সপ্তম অধ্যায়
প্রসঙ্গঃ ঈদে মিলাদুন্নবী ও জন্মবার্ষিকী পালন
===========
১) হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) নূর নবী [ﷺ]-এঁর জন্ম প্রসঙ্গে ৯ম হিজরীতে একটি কবিতায় বলেছেনঃ-
– وانت لما ولدت اشرقت الأرض – وضاءت بنورك الأفق
অর্থঃ “হে প্রিয় রাসূল, আপনি যখন ভূমিষ্ঠ হন, তখন পৃথিবী উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল এবং আপনার নূরের ছটায় চতুর্দিক আলোময় হয়ে গিয়েছিল।” (নশরুত ত্বীব, মাওয়াহিব, বেদায়া ও নেহায়া)
২) বিশিষ্ট সাহাবী হযরত হাসসান বিন সাবিত (রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু) মিলাদুন্নবী নবী [ﷺ] বর্ণনা প্রসঙ্গে একখানি কবিতাগ্রন্থ লিখেছিলেন এবং হুযুর নবী [ﷺ]-কে শুনিয়েছিলেন। পরবর্তীতে যার নাম রাখা হয়েছিল ‘দিওয়ানে হাসসান বিন সাবিত’। তিনি লিখেন,
أنك ولدت مبرا من كل عيب -كأنك خلقت كما تشاء –
وضم الاله اسمه الي اسمه -إذا قال في الخمس المؤذن اشهد –
وشق له من اسمه ليجله فذو العرش محمود ومذا محمد –
অর্থঃ ”হে প্রিয় রাসূল নবী [ﷺ], আপনি সর্বপ্রকার ত্রুটিমুক্ত হয়েই মাসুম নবী হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছেন। মনে হয়, যেন আপনার ইচ্ছা অনুযায়ীই আপনার বর্তমান সুরত পয়দা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ আযানের মধ্যে আপন নামের সাথে নবীর নাম সংযোজন করেছেন, যখন মুয়াযযিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের আযানে উচ্চারণ করেন, ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলাল্লাহ নবী [ﷺ]’। আর আল্লাহ আপন নামের অংশ দিয়ে তাঁর প্রিয় হাবীবের নাম রেখেছেন। আরশের অধিপতি হলেন ‘মাহমুদ’ এবং ইনি হলেন ‘মুহাম্মদ নবী [ﷺ]’।”
মাহমুদ থেকে মুহাম্মদ নামের সৃষ্টি হয়েছে এবং আহাদ থেকে আহমদ নামের সৃষ্টি হয়েছে (আল হাদীস)। মাহমুদ থেকে মুহাম্মদ গঠনে একটি ‘ওয়াও’ অক্ষর বাদ দিতে হয় এবং আহাদ থেকে আহমদ গঠনে একটি ”মীম” অক্ষর যোগ করতে হয়। যোগ বিয়োগের এই প্রক্রিয়াটি সুফী-সাধকগণের নিকট অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থাৎ মাহমুদ ও মুহাম্মদ এবং আহাদ ও আহমদ অতি ঘনিষ্ঠ। আল্লাহ নামটি চার অক্ষরবিশিষ্ট এবং মুহাম্মদ ও আহমদ নামটিও চার অক্ষরবিশিষ্ট। প্রধান ফেরেশতা, প্রধান আসমানী কিতাব, প্রধান সাহাবী, প্রধান মাযহাব ও প্রধান তরীকার সংখ্যা চার চার এবং সৃষ্টির প্রধান উপাদানও চারটি।
যথাঃ আব, আতিশ, খাক, বাদ (আগুন, পানি, মাটি, বায়ু)। কালেমা তাইয়েবার তাওহীদ অংশ বারো অক্ষরবিশিষ্ট এবং রিসালাতের অংশও বারো অক্ষরবিশিষ্ট। নবী করিম [ﷺ]-এঁর নামকরণ এবং কালেমাতে আল্লাহর সাথে মুহাম্মদ নাম সংযোজন, সবই আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। এতে মানুষের কোন হাত নেই। সুতরাং এই পরিকল্পনার তাৎপর্য পূর্ণভাবে উপলব্ধি করাও মানুষের সাধ্যাতীত ব্যাপার।
এখানে উপরোল্লিখিত হযরত আব্বাস ও হযরত হাসসান ((رضي الله عنه)মা) সাহাবীদ্বয়ের কাব্য রচনার ঘটনাটি ঈদে মিলাদুন্নবী [ﷺ] উপলক্ষ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন ও স্মরণিকা প্রকাশের একটি উত্তম দলীল ও প্রকৃষ্ট প্রমাণ। আল্লাহ তায়ালা কোরআন মাজীদে সূরা ইউনুসের ৫৮ নং আয়াতে মীলাদুন্নবী উপলক্ষ্যে প্রতি বৎসর ঈদ ও পবিত্র আনন্দানুষ্ঠান পালনের কথা উল্লেখ করেছেন। সূরা বাক্বারাতে মূসা (عليه السلام) ও বনী ঈসরাইলগণের নীলনদ পার হওয়া এবং প্রতি বৎসর এ উপলক্ষ্যে আশুরার রোযা ও ঈদ পালন করা এবং সূরা মায়েদায় ঈসা (عليه السلام) ও বনী ঈসরাইলের হাওয়ারীগণের জন্য আকাশ থেকে আল্লাহ কর্তৃক যিয়াফত হিসেবে মায়েদা অবতীর্ণ হওয়া উপলক্ষ্যে প্রতি বৎসর ঐ দিনকে ঈদের দিন হিসেবে পালন করার কথা কোরআনে উল্লেখ আছে।
বনী ইসরাইলের উপর আল্লাহর রহমত নাযিলের স্মরণে যদি প্রতি বৎসর ঐ দিনে ঈদ পালন করা যায়, তাহলে আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম নেয়ামত রাহমাতুল্লিল ‘আলামীন [ﷺ]-এঁর আগমন দিবস উপলক্ষ্যে প্রতি বৎসর ঈদে মিলাদুন্নবী [ﷺ] পালন করা যাবে না কেন? হুযুর করিম [ﷺ]-কে এক সাহাবী জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ [ﷺ]! প্রতি সোমবার আপনার রোযা রাখার কারণ কী? হুযুর [ﷺ] বললেনঃ এই দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং এই দিনেই (সোমবার) ২৭ শে রমযান আমার উপর কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে।” উক্ত প্রমাণাদিই ঈদে মিলাদুন্নবী [ﷺ] পালনের স্বপক্ষে জোরালো দলীল।
উল্লেখ্য, ঈদ মোট ৯টি। যথাঃ- (১) ঈদে রামাদ্বান, (২) ঈদে কোরবান, (৩) ঈদে আরাফা, (৪) ঈদে জুমা, (৫) ঈদে শবে বারাআত, (৬) ঈদে শবে ক্বাদর, (৭) ঈদে আশুরা, (৮) ঈদে নুযুলে মায়েদা এবং (৯) ঈদে মিলাদুন্নবী। সবগুলোই কোরআনে, হাদীসে ও বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ আছে।
ইন্তেকাল দিবস পালন হয় না কেন?
আরেকটি বিষয় প্রশ্ন সাপেক্ষ! তা হচ্ছে, নবী করিম [ﷺ]-এঁর শুধু জন্মতারিখ পালন করা হয় কেন, ইন্তেকাল তো একই তারিখে এবং একই দিনে হয়েছিল? সুতরাং একসাথে জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালন করাইতো যুক্তিযুক্ত। যেমন অন্যান্য মহামানব ও ওলী-গাউসদের বেলায় মৃত্যু দিবসে ওরস পালন করা হয়ে থাকে।
প্রথম উত্তর হলো, আল্লাহ পাক কোরআন মাজীদে নির্দেশ করেছেন নিয়ামত পেয়ে খুশী ও আনন্দ করার জন্য। নিয়ামত পাওয়া জন্ম উপলক্ষ্যেই হয়। যেমন কোরআনে আছেঃ- قُلْ بِفَضْلِ اللّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُواْ هُوَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُونَ
অর্থঃ “হে নবী! আপনি এ কথা ঘোষনা করে দিন, মুসলমানগণ খোদার ফযল ও রহমত পাওয়ার কারণে যেন নির্মল খুশি ও আনন্দোৎসব করে। এটা তাদের যাবতীয় সঞ্চিত সম্পদ থেকে উত্তম।”
তাফসীরে রুহুল মায়ানী উক্ত আয়াতে ‘ফযল’ ও ‘রহমত’ অর্থে হযরত মুহাম্মদ [ﷺ]-এঁর নাম উল্লেখ করেছেন। এটা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ((رضي الله عنه)মা)’র ব্যাখ্যা। রাসূল [ﷺ]-এঁর একহাজার চারশত নামের মধ্যে ‘ফযল’, ‘রহমত’, বরকত’, ‘নেয়ামত’ ও ‘নূর’ প্রভৃতি অন্যতম গুণবাচক নাম, যা গ্রন্থের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং নেয়ামতপ্রাপ্তি উপলক্ষ্যে শুকরিয়া আদায়ের জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠান করাই কোরআনের নির্দেশ। সূরা ইউনুসের ৫৮ নং আয়াতে নবীজী’র জন্মোৎসব পালন করার স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। সুতরাং ঈদে মিলাদুন্নবী [ﷺ] ও জশনে জুলুস কোরআনের আলোকেই প্রমাণিত।
দেখুন তাফসীরে রুহুল মায়ানী সূরা ইউনুসের ৫৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা।)
মোদ্দাকথা, আল্লাহ পাক হুযুর [ﷺ]-এঁর আবির্ভাব উপলক্ষ্যে আনন্দোৎসব করার নির্দেশ করেছেন। কিন্তু ইন্তেকাল উপলক্ষ্যে শোক পালন করতে বলেন নি। তাই আমরা আল্লাহর নির্দেশ মানি।
দ্বিতীয় উত্তর- নবী করিম [ﷺ] নিজে সোমবারের রোযা রাখার কারণ হিসেবে তাঁর পবিত্র বেলাদাত ও প্রথম ওহী নাযিলের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ বা ইন্তেকাল উপলক্ষ্যে শোক পালন করার কথা উল্লেখ করেন নি। যদি করতেন, তাহলে আমরা তা পালন করতাম। সুতরাং একই দিনে ও একই তারিখে নবী করিম [ﷺ]-এঁর জন্ম এবং ইন্তেকাল হলেও মৃত্যুদিবস পালন করা যাবে না। এটাই কোরআন-হাদীসের শিক্ষা।
তৃতীয় উত্তর- নবী করিম [ﷺ] তো স্বশরীরে হায়াত্ননবী। হায়াতুন্নবীর আবার মৃত্যুদিবস হয় কী করে? কেউ কি জীবিত পিতার মৃত্যুদিবস পালন করে? আসলে ওরা কোনটাই পালনের পক্ষে নয়। শুধু ঈদে মীলাদুন্নবী [ﷺ] পালনকারীদেরকে ঘায়েল করার লক্ষ্যেই এইসব শয়তানী কূটতর্কের অবতারণা করে থাকে। ওরা শয়তানের প্রতিনিধি। আমরা কোরআন নাযিলের আনন্দোৎসব করি শবে ক্বদরে এবং নবীজী’র আগমনের আনন্দোৎসব পালন করি ১২ ই রবিউল আউয়ালে। ওরা কোনটাই পালনের পক্ষপাতী নয়। আমরা সূরা ইউনুসের ৫৮ নং আয়াতের নির্দেশ পালন করি।