি এখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত। আপনার এই রহস্যময় কথা আমার বুঝে আসছে না। অনুগ্রহ পূর্বক কথাটির ব্যাখ্যা করুন।
হযরত বাহলুল (রাহঃ) বললেন এটা এজন্য যে, আমি দেখেছি আপনার ছোট থেকে ছোট সফর অতি সামান্য সময়ের জন্য হলেও প্রায় মাস খানেক পূর্ব থেকে তার প্রস্তুতি চলত। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সামান্য পাইক-পেয়াদার পর্যন্ত কর্মচঞ্চলতা বেড়ে যেত। সফরে যেন কোনো কষ্ট না হয়, এজন্য যাবতীয় ব্যবস্থাপনা আগেই সম্পন্ন করা হত। পানাহারের জিনিসপত্র, লোক-লস্কর, তাঁবু ইত্যাদি সবকিছু সফরের পূর্বেই প্রেরণ করা হত। আর এখন এত দীর্ঘ সফর এবং তা এমন সফর যেখান থেকে আর ফেরাও হবে না তার কোনো প্রস্তুতি নেই। নেই কোন আয়োজন। সুতরাং আপনার চেয়ে বড় বোকা আর কে হতে পারে? কাজেই আপনাকে আমি আপনার দেওয়া আমানত ফিরিয়ে দিচ্ছি।
হযরত বাহলুল (রাহঃ)- এর কথাগুলো খলীফা তন্ময় হয়ে শুনলেন। তারপর কেঁদে কেঁদে করুণ কণ্ঠে বললেন- জনাব! আপনি ঠিকই বলেছেন। সারা জীবন আমি আপনাকে বোকা মনে করেছি। কিন্তু আসল বুদ্ধিমানের মতো কথা আপনিই বলেছেন। আসলেই আমি আমার জীবন নষ্ট করেছি। আখেরাতের এ দীর্ঘ সফরের কোনো প্রস্তুতিই আমি নেইনি।
সম্মানিত পাঠ-পাঠিকা, খলীফা হারুনুর রশীদকে সম্বোধন করে হযরত বাহলুল (রাহঃ) যে কথাগুলো বলেছিলেন, গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে তা আমাদের প্রায় সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ দুনিয়াতে থাকা অবস্থায় আমাদের প্রত্যেককে সর্বদা এই চিন্তা আচ্ছন্ন করে রাখে যে,
কিভাবে অঢেল সম্পত্তির মালিক হব, কিভাবে সম্মানজনক বড় কোন পদ লাভ করব, কিভাবে নতুন বাড়ি নির্মাণ করব, কিভাবে আরাম-আয়েশের ছামানাদি সংগ্রহ করব ইত্যাদি। অনুরূপ কোথাও সফরে গেলে পূর্ব থেকেই ট্রেন, বাস ইত্যাদির টিকেট কেটে আসন সংরক্ষণ করে রাখি, যেখানে যাওয়া হবে সেখানে পূর্বেই সংবাদ পৌঁছে দেই, হোটেলে সিট বুক করে রাখি ইত্যাদি। এসব কাজ এজন্য করা হয় যে, যাতে সফরে আমাদের কোনোরূপ কষ্ট না হয়। অথচ দুনিয়ার এ সফর খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হয়ে থাকে।
কিন্তু যেখানে সদা সর্বদা থাকতে হবে, যে জীবনের কোনো ইতি নেই, একবার শুরু হলে আর শেষ হবে না, সেই জীবনের জন্য আমাদের কোনো চিন্তা নেই যে, সেখানে কিভাবে আমরা আরামে থাকবো, কিভাবে বাড়ি নির্মাণ করবো। কিভাবে সেখানে পূর্ণ সফলতা অর্জন করবো। এটা বড়ই আফসোসের বিষয়।
স্বীয় প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণকারী ও মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের জন্য তৈরি গ্রহণকারীকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বুদ্ধিমান বলে আখ্যায়িত করেছেন। সুতরাং বুঝা গেল কেউ যদি তা না করে, তবে সে নিতান্তই বোকা, মস্তবড় নির্বোধ ও চুড়ান্ত পর্যায়ের আহমক। এরূপ ব্যক্তি দুনিয়াবী দৃষ্টিকোণ থেকে যতবড় সম্পদশালীই হোক না কেন, যতবড় পদের অধিকারীই হোক না কেন, দুনিয়াদারদের চোখে সে যতবড় জ্ঞানীই হোক না কেন, প্রকৃত পক্ষে সে যে চরম বোকা তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই ।