আশুরা, শোহাদায়ে কারবালার স্মরণ, সুন্নি-শিয়া বিষয়ক কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নত্তোরঃ
🖋শায়খ সাইফুল আজম বাবর আল-আযহারী
১- প্রশ্নঃ এই যুগে কারবালা বিষয়ক মাহফিল করা বা কারবালায় সংঘঠিত ঘঠনার স্মরণ করা পবিত্র কোরানের আলোকে কতটুকু সমর্থিত?
Answer: কারবালার ঘঠনা হুযুর (ﷺ) এর ইনতিকালের পরের ঘঠনা। স্বাভাবিক ভাবে অহির অবতরন বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে এই ঘটনার বর্ণনা পবিত্র কোরানে আসার কথা না। কিন্তু আমরা যদি পবিত্র কোরান ও হাদীছের আলোকে কিছু প্রিন্সিপল বা মূলনীতি ঠিক করি তবে দেখব ঐতিহাসিক ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ঘঠনার স্মরণ করা এবং বর্ণনা দেওয়া পবিত্র কোরানের মূলনীতি সিদ্ধ ও আল্লাহর সুন্নাত। পবিত্র কোরানের বিষয়বস্তুর দিকে নজর দিলে দেখবেন বেশিরভাগ আয়াত হুযুর (ﷺ) দুনিয়ায় তাশরিফ আনার আগে বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। পবিত্র কোরানের সুরা বাকারা, কাহাফ, ইউছুফ সহ বেশিরভাগ আয়াতের বিষয়বস্তুর দিকে নজর দিলে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে যে কারবালার মত তাৎপর্যপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা পবিত্র কোরানের মূলনীতি সিদ্ধ। এই বিষয়ে ভিন্ন মত পোষন মুর্খতা বৈ কিছুই না।
২- প্রশ্নঃ এই যুগে কারবালায় সংঘঠিত ঘঠনার স্মরণ করার যুক্তিকতা ও তাৎপর্য কতটুকু?
উত্তরঃ এমন একটা সময়ে এসে আমরা আপতিত হয়েছি যখন সম্পর্ক গুলো কেমন যেন নড়েবড়ে হয়ে যাচ্ছে। সম্পর্ক গুলো শুধু নাম কা ওয়াস্তে বেচে আছে। কিন্তু সম্পর্ক গুলোর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, টান, ভালোবাসা আর ইমোশনাল এটাচমেন্ট একেবারে বিলুপ্তির পথে। এটা ইউরোপে বসবাসকারী লোক বিনা বাক্যব্যায়ে মেনে নিবে। এটা শুধু দুনিয়াবি সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঘটেনি বরং দ্বীনি সম্পর্ক গুলোর ক্ষেত্রেও একি ঘটনা লক্ষনীয়। কাজেই আমাদের উচিত আমাদের ঈমানের সাথে যেই বিষয়গুলি জড়িত তা প্রাত্যহিক স্মরনের সাথে সাথে সেই দিনটিতে বিশেষ স্মরণ করা বছরের যেই দিনটির সাথে এই বিষয়টা সংশ্লীস্ট।
কারবালার ঘটনার দুই পক্ষের মধ্যে এক পক্ষ এমন ছিল যাদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসাই ঈমান। অগণিত সহিহ্ হাদীছের মাধ্যমে এই বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রমাণিত। কিন্তু প্রত্যেক যুগের ন্যয় এই যুগেও খারেজী মাইন্ডসেটের লোকেরা সাধারণ মানুষের ঈমান আকিদা হরনের জন্য এটাকে দুই শাহজাদার মধ্যকার ক্ষমতার হাসিলের যুদ্ধ বলে প্রচার করে। নাউঝুবিল্লাহ্। অথচ দুনিয়া ও আখিরাতের শাহ্জাদা ইমাম হুছাইন (رضي الله عنه)। যার নানা ইমামুল মুরসালীন (ﷺ), নানী জীবরিল (আঃ) এর মাধ্যমে আল্লহর পক্ষ থেকে সালাম প্রাপ্তা, বাবা হযরত আলী (رضي الله عنه), মা ছায়্যিদাতুন নিছা ফাতেমা ঝাহরা (رضي الله عنه), ভাই হযরত হাছান (رضي الله عنه) আর বোন ছৈয়্যদা যয়নাব (رضي الله عنه)। সুতরাং সময়ের গতিতে উম্মতে মুহাম্মদীর নিউ জেনারেশান যাতে নবী বাগানের এই ফুল গুলির অনুপম আত্মত্যাগ, ধৈর্য্য, তাওয়াক্কুল ও ইয়াকিনের স্মৃতিগাথা সেই কারবালা এবং ঘৃন্য ইয়াযিদ, সিমার ও ইবনে যিয়াদ নামধারি সেই খারিজিদের জানোয়ারদের ভুলে না যায় সেই জন্য এই দিন গুলিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩- প্রশ্নঃ কারবালা সংঘঠিত হওয়ার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট খুব সংক্ষেপ করে বর্ণনা করুন যাতে পাঠক সমাজ উপকৃত হয়।
Answer: খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে বলা আসলেই মুশকিল। তবুও বলছি- হযরত উছমান (رضي الله عنه)-র শাহাদাতের পর হযরত আলী (رضي الله عنه) কে খেলাফতের দায়িত্বভার দেওয়া হয়। হযরত আমির মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) তখন সিরিয়ার গভর্ণর। তিনি হযরত উছমান (رضي الله عنه)-র শহিদকারীদের বিচারের ইস্যুতে হযরত আলী (رضي الله عنه)-র হস্তে বাইয়াত গ্রহনে অস্বীকৃতি জানান। পরবর্তী পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি মুসলমানদের সিফ্ফিনের যুদ্ধ পর্যন্ত নিয়ে যায়। এখানে এটা পরিস্কার করা দরকার যে, কুরাইশ বংশের বনি হাশিম ও উমাইয়া গোত্রের মধ্যকার সম্পর্ক অনেক আগ থেকেই বিরোধপূর্ণ ছিল। হযরত আলী (رضي الله عنه) হাশেমী আর হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) উমাইয়া বংশের ছিলেন। যাই হোক সিফ্ফিনের যুদ্ধে হযরত আলী (رضي الله عنه) নিশ্চিত জয় বুঝতে পেরে হযরত আমির মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-র পক্ষ থেকে যুদ্ধ বন্ধ ও ডায়োলগের প্রস্তাব আসে। প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। যুদ্ধ বন্ধ হয়। পরবর্তী পরিস্থিতিতে হযরত আলী (رضي الله عنه) শাহাদাত বরন করেন। এরপর হযরত হাছান (رضي الله عنه) খেলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। উনি ছয় মাস খেলাফতের দায়িত্ব পালন করে মুসলমানদের বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্যের খাতিরে শাসনভার হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-র হাতে ন্যস্ত করে স্টেপ ডাউন করেন। উনি স্টেপ ডাউন করার সাথে সাথে খেলাফতে রাশেদার পরিসমাপ্তি ঘটে এবং মুসলমানদের রাজনৈতিক আকাশে রাজতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে যা থেকে মুসলমানদের আজকের এই যুগ পর্য্যন্ত মুক্তি মিলেনি। হযরত আমীর মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) উনার মৃত্যুর আগে শাসন কার্য পরিচালনার জন্য ইয়াযিদকে নির্বাচিত করে যান। ইয়াযিদের দুশ্চরিত্র, লাম্পট্য আর শরাবখোরি কারো অজানা ছিলনা। তাই তার দায়িত্ব প্রাপ্তির সংবাদে মক্কা শরিফ, মদীনা শরিফ সহ মুসলমানদের দেশে দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। সাধারণ লোকজনের দৃষ্টি ছিল মদীনা শরিফে অবস্থানরত হুযুর (ﷺ) চারজন সাহাবী যারা স্বাভাবিক ভাবেই অনেক জনপ্রিয় ছিলেন। তম্মধ্যে একজনের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বি এবং তিনি ছিলেন মুসলমানদের অন্তরের মুকুটহীন সম্রাট প্রিয় নবীর (ﷺ) প্রানপ্রীয় দৌহিত্র ইমাম হুছাইন (رضي الله عنه)। তাই ইয়াযিদের কাছে এই চার জনের বাইয়াত বিশেষ করে ইমাম হুছাইন (رضي الله عنه)-র বাইয়াত গ্রহণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। স্বভাবতই তিনি বাইআত গ্রহণে অস্বিকৃতী জানান। আর এটা কস্মিনকালরই জান্নাতি যুবকদের সরদারের জন্য সম্ভব ছিলনা। এজিদ ক্ষমতার জন্য কোনকিছু করতে দ্বিধা করবেনা জেনে সবার পরামর্শে তিনি মদীনা শরিফ ত্যাগ করে মক্কা শরীফে চলে যান। এরই মধ্যে ইরাকের কুফা থেকে হাজার হাজার চিঠি আসতে থাকে। চিঠির সারমর্ম ছিল-আমরা ইয়াযিদকে মানিনা। আপনি কুফা আসেন। এখানকার লোক আপনার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তিনি গ্রাউন্ড রিয়ালিটি দেখার জন্য মুসলিম বিন আকীল (رضي الله عنه) কে কুফায় প্রেরণ করেন। উনি কুফায় পৌছার সাথে সাথে হাজার হাজার লোক তারঁ হাতে ইমাম হোছাইনের (رضي الله عنه) পক্ষে বাইয়াত গ্রহণ করেন। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে উনি ইমাম হোছাইন (رضي الله عنه) কে কুফায় আসার জন্য সবুজ সংকেত দেন। এই সংবাদ ইয়াযিদের কাছে পৌছাতেই সে অত্যাচারী উবাইদুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদকে কুফার গভর্ণর হিসেবে নিয়োগ দেয় এবং শক্ত হাতে পরিস্থিতি দমনের নির্দেশ দেয়। উবাইদুল্লাহ্ এসেই হযরত মুসলিম বিন আকীলকে নির্দয়ভাবে হত্যা করেন। এমনকি তারঁ ছোট ছোট দুই শাহজাদাকেও নিমর্মভাবে হত্যা করে শরীর থেকে মস্তক ছিন্ন করে হারিছ নামের এক পাষন্ড। কুফার পরিবর্তিত পরিস্থিতি সম্পর্কে অনবগত হওয়ার কারণে ইমাম হোছাইন (رضي الله عنه) কুফাই আগমন করেন। সামগ্রীক পরিস্থিতি জানতে পেরে উনি যারপরনাই আফছোছ করেন। কিন্তু ইবনে যিয়াদের নির্দেশে তার হাজার হাজার সৈন্য তারঁ গতিরোধ করে কারবালার দিকে তাকে পুশ করতে থাকে। এক পর্য্যায়ে উনি কারবালার প্রান্তরে তাবু ফেলেন। এর পর যা হয়েছিল তা পৃথিবীবাসীর জন্য কিয়ামতে ছুগরা। সিমার বিন জাউশান ইয়াযিদি বাহিনীর সাথে যোগদান। ফোরাত অবরুদ্ধ। নবী পরিবারের সদস্যদের নির্মম হত্যাকাণ্ডে। ইমাম হুছাইনের মস্তক শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন। আহলে বাইতে রাছুলের (ﷺ) তাবুতে আগুন।
৪- প্রশ্নঃ এই ঘটনার সাথে পরোক্ষভাবে হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-র নাম এসে যায়। হযরত আলী (رضي الله عنه)-র হাতে বাইয়াত গ্রহণ না করা এবং ইয়াজিদকে মসনদে বসানোর যেই কাজ, সেই কাজের সাথে সংশ্লিস্ট থাকার কারণে হযরত আমীর মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) সম্পর্কে সলফে সালেহীন এবং পরবর্তীতে উম্মতে মুহাম্মদীর সংখ্যাগরিস্ঠ আইম্মায়ে কিরামের অভিমত কি?
Answer: এই বিষয়টি একটা সেটেল্ড বিষয়। এই বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ফতওয়া দেওয়ার, চিন্তা করার বা কথা বলার কোন সুযোগ নেই। কারণ এটার উপর মসলমানদের মেইন স্ট্রীম আহলে ছুন্নাত ওয়াল জামাতের উছুলুদ্দীন বা আকীদা, তাফছীর, হাদীছ ও ফিকাহ্-র আয়িম্মায়ে কেরামের ইজমা বা কনসেনসাস বা ঐক্যমত্য রয়েছে। সুতারং অন্য কথা বলা মানেই হচ্ছে মেইন স্ট্রীম বা আহলে ছুন্নাত ওয়াল জামাত থেকে সটকে পড়া।
হযরত আলী (رضي الله عنه)-র উপর খেলাফতের দায়িত্বভার অর্পণের পর হযরত আমীর মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) কতৃক বাইয়াত গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানো যা পরবর্তীতে ‘সিফফিনের’ যুদ্ধে রূপ নেয়- এই মুশাজারাহ্ বা কনফ্লিকশন বা দ্বন্দ্বে আয়িম্মায়ে উম্নতের অভিমত হচ্ছে-
“হযরত আলী (رضي الله عنه) ‘হক্ব’ তথা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। উনিই লেজিটিমেট খলিফা ছিলেন এবং তাঁর দাবীই ন্যয়নিষ্ট ছিল। এই ক্ষেত্রে হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-র টা বিদ্রোহ ছিল এবং উনার দাবী অসমিচীন ছিল। তবে এই কারণে তাকে ফাছেক বা কাফের বলা যাবেনা, নিন্দা বা তিরস্কার করা যাবেনা এবং সমালোচনা করা যাবেনা। কারণ উনি একজন সম্মানিত সাহাবী। আর সাহাবীরা ‘আদূল’ বা ন্যয়নিস্ট বলে রাছুল (ﷺ) এর ফরমান রয়েছে। বিশেষ করে উনার সাহাবী হওয়ার কারণে এবং সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনা ও গলমন্দের উপর হুযুর করীম (ﷺ) এর নিষেধাজ্ঞার কারণে মুসলমানরা উনার মাধ্যমে সংঘঠিত বিষয় গুলিকে ইজতিহাদগত ভুল মনে করে এই বিষয়ে চুপ থাকবে”। কিন্তু এই বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, ‘হক্ব’ এর উপর হযরত আলীই (رضي الله عنه) প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।
আমি উপরে যেই অভিমতটা উল্লেখ করেছি তা গত হাজার, বারশ বছরে উম্মতে মুসলিমার আকিদার, হাদীছের এবং ফিকাহর ইমামদের লিখিত কিতাব থেকেই উল্লেখ করেছি। কেউই এই বিষয়ে ব্যতিক্রম বলেননি। আমি উদাহরণ স্বরূপ এই তিন বিষয়ের (আকিদা, হাদীছ ও ফিকহ্) তিনটি সর্বজনগৃহিত কিতাব থেকে উদ্ধৃতি দিলে বিষয়টি দিবালোকের ন্যয় স্পষ্ট হয়ে যাবে । সুতরাং এই বিষয়ে অতিরিক্ত স্মার্ট ও আহলে বাইতের প্রেমিক সাজতে গিয়ে শিয়া ইজমের বেশ ধরার যেমন কোন সুযোগ নেই, ঠিক তেমনিভাবে নিজেকে অতিমাত্রায় সুন্নি প্রমাণ করতে গিয়ে মুহাররম মাসে হযরত আমির মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-র ওরছ করা, আহলে বাইতে রাছুল (ﷺ) ও শোহাদায়ে কারবালা বিষয়ক মাহফিলে অনুৎসাহিতবোধ করা ও হযরত আলী (رضي الله عنه) ও হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এনে এক কাতারে দাড় করিয়ে দেওয়ারও কোন সুযোগ নেই।
একঃ ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رضي الله عنه) উনার বিশ্ববিখ্যাত কিতাব ‘ফতহুল বারীতে’ (যা সহিহ্ বোখারি শরিফের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং নির্ভরযোগ্য ব্যখ্যাগ্রন্হ) হুযুর (ﷺ) এর হাদীছ যাতে তিনি (ﷺ) হযরত আম্মার বিন ইয়াছের (رضي الله عنه)-র ব্যাপারে ভবিষ্যতবাণী করে বলেছিলেন যে, “হযরত আম্মার বিন ইয়াছের (رضي الله عنه) বিদ্রোহীদের হাতে শহীদ হবেন” (সহিহ্ বোখারি ও মুসলিম শরিফ-এ বর্ণিত এবং উনি পরবর্তীতে হযরত আমীর মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-র সৈন্যবাহিনীর হাতে শাহাদাত বরন করেন) এর ব্যখ্যায় বলেন: “ওয়াকাদ ছাবাতা আন্না মান কাতালা আলিয়্যান কানু বুগাত” অর্থাত্: এটা স্পষ্ট যে, যারা হযরত আলী (رضي الله عنه)-র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন তারা বিদ্রোহী ছিলেন। তবে এই কারণে তাদের ‘ঝম’ তথা তিরস্কার বা নিন্দা করা যাবেনা। এটা ইজতিহাদগত ভুল বলে বিবেচ্য হবে”। এরপর উনি বলেনঃ “ওয়া ইয়াকফি লিইছবাতে ঝালিকা আল-হাদীছ আল-ছাহীহ্ আল্লাঝি রাওয়াহুল বোখারীয়্যু” অর্থাত: এটা যে হযরত আলী (رضي الله عنه)-র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল তা বুঝার জন্য বোখারী শরিফের এই হাদীছ-ই যথেষ্ট। অর্থাত স্বয়ং রাছুল কারীম (ﷺ)-ই বলেছেন “আল ফিয়াতুল বাগিয়াহ্” বা বিদ্রোহী দল”।
ঠিক এই স্টাইলেই এই বিষয়ক বর্ণনা এসেছে ইমাম বদরুদ্দীন আইনি কৃত সহিহ্ বোখারীর শরাহ্ ‘ওমদাতুল কারীতে’ এবং মৌল্লা আলী কৃত মিশকাত শরীফের ব্যখ্যাগ্রন্হ ‘মিরকাতে’। বরং মোল্লা আলী কারী বলেছেন: “বিআন্নাল লাঝীনা কাতালূহু বুগাতুন ঝালেমুনা লাহূ” (এই অনুবাদ সাধারণ মানুষের অন্তরে বে-আদবির জন্ম দেবে বিধায় বিরত রইলাম)
দুইঃ ইলমে উসুলিদ্দীনের উপর লিখিত সকল যুগের কিতাবেও ঠিক এটাই বর্ণিত হয়েছে। আমি শুধু দুটি স্বনামধন্য কিতাবের উদ্বৃতি এখানে উল্লেখ করব। একটা মাদ্রাসার পাঠ্যপুস্তক হিসেবে বহুল পঠিত।
-ইমাম আবুল মুঈন আন নছফি আল হানাফি উনার বিখ্যাত কিতাব “তাবছেরাতুল আদিল্লাহ্” তে উল্লেখ করেন যে, এটা হযরত আমীর মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-র ‘বাগাওয়াত’ বা বিদ্রোহ ছিল। তবে সেই কারণে উনার কোনরূপ সমালোচনা করা যাবেনা। উনি এই বিষয়ে আরো বলেন যে, উভয়ের মধ্যে ফজিলতের ক্ষেত্রে হযরত আলী (رضي الله عنه)-র মকাম ও মরতবা অনেক উপরে।
– ইমাম তাফতাঝানি শরহুল মাকাসিদে বলেনঃ “ফাল মুসীবু আলী, ওয়াল মুখালিফুনা বুগাত” অর্থাত্: হযরত আলী (رضي الله عنه) সত্যের উপর ছিলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধাচরন যারা করেছেন তারা বিদ্রোহী ছিলেন। তবে এই কারণে হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) কে কাফের, ফাছেক বলা যাবে না, যা শিয়া মুর্খরা করে থাকে।
মোদ্দা কথা আকিদার যেই কিতাবই আপনি পড়েন না কেন তাতে এই বিষয়টি স্পষ্ট যে,
– হযরত আলী (رضي الله عنه) সত্যের উপর ছিলেন
-হযরত আমীর মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-র টা ‘বাগাওয়াত’ বা বিদ্রোহ ছিল। তবে সেই কারণে উনাকে কাফের, ফাছেক বলা যাবেনা, তার নিন্দা করা যাবেনা, সমালোচনা করা যাবেনা, অভিসম্পাত করা যাবেনা এবং গালি-গালাজ করা যাবেনা। এটা ইজতিহাদী ভুল বিবেচিত হবে। কারণ উনি সাহাবিয়ে রাছুল (ﷺ) আর সাহাবীরা ‘আদূল’ বা (ন্যয়নিস্ট) বলে রাছুল (ﷺ) এর ফরমান রয়েছে।
তিন: এবার ফিকাহ্-র কিতাবে দেখব এই বিষয়ে কি বলা হয়েছে। ফিকাহ্ এর কিতাব সমুহের মধ্যে একটা অধ্যায় আছে- “আদাবুল কাজী” যা প্রধান বিচারপতির শিস্টাচার বিষয়ক। এই অধ্যায়ে আলোচিত বিষয় সমুহের মধ্যে একটি হচ্ছে- যদি কেউ অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখল করে তবে তার পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হলে ঐ ব্যক্তির জন্য পোস্টটা গ্রহণ করা বা না করা এবং তার তাকলীদ করা আর না করা বিষয়ক।
এই বিষয়ে সকল কিতাবের ভাষার গঠন এবং ধরন অনেকটাই একইরকম। তবে এখানে আমরা শুধুমাত্র হিদায়ার উদ্বৃতি উল্লেখ করব। কারণ হিদায়া ফিকাহর অন্যতম নির্ভরযোগ্য কিতাব যা সকল মাদ্রাসাই অনার্স ও মাস্টার্স লেভেলে পড়ানো হয়। তাছাড়া এই কিতাবটি আরো তিনটি উল্লেখযোগ্য কিতাবকে নীজের মধ্যে ধারন করে: বিদায়াতুল মুবতাদী, কুদূরী, আল জামে’ আল ছাগীর। ইমাম মরগেনানী হিদায়াতে উল্লেখ করেন: “ইয়াজুঝুত তাকলীদ মিনাছ ছুলতানিল জাঈর কামা ইয়াজুঝু মিনাল আদেল। লিআন্নাস সাহাবাতা তাকাল্লাদূহু মিন মুয়াবিয়াতা ওয়াল হাক্বু কানা বিইয়াদে আলিয়্য়িন ফি নাওবাতিহী। ওয়াত তাবেঈনা তাকাল্লাদূহু মিনাল হাজ্জাজ ওয়া কানা জাইরান”। অর্থাত শাসক গোষ্ঠী যদি অন্যায়ভাবেও ক্ষমতায় আসীন হয় তবুও কাজী বা প্রধান বিচারপতির তাকলীদ বৈধ। যেমন হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-র সময়কালে সাহাবায়ে কেরামের তার তাকলীদ করেছেন। অথচ হক্বের উপর হযরত আলী (رضي الله عنه)-ই প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তাবেঈনগন অত্যাচারী হাজ্জাজেরটা মেনেছেন”।
সকল ফিকাহর কিতাবে ইমামগণ এই বিষয়ে (অর্থাত কেউ যদি অসমীচিন উপায়ে ক্ষমতা দখল করে তবে তার পক্ষ থেকে নিয়োগকৃত প্রধান বিচারপতির তাকলীদ প্রসঙ্গে)
সাহাবায়ে কেরামের সময়কালীন উদাহরণ দিতে গিয়ে হযরত আমীর মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-র কথা উল্লেখ করেন।
সুতরাং এই বিষয়টা নিয়ে পানি ঘোলা করার কোন সুযোগ নেয়। এই ধরনের কথা বলা মুর্খতা ও বেঈমানি হবে যে, দুইজনই সাহাবীয়ে রাছুল (ﷺ)। জানিনা কে হক্বের উপর ছিলেন আর কে ছিলেন না। এই কথা চৌদ্দশ বছরের ইতিহাসে কেউ বলেননি। আর দুজনই সাহাবী, তবে তারা দুজন একই স্টেটাসের না। ফজিলতের দিক থেকে হযরত আলী (رضي الله عنه)-র মকাম অনেক উপরে। যেভাবে আম্বিয়ায়ে কিরাম সকলে একই স্টেটাসের না। ফজিলরের দিক থেকে কারো কারো অবস্থান অন্য নবীর তুলনায় অনেক উপরে।
পরিশেষে বলব আহলে বাইতে রাছুল (ﷺ) কে সম্মান করতে গিয়ে হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) সহ কোন সাহাবির নিন্দা করা শিয়াইজম। দুইজনকে মন্দ বলা ‘খারিজিয়্যত’। হযরত আলীর (رضي الله عنه) প্রতি ছাপা ক্ষোভ বা হালকা মনোভাব পোষন করে হযরত আমির মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) কে বেশি প্রাধান্য দেওয়া এবং সমানে সমান বলা ‘মোনাফেকত’। এই যুদ্ধে এবং দ্বন্দ্বে হযরত আলী (رضي الله عنه) হক্ব ছিলেন। হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-র টা বিদ্রোহ ছিল। তবে সেই কারণে উনাকে কাফের, ফাছেক বলা যাবেনা, তার নিন্দা করা যাবেনা, সমালোচনা করা যাবেনা, অভিসম্পাত করা যাবেনা এবং গালি-গালাজ করা যাবেনা। এটা ইজতিহাদী ভুল বিবেচিত হবে। কারণ উনি সাহাবিয়ে রাছুল (ﷺ) আর সমস্ত সাহাবী ‘আদূল’ বা (ন্যয়নিস্ট) বলে রাছুল (ﷺ) এর ফরমান রয়েছে। এটাই আহলে ছুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা। আপনি এক সাহাবীর বিরুদ্ধে সমালোচনার তীর ছুড়লে আরেকজন আরেক সাহাবীর বিরুদ্ধে ছুড়বেন। হাজার মুনাফিক অপেক্ষায় আছে এই অবস্থা সৃষ্টের। সুতরাং সাবধান। এটা দ্বীনে মুহাম্মাদীর (ﷺ)-র ‘রেড ঝোন’। ক্রছ করলেই শয়তান কতৃক এরেস্টেড হবেন।
মারহুম আবুল আলা মাউদুদীর লিখিত কিতাব “খিলাফত আওর মুলুকিয়্যতে” হযরত উছমান (رضي الله عنه) ও হযরত আলী (رضي الله عنه) কতৃক গৃহিত অনেক পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন এই বলে- ‘ভুল ভুলই। ভুলকে ইজতেহাদী ভুল বলে চালিয়ে দেওয়ার কোন সুযোগ নেই।’
আর এই কারণেই লক্ষ করবেন জামাত শিবিরের কর্মিদের মধ্যে ‘মুহাব্বাত’, ‘আদব’ এবং তা’যিমের মাত্রা কম। এটা মাউদুদীবাদের প্রভাব।
অনেকেই দেখি, অতিরিক্ত মুহাব্বাত আর স্মার্টনেসের ভারে সুন্নিয়তের চাদরে আবৃত হয়ে শিয়াদের টোনে কথা বলেন। এটা পাক্কা মুনাফেকি। আইম্মায়ে কেরাম সবকিছু দুধ কা দুধ, পানি কা পানি করে দিয়ে গেছেন।
আবার অনেকেই দেখি মুহাররম মাসে শিয়াদের রোধ করতে গিয়ে হযরত আমীর মুয়াবিয়ার (رضي الله عنه) ওরছ ও জিকির বেশি করা শুরু করেন। এটা খারিজি আইঢিওলজির প্রভাব এবং অত্যন্ত পরিতাপের। শিয়া রোধে আহলে ছুন্নতের প্লাটফর্মে এই ধরনের ফালতু টেকনিক খারিজিয়্যত, ঘৃণিত ও পরিত্যাজ্য।
৫- প্রশ্নঃ কারবালার যুদ্ধ দুই শাহজাদার মধ্যকার ক্ষমতা লাভের যুদ্ধ। কীভাবে মুল্যায়ন করবেন?
উত্তরঃ এই ধরনের মন্তব্য মুনাফিক এবং চরম খারিজি আদর্শের ধারক আহলে বাইত বিদ্বেষী সময়ের ঝুল খুওয়ায়ছারাই করতে পারে। কার সাথে কার তুলনা? সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্য্যন্ত ইমাম হুছাইন (رضي الله عنه)-র চেয়ে বড় শাহ্জাদা না এই যমিন কখনো দেখেছে, না আসমান।
তাঁর নানা ইমামুল মুরসালীন (ﷺ)। নানী পৃথিবীর নারীদের মধ্যে উত্তম, যাকে আল্লাহ্ তায়ালা জিবরীল মারফত সালাম পাঠিয়েছে। যার মা জান্নাতী নারীদের লিডার। যার বাবা মুমিনদের মাওলা, রাছুল কারীম (ﷺ) এর জ্ঞান শহরের প্রবেশপথ এবং খোলাফায়ে রাশেদার চতুর্থ খলিফা। যার ভাই জান্নাতি যুবকদের লিডার। যিনি নিজেও জান্নাতি যুবকদের সরদার। স্বয়ং রাছুলে খোদা (ﷺ) যাকে নানা-নানী, মা-বাবা, চাচা-ফুফু এবং মামা-খালার দিক থেকে ‘খাইরুন-নাস’ তথা সবচেয়ে উত্তম বলেছেন। (তাবরানী, মু’জামুল কাবীর, নং২৬৮২, হাইছামী, মাজমা’উঝ ঝাওয়ায়েদ, ৯:১৮৪)
এরপরও কি ওই ইয়াজিদ খাবীছকে ইমাম হুছাইনের (رضي الله عنه)-র সাথে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে শাহজাদা বলবেন? লজ্জা হওয়া দরকার।