আহকামুল মাযার ও জিয়ারাতুল কুবুর
🖋কৃতঃ শাইখ সৈয়দ হাসান আযহারী
হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় মক্কার মুশরিকদের প্রতিনিধি ছিলেন উরউয়া ইবনে মাসউদ। তিনি মক্কায় ফিরে গিয়ে রাসূল স. এর সাহাবীদের সম্পর্কে মক্কার মুশরিকদেরকে বলেন,
أي قوم!!، والله لقد وفدت على الملوك، ووفدت على قيصر وكسرى والنجاشي، والله إن رأيت ملكا قط يُعظمه أصحابه ما يعظم أصحاب محمد محمدا، والله إن تنخم نخامة إلا وقعت في كف رجل منهم فدلك بها وجهه وجلده، وإذا أمرهم ابتدروا أمره، وإذا توضأ كادوا يقتتلون على وضوئه، وإذا تكلم خفضوا أصواتهم عنده، وما يحدون إليه النظر تعظيما له
অর্থ: হে কুরাইশ সম্প্রদায়, আল্লাহর শপথ, আমি বহু রাজা-বাদশার নিকট প্রতিনিধি হয়ে গমন করেছি। আমি কায়সার, কিসরা, ও নাজ্জাশীর নিকট প্রতিনিধি হয়ে গিয়েছি। আল্লাহর শপথ, মুহাম্মাদ স. এর সাহাবীরা তাকে যে পরিমাণ সম্মান করে, কোন রাজা-বাদশাকে এধরনের সম্মান করতে দেখিনি। আল্লাহর শপথ, তিনি যদি কফ ফেলেন, তাহলে সেটা তার কোন সাহাবীর হাতে পড়ে। আর সেই সাহাবী সেটি তার মুখে ও শরীরে মেখে নেয়। তিনি কোন আদেশ করলে সেটি পালনে তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। তিনি ওজু করলে তার ওজুর পানি নেয়ার জন্য এত বেশি প্রতিযোগিতা করে যেন তারা যুদ্ধ করছে। রাসূল স. এর সামনে তারা অত্যন্ত নিচু স্বরে কথা বলে। তাঁর সম্মানে তারা চোখ তুলে তার দিকে তাকায় না। [বোখারী শরীফ, হাদীস নং ২৭৩৪]
হাদীস থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন,
وفيه طهارة النخامة والشعر المنفصل، والتبرك بفضلات الصالحين الطاهرة
অর্থ: এই হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, মানুষের কফ ও কর্তিত চুল পবিত্র এবং নেককার বুজুর্গদের শরীরের পবিত্র জিনিস দ্বারা বরকত হাসিল করা যায়। [ফাতহুল বারী, খ.৫, পৃ.৩৪১]
বোখারী শরীফের বিখ্যাত ব্যাখ্যাকার আল্লামা বদরুদ্দিন আইনি রহ. বলেন,
ومن الاستنباط من هذا الحديث، التبرك ببزاق النبي صلى الله عليه وآله وسلم توقيرا له وتعظيما
অর্থ: এই হাদীস থেকে গবেষণালব্ধ শিক্ষণীয় বিষয় হল, রাসূল স. এর সম্মানে তার থুতু দ্বারা বরকত হাসিল করা ।[উমদাতুল কারী, খ.৩, পৃ.১৭৮]
২ য় হাদীস:
হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. বর্ণনা করেন,
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا صلى الغداة جاء خَدَمُ المدينة بآنيتهم فيها الماء، فما يؤتى بإناء إلا غمس يده فيها، فربما جاءوه في الغداة الباردة فيغمس يده فيها
অর্থ: রাসূল স. যখন ফজরের নামাজ শেষ করতেন, মদীনার খাদেমরা পানিভর্তি পাত্র নিয়ে উপস্থিত হত। রাসূল স. সকল পাত্রে নিজের হাত ডুবিয়ে নিতেন। এমনকি অনেক শীতের সকালে পাত্র নিয়ে এলেও রাসূল স. হাত ডুবাতেন।[ মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ২৩২৪, অধ্যায়, সাধারণ মানুষকে রাসূল স. এর নৈকট্য প্রদান এবং রাসূল স. এর থেকে তাদের বরকত হাসিল]
হাদীস থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
এই হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনুল জাওযী রহ. বলেন,
إنما كانوا يطلبون بهذا بركته صلى الله عليه وسلم، وينبغي للعالم إذا طلب العوام التبرك به في مثل هذا ألا يخيب ظنونهم
অর্থ: সাহাবীরা এভাবে রাসূল স. এর বরকত হাসিল করত। একইভাবে কোন আলেম থেকে সাধারণ মানুষ যদি বরকত হাসিল করতে চায়, তাহলে তাদেরকে সুযোগ দেয়া উচিৎ, যেন তাদের ধারণা নষ্ট না হয়। [কাশফুল মুশকিল মিন হাদিসিস সহীহাইন, খ.৩, পৃ.৩১২]
মুসলিম শরীফের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাগ্রন্থে ইমাম নববী রহ. বলেন,
وفيه التبرك بآثار الصالحين، وبيان ما كانت الصحابة عليه من التبرك بآثاره صلى الله عليه وسلم وتبركهم بإدخال يده الكريمة في الآنية
অর্থ: এই হাদীস থেকে একটি শিক্ষণীয় বিষয় হল, নেককার বুজুর্গদের থেকে বরকত হাসিল। সাহাবায়ে কেরাম রা. রাসূল স. এর থেকে কীভাবে বরকত হাসিল করতেন তার বর্ণনাও রয়েছে এই হাদীসে । অর্থাৎ বরকতের উদ্দেশ্যে রাসূল স. এর মোবারক হাত তাদের পাত্রে ঢোকাতেন।[শরহু সহীহি মুসলিম, খ.১৫, পৃ.৮২]
৩ য় হাদীস:
হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. বলেন,
لقد رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم والحلاق يحلقه، وأطاف به أصحابه، فما يُريدون أن تقع شعرة إلا في يد رجل
অর্থ: আমি রাসূল স. এর মাথার চুল হলক করতে দেখেছি। সাহাবায়ে কেরাম রাসূল স. এর চার পাশে চক্কর দিতেন। রাসূল স. এর মাথা থেকে কোন চুল পড়লে যেন কোন সাহাবীর হাতে পড়ে। [মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ২৩২৫]
হাদীস থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
ইমাম নববী, ইবনে হাজার আসকালানী ও ইমাম বদরুদ্দিন আইনি রহ. বলেন,
” এই হাদীস থেকে রাসূল স. এর চুলের মাধ্যমে বরকত হাসিল প্রমাণিত হয়”[ শরহু সহীহি মুসলিম, খ.৯, পৃ.৫৪, ফাতহুল বারী, খ.১, পৃ.২৭৫, উমদাতুল কারী, খ.৩, পৃ. ৩৮]
আহলে হাদীস-সালাফীদের অনুসরণীয় আলেম কাজী শাওকানী, আব্দুর রহমান মুবারকপুরী ও শামসুল হক আজীমাবাদী বলেন,
” এই হাদিস থেকে বুজুর্গদের চুল ও অন্যান্য জিনিস দ্বারা বরকত হাসিলের বৈধতা প্রমাণিত হয়”[নাইলুল আওতার, খ.৫, পৃ.১২৮, তুহফাতুল আহওয়াজী, খ.৩, পৃ.৫৬, আউনুল মা’বুদ, খ.৫, পৃ.৩১৭]
৪ র্থ হাদীস:
হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. বলেন,
قال دخل علينا النبي صلى الله عليه وسلم فقال عندنا فعرق وجاءت أمي بقارورة فجعلت تسلت العرق فيها فاستيقظ النبي صلى الله عليه وسلم فقال يا أم سليم ما هذا الذي تصنعين قالت هذا عرقك نجعله في طيبنا وهو من أطيب الطيب
অর্থ: রাসূল স. আমাদের বাড়ীতে আগমন করেন এবং বিশ্রামের উদ্দেশ্যে শয়ন করেন। রাসূল স. ঘেমে যাচ্ছিলেন। আমার মা একটি বোতল নিয়ে এলেন এবং রাসূল স. এর শরীর থেকে ঘাম মুছে সেই বোতলে ভরছিলেন। রাসূল স. জেগে উঠলেন এবং বললেন, হে উম্মে সুলাইম, তুমি এটি কী করো? তিনি বললেন, এটি আপনার ঘাম। আমরা একে সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহার করি। কেননা এটি সর্বোত্তম সুগন্ধি। [মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ২৩৩১]
মুসলিম শরীফের অপর বর্ণনায় রয়েছে,
ما تصنعين يا أم سليم فقالت يا رسول الله نرجو بركته لصبياننا قال أصبت
অর্থ: হে উম্মে সুলাইম, তুমি কী করছ? তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের শিশুদের জন্য এর থেকে বরকত হাসিল করতে চাই। রাসূল স. বললেন, তুমি ঠিক করেছ।
এছাড়াও সাহাবায়ে কেরাম রাসূল স. এর পরিহিত পোশাক দ্বারা বরকত হাসিল করতেন। এ সংক্রান্ত বর্ণনার জন্য দেখুন, বোখারী শরীফের ৫৬৮৯ নং হাদীস।
৫ম হাদীস:
হযরত মাহমুদ ইবনে রবী আল-আনসারী বর্ণনা করেন,
أن عتبان بن مالك كان يؤم قومه وهو أعمى، وأنه قال لرسول الله صلى الله عليه وسلم: يا رسول الله إنها تكون الظلمة والسيل وأنا رجل ضرير، فصل يا رسول الله في بيتي مكانا أتخذه مصلى، فجاءه رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال: “أين تحب أن أصلي؟” فأشار إلى مكان من البيت، فصلى فيه رسول الله صلى الله عليه وسلم
অর্থ: হযরত ইতবান বিন মালিক রা. একজন অন্ধ সাহাবী ছিলেন। তিনি তার সম্প্রদায়ের ইমাম ছিলেন। তিনি রাসূল স. কে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, অনেক সময় পথ অন্ধকার থাকে, বৃষ্টি হলে পানির প্রবাহ থাকে। আর আমি একজন অন্ধ। হে আল্লাহর রাসূল, আপনি আমার ঘরের একটি জায়গায় নামায পড়ুন। এটাকে আমার নামাযের জায়গা বানাব। রাসূল স. তার বাড়ী আগমন করলেন এবং বললেন, আমি কোথায় নামায পড়লে তুমি খুশি হবে? তিনি ঘরের একটি জায়গা দেখালেন। রাসূল স. সেখানে নামায আদায় করলেন।[বোখারী শরীফ, হাদীস নং ৬৩৬]
হাদীস থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
কাজী ইয়াজ রহ. বলেন,
فيه التبرك بالفضلاء، ومشاهد الأنبياء وأهل الخير ومواطئهم، ومواضع صلاتهم، وإجابة أهل الفضل لما رغب إليهم فيه من ذلك” এই হাদীস থেকে বুজুর্গদের থেকে বরকত হাসিলের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। এছাড়া নবী ও ওলীগণের স্মরণীয় স্থান, তাদের হাটা-চলার জায়গা, তাদের নামাজের জায়গা থেকে বরকত হাসিল প্রমাণিত হয়। সেই সাথে এটাও প্রমাণিত হয় যে, বুজুর্গদের থেকে এভাবে কেউ বরকত লাভ করতে চাইলে তার আবেদনে সাড়া দেয়া উচিৎ। “[ইকমালুল মু’লিম, কাজী ইয়াজ রহ. খ.২, পৃ.৩৫৩]
ইমাম নববী রহ. বলেন,
وفيه التبرك بالصالحين وآثارهم، والصلاة في المواضع التي صلوا بها، وطلب التبريك منه
অর্থ: এই হাদীস থেকে একটি শিক্ষণীয় বিষয় হল, নেককার বুজুর্গদের মাধ্যমে বরকত লাভ। এবং বুজুর্গরা যেখানে নামায আদায় করেছেন সেখানে নামায আদায় করে বরকত অর্জন করা। [শরহু সহীহি মুসলিম, খ.৫, পৃ.১৬১]
কাজী শাওকানী নাইলুল আওতারে লিখেছেন,
“وفيه أنه يشرع لمن دعي من الصالحين للتبرك به الإجابة، وإجابة الفاضل دعوة المفضول، وغير ذلك من الفوائد
অর্থ: এই হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, কোন নেককার বুজুর্গ থেকে কেউ যদি বরকত হাসিল করতে চাই, তাহলে তার আবেদনে সাড়া দেয়া উচিৎ । এছাড়াও অনুত্তমের দাওয়াতে উত্তমের সাড়া প্রদানসহ আরও অনেক শিক্ষণীয় বিষয় এই হাদীসে রয়েছে।[নাইলুল আওতার, খ.৩, পৃ.৯৫]
৬ষ্ঠ হাদীস:
হযরত আবু বকর রা. এর কন্যা আসমা এর নিকট রাসূল স. এর জুব্বা ছিল। তিনি জুব্বাটি বের করে বলেন,
وقالت: هذه جبة رسول الله صلى الله عليه وسلم كانت عند عائشة فلما قبضت قبضتها، وكان النبي صلى الله عليه وسلم يلبسها، فنحن نغسلها للمرضى نستشفي بها
অর্থ: এটি রাসূল স. এর জুব্বা। এটি হযরত আয়েশা রা. এর কাছে ছিল। হযরত আয়েশার যখন ইন্তেকাল হলে আমি এটি নিয়েছি। রাসূল স. জুব্বাটি পরতেন। আমরা এই জুব্বা ধৌত করে অসুস্থদেরকে পানি পান করায় যেন তারা এর দ্বারা আরোগ্য লাভ করে। [মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ২০৬৯]
ইমাম যাহাবী সিয়ারু আ’লামিন নুবালাতে লিখেছেন,
قال عبد الله بن أحمد -أي ابن حنبل- رأيت أبي يأخذ شعرة من شعر النبيّ فيضعها على فيه يقبلها وأحسب أني رأيته يضعها على عينه ويغمسها في الماء ويشربه يستشفي به ورأيته أخذ قصعة النبيّ فغمسها في جب الماء ثم شرب فيها
অর্থ: ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের ছেলে আব্দুল্লাহ বলেন, আমি আমার পিতাকে দেখেছি, তিনি রাসূল স. এর একটি চুল নিয়ে চুমু খাচ্ছিলেন। এছাড়াও তিনি রাসূল স. এর চুল তার চোখের উপর রাখতেন। রোগমুক্তির জন্য চুল পানিতে ডুবিয়ে পানি পান করতেন। আমি তাকে আরও দেখেছি, তিনি রাসূল স. এর ব্যবহৃত পাত্র পানিতে ডুবাতেন এবং সেই পানি পান করতেন।
এই বর্ণনার পর ইমাম যাহাবী নিজের মন্তব্য লিখেছেন,
: قلت -أي الذهبي-: أين المتنطع المنكر على أحمد وقد ثبت أن عبد الله سأل أباه عمن يلمس رمانة منبر النبيّ ويمس الحجرة النبوية، فقال -أي أحمد بن حنبل-: لا أرى بذلك بأسا. أعاذنا الله وإياكم من رأي الخوارج ومن البدع
অর্থ: “ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের সমালোচনাকারীরা এখন কোথায়? অথচ ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল থেকে প্রমাণিত যে, তার ছেলে আব্দুল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করেন, কেউ যদি বরকত হাসিলের জন্য রাসুল স. এর মেম্বার ও তার হুজরা স্পর্শ করে, এ বিষয়ে আপনার মতামত কি? ইমাম আহমাদ বলেন, এতে আমি কোন অসুবিধা দেখি না। আল্লাহ তায়ালা সবাইকে খারেজী ও বিদয়াতীদের মতাদর্শ থেকে হেফাজত করুন। “[সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.১১, পৃ.২১২]
উপর্যুক্ত আলোচনায় হাদীসগুলি গ্রহণ করা হয়েছে বোখারী ও মুসলিম শরীফ থেকে। হাদীসের বুঝ গ্রহণ করা হয়েছে আহলে সুন্নতের বিখ্যাত ইমামগণ থেকে। ইমাম নববী রহ, ইবনে হাজার আসকালানী রহ, কাজী ইয়াজ রহ, ইমাম বদরুদ্দীন আইনি রহ ও ইমাম যাহাবীর মত নক্ষত্রতুল্য ইমামগণের মতামত উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের এসব বক্তব্যের মাধ্যমে তাবাররুক সম্পর্কে আহলে সুন্নতের অবস্থান স্পষ্ট হয়েছে। তাদের মতে নবী-রাসুল ও অলী-বুজুর্গদের থেকে তাবাররুক বা বরকতগ্রহণ শরীয়তে বৈধ। নবী-রাসুল ও অলীদের ব্যবহ্রত আসবাব, তাদের স্মরণীয় স্থান, নামাযের জায়গা, জামা-কাপড় ইত্যাদি থেকেও বরকত হাসিল শরীয়তে বৈধ। মোটকথা, চার মাজহাবের সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমগণের নিকট তাবাররুক বৈধ।
আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।