আল্লাহকে সর্বত্র হাযির বলা যাবে না এবং আহলে হাদিসদের মতো আল্লাহ আরশে আযীমে সমাসীনও বলা যাবে না। কেননা আল্লাহ স্থান কাল থেকে মুক্ত। মহান আল্লাহ সমস্ত জগত বেষ্টন করে রয়েছে। অনেকে রাসূল (ﷺ) কে হাযির নাযির অস্বীকার করতে গিয়ে বলেন হাযির-নাযির আল্লাহর গুণ। কিন্তু আহলে হাদিসদেরই মাযহাব আল্লাহ সব জায়গায় হাযির-নাযির নন; বরং আরশে সমাসীন; কিন্তু রাসূল (ﷺ)‘র হাযির-নাযির অস্বীকার করতে গিয়ে তাদের নিজস্ব মতবাদ ভুলে যান। আর দেওবন্দীরা তাদের বিভিন্ন আক্বায়েদের কিতাবে লিখে থাকেন যে, আল্লাহ স্থান, কাল, আকার, আকৃতি থেকে মুক্ত। কিন্তু রাসূল (ﷺ)‘র হাযির-নাযির অস্বীকার করতে গিয়ে তারা আবার বেঁকে বসে এবং মুতাযিলা ও ক্বাদারিয়া ফিরকার আক্বিদা পোষণ করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো তারও আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অনুসারী বলে দাবী করে। ইমাম জুরজানী (رحمة الله) বলেন- أََنَّهُ تَعَالَى لَيْسَ فِي جِهَة، وَلَا فِي مَكَان.
-‘‘মহান আল্লাহ কোনো দিকে বা স্থানে নন।’’
➤ইমাম জুরজানী, শরহুল মাওয়াকিফ, ২/৫১-৫২পৃষ্ঠা, সাফর বিন আবদুর রাহমান আল-হাওলী, মিনহাজুল আশাইরাহ, ৭৯পৃষ্ঠা, (শামিলা)
ইমামে আহলে সুন্নাহ আবূ মানসূর মাতুরিদী {ওফাত.৩৩৩হি.} বলেন-
وَقَالَت القَدَرِية وَ الْمُعْتَزِلَة اَنَّ اللهَ تَعَالى فِى كُل مَكَان
-‘‘‘মুতাযিলা ও কাদারিয়াগণ বলেন, আল্লাহ সব স্থানে উপস্থিত।’’
➤ইমাম মাতুরিদী, শরহুল ফিকহুল আকবার, ১৯পৃষ্ঠা,
ইমাম ইবনে জারীর আত্-তবারী (رحمة الله) বলেন-
لَا يَتَمكن فِي كُلّ مَكَان.
-‘‘তিনি কোনো (নির্দিষ্ট) স্থানে নন।’’
➤ইমাম তবারী, তাফসীরে তবারী, ৬/২১০পৃষ্ঠা,
ইমাম কুরতুবী আন্দুলুসী (رحمة الله) বলেন-
وَأَنَّهُ فِي كُل مَكَان بِعِلْمِهِ
-‘‘নিশ্চই মহান রবের জ্ঞান সকল স্থানে উপস্থিত।’’
➤ইমাম কুরতুবী, হিদায়া ইলা বুলুগুল নিহায়া, ১/১২পৃষ্ঠা,
শায়খ আহমাদ বিন উমর মাসআদ হাযামী তার شَرْحِ كِتَابُ الْتَوْحِيْد কিতাবের ৫৩/৮পৃষ্ঠায় (শামিলা) উল্লেখ করেন-
اِعْتَقَد أَنَّ اللهَ تَعَالى فِي كُل مَكَان هَذَا كُفْرٌ أَكْبَرْ
-‘‘কেউ যদি আক্বিদা রাখে আল্লাহ সবখানে (হাযির-নাযির) এই ধারণা কুফুরে আকবার।’’ ইমামে আহলে সুন্নাহ আবুল হাসান আশ‘আরী (رحمة الله) {ওফাত. ৩২৪হি.} তার الإبانة عن أصول الديانة গ্রন্থের ১০৯ পৃষ্ঠায় (যা দারুল আনসার, কায়রু মিশর হতে ১৩৯৭ হিজরীতে প্রকাশিত) লিখেন-
وزعمت المعتزلة والحرورية والجهمية أن الله تعالى في كل مكان
-‘‘মুতাযিলা, হারুরিয়াহ এবং জাহমিয়্যাহ বাতিল ফিরকার লোকেরা বিশ্বাস করে আল্লাহ সকল স্থানে (হাযির-নাযির) আছেন।’’ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله)-এর ছেলে ইমাম আবু আব্দুল্লাহ আহমদ ইবনে মুহাম্মদ হাম্বল (ওফাত. ২৪১হি.) তিনি তার الرد على الجهمية والزنادقة কিতাবের ১১৪পৃষ্ঠায় এ আক্বিদা পোষণ কারীদের খন্ডনে একটি শিরোনাম করেন এ নাম দিয়ে-
الرد على الجهمية في زعمهم أن الله في كل مكان
-‘‘আল্লাহ সকল স্থানে (হাযির-নাযির) আছেন জাহমিয়্যাহ ফিরকার বাতিল আক্বিদার খন্ডন।’’ জাহমিয়্যাহ ফিরকার মতে, ইবাদত করা হয় এমন কোন ইলাহ আসমানে নেই। আল্লাহ তা‘য়ালা সত্তাগতভাবে জগতের সর্বত্র বিদ্যমান রয়েছেন।
➤ ইবনু বাত্তাহ, আল-ইবানাহ, ৩/১৯৪পৃষ্ঠা, ইবনু কুদামাহ, ইছবাতু সিফাতিল ‘উলুয়ি, ১১৮পৃষ্ঠা,
একদা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের উস্তায ইমাম সা‘ঈদ ইবনু ‘আমির আদ-দুবাঈ (ওফাত.২০৮হি.)-এর নিকট একবার জাহমিয়্যাদের কথা উঠলো। তখন তিনি বললেন-
الْجَهْمِيَّةُ أَشَرُّ قَوْلًا مِنَ الْيَهُودِ وَالنَّصَارَى
-‘‘তারা তো ইয়াহুদী-খৃস্টানদের চাইতেও নিকৃষ্ট কথা বলে।’’
➤ ইমাম বুখারী, খালকু আফ‘আলিল ইবাদ, ৩০পৃ, যাহাবী, আল-‘উলুয়ু, ১৫৮পৃষ্ঠা,
ইমাম যাহাবী (رحمة الله) তার এক কিতাবে লিখেন-
مَنْ قَالَ بَأَنَّ اَلله بِذَاتِه فِي كُلِّ مَكَان فَهُوَ مُخَالِف لِلْكِتَاب ِوَالسُّنَّة وَإِجْمَاع سَلْف اَلأِمَّة
-‘‘যে ব্যক্তি বলবে মহান রব সত্ত্বাগতভাবে সর্বত্র তাহলে তা হবে কিতাবুল্লাহ, সুন্নাহ এবং পূর্ববর্তী উম্মতের আক্বিদার বিপরীত।’’
➤ যাহাবী, কিতাবুল আরশ, ১৮২পৃষ্ঠা,
তিনি তার আরেক গ্রন্থে লিখেন-
وأما قول العامة وكثير من الخاصة الله موجود فى كل مكان أو فى كل الوجود ويعنون بذاته فهو ضلال بل هو مأخوذ من القول بوحدة الوجود الذى يقول به غلاة الصوفية الذين لا يفرقون بين الخالق والمخلوق
-‘‘ ‘আল্লাহ সত্তাগতভাবে সর্বত্র বিদ্যমান’- সর্বসাধারণ ও বহু বিশিষ্টজনের এরূপ কথা ভ্রান্ত। বস্তুতপক্ষে তা চরমপন্থী অদ্বৈতবাদী সূফীদের ‘ওয়াহদাতুল ওয়াজূদ’- এর বক্তব্য থেকেই গৃহীত।’’
➤ যাহাবী, আল-‘উলুউ, পৃষ্ঠা, ১৭৪
হাকিমুল উম্মত আল্লামা মুফতি আহমাদ ইয়ার খঁান নাঈমী (رحمة الله) লিখেন-
خدا كو هر جگہ ماننا بے دينى هے
-‘‘আল্লাহ তা‘য়ালাকে প্রত্যেক যায়গায় আছে মনে করা অধার্মিকতারই নামান্তর।’’
➤মুফতি আহমদ ইয়ার খঁান, জ্বা‘আল হক, ১/১৫৩পৃষ্ঠা, (উর্দু)
অনেকে বলতে পারেন মহান আল্লাহ তা‘য়ালা তো বলেছেন যে-
وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنْتُمْ
-‘‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন তিনি (আল্লাহ) তোমাদের সাথেই আছেন।’’ (সূরা হাদীদ, ৪) প্রকৃতপক্ষে এখানে মহান রব তার জ্ঞান সকলের সাথে আছে তাই বুঝিয়েছেন। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম সুয়ূতি (رحمة الله) উল্লেখ করেন-
وَأخرج الْبَيْهَقِيّ فِي الْأَسْمَاء وَالصِّفَات عَن سُفْيَان الثَّوْريّ رَضِي الله عَنهُ أَنه سُئِلَ عَن قَوْله: {وَهُوَ مَعكُمْ} قَالَ: علمه
-‘‘ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) তাঁর ‘আসমাউ ওয়াল সিফাত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ইমাম সুফিয়ান সাওড়ী (رحمة الله) কে এই আয়াতের ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, আল্লাহর জ্ঞান তোমাদের সাথে আছে তা মহান রব বুঝিয়েছেন।’’
➤ ইমাম সুয়ূতি, আদ-দুররুল মানছুর, ৮/৪৯পৃষ্ঠা, আলূসী, তাফসিরে রুহুল মা‘আনী, ২০/৩০৫পৃষ্ঠা, ইমাম বায়হাকী, আসমাউ ওয়াল সিফাত, ২/৪৪৮পৃষ্ঠা, ক্রমিক: ৮৭০
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) বলেন- وقدرته وعلمه في كل مكان -‘‘আল্লাহর কুদরত (ক্ষমতা) এবং জ্ঞান সর্বত্র উপস্থিত।’’
➤ইমাম লালকায়ী, ই‘তিক্বাদে আহলে সুন্নাহ, ৩/৪০১পৃষ্ঠা,
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম সুয়ূতি (رحمة الله) উল্লেখ করেন-
أخرج ابْن أبي حَاتِم عَن ابْن عَبَّاس فِي قَوْله: {وَهُوَ مَعكُمْ أَيْن مَا كُنْتُم} قَالَ: عَالم بكم أَيْنَمَا كُنْتُم
-‘‘ইমাম আবু হাতেম (رحمة الله) সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন-‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের ব্যাপারে সম্যক অবগত।’’
➤ইমাম সুয়ূতি, আদ-দুররুল মানছুর, ৮/৪৯পৃষ্ঠা, আলূসী, তাফসিরে রুহুল মা‘আনী, ২০/৩০৫পৃষ্ঠা,
বিশিষ্ট মুফাসসির মুকাতিল ইবনু হাইয়ান (১৫০হি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
يَعْنِي قدرته وسلطانه وَعلمه مَعكُمْ إينما كُنْتُم
-‘‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তোমরা তাঁর (আল্লাহর) কুদরাত, প্রতিপত্তি ও জ্ঞানের ব্যাপ্তির মধ্যেই রয়েছো।’’ ➤ ইমাম বায়হাকী, আসমাউ ওয়াল সিফাত, ২/৪৪৬পৃষ্ঠা, ক্রমিক: ৮৬৮, আবু হাইয়্যান, আল-বাহরুল মুহীত, ৮/২১৭পৃষ্ঠা, ইমাম সুয়ূতি, আদ-দুররুল মানছুর, ৮/৪৮পৃষ্ঠা,
আবার অনেকে বলতে পারেন মহান রব পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন-
مَا يَكُونُ مِنْ نَجْوى ثَلاثَةٍ إِلاَّ هُوَ رابِعُهُمْ
-‘‘তোমার কোন স্থানে যদি তিনজন থাক চতুর্থজন হিসেবে তিনি (মহান আল্লাহ) থাকেন।’’(সূরা মুজাদালাহ, ৭)
তাই অনেকে বলে থাকেন মহান রব সকলের সাথেই আছেন। ইমাম ইবনু জারীর আত-তাবারী (رحمة الله) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেন-
بِمَعْنَى أَنَّهُ مُشَاهِدُهُمْ بِعِلْمِهِ
-‘‘তাঁর (আল্লাহর) ইলমের মাধ্যমে তাদেরকে প্রত্যক্ষ করেন।’’
➤ ইমাম তাবারী, জামি‘উল বায়ান ফী তা‘ভীলিল কুর‘আন, ২২/৪৬৮পৃষ্ঠা,
ইমাম সুয়ূতি (رحمة الله) তাবেয়ী যাহ্হাক (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেছেন- وَعلمه مَعَهم -‘‘তাঁর জ্ঞান তোমাদের (চতুর্থজন হিসেবে) সকলের সাথে আছে।’’
➤ইমাম সুয়ূতি, আদ-দুররুল মানছুর, ৮/৭৯পৃষ্ঠা,
ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন-
وَفِيمَا كَتَبْنَا مِنَ الْآيَاتِ دَلَالَةٌ عَلَى إِبْطَالِ قَوْلِ مَنْ زَعَمَ مِنَ الْجَهْمِيَّةِ أَنَّ اللَّهَ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى بِذَاتِهِ فِي كُلِّ مَكَانٍ، وَقَوْلُهُ عَزَّ وَجَلَّ {وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنْتُمْ} [الحديد: ৪] ، إِنَّمَا أَرَادَ بِهِ بِعِلْمِهِ لَا بِذَاتِهِ
-‘‘আমরা যে সব আয়াত লিপিবদ্ধ করেছি তা দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হয় যে, জাহমিয়্যাদের মধ্যে যারা মনে করে যে, আল্লাহ তা‘য়ালা সত্তাগতভাবে প্রত্যেক স্থানে বিদ্যমান রয়েছেন-তা অমূলক। ‘তিনি তোমাদের সাথেই থাকেন, তোমরা তোমরা যেখানেই থাকনা কেন’ (সূরা হাদিদ, ৪)- আল্লাহ তা‘য়ালার এ কথাটিতে তাঁর জ্ঞানকেই বোঝানো হয়েছে; তাঁর সত্তাকে নয়।’’
➤ইমাম বায়হাকী, আল-ই‘তিকাদ, ১১৪ পৃষ্ঠা,
বিশিষ্ট মুফাসসির আবূ হাইয়ান আল-আন্দালুসী (ওফাত.৭৪৫হি.) এবং আল্লামা মাহমুদ আলূসী (رحمة الله) এই আয়াতের তাফসিরে লিখেন-
وَهَذِهِ آيَةٌ أَجْمَعَتِ الْأُمَّةُ عَلَى هَذَا التَّأْوِيلِ فِيهَا، وَأَنَّهَا لَا تُحْمَلُ عَلَى ظَاهِرِهَا مِنَ الْمَعِيَّةِ بِالذَّاتِ
-‘‘এ আয়াতের উক্ত ব্যাখ্যায় ব্যাপারে উম্মাতের সকলেই ঐকমত্য পোষণ করেছেন। এ আয়াতের বাহ্যিক অর্থ (অর্থাৎ প্রত্যেক কিছুর সাথে সত্তাগতভাবে আল্লাহর বিদ্যমান থাকা) উদ্দেশ্য নয়।’’
➤ইমাম আবূ হাইয়ান, আল-বাহরুল মুহীত, ১০/১০১পৃষ্ঠা, আলূসী, রুহুল মা‘আনী, ১৪/১৬৮পৃষ্ঠা,
এজন্যই বড়পীর শায়খ আবদুল কাদের জিলানী (رحمة الله) তার কিতাবে বলেন-
وَلَا يُجَوزُ وَصفة بأنه فى كُل مكان
-‘‘আল্লাহ তা‘য়ালা সর্বজায়গায় বিদ্যমান-এরূপ কথা বলা জায়েয নয়।’’ (আল-গুনিয়াতু লি তালিবী তারীক্বিল হাক্ব, পৃ. ৫৪-৫৭, ইমাম যাহাবী, কিতাবুল আরশ, ১৫৪পৃ.)