হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের জন্য এলম অর্জন করা ফরজ’। (ইবনে মাজাহ : ২২৪)। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম মালেক (রহ.) বলেন, ‘এলম দুই প্রকার। শরিয়ত ও মারেফত। যে ব্যক্তি শরিয়ত শিখল কিন্তু মারেফত শিখল না সে ফাসেক। আর যে মারেফত শিখল কিন্তু শরিয়ত শিখল না সে কাফের।’ (আল ইতকান : ২/১৮৭)। ইমাম মালেকের বক্তব্যের ব্যাখ্যা করে বিজ্ঞজনরা বলেন, শুধু শরিয়তের দ্বারা ব্যক্তি আমলের হুকুম-আহকাম জানতে পারে কিন্তু এর নিগূঢ় রহস্য অনুধাবন করতে পারে না। ফলে এমন ব্যক্তির দ্বারা সহজেই রিয়া, আত্মম্ভরিতাসহ যে কোনো ধরনের সূক্ষ্ম গোনাহ সংঘটিত হয়ে যেতে পারে। এর ফলে সে ইবাদত করেও ফাসেক তথা পাপীর খাতায় নাম লেখাবে। আবার যে শুধু মারেফত শিখল কিন্তু শরিয়ত শেখেনি সে যখন কাশফসহ বিভিন্ন স্তরে উন্নীত হতে থাকবে তখন শয়তানের ধোঁকা থেকে নিজেকে আত্মরক্ষা করতে পারবে না। যার শেষ পরিণাম তাকে কুফরির পথে নিয়ে যাবে। অতীতে এমন অসংখ্য বুজুর্গ তরিকতের বিভিন্ন মনজিলে শয়তান কর্তৃক প্রতারিত হয়ে ঈমান আমল সব হারিয়েছেন। তাই ইমাম মালেক (রহ.) এর কথাই চিরসত্য ও যুক্তিযুক্ত। শরিয়ত ছাড়া মারেফত আবার মারেফত ছাড়া শরিয়ত দুটোই ব্যক্তির জন্য চরম ক্ষতিকর। যার স্বীকৃতি মেলে সুফিয়ান সাওরী (রহ.) এর কথায়। তিনি বলেন, ‘শায়খ আবুল হাশেম সুফির সাক্ষাৎ না পেলে ইবাদতে রিয়ার অনেক সূক্ষ্ম বিষয় আমার অজানা থেকে যেত।’ (নাফখাতুল ইনস : ২২)।
শুধু ইমাম মালেক বা সুফিয়ান সাওরীই নয়, সব হকপন্থী সুফি-দরবেশ একবাক্যে স্বীকার করে গেছেন, শরিয়ত ব্যতীত তাসাউফ চর্চার কোনো মূল্য নেই। আবার শরিয়তের বিষয়ে বিজ্ঞ আলেমরাও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য সমসাময়িক তরিকতের ইমামদের কাছে বায়াত গ্রহণ করেছেন। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য! একদল মানুষ শরিয়তকে মারেফতের প্রতিদ্বন্দ্বী করে ফেলেছে। আবার আরেক দল মারেফতকে শরিয়তের বহির্ভূত মনে করে নিয়েছে। মূলত শরিয়ত-মারেফত এ দুটোর সমন্বয়ের নামই ইসলাম। এ সম্পর্কে সুফি আবুল কাশেম আল কুশাইরী (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি শরিয়তকে মারেফতের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে সে আমাদের সুফিদের কাছে পরিত্যক্ত। আর যার মারেফত শরিয়তের বিপরীত হয়, বুঝতে হবে মারেফত কী সে তা বুঝতে পারেনি।’ শায়খ আবু তালেব মাক্কি বলেন, ‘এলমে শরিয়ত ও এলমে তাসাউফ এ দুটো একটি অপরটি থেকে আলাদা হতে পারে না। বরং শরিয়ত-মারেফত দুটো পরস্পরের পরিপূরক। যেমনÑ ঈমান ইসলামের পরিপূরক। আবার ইসলাম ঈমানের পরিপূরক। (মিরকাতুল মাফাতিহ : ১/২৫৬)।
ইমাম হুজ্জাতুল ইসলাম মুহাম্মাদ গাজালী (রহ.) তার বিখ্যাত গ্রন্থ এহইয়াউল উলুমুদ্দিনে শরিয়ত ও তাসাউফের তত্ত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর বলেছেন, ‘শরিয়ত ও মারেফত ভিন্ন কোনো জিনিস নয়। এ দুটোর তুলনা দেহ ও প্রাণের মতো। প্রাণহীন দেহ যেমন মূল্যহীন তেমনি শরিয়ত ছাড়া মারেফতও মূল্যহীন।’ এরপর তিনি লেখেন, ‘আমার বক্তব্যের পেছনে কোরআন-হাদিস ও সাহাবিদের এত বেশি বর্ণনা আছে যে, তা সব উল্লেখ করলে স্বতন্ত্র গ্রন্থ হবে, যা কয়েকখ-েও সমাপ্ত করা যাবে না।’ (এহইয়াউল উলুমুদ্দিন : ৩/২০-২১)।
মোদ্দা কথা, শরিয়ত ও মারেফত এ দুটো থেকে গাফেল থাকার সুযোগ যেমন নেই, তেমনি একটি বাদ দিয়ে অপরটি নিয়ে মেতে থাকাও সংগত নয়। বিজ্ঞ ফকিহ আল্লামা শামী (রহ) বলেন, ‘শরিয়ত-মারেফত পরস্পর অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আল্লাহ প্রদত্ত সিরাতাল মুস্তাকিমের বাহ্যিক দিক হলো শরিয়ত আর ভেতরের দিক মারেফত। আল্লাহ প্রাপ্তির জন্য এ দুটোই আবশ্যক। (রদ্দুল মুহতার : ৩/৩০৩)। আল্লামা তাহের আলাউদ্দিন গিলানী (রহ.) বলেন, ‘তাসাউফবিহীন শরিয়ত দাম্ভিকতার অপর নাম। আর শরিয়তবিহীন তাসাউফের অপর নাম পথভ্রষ্টতা।’ (তাসাউফের আসল রূপ : ৫৫)। তাই আসুন! আমরা সবাই শরিয়ত এবং মারেফতের সমন্বয়ে ইসলামী জিন্দেগি যাপন করে আল্লাহ প্রাপ্তির পথে এগিয়ে যাই।
ইলমে দ্বীন কিভাবে অর্জন করতে হবে?
পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।