ইসলামে ব্যবসা করার নিয়ম

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

ইসলামে ব্যবসা করার নিয়ম সম্পর্কে অনেকেই জানে না। সততা ও আমানতদারির সাথে ব্যবসা করাটাও ইবাদাত। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছে, রমজান মাস আসলেই অধিক লাভের জন্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে দেয়। অবৈধভাবে কৃত্তিম সংকট তৈরি করে।

একজন মুসলমান ব্যবসায়ী হিসাবে অবশ্যই আপনাকে ইসলামে ব্যবসা করার নিয়ম কানুনগুলো ভালভাবে জানতে হবে। আজকের এই লেখায় ইসলামে ব্যবসা করার নিয়ম বলার পাশাপাশি পদ্ধতিগুলো নিয়েও আলোচনা করবো ইনশা আল্লাহ।

ইসলামে ব্যবসা করার নিয়ম নিয়ে আলোচনার আগে ইসলামে ব্যবসা করার পদ্ধতিগুলো নিয়ে আলোচনা করা জরুরি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  • মুদারাবা পদ্ধতি
  • মুশারাকা পদ্ধতি
  • বায়’মুরাবাহা
  • বায় মু’আজ্জাল
  • বায়’ সালাম
  • বায়’ ইসতিসনা
  • হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিল্ক বা মালিকানায় অংশীদারিত্ব

১. মুদারাবা পদ্ধতি

মুদারাবা হচ্ছে অন্যতম একটা বিনিয়োগ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে দুটি পক্ষ থাকে।

  • একপক্ষ মূলধন সরবরাহ করে।
  • অপরপক্ষ মেধা ও শ্রম দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে।

ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক এর মতে, মুদারাবা এক ধরনের অংশীদারিত্ব যেখানে একপক্ষ তহবিল (মূলধন) দেয়; অন্যপক্ষ তার দক্ষতা ও ব্যবস্থাপনা বিনিয়োগ করেন। তাকে আখ্যায়িত করা হয় মুদারিব (ব্যবস্থাপক) হিসেবে। ব্যবসায় অর্জিত লাভ দু’পক্ষের মধ্যে পূর্ব নির্ধারিত অনুপাত অনুসারে ভাগ হয়। লোকসান হলে তার পুরোটাই পুঁজি সরবরাহকারী বহন করবে।

উদাহরণ, একজনের ব্যবসায়িক অনেক অভিজ্ঞতা আছে কিন্তু তার কাছে বিনিয়োগ করার মতো মূলধন নেই। আবার অন্যজনের কাছে অভিজ্ঞতা নেই কিন্তু বিনিয়োগ করার জন্য অনেক মূলধন রয়েছে, এই দুই ব্যক্তির সমন্বয়ে মুদারাবা পদ্ধতিতে ব্যবসা হয়ে থাকে। অর্থাৎ একজন দিবে মেধা আর শ্রম আরেকজন দিবে মূলধন।

২. মুশারাকা পদ্ধতি

মুশারাকা হচ্ছে একটি অংশীদারি ব্যবসা। মুশারাকা বলতে এমন একটি অংশীদারি ব্যবসাকে বুঝায় যেখানে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি একত্রিত হয়ে লাভের উদ্দেশ্যে ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে।

এই পদ্ধতিতে সবার একই পরিমাণ অংশীদারি থাকেনা। কারো কম কারো বেশি অংশীদারি থাকে। যদি এই ব্যবসায় লাভ হয় তাহলে তা বণ্টন হবে অংশীদারি অংশের ভিত্তিতে। আবার তার বিপরীতে লোকসান হলে তা একই পদ্ধতিতে সবাই লোকসানের অংশ ভাগ করে নিবে।

কুরআনের বাণী-“আর শরিকদের অনেকেই একে অন্যের ওপর সীমালঙ্ঘন করে থাকে। তবে তারাই এরূপ করে না যারা ঈমান আনে ও নেক আমল করে”। (সূরা সোয়াদ-২৪)

হাদিস

“হযরত আবু হুরায়রা (রা.) মহানবী (সা) এর নাম করে বললেন, তিনি বলেছেন, “আল্লাহ তা’আলা বলেন, দু’জন অংশীদারের সাথে আমি (আল্লাহ) তৃতীয় জন হয়ে থাকি যতক্ষণ না তাদের একজন তার অপর সাথি এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা বা খিয়ানত করে। আর যখনই কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করে তখন আমি সেখান থেকে বের হয়ে আসি”।

(আবু দাউদ শরীফ, কিতাবুল বুয়্যু,বাব ২৬, হাদিস নং-৩৩৮৩)

৩. বায়’মুরাবাহা

মুরাবাহা শব্দের অর্থ হলো- নির্ধারিত লাভ। অর্থাৎ কোনো পণ্যের ক্রয়মূল্যের ওপর ক্রেতা, বিক্রেতা উভয়ের সম্মতিতে নির্ধারিত লাভে বিক্রয় করাকে মুরাবাহা বলে।

ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এর শরিয়াহ কাউন্সিলের মতে- “কোন পণ্যের ক্রয়মূল্যের ওপর ক্রেতা-বিক্রেতার উভয়ের সম্মতিতে নির্ধারিত লাভে বিক্রয় করাকে মুরাবাহা বলে।

ক্রয়-বিক্রয়ের পণ্য অবশ্যই হালাল পণ্য হতে হবে যা ইসলামি শরিয়তে নিষিদ্ধ নয়। বায়’ মুরাবাহার ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণ ইনসাফভিত্তিক হতে হবে।

কুরআনের বাণী,

“আল্লাহ তায়ালা ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সুদ হারাম করেছেন”। (সূরা বাকারা-২৭৫ নং আয়াত)

৪. বায় মু’আজ্জাল

মু’আজ্জাল শব্দের অর্থ হলো, বিলম্বিত, বিলম্বে পরিশোধযোগ্য, বাকি, নগদের বিপরীতে ক্রয়-বিক্রয়, নির্ধারিত সময় দাম পরিশোধ করার শর্তে বাকিতে বিক্রয়। অর্থাৎ বাকিতে ক্রয়-বিক্রয় করাকে বায় মু’আজ্জাল বলে।

সেন্ট্রাল শরীয়াহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশ এর মতে- “ভবিষ্যতের নির্ধারিত কোনো সময়ে, এক সাথে অথবা নির্ধারিত কিস্তিতে মূল্য পরিশোধ করার শর্তে পণ্যসামগ্রী বিক্রয় করাকে বায় মু’আজ্জাল পদ্ধতি বলা হয়”।

হাদিস

“হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) হতে এক হাদিসে বর্ণিত আছে যে, মহানবী (স) জনৈক ইহুদির কাছ থেকে কিছু খাদ্য বাকিতে ক্রয় করেছিলেন এবং তার কাছে একটি লৌহ বর্ম বন্ধক রেখেছিলেন”।

(ইমাম বুখারী, প্রাগুক্ত, হাদিস নং- ২০৯৬)

এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে ইসলামে বাকিতে ক্রয়-বিক্রয় করার বিধান আছে।

সর্বশেষ বায়’ মু’আজ্জালের ক্ষেত্রে এরূপ বলা যাবে না যেমন, নগদ হলে ২ লাখ টাকা আর বাকি হলে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এরূপ বলা হলে অতিরিক্ত ৫০ হাজার টাকা ইসলামি শরী’আতে সুদ হিসেবে পরিগণিত হবে। মালের বিক্রয়মূল্য নির্দিষ্ট হতে হবে এবং তা চুক্তিপত্রে স্পষ্ট থাকতে হবে।

৫. বায়’ সালাম

বায়’ সালাম শব্দের অর্থ হচ্ছে- অগ্রিম ক্রয়। যে পণ্য এখনো উৎপাদিত হয়নি বা তৈরি হয়নি, ভবিষ্যতে হবে সে পণ্য অগ্রিম বিক্রয় করাকে বায়’ সালাম বলে।

মুফতি মুহাম্মদ তাকী উসমানী- এর মতে, “সালাম এমন একটি ক্রয়-বিক্রয় যার মাধ্যমে বিক্রেতা এই দায়িত্ব গ্রহণ করে যে, সে ভবিষ্যতের কোনো একটি তারিখে নির্দিষ্ট জিনিস ক্রেতাকে সরবরাহ করবে এবং তার বিনিময়ে পূর্ণ মূল্য বিক্রির সময়ই অগ্রিম নিয়ে নেয়।

কুরআনের বাণী- “হে ইমানদারগণ, তোমরা যখন নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য একে অন্যের সাথে কোনো লেনদেন কর তখন তা লিখে রাখো”।

(সূরা বাকারা-২৮২ নং আয়াত)

হাদিস- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন, মহানবী (সা.) যখন হিজরত করে মদিনায় আসেন তখন সেখানকার অধিবাসীগণ এক বছর ও দুই বছর মেয়াদের জন্য বায়’ সালাম পদ্ধতিতে খেজুর ক্রয়-বিক্রয় করছিল।

মহানবী (সা) তা দেখে বললেন, “যে অগ্রিম মূল্যে ক্রয়-বিক্রয় করতে চায় সে যেন ওজন ও পরিমাণ সুনির্দিষ্ট করে, নির্দিষ্ট মেয়াদে পরিশোধ করার কথা দিয়ে অগ্রিম ক্রয়-বিক্রয় করে।

(ইমাম বুখারী, প্রাগুক্ত, হাদিস নং-২২৪০)

বায়’ সালামে পণ্যের মূল্য, পরিমাণ, হস্তান্তরের তারিখ সহ সব কিছু ক্রেতা-বেক্রেতার উভয়ের জানা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো অস্পষ্টতা গ্রহণযোগ্য নয়। অর্থাৎ অগ্রিম কেনা বেচার ব্যাপারে ইসলামে বিধান রয়েছে।

৬. বায়’ ইসতিসনা

ইসতিসনা শব্দের অর্থ হলো- তৈরি করা, প্রস্তুত করা, বানানো ইত্যাদি। অর্ডার অনুযায়ী কোনো বস্তু তৈরি করাকে ইসতিসনা বলে।

মুফতি মুহাম্মদ তাকী উসমানীর এর মতে, “ইসতিসনা ক্রয়-বিক্রয়ের এক ভিন্ন প্রকার যে প্রকারে পণ্য অস্তিত্বে আসার পূর্বেই ক্রয়-বিক্রয় সংঘটিত হয়ে যায়। ইসতিসনা অর্থ হচ্ছে কোনো প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান কে ক্রেতার জন্য নির্দিষ্ট জিনিস তৈরি করে দেওয়ার অর্ডার দেয়া।

হাদিস-“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি স্বর্ণের আংটি অর্ডার দিয়ে বানিয়েছিলেন এবং তিনি তা পরিধান করতেন”।

উপরের সব আলোচনা আর উক্ত হাদিস দ্বারা বুঝা যায় যে ইসলামে বায়’ ইসতিসনার বিধান রয়েছে যা রাসূল (সা) নিজে করেছেন।

৭. হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিল্ক বা মালিকানায় অংশীদারিত্ব

এটা বিশেষ এক সমন্বিত চুক্তি। প্রকৃতপক্ষে এটি মালিকানায় শরিকানা, ইজারা এবং বিক্রি এ তিন চুক্তির সমন্বয়।

এই তিনটা জিনিস বিস্তারিত আলোচনা করা হলো বোঝার সুবিধার্থে।

ক) শিরকাতুল মিলক

সহজ ভাষায় বললে হবে চুক্তিবদ্ধ না হয়ে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো সম্পত্তির মালিক হলে তাকে শিরকাতুল মিলক বলা হয়। কুরআনের বাণী-

“তারা তিন ভাগের এক ভাগের মধ্যে সম-অংশীদার হবে”। (সূরা নিসা-১২ নং আয়াত)

খ) ইজারা

ইজারা এমন এক ধরনের চুক্তি সেখানে ভাড়াদাতা ও ভাড়াগ্রহীতা দুটি পক্ষ থাকে। এ পদ্ধতিতে ভাড়াগ্রহীতা সুনির্দিষ্ট ভাড়া প্রদানপূর্বক ভাড়াদাতার মালিকানাধীন সম্পদ থেকে সুবিধা ভোগ করবে।

কুরআনের বাণী-

“আর যদি তোমরা তোমাদের সন্তানদের অন্য কারো থেকে দুধ পান করাতে চাও, তাহলেও তোমাদের কোনো পাপ হবে না, যদি তোমরা বিধি মোতাবেক তাদের পারিশ্রমিক দিয়ে দাও”। (সূরা বাকারা-২৩৩ নং আয়াত)

গ) বিক্রয়

বিক্রয় হলো ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে চুক্তি। এ চুক্তির মাধ্যমে বিক্রেতার মালিকানাধীন কোনো নির্দিষ্ট পণ্য বা সম্পদ নির্ধারিত মূল্য নগদ/অগ্রিম বা ভবিষ্যতে পরিশোধের শর্তে ক্রেতার মালিকানায় ন্যস্ত হয়।

ইসলামে ব্যবসা করার নিয়ম

আশা করি, ইসলামে ব্যবসা করার পদ্ধতির মধ্যেই ব্যবসা করার অনেকগুলো নিয়ম জেনে গিয়েছেন। এবার চলুন সেগুলো সহ ইসলামে ব্যবসা করার নিয়মগুলোর তালিকা দেখা যাক।

  • প্রথমত মুদারাবা ব্যবসায় যিনি মূলধন ব্যবহারকারী তাকে অবশ্যই শরীয়াহ সম্মত খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। ইসলামে সম্মত না এমন ব্যবসায় বিনিয়োগ করা যাবেনা।
  • ব্যবসায়ের লাভ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পূর্বনির্ধারিত হারে যোগানদাতা এবং ব্যবহারকারীর মধ্যে ভাগ হয়। যেমন (২৫% ও ৭৫%), (৩০% ও ৭০%), (৪০% ও ৬০%), (৫০% ও ৫০%) হারে লাভের অংশ ভাগ করে নেয়।
  • পণ্য বিক্রি করার সময় মিথ্যা কথা বলা যাবে না। ওজনে কম দেয়া যাবে না ও প্রতারণা করা যাবে না। – সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০২
  • যে ব্যবসা করলে কারও ক্ষতি হবে; এমন ব্যবসা করা যাবে না। – ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২৩৪১
  • বিক্রির সময় মিথ্যা শপথ করা যাবে না। – সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৬
  • নিজে যেমন ঠকা যাবে না, অন্যজনকেও ঠকানো যাবে না। – সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৯৬৪
  • সুদের সাথে যুক্ত হওয়া যাবে না। – সহীহ মুসলিম নং ১৫৯৮
  • অনুমান ভিত্তিক ব্যবসা করা যাবে না। মানে, অনুমানের উপর ভিত্তি করে কোন কিছু বিক্রি করা যাবে না। – ইবন কাসীর
  • কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করা যাবে না।
  • মালে দোষ ত্রুটি থাকলে তা বলে নিতে হবে। পরে পাওয়া গেলে ফেরত নিতে হবে।

পরিশেষে

এই ছিল আজকে ইসলামে ব্যবসা করার নিয়ম নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা। আরও বিস্তারিত জানার জন্য একজন মুফতি সাহেবের শরণাপন্ন হতে পারেন। আর কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী ১৪টি টাকা পয়সা বৃদ্ধির আমল লেখাটি পড়ে নিতে পারেন।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment