ইসলামের ইতিহাসে হুনাইনের যুদ্ধ বিশেষ তাৎপর্যবাহী ঘটনা। আরবদের সঙ্গে এটিই ছিল ইসলামের শেষ যুদ্ধ। এই যুদ্ধে জয়লাভের পর গোটা আরব ভূখণ্ড ইসলামের করায়ত্তে চলে আসে। বদর যুদ্ধের মতো এই যুদ্ধেও আল্লাহ তাআলা ফেরেশতা পাঠিয়ে মুসলমানদের গায়েবি সাহায্য করেন। তবে ফেরেশতারা বদরের মতো এই যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেননি। সাধারণ মুসলমানরা তাদের অংশগ্রহণকে প্রত্যক্ষও করেনি।
মক্কা বিজয়ের পর হাওয়াজিন গোত্র মক্কা থেকে তায়েফ পর্যন্ত বিস্তৃত তার শাখা গোত্রগুলোকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে একত্র করে। চার হাজার সৈন্যবাহিনীর পাশাপাশি সেনানায়ক মালিক বিন আউফ পূর্ণ শক্তির সঙ্গে রণাঙ্গনে তাদের সুদৃঢ় রাখার জন্য এই কৌশল অবলম্বন করে যে যুদ্ধক্ষেত্রে সবার পরিবার-পরিজনও উপস্থিত থাকবে। প্রত্যেকে নিজেদের সহায়-সম্পত্তিও সঙ্গে রাখবে। উদ্দেশ্য হলো, কেউ যেন পরিবার-পরিজন ও সহায়-সম্পদের টানে রণক্ষেত্র ত্যাগ না করে। পরিবার-পরিজনসহ তাদের মোট সংখ্যা ছিল ২৪ থেকে ২৮ হাজার। অন্যদিকে মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা ছিল ১২ থেকে ১৪ হাজার। এদের মধ্যে কয়েক শ ছিল নওমুসলিম। সংখ্যার আধিক্য দেখে কোনো কোনো মুসলিম সেনা উৎসাহের আতিশয্যে এ দাবি করে বসেন যে আজ আমাদের জয় অনিবার্য, পরাজয় অসম্ভব। কিন্তু এই অহংকারী মনোভাব আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) খুবই অপছন্দ করেন। তাই আল্লাহর হুকুমে মুসলমানরা প্রথমে বিপর্যস্ত হয়ে যায়। ৮০ থেকে ১০০ জন সাহাবি ছাড়া সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তারপর মহানবী (সা.)-এর দৃঢ়তা, সাহসিকতা ও আল্লাহর গায়েবি সাহায্যে মুসলমানরা চূড়ান্ত জয় লাভ করে।
হুনাইনের যুদ্ধ হচ্ছে মুহাম্মাদ ও তার অনুসারীগণ কর্তৃক বেদুঈন গোত্র হাওয়াজিন ও তার উপশাখা সাকিফ এর বিরুদ্ধে মক্কা থেকে তাইফের পথে একটি রাস্তায় ৬৩০ সালে লড়াইকৃত একটি যুদ্ধ। মুসলিমদের বিজয়ের মাধ্যমে যুদ্ধটি সমাপ্ত হয়, যারা অসংখ্য গনিমতের মাল দখল করে নেয়। সূরা তওবা তে এই যুদ্ধের উল্লেখ আছে, যা কুরআনে উল্লেখিত স্বল্পসংখ্যক যুদ্ধের মধ্যে অন্যতম।
এই হুনাইন হচ্ছে মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী একটি উপত্যকা। এখানেই এই ঐতিহাসিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুসলমানরা সামনে আসা মাত্র দুশমনরা আশ-পাশের পাহাড় থেকে এলোপাথাড়ি তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করলো। এ পরিস্থিতির জন্যে মুসলমানরা মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। এর ফলে তাদের সৈন্যদলে বিশৃংখলা দেখা দিলো এবং কিছুক্ষণের জন্যে তারা ময়দান ত্যাগ করলো। অনেক বেদুইন গোত্র ময়দান থেকে পালিয়ে গেলো। এদের মধ্যে সবেমাত্র ঈমান এনেছে এবং পূর্ণ প্রশিক্ষণ পায়নি এমন অনেক নও-মুসলিমও ছিলো। এই বিশৃংখল পরিস্থিতিতে হযরত (স) অত্যন্ত দৃঢ়তা ও প্রশান্ত চিত্তে যুদ্ধ ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে রইলেন এবং দুশমনদের মোকাবিলা করা ও ময়দান থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন না করার জন্যে মুসলমানদের প্রতি ক্রমাগত আহবান জানাতে লাগলেন। তার এই অপূর্ব ধৈর্য-স্থৈর্য এবং তার চারপাশে বহু সাহাবীর অকৃত্রিম দৃড়তা দেখে মুসলিম সৈন্যরা পুনরায় ময়দানে আসতে শুরু করলো এবং নবতর উৎসাহ-উদ্দীপনা ও শৌর্য-বীর্যের সঙ্গে দুশমনদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। নবী করীম (স) এবং তার সাহাবীদের এই ধৈর্য ও দৃঢ়তাকেই আল্লাহ তা’আলা তাঁর তরফ থেকে অবতীর্ণ সান্ত্বনা ও প্রশান্তির লক্ষণ বলে উল্লেখ করেছেন। এর ফলে আল্লাহর অনুগ্রহে অল্পক্ষণের মধ্যেই যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেলো এবং মুসলমানরা পুরোপুরি জয়লাভ করলো। কাফিরদের প্রায় ৭০ ব্যক্তি নিহত এবং সহস্রাধিক লোক বন্দী হলো।
দুশমনদের পশ্চাদ্ধাবন ও কল্যাণ কামনা কাফিরদের বাকি সৈন্যদের পালিয়ে গিয়ে তায়েফে আশ্রয় গ্রহণ করলো। কারণ তায়েফকে একটি নিরাপদ স্থান মনে করা হতো। হযরত (স) তাদের পশ্চাদ্ধাবন করলেন এবং তায়েফ অবরোধ করলেন। তয়েফে একটি মশহুর ও মজবুত দুর্গ ছিলো। এর ভেতরেই কাফিরগণ আশ্রয় গ্রহণ করেছিলো। অবরোধ প্রায় বিশ দিন অব্যাহত রইলো। হযরত (স) যখন ভালোমতো বুঝতে পারলেন যে, দুশমনদের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়েছে এবং এখন আর তাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার কোনো আশংকা নেই, তখন তিনি অবরোধ তুলে নিলেন এবং তাদের জন্যে দোয়া করলেন :
‘হে আল্লাহ! সাকীফ গোত্রকে সুপথ প্রদর্শন করো এবং তাদেরকে আমার কাছে হাযির হবার তাওফিক দাও।’
হুনাইনের যুদ্ধ থেকে মুসলমানদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। প্রথমত, মুসলমানদের কোনো অবস্থায়ই শক্তি-সামর্থ্য ও সংখ্যাধিক্যের ওপর আত্মপ্রসাদ করা উচিত নয়। সম্পূর্ণ নিঃস্ব অবস্থায় যেমন তাদের দৃষ্টি আল্লাহর সাহায্যের প্রতি নিবদ্ধ থাকে, তেমনি সব শক্তি-সামর্থ্য থাকাবস্থায়ও আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে হবে।
দ্বিতীয়ত, দেশ রক্ষার প্রয়োজনে অমুসলিম নাগরিকদের সহযোগিতা গ্রহণ বৈধ। কেননা হুনাইন যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে মক্কার বিজিত কাফিরদের থেকে মহানবী (সা.) সমরাস্ত্র ধারস্বরূপ নিয়েছিলেন। পরে তিনি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে সেসব তাদের ফিরিয়ে দেন।
তৃতীয়ত, রাসুলুল্লাহ (সা.) হুনাইন গমনকালে ‘খাইফে বনি কেনানা’ নামক স্থান সম্পর্কে বলেছিলেন, আগামীকাল আমাদের অবস্থান হবে সেখানে, যেখানে মক্কার কুরাইশরা মুসলমানদের একঘরে করে রাখার প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেছিল। এতে মুসলমানদের প্রতি যে বিশেষ হিদায়েত আছে, তা হলো শক্তি-সামর্থ্য হয়ে গেলেও বিগত বিপদের কথা ভুলে না যাওয়া, বরং আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত।
চতুর্থত, যুদ্ধের শেষ লগ্নে কাফিররা দুর্গে আশ্রয় নিয়ে মুসলমানদের প্রতি বাণ নিক্ষেপ করেছিল। এর জবাবে বদদোয়ার পরিবর্তে রাসুলুল্লাহ (সা.) হিদায়েতের দোয়া করেন। এতে এই শিক্ষা রয়েছে যে ইসলামের যুদ্ধবিগ্রহের উদ্দেশ্য শত্রুদের হত্যা বা পরাভূত করা নয়, বরং উদ্দেশ্য হলো তাদের হিদায়েতের পথে নিয়ে আসা।





Users Today : 880
Users Yesterday : 677
This Month : 7455
This Year : 179326
Total Users : 295189
Views Today : 13458
Total views : 3519587