ইসলামে তাওবা তথা ভুল স্বীকার করা ও দোষ-ত্রুটি গোপন রাখার গুরুত্ব।
– মুহাম্মদ দেলোয়ার হোসাইন কাদেরী।
আমাদের নিত্যদিনের ভুলগুলো যদি আল্লাহ প্রকাশ করে দিতেন তবে আমরা সমাজে কারো দিকে তাকাতে পারতাম?
ভুল করেনা এমন মানুষ আছে?
নাই, থাকতেও পারেনা। মানুষ অতি দূর্বল। নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যেই রয়েছে (সূরা আসর-২)।
এজন্য আল্লাহ তায়ালাও ওয়াদা দিয়ে রেখেছেন এভাবে যে, হে রাসুল আপনি বলে দিন – ওহে আমার প্রাণপ্রিয় উম্মতগণ, তোমরা নিজের নফসের সাথে জুলুম তথা যতই অন্যায় অবিচার করনা কেন, মনে রেখ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অতিব দয়াবান, তার রহমত থেকে কখনোই নিরাশ হইও না। যদি স্বীকারোক্তি দিয়ে লজ্জিত হতে পার তবে নিশ্চয়ই তিনি তোমাদের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিবেন। তিনি অতি দয়ালু ও ক্ষমাশীল। (সূরা যুমার-৫৩)
আরও বলেছেন- বান্দা ভুল করে আল্লাহর দিকে ফিরে গেলে তাওবার মত তাওবা করলে বান্দার ভুলগুলোর জন্যেও আল্লাহ সাওয়াব লিখে দিবেন।(সূরা ফোরকান-৭০)
সুবহানাল্লাহ আল্লাহ কত দয়াবান! ভুল স্বীকারকারীকে আল্লাহ কতটা পচন্দ করেন এতেই বুঝা যায়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন একনিষ্ঠ (খালেস) নিয়্যাতে কেউ তাওবা করলে তাকে সেভাবেই মাসুম তথা নিস্পাপ করে দেয়া হয় যেভাবে মাতৃগর্ভ থেকে নিস্পাপ শিশু জন্ম নেয়।( ইবনে মাজাহ -৪২৫০)
কেউ ভুল করলে তাঁর ভুলগুলোকে নিয়ে প্রচার করা কোন মোমিনের কাজ হতে পারেনা। কারণ মোমিন মাত্রই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণ করে। খোদ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য ভাইয়ের দোষ প্রকাশ করতে নিষেধ করেছেন।(আবু দাউদ শরীফ,হাদীস নং-৪৪৮০, মুসলিম শরীফ-২৬৯৯)
কেউ ভুল করলে তাঁর উচিত নিজের ভুল স্বীকার করে তাওবা করে নেয়া। তাওবার মাধ্যমেই বান্দা সফল হয়। আল্লাহ তাআলা একথাই বলেছেন যে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর। যাতে তোমরা সফলতা লাভ করতে পার।’ (সুরা নুর : আয়াত ৩১)।
নিজের ভুলের উপর তারাই অটল অবিচল থাকে যারা মুনাফিক। মুনাফিকদের চরিত্রই এমন যে তারা দোষ খোঁজে এবং নিজের দোষকে গুণ মনে করে। আল্লাহর ভাষ্যনুযায়ী তারা বুঝতেই পারেনা যে তারা ভুল করেছে তারা নিজেদেরকেই সঠিক মনে করে, বাস্তবে তাদের সব আমল বরবাদ হয়ে যায়।(সূরা হুজরাত-২)
এমন মানুষ আছে যারা দেখেও যেন দেখেনা, বুঝেও যেন বুঝেনা, শুনেও যেন শুনেনা। সুস্পষ্ট ভুলকেও শুদ্ধ প্রমাণের জন্য নানা অজুহাত খোঁজে বেড়ায়। অবাক হওয়ার কারণ নেই। আল্লাহ তাদেরকে এমনই বানিয়েছেন। আল্লাহ তাদের অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন, কানে শীশা ও চোখের উপর পর্দা দিয়ে দিয়েছেন। অতএব আপনি তাদের যতই সতর্ক করেন তারা সচেতন হবেনা, বরং তাদের জন্য প্রস্তুত রয়েছে কঠিন শাস্তি। (সূরা বাকারা-৭)
আমার নেতা ভুল করতেই পারেনা। তাঁর ভুলগুলো ভুল নয় বরং হেকমত এমন ধারণাই উগ্রবাদিতার অন্যতম আলামত। এটা জঘন্য চরিত্র। এটা কুরানের বিরুদ্ধাচারণ।
দোষকে স্বীকার করে নেয়ার মধ্যেই শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। এতে মনুষ্যত্ব নিহিত। পশু ও মানবের মধ্যে পার্থক্য ঠিক এখানেই।
যারা আত্মসমালোচনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির পথ বেঁচে নেয় তারাই যুগের শ্রেষ্ঠ মানুষ ও ইতিহাসের পাতায় মহান ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতজন লাভ করে।
কারো ভুল-ভ্রান্তি, দোষ-ত্রুটি প্রচারের মাধ্যমে নিজেকে সঠিক প্রমাণ করার পদ্ধতি মোটেই ইসলামিক পদ্ধতি নয়। বরং ইসলামের পদ্ধতি হচ্ছে ইসলামি আদর্শের যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সততা, নৈতিকতা, মানবিকতা, উদারতা, সহিষ্ণু, ন্যায়-নীতি, ভাতৃত্ববোধ ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেকে সঠিক প্রমাণ করা।
ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার প্রসারের ইতিহাস দেখলে আপনি ঠিক এ পদ্ধতিটাই দেখবেন। সুফি-দরবেশ অলি আওলিয়াগণ হিন্দু, বৌদ্দ, ইহুদি, খ্রিস্টানের ভুল-ভ্রান্তি , দোষ-ত্রুটির প্রচার করেননি বরং তারা যথাযথভাবেই ইসলামের আদর্শের উপর জীবন অতিবাহিত করেছেন আর তাদের এত সুন্দর আচরণ, উদারতা, মানবতা ও ন্যায়নিষ্ঠ জীবনী দেখেই বিধর্মীরা আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। তারা অটোমেটিক বুঝতে পেরেছিল একমাত্র ইসলামই গ্রহণযোগ্য ধর্ম।
আর এভাবেই প্রয়োজনে কৌশল ও সুন্দর আচরণ, উত্তম ভাষায় যৌক্তিক তর্কের মাধ্যমেই ইসলামের দিকে আহবান করার কথা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন।(সূরা নাহাল-১২৫)
যদি কেউ ভুল করে, অন্যায় করে, পাপ করে, বিশ্বাস করুন সে সম্পর্কে আপনার চেয়েও বেশি আপনার সৃষ্টিকর্তা জানেন। এটাও বিশ্বাস করুন যে আল্লাহ ন্যায়বিচারক। আল্লাহ প্রত্যেক ব্যক্তিকেই তাঁর কাজ অনুযায়ী ফলাফল দান করেন। ভালো কাজের উত্তম প্রতিদান আর মন্দ কাজের জন্য উচিত শাস্তি। যদিও তা বিন্দু পরিমাণ হয়।(সূরা ঝিলজালা-৭,৮)
অতএব, কারো দোষ ত্রুটির প্রচারণা করে কাউকে লাঞ্চিত করার দায়িত্ব নিজের হাতে নেয়া অন্যায়, এ দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহর। আমাদেরকে এ দায়িত্ব পালন করতে নিষেধ করা হয়েছে।
শুধুমাত্র আখিরাতে নয় বরং আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতেই ভালো-মন্দের ফলাফল দিয়ে দেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন – “নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে কষ্ট দেয় তাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জাহানেই লাঞ্চনা। তাদের জন্য প্রস্তুত রয়েছে কঠিন আযাব।”(সূরা আহযাব-৫৭)।
আর এজন্যই আল্লাহ তায়ালা প্রার্থনা করার পদ্ধতি শিখিয়ে দিলেন এভাবে -“রাব্বানা আ-তিনা ফিদদুনিয়া হাস্নাতাও ওয়াফিল আ-খি-রাতে হাস্না, ওয়াক্বিনা আজাবান্না-র” অর্থাৎ – হে আমার প্রভু! আমাকে দুনিয়াতে কল্যাণ দান কর, আখেরাতেও কল্যাণ দান কর এবং আমাকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও। (-সূরা বাকারা : ২০১)
-মুহাম্মদ দেলোয়ার হোসাইন কাদেরী
খতিব-মোবারক খান খীল শাহী জামে মসজিদ।
গহিরা, রাউজান, চট্টগ্রাম।
শিক্ষার্থীঃ (কামিল -হাদীস বিভাগ)- জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া কামিল মাদ্রাসা। ষোলশহর, চট্টগ্রাম।





Users Today : 351
Users Yesterday : 767
This Month : 14773
This Year : 186644
Total Users : 302507
Views Today : 37895
Total views : 3614639