স্রষ্টাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদানে বাতিল ফেরকাসমূহ আসমানী ধর্মসমূহের মধ্যে স্রষ্টাকে সৃষ্টির স্তরে নামিয়েছে ইহুদীরা। খ্রিষ্টানরা স্বয়ং সৃষ্টিকে স্রষ্টা বানিয়েছে। এভাবে মূল তাউহীদের আক্বিদায় মারাত্মকভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে কুফুর-শিরকে নিপতিত হয়েছে। পরবর্তীতে মুসলমানদের অনেক বাতিল ফেরকা ইহুদী-খ্রিষ্টানদের এসব কুফুরী-শিরকী আক্বিদা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিভিন্ন সময়ে ইহুদী-খ্রিষ্টানদের কুফুরী আক্বিদাগুলো মুসলমানদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। ইহুদী বর্ণনার দ্বারা প্রভাবিত মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম শিয়ারা এসব কুফুরী আক্বিদা প্রচার করে। এদের পাশাপাশি একদল অজ্ঞ মুহাদ্দিস কুরআন-সুন্নাহের বাহ্যিক শব্দ অনুসরণের নামে ইহুদীদের এসব কুফুরী আক্বিদা প্রচার করতে থাকে।
এবাবে সাধারণ মুসলমানদের মাঝে ইহুদী-খ্রিষ্টানদের কুফুরী আক্বিদাগুলো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। মুসলমানদেও অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে এবং কুরআন সুন্নাহের অনুসরণের ধুয়ো তুলে তারা অনেক সাধারণ মানুষকেও এসব কুফুরী আক্বিদার দিকে পরিচালিত করে। আল্লাহ তায়ালার নাম ও গুণাবলী বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে এসব বাতিল ফেরকাসমূহের পরিচিতি স্পষ্ট হওয়া আবশ্যক।
শিয়াদের মুজাসসিমাঃ
যারা আল্লাহর শরীর, দেহ ও অঙ্গ-প্রতঙ্গ সাব্যস্ত করে তাদেরকে মুজাসসিমা বলে।
মুশাববিহা ফেরকাঃ
যারা আল্লাহর জন্য সৃষ্টির গুণাবলী সাব্যস্ত করে তাদেরকে মুশাববিহা বলে।
ইহুদী-খ্রিষ্টানদের কুফুরী আক্বিদা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেক শিয়া-রাফেযী আল্লাহ তায়ালার জন্য সৃষ্টির গুণাবলী সাব্যস্ত করেছে। আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির স্তরে নামিয়েছে। মানুষের মতো রক্ত-মাংসের প্রভূ হিেেসব গ্রহণ করেছে। বাস্তবে এরা মুসলমান দাবী করলেও এরা হিন্দুদেরই সমগোত্রীয়।
এদের নিজেদের মধ্যে অনেক দল রয়েছে। প্রত্যেক দলের এক একজন নেতা রয়েছে। এদের মতাদর্শের মধ্যে সামান্য কিছু বাহ্যিক পার্থক্য দেখা গেলেও আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য দেয়ার ক্ষেত্রে সব মতবাদই অভিন্ন। শিয়াদের মধ্যে প্রসিদ্ধ মুজাসসিমাদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
হিশামিয়া: বাতিল ফেরকা বিষয়ে অভিজ্ঞ ইমাম ও ঐতিহাসিকগণ হিশামিয়া দ্বারা দু’টি বাতিল ফেরকা উদ্দেশ্য নেন। একটি ফেরকার জনক হলো, হিশাম ইবনে হাকাম (মৃত: ১৯০ হি.)। অপর ফেরকার জনক হলো, হিশাম ইবনে সালিম আল-জুয়ালিকি।
[আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ.৪৭।]
ইমাম বাগদাদী (رحمة الله) এর মতে ফেরকাটি শিয়াদের ইমামের ধ্যান-ধারণা, আল্লাহর শরীর সাব্যস্তরণের ভ্রষ্টতা এবং আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদানের ক্ষেত্রে অভিন্ন। ইমাম ইসফারাইনী (رحمة الله) বলেন,وهم الأصل في التشبيهঅর্থ: আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদানে এই দলটি হলো মূল। [আত-তাবসীর ফিদ দিন, পৃ.২৫।]
ইমাম শাহরাস্তানীর মতে হিশামিয়া মূলত: একটি ফেরকা, দুই ব্যক্তির দিকে সম্পৃক্ত করা হয়। এদের মতাদর্শও এক। এরা মূলত: একজন আরেকজনের অনুগামী ছিলো। তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদানে অগ্রগামী ছিলো হিশাব ইবনে হাকাম। হিশাব ইবনে সালেম আল-জুয়ালিকি ছিলো তার অনুগামী এবং তারা উভয়ে একই পথে হেঁটেছিলো।[আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১৮৪]
হিশাম ইবনে হাকাম এর উপনাম ছিলো আবু মুহাম্মাদ। সে বনী শাইবান এর আযাদকৃত গোলাম ছিলো। বাগদাদ থেকে কুফায় স্থানান্তরিত হয় এবং সেখানেই বসবাস করে। সে শিয়াদের অন্যতম একজন বক্তা ছিলো। খলিফা মা’মুনের সময় সে ইন্তেকাল করে।
[আল-ফিহরিস্ত, ইবনে নাদীম, খ.১, পৃ.১৪১। সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.৪, পৃ.৫৪৪।]
ইমাম আবুল হাসান আশআরী (رحمة الله) হিশাম ইবনে হাকাম ও তাঁর অনুসারীদের আক্বিদা বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন,
الهشامية أصحاب هشام بن الحكم الرافضي، يزعمون أن معبودهم جسم له نهاية وحد طويل عريض طوله مثل عرضه، وعرضه مثل عمقه لا يوفي بعضه على بعضه. ولم يعينوا له طولاً غير الطويل. وإنما قالوا: طوله مثل عرضه على المجاز دون التحقيق، وزعموا أنه نور ساطع، له قدر من الأقدار. في مكان دون مكان. كالسبيكة الصافية كاللؤلؤة المستديرة من جميع جوانبها.ذو لون وطعم ورائحة. لونه هو طعمه، هو رائحته، ورائحته هي محسته. وهو نفسه لونه. ولم يعينوا لوناً ولا طمعاً هو غيره. وزعموا أنه هو اللون وهو الطعم، وأنه قد كان لا في مكان، ثم حدث المكان بأن تحرك الباري فحدث المكان بحركته فكان فيه. وزعم أن المكان هو العرش.وذكر أبو الهذيل في بعض كتبه أن هشام بن الحكم قال إن ربه جسم ذاهب جاء، فيتحرك تارة ويسكن أخرى، ويعقد مرة ويقوم أخرى، وإنه طويل عريض عميق، لأن ما لم يكن كذلك دخل في حد التلاشي. قال: فقلت له: فأيهما أعظم إلهك أو هذا الجبل وأومأت إلى جبل أبي قبيس قال: فقال هذا الجبل يوفي عليه، أي هو أعظم منه. وذكر ابن الراوندي أن هشام بن الحكم كان يقول: إن بين إلهه وبين الأجسام المشاهدة تشابهاً من جهة من الجهات، لولا ذلك ما دلت عليه.وحكي عنه خلاف هذا وأنه كان يقول إنه جسم ذو أبعاض لا يشبهها ولا تشبهه، وحكى عنه الجاحظ أنه قال في ربه في عام واحد خمسة أقاويل، مرة رغم أنه كالبلورة وزعم مرة أنه كالسبيكة. وزعم مرة أنه غير ذي صورة، وزعم مرة أنه بشبر نفسه سبعة أشبار، ثم رجع عن ذلك وقال هو جسم لا كالأجسام.وزعم الوراق أن بعض أصحاب هشام أجابه مرة إلى أن الله عز وجل على العرش مماس له وأنه لا يفضل عن العرش ولا يفضل العرش عنه
অর্থ: হিশাম ইবনে হাকাম শিয়ার অনুসারীদেরকে হিশামিয়া বলা হয়। তাদের আক্বিদা-বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালার শরীর রয়েছে। শরীরের সমাপ্তি ও সীমা-পরিসীমা রয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ রয়েছে। আল্লাহর শরীরের দৈর্ঘ্য প্রস্থের সমান। শরীরের প্রস্থ এর গভীরতার সমান। আল্লাহর শরীরের কোন অংশ একে-অপরের পরিপূরক নয়। তারা আল্লাহর জন্য দৈর্ঘ্য সাব্যস্ত করেছে কিন্তু এই দৈর্ঘ্যরে সুনিদিষ্ট কোন পরিমাণ উল্লেখ করেনি। আল্লাহর দৈর্ঘ্য তার প্রস্থের সমান এজাতীয় কথা তারা অনেক সময় রূপক অর্থে ব্যবহার করে। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী আল্লাহ তায়ালা হলেন, একটি উজ্জ্বল আলো। এই উজ্জ্বল আলোর সুনির্দিষ্ট একটা পরিমাপ রয়েছে। এটি কোন স্থানে রয়েছে, তবে তা সুনির্দিষ্ট নয়। তিনি উজ্জ্বল ধাতু-মিশ্রণের মতো। চতুর্দিক থেকে গোলাকার মণি-মুক্তার উজ্জ্বল।আল্লাহর রঙ, স্বাদ ও ঘ্রাণ রয়েছে। আল্লাহর রঙ তার স্বাদের অনুরূপ। আল্লাহর রঙ তার ঘ্রাণেরও অনুরূপ। আল্লাহর ঘ্রাণ তার স্পর্শ অনুভূতির প্রকাশ। সেটিই আবার তার রঙ। তারা আল্লাহর সত্তার অতিরিক্ত কোন রঙ বা ঘ্রাণ সাব্যস্ত করেনি। বরং তাদের নিকট স্বয়ং এই রঙ ও ঘ্রাণই আল্লাহ। তাদের বিশ্বাস হলো, আদিতে আল্লাহ তায়ালা কোন স্থানে ছিলেন না। অত:পর আল্লাহ তায়ালা নড়া-চড়া করেন, ফলে স্থান সৃষ্টি হয়। তিনি নতুন সৃষ্ট এই স্থানে থাকেন। তাদের বিশ্বাস হলো, নতুন সৃষ্ট এই স্থান হলো আরশ।আবুল হুজাইল তার একটি কিতাবে লিখেছে, হিশাম ইবনে হাকামকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই পাহাড় বড় না তোমার প্রভূ বড়। সে বলল, প্রভূ বড়। আমি তাকে আবু কুবাইস পাহাড়ের দিকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। ইবনে রাওয়ান্দী বলেন, হিশাম ইবনে হাকাম বলত, বাহ্যিক শরীর ও তার প্রভূর মাঝে একটি বিশেষ দিক থেকে সাদৃশ্য রয়েছে। যদি এটি না থাকত, তাহলে আল্লাহর প্রমাণ পাওয়া যেত না।কেউ তার এই বক্তব্যের বিপরীত বক্তব্য তার থেকে বর্ণনা করেছে। সে বলত, আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিশিষ্ট সত্তা। তবে তার সঙ্গে তুলনীয় কিছু নেই এবং তিনিও কারও সাদৃশ্য রাখেন না। ইমাম জাহেয তার থেকে বর্ণনা করেন, সে একই বছরে আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে পাঁচ ধরনের মতবাদ তৈরি করতো। কখনও সে বলত, আল্লাহ তায়ালা উজ্জ্বল মণি-মুক্তার মতো। কখনও ধারণা করতো আল্লাহ তায়ালা মিশ্রধাতুর মতো। কখনও বিশ্বাস করতো আল্লাহ তায়ালা আকার-আকৃতি বিশিষ্ট নন। কখনও বলত, আল্লাহ তায়ালা নিজ হাতের পরিমাপ হিসেবে সাত বিঘাত। অত:পর, এসব থেকে ফিরে এসে নতুন মতবাদ চালু করলো যে, আল্লাহ তায়ালার দেহ রয়েছে, তবে অন্যান্য দেহ এর মতো নয়।ওয়াররাক বলেন, হিশামের কিছু অনুসারী তাকে উত্তর দিয়েছিলো, আল্লাহ তায়লা আরশের উপর আরশ স্পর্শ করে আছেন। তিনি আরশ থেকে বড় নন এবং আরশও তার থেকে বড় নয়।
[মাকালাতুল ইসলামিয়্যিন, পৃ.৩১-৩৪। তাদের মতবাদ সম্পর্কে অবগত হতে আরও দেখুন, আত-ম্বীহ ওয়ার রাদ, পৃ.২৪। আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ.২০, ৪৭। আল-বুদউ ওয়াত তা’রীখ, খ.৫, পৃ.১৩২। আত-তাবসীর ফিদ দীন, পৃ.২৪, ৭০। আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১৮৪। সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.১০, পৃ.৫৪৪।]
ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (رحمة الله) হিশাম ইবনে হাকামের আক্বিদা সম্পর্কে বলেন,
وكان يزعم أن الله تعالى جسم. وغيَّر مذهبه في سنة واحدة عدة تغيرات. فزعم تارة أن الله تعالى كالسبيكة الصافية، وزعم مرة أخرى أنه كالشمع الذي من أي جانب نظرت إليه كان ذلك الجانب وجهه. واستقر رأيه عاقبة الأمر على أنه سبعة أشبار، لأن هذا المقدار أقرب إلى الاعتدال ليس بجسم، لكن صورته صورة الآدمي، وهو مركب من اليد والرجل والعين لأن أعضاءه ليست من لحم ولا دم
অর্থ: “সে বিশ্বাস করতো আল্লাহ তায়ালা দেহ ও শরীর বিশিষ্ট। একই বছরে সে তার মতাদর্শ কয়েকবার পরিবর্তন করতো। কখনও ধারণা করতো আল্লাহ তায়ালা উজ্জ্বল মিশ্র ধাতুর মতো। কখনও বিশ্বাস করতো আল্লাহ তায়ালা মোমবাতির আলোর মতো; যেদিক থেকে দেখা হয় সেদিকেই এর মুখ থাকে। সর্বশেষ সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, আল্লাহ তায়ালা সাত বিঘাত বিশিষ্ট। কেননা এই পরিমাপ ভারসাম্যের অধিক নিকটবর্তী। সর্বশেষ সে বলতো, আল্লাহ তায়ালা দেহ বিশিষ্ট নন। তবে তিনি মানুষের আকৃতি বিশিষ্ট। তিনি হাত, পা, চোখ ইত্যাদি দ্বারা গঠিত। তবে তার অঙ্গ-প্রতঙ্গ রক্ত-মাংশের নয়।”[ই’তেকাদু ফিরাকিল মুসলিমিন, পৃ.৩৪ ও ২০৯।]
হিশাম ইবনে সালেম আল-জুয়ালেকী:ইমাম আবুল হাসান আশআরী (رحمة الله) হিশাম ইবনে সালিম আল-জুয়ালেকী এর আক্বিদা-বিশ্বাস সম্পর্কে বলেন,
الهشامية أصحاب هشام بن سالم الجواليقي يزعمون أن ربهم على صورة الإنسان، وينكرون أن يكون لحماً ودماً، ويقولون: هو نور ساطع يتلألأ بياضاً وأنه ذو حواس خمس بحواس الإنسان، له يد ورجل وأنف وأذن وعين وفم، وأنه يسمع بغير ما يبصر به، وكذلك سائر حواسه عندهم متغايرة
অর্থ: হিশাম ইবনে সালেম আল-জুয়ালেকীর অনুসারীদেরকেও হিশামিয়া বলা হয়। তাদের বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালা মানুষের আকৃতি বিশিষ্ট। তবে তারা আল্লাহর জন্য মানুষের মতো রক্ত-মাংশ সাব্যস্ত করে না। তারা বলে, আল্লাহ তায়ালা হলেন উজ্জ্বল আলো। যেটি উজ্জ্বল সাদা আলোয় জ্বল জ্বল করে। আল্লাহ তায়ালা মানুষের মতো পঞ্চ ইন্দ্রিয় বিশিষ্ট। আল্লাহ তায়ালার হাত, পা, নাক, কান, চোখ ও মুখ রয়েছে। তিনি যা দিয়ে শ্রবণ করেন সেটি তার দর্শনের অঙ্গ থেকে ভিন্ন। এভাবে আল্লাহ তায়ালার সকল ইন্দ্রিয় ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন।”
[মাকালাতুল ইসলামিয়্যিন, পৃ.৩৪ ও ২০৯।]
ইমাম আবুল হাসান আশআরী (رحمة الله) বলেন,وحكى أبو عيسى الوراق أن هشام بن سالم كان يزعم أن لربه وفرة سوداء وأن ذلك نور أسودআবু ইসা আল-ওররাক বলেন, হিশাম ইবনে সালেম বিশ্বাস করতো যে, আল্লাহ তায়ালার কালো গোফ রয়েছে। আর এই কালো গোফ কালো আলো বিশিষ্ট।
[মাকালাতুল ইসলামিয়্যিন, পৃ. ২০৯]
ইমাম শাহরাস্তানী (رحمة الله) বলেন,قال إنه تعالى على صورة إنسان أعلاه مجوف وأسفله مصمت.. ليس بجسم لكن صورته صورة الآدمي وهو مركب من اليد والرجل والعين، لأن أعضاءه ليست من لحم ولا دم
অর্থ: হিশাম ইবনে সালেম এর আক্বিদা-বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালা মানুষের আকৃতি বিশিষ্ট। আল্লাহর শরীরের উপরের অংশ ফাঁকা গহ্বর বিশিষ্ট এবং নিচের অংশ নিঃছিদ্র। আল্লাহ তায়ালা দেহ বিশিষ্ট নয়। তবে আল্লাহর আকৃতি মানুষের আকৃতির মতো। তিনি হাত, পা, চোখ ইত্যাদি দ্বারা গঠিত। আল্লাহর অঙ্গ-প্রতঙ্গ রক্ত-মাংসের নয়।”
[আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.২১০]
মুগিরিয়া ফেরকা:
মুগিরা ইবনে সাইদ আল-ইজলি (মৃত:১১৯ হি:) ও তার অনুসারীদেরকে মুগিরিয়া বলা হয়। ইমাম যাহাবী মুগিরা ইবনে সাইদ সম্পর্কে বলেন,
وكان هذا الرجل ساحراً فاجراً شيعياً خبيثاًঅর্থ: সে যাদুকর, পাপী, শিয়া ও নিকৃষ্ট প্রকৃতির লোক ছিলো।
মুগিরিয়া ফেরকার আক্বিদা সম্পর্কে ইমাম আব্দুল কাহের বাগদাদী (رحمة الله) বলেন,
ومنها إفراطه في التشبيه، وذلك أنه زعم أن معبوده رجل من نور على رأسه تاج من نور، وله أعضاء على صور حروف الهجاء، وأن الألف منها مثال قدميه والعين على صورة عينيه، …ومنها أنه تكلم في بدء الخلق فزعم أن الله تعالى لما أراد أن يخلق العالم تكلم باسمه الأعظم فطار ذلك الاسم ووقع تاجاً على رأسه. وتأول على ذلك قوله تعالى: (سبح اسم ربك الأعلى) وزعم أن الاسم الأعلى إنما هو ذلك التاج. ثم إنه بعد وقوع التاج على رأسه كتب بإصبعه على كفه أعمال عباده. ثم نظر فيها فغضب من معاصيهم فعرق، فاجتمع من عرقه بحران أحدهما مالح والآخر عذب. ثم اطلع في البحر فأبصر ظله فذهب ليأخذه فطار فانتزع عيني ظله فخلق منها الشمس والقمر، وأفنى باقي ظله وقال: لا ينبغي أن يكون معي ثم خلق الخلق من البحرين فخلق الشيعة من البحر العذب النير فهم المؤمنون وخلق الكفرة وهم أعداء الشيعة من البحر المظلم المالح
অর্থ: তার ভ্রান্ত বিষয়গুলোর একটি হলো সে আল্লাহ তায়ালাকে নিকৃষ্টভাবে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদান করতো। সে বিশ্বাস করতো, আল্লাহ তায়ালা আলোকময় এক ব্যক্তি, যার মাথায় নূরের মুকুট রয়েছে। আরবী বর্ণমালার আকৃতি অনুযায়ী আল্লাহর আকৃতি রয়েছে। আরবী বর্ণমালার আলিফ আল্লাহর পায়ের উদাহরণ। আরবী আইন অক্ষরটি আল্লাহর চোখের অনুরূপ। সে বিশ্বাস করতো, আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির শুরুতে কথা বলেন। সে ধারণা করতো আল্লাহ তায়ালা যখন মহাবিশ্ব সৃষ্টির ইচ্ছা করেন তিনি তার ইসমে আ’জম উচ্চারণ করেন। এই ইসমে আজম উড়ে গিয়ে তার মাথায় বসে এবং এটি তার মুকুট হয়। সে তার বক্তব্যের প্রমাণ হিসেবে পবিত্র কুরআনের আয়াত উপস্থাপন করে এর বিকৃত ব্যাখ্যা করে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আপনি আপনার প্রভূর নামের পবিত্রতা বর্ণনা করুন, যিনি মহান। সে এই আয়াতের বিকৃত ব্যাখ্যা করে বলেছে, এখানে সম্মানিত নাম দ্বারা আল্লাহর মুকুট উদ্দেশ্য। আল্লাহ তায়ালার মাথায় এই মুকুট আসার পর তিনি তার দুই আঙ্গুল দ্বারা হাতের তালুর উপরে বান্দার আমল লিপিবদ্ধ করেছেন। অত:পর তিনি এই আমলগুলোর দিকে দৃষ্টি বুলান। বান্দার গোনাহ দেখে তিনি রাগান্বিত হয়ে যান। এই রাগের কারণে তিনি ঘর্মাক্ত হয়ে যান। তার ঘাম থেকে দু’টি সমুদ্র প্রবাহিত হয়। একটি লবণাক্ত, অপরটি সুমিষ্ট। এরপর তিনি সমুদ্রের দিকে উঁকি দেন। সেখানে তিনি নিজের ছায়া দেখতে পান। তিনি সেটা ধরতে যান। কিন্তু ছায়া উড়ে যায়। এরপর তিনি তার নিজ ছায়া থেকে চন্দ্র ও সূর্য সৃষ্টি করেন। অবশিষ্ট ছায়াকে তিনি নি:শেষ করে দেন। অত:পর তিনি বললেন, এগুলো আমার সাথে থাকা উচিৎ নয়। দুই সমুদ্র থেকে তিনি মাখলুককে সৃষ্টি করলেন। সুমিষ্ট পানির সমুদ্র থেকে শিয়াদেরকে সৃষ্টি করেন এবং লবণাক্ত ও অন্ধকার সমুদ্র থেকে শিয়াদের শত্রুদেরকে সৃষ্টি করেন।”
(আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, ২৩১-২৩৩। আরও দেখুন, আল-ফিসাল, ইবনে হাজাম, খ.৪, পৃ.১৪১। আত-তাবসীর, পৃ.৭০, আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, শাহরাস্তানী, পৃ.১৭৬, আল-কামেল, ইবনুল আসীর, খ.৪, পৃ.৪২৯।)
বয়ানিয়া ফেরকা:
বয়ান ইবনে সাময়ান (মৃত:১১৯) ও তার অনুসারীদেরকে বয়ানিয়া ফেরকা বলা হয়। সে কুফার অধিবাসী ছিলো। বয়ান ইবনে সাময়ানের আক্বিদা-বিশ্বাস ছিলো,
وكان يزعم أنه يعرف الاسم الأعظم، وأنه يهزم به العساكر ৃثم أنه زعم أن الإله الأزلي رجل من نور، وأنه يفنى كله غير وجهه. وتأول على ذلك قوله: (كل شيء هالك إلا وجهه) وقوله: (كل من عليها فان) وقوله (ويبقى وجه ربك) ورفِع خبر بيان هذا إلى خالد بن عبد الله القسري في زمان ولايته في العراق فاحتال عليه حتى ظفر به
অর্থ: সে বিশ্বাস করতো যে সে ইসমে আ’জম জানে। এর মাধ্যমে সে সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারবে বলে প্রচার করতো। তার আক্বিদা ছিলো, আল্লাহ তায়ালা নূরের তৈরি একজন লোক। আল্লাহর চেহারা ব্যতীত সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। তার এই মতের স্বপক্ষে সূরা কাসাস এর ৮৮ নং আয়াত, সূরা আর-রহমানের ২৬ ও ২৭ নং আয়াত দ্বারা প্রমাণ পেশ করতো। সূরা কাসাস এর ৮৮ নং আয়াতের অর্থ: আল্লাহর চেহারা ব্যতীত সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। সূরা আর-রহমানের ২৬ ও ২৭ নং আয়াতের অর্থ: ভূ-পৃষ্ঠের উপর যা কিছু রয়েছে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। কেবল আপনার প্রভূর চেহারা অবশিষ্ট থাকবে।বয়ান ইবনে সাময়ানের এসব ভ্রান্ত আক্বিদা সম্পর্কে ইরাকের গভর্ণর খালেদ ইবনে আব্দুল্লাহ কাসারী অবগত হন। তিনি তাকে গ্রেপ্তার করে শূলিতে চড়ান।
[আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ.২২৭-২২৮। বিস্তারিত জানতে দেখুন, আল-ফিসাল, খ.৪, পৃ.১৪১। আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, পৃ.১৫৩।]
ইউনুসিয়া ফেরকা:
বিখ্যাত শিয়া ইউনুস ইবনে আব্দুর রহমান ও তার অনুসারীরা বয়ানিকা ফেরকা নামে পরিচিত। তার আক্বিদা ছিলো, ফেরেশতারা আল্লাহ তায়ালাকে বহন করে। ইমাম শাহরাস্তানী (رحمة الله) বলেন,زعم أن الملائكة تحمل العرش والعرش يحمل الرب تعالىঅর্থ: সে বিশ্বাস করতো যে ফেরেশতাগণ আরশ বহন করছে এবং আরশ আল্লাহ তায়ালাকে বহন করছে।
[আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১৮৮।]
জাওয়ারিবি ফেরকা:
দাউদ জাওয়ারিবি ও তার অনুসারীরা জাওয়ারিবি ফেরকা নামে পরিচিত। ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) বলেন,
رأس في الرافضة والتجسيم من مرامي جهنم
অর্থ: মুজাসসিমা ও শিয়াদের গুরু এক জাহান্নামী।
[লিসানুল মিজান, খ.২, পৃ.৪২৭।]
ইমাম শাহরাস্তানী (رحمة الله) তার আক্বিদা সম্পর্কে বলেন,
يحكى عن داود أنه قال: أعفوني عن الفرج واللحية، واسألوني عما وراء ذلك فإن في الأخبار ما يثبت ذلك. وقال: إن معبوده جسم ولحم ودم ومع ذلك جسم لا كالأجسام، ولحم كاللحوم ودم لا كالدماء، وكذلك سائر الصفات، وحكي أنه قال هو أجوف من أعلاه إلى صدره مصمت ما سوى ذلك وأن له وفرةً سوداء وله شعر قطط
অর্থ: দাউদ জাওয়ারিবি থেকে বর্ণিত, সে বলতো, আমাকে আল্লাহর গুপ্তাঙ্গ ও দাঁড়ি ছাড়া আর সব কিছু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো। কেননা, হাদীসে এই দু’টো ছাড়া সব কিছু আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। সে বিশ্বাস করতো, আল্লাহ তায়ালা শরীর, রক্ত, গোশত বিশিষ্ট। এগুলো থাকা সত্ত্বেও তার শরীর অন্য কোন শরীরের মতো নয। আল্লাহর গোশত অন্য কারও গোশতের মতো নয় এবং তার রক্ত অন্য কারও রক্তের মতো নয়। আল্লাহর অন্য সব গুণ সম্পর্কে একই কথা। তার থেকে বর্ণিত আছে, সে বলতো, আল্লাহ তায়ালা উপরের অংশ থেকে বুক পর্যন্ত ফাঁপা গহ্বর বিশিষ্ট এবং পরবর্তী অংশ ফাঁপা নয়। আল্লাহর কালো গোফ রয়েছে এবং কোকড়ানো চুল রয়েছে।
[আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১০৫। আল-ফিসাল, খ.৪, পৃ.১৩৯।]
শয়তানিয়া ফেরকা:
শয়তান আত-তাক ও তার অনুসারীদেরকে শয়তানিয়া ফেরকা বলা হয়। শয়তান আত-তাক এর প্রকৃত নাম হলো, মুহাম্মাদ বিন আলী আল-কুফী। সে শিয়াদের বড় একজন ইমাম ছিলো। মুশাববিহা ও মুজাসসিমাদের আক্বিদা প্রচার করতো। সে হিশাম আল-জুয়ালেকীর অনেক মতাদর্শ গ্রহণ করেছিলো।
[আল-বুদউ ওয়াত তারিখ, খ.৫, পৃ.১৩২।]
তার আক্বিদা সম্পর্কে ইমাম আবুল হাসান আশআরী (رحمة الله) বলেন,
وقال إن الله تعالى على صورة إنسان ربانيসে বলতো, আল্লাহ তায়ালা মানুষের আকৃতির অনুরূপ আকৃতি বিশিষ্ট।
[আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১৮৭।]
ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (رحمة الله) শয়তান তাকের আক্বিদা সম্পর্কে বলেন,
الشيطانية أتباع شيطان الطاق وهم يزعمون أن الباري تعالى مستقر على العرش والملائكة يحملون العرش. وهم وإن كانوا ضعفاء بالنسبة إلى الله تعالى. لكن الضعيف قد يحمل القوي كرجل الديك التي تحمل مع دقتها جثة الديك
অর্থ: শয়তান তাকের অনুসারীদেরকে শয়তানিয়া বলা হয়। তাদের বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশে অবস্থান করেন এবং ফেরেশতাগণ আরশ বহন করে। ফেরেশতারা যদিও আল্লাহর তুলনায় দুর্বল কিন্তু কখনও দুর্বল সবলকে বহন করতে পারে। যেমন, মোরগের পা দু’টি চিকন হওয়া সত্ত্বেও মোরগের শরীর বহন করে।
[ই’তেকাদু ফিরাকিল মুসলিমিন, পৃ.৬৩।]
আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে রাফেযী শিয়াদের কুফুরী আক্বিদা ও তাদের বিভিন্ন ফেরকা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো। এই আলোচনার মৌলিক একটি উদ্দেশ্য হলো, বর্তমানেও বিভিন্ন নামে এসব আক্বিদা আমাদের সমাজে প্রচার করা হচ্ছে সে বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত দেয়া। ইসলামের তেরশ’ বছর আগে এসব কুফুরী আক্বিদার সূচনা হলেও এগুলো নি:শেষ হয়ে যায়নি। বরং বর্তমানে নতুনরূপ দিয়ে নতুন আঙ্গিকে মানুষকে এসব কুফুরীর দিকে দাওয়াত দেয়া হচ্ছে। আল্লাহ পাক মুসলিম উম্মাহকে এধরণের ভ্রান্তি থেকে রক্ষা করুন।
মুকাতেলিয়া ফেরকা:
মুকাতিল ইবনে সুলাইমান আল-বালখী (মৃত:১৫০ হি:) ও তার অনুসারীদেরকে মুকাতিলিয়া ফেরকা বলা হয়। মুকাতিল ইবনে সুলাইমান তাফসীর শাস্ত্রে অভিজ্ঞ ছিলো, কিন্তু আক্বিদার ক্ষেত্রে সে ছিলো মুশাববিহা ও মুজাসসিমা। হাদীস শাস্ত্রে মুহাদ্দিসদের ঐকমত্য অনুসারে সে পরিত্যক্ত।
ইমাম যাহাবী (رحمة الله) সিয়ারু আ’লামিন নুবালাতে লিখেছেন,
أجمعوا على تركه
অর্থ: হাদীস শাস্ত্রে সে পরিত্যাক্ত হওয়ার ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণের ইজমা হয়েছে।
(সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.৭, পৃ.২০২। বিস্তারিত জানতে দেখুন, আত-তারীখুল কাবীর, খ.৮, পৃ.১৪। আল-জারহু ওয়াত তা’দীল, খ.৭, পৃ.৩৪৫, মিজানুল ই’তেদাল, খ.৪, পৃ.১৭২।)
মুকাতিল ইবনে সুলাইমান মুজাসসিমা হওয়ার বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তার আক্বিদা বিশ্বাস বাতিল হওয়ার ব্যাপারেও কারও দ্বিমত নেই।
ইমাম আবুল হাসান আশআরী (رحمة الله) তার সম্পর্কে বলেন,
حكي عن أصحاب مقاتل أن الله جسم وأن له جثةً وأنه على صورة الإنسان لحم ودم وشعر وعظم وجوارح وأعضاء من يد ورجل ورأس وعينين مصمت وهو مع ذلك لا يشبه غيره ولا يشبهه غيره
অর্থ: মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের অনুসারীদের থেকে বর্ণিত আছে, আল্লাহ তায়ালা দেহ ও শরীর বিশিষ্ট। তিনি মানুষের আকৃতি বিশিষ্ট। আল্লাহর গোশত, রক্ত, চুল, হাড্ডি ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রতঙ্গ যেমন হাত, পা, মাথা ও দু’ চোখ রয়েছে। এগুলো থাকা সত্ত্বেও তিনি কারও সঙ্গে সাদৃশ্য রাখেন না এবং কেউ তার সদৃশ নয়।
[মাকালাতুল ইসলামিয়্যিন, পৃ.১৫২, ২০৯।]
মুকাতিল ইবনে সুলাইমান এর আক্বিদাগত ভ্রান্তি দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও ইবনে তাইমিয়া (رحمة الله) তার ওকালতি করার অনর্থক চেষ্টা করেছেন। ইবনে তাইমিয়া (رحمة الله) মুজাসসিমা প্রীতি খুবই আশ্চর্যজনক। তিনি মুকাতিল ইবনে সুলাইমান এর অনর্থক ওকালতি করে লিখেছেন,
وأما مقاتل فالله أعلم بحقيقة حاله والأشعري ينقل هذه المقالات من كتب المعتزلة وفيهم انحراف عن مقاتل بن سليمان فلعلهم زادوا في النقل عنه أو نقلوا عن غير ثقة وإلا فما أظنه يصل إلى هذا الحد
অর্থ: মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ ভালো জানেন। ইমাম আবুল হাসান আশআরী মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের এসব বক্তব্য মু’তাজিলাদের থেকে বর্ণনা করেছে। সম্ভবত তারা মুকাতিল ইবনে সুলাইমান সম্পর্কে অতিরঞ্জন করেছে অথবা বিশ্বস্ত নয় এমন বর্ণনাকারীদের বর্ণনা গ্রহণ করেছে। নতুবা আমি মনে করি না, সে আক্বিদার ক্ষেত্রে এতোটা নি¤œ স্তরে পৌঁছেছিল।[৩]
[মিনহাজুস সুন্নাহ, খ.২, পৃ.৬১৮।]
অথচ মুকাতিল ইবনে সুলাইমান মুজাসসিমা হওয়ার বিষয়টি কারও কাছে অস্পষ্ট নয়। ইবনে তাইমিয়া (رحمة الله) এর এই মুজাসসিমা প্রীতি তাকে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত করেছে। মুজাসসিমাদের প্রতি এই অনর্থক প্রীতির কারণে অনেক ক্ষেত্রে তিনি নিজেও মুজাসসিমাদের আক্বিদা প্রচার করেছেন এবং সেগুলো সমর্থন করেছেন।
খতীব বাগদাদী নিজ সনদে ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) থেকে বর্ণনা করেন, ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) বলেন,أتانا من المشرق رأيان خبيثان جهم معطل ومقاتل مشبه অর্থ: পূর্ব দিক থেকে আমাদের নিকট দু’টি নিকৃষ্ট মতবাদ এসেছে। ১. জাহাম ইবনে সাফওয়ান আল্লাহ তায়ালার গুণাবলী অস্বীকার করে। ২. মুকাতিল ইবনে সুলাইমান আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদান করে।
[তারীখে বাগদাদ, খ.১৩, পৃ.১৬৪, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.৭, পৃ.২০২।]
ইমাম আবুল হাসান আশআরী (رحمة الله) মুকাতিল ইবনে সুলাইমান এর আক্বিদা বর্ণনা করে লিখেছেন,
إن الله جسم وله جثه وإنه على صورة الإنسان لحم ودم وشعر وعظم..وهو مع ذلك لا يشبه غيره، ولا يشبهه غيره
অর্থ: আল্লাহ তায়ালা শরীর ও দেহ বিশিষ্ট। তিনি মানুষের আকৃতির মতো। তার গোশত, রক্ত, চুল ও হাড় রয়েছে। আল্লাহ তায়ালার এগুলো থাকলেও তিনি কারও সাথে সাদৃশ্য রাখেন না এবং কোন কিছু তার সদৃশ নয়।
[মাকালাতুল ইসলামিয়্যিন, পৃ.২৫১।]
মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের মতাদর্শ একটু লক্ষ্য করুন। সে আল্লাহর জন্য শরীর সাব্যস্ত করেছে। রক্ত, মাংশ সাব্যস্ত করেছে। অথচ নিজেকে বাঁচানোর জন্য বলেছে, আল্লাহ তায়ালা কারও সাথে সাদৃশ্য রাখেন না। পরবর্তী আলোচনায় মুশাববিহাদের এই প্রতারণামূলক বক্তব্য প্রায় সকল ক্ষেত্রেই দেখতে পাবেন। তারা আল্লাহ তায়ালার জন্য মানুষের আকৃতি সাব্যস্ত করলেও সেটা সাদৃশ্য দেয়া হয় না। আল্লাহর জন্য হাড্ডি ও চুল সাব্যস্ত করলেও সাদৃশ্য দেয়া হয় না। তারা মূলত: সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য এই পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছে। আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য দেয়ার পর বলবে যে আল্লাহ তায়ালার সাথে কিছুই সাদৃশ্য রাখে না। মুশাববিহারা এধরনের স্ববিরোধীতার আশ্রয় নিয়েই তাদের কুফুরী আক্বিদা সাধারণ মানুষের মাঝে প্রচার করে থাকে।
ইমাম জাহাবী (رحمة الله) মুকাতিল ইবনে সুলাইমান সম্পর্কে বলেন,
مقاتل بن سليمان.. متروك الحديث وقد لطخ بالتجسيم مع أنه كان من أوعية العلم بحراً في التفسيرমুকাতিল ইবনে সুলাইমান হাদীসের ক্ষেত্রে পরিত্যক্ত। সে আল্লাহর শরীর সাব্যস্তের নোংরা আক্বিদায় বিশ্বাসী ছিলো। অথচ সে প্রচুল ইলমের অধিকারী ছিলো এবং তাফসীর শাস্ত্রে সমুদ্রের মতো গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলো।
[তাযকিরাতুল হুফফায, খ.১, পৃ.১৭৪। তারীখে বাগদাদ, খ.১৩, পৃ.১৬২।]
ঐতিহাসিক ও মুহাদ্দিসগণের বর্ণনা অনুযায়ী মুকাতিল ইবনে সুলাইমান এই নিকৃষ্ট আক্বিদায় বিশ্বাসী হওয়ার মূল কারণ ছিলো সে ইহুদী-খ্রিষ্টানদের বর্ণনা গ্রহণ করতো এবং তাদের আক্বিদা-বিশ্বাস চর্চা করতো। ইসরায়েলী বর্ণনা দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কারণে মুকাতিল ইবনে সুলাইমান আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদান করতো। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) এ প্রসঙ্গে বলেন,
كانت له كتب ينظر فيها إلا أني أرى أنه كان له علم بالقرآن
অর্থ: তার কাছে (ইহুদী-খ্রিষ্টানদের) কিছু কিতাব ছিলো, সে এগুলো দেখতো। তবে সে তাফসীর শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলো। [তারীখে বাগদাদ, খ.১৩, পৃ.১৬১।]
ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله) মুকাতিল ইবনে সুলাইমান সম্পর্কে বলেন,
كان يأخذ عن اليهود والنصارى علم القرآن الذي يوافق كتبهم وكان مشبها يشبه الرب بالمخلوقين. وكان مع ذلك يكذب في الحديث অর্থ: সে ইহুদী ও খ্রিষ্টানদের নিকট থেকে তাফসীর শিখতো। ইহুদী-খ্রিষ্টানরা তাদের কিতাব থেকে এই তাফসীর বর্ণনা করতো। সে একজন মুশাববিহা ছিলো। আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদান করতো। এছাড়া সে হাদীস শাস্ত্রে মিথ্যুক ছিলো।
[আল-মাজরুহুন, খ.২, পৃ.১৫। আরও দেখুন, ওফায়াতুল আইয়ান, খ.৫, পৃ.২৫৫, আজ-জুয়াফা, ইবনুল জাওযী, খ.১, পৃ.১৩৬।]
ইমাম আহমাদ ইবনে সাইয়ার (رحمة الله) তাঁর সম্পর্কে বলেন,
مقاتل متروك الحديث كان يتكلم في الصفات بما لا تحل الرواية عنه
অর্থ: মুকাতিল ইবনে সুলাইমান হাদীসের ক্ষেত্রে পরিত্যাক্ত। আল্লাহর গুণাবলীর ক্ষেত্রে সে এমন সব মতবাদ প্রচার করতো যা বর্ণনা করাও বৈধ নয়।
[তারীখে বাগদাদ, খ.১৩, পৃ.১৬২।]
ইমাম যাহাবী (رحمة الله) তার সম্পর্কে বলেন,ظهر بخراسان الجهم بن صفوان ودعا إلى تعطيل صفات الله عز وجل.. وظهر في خراسان في قبالته مقاتل بن سليمان المفسر وبالغ في إثبات الصفات حتى جسم وقام على هؤلاء علماء التابعين وأئمة السلف وحذروا من بدعهم
অর্থ: খোরাসানে জাহাম ইবনে সাফওয়ানের আবির্ভাব হয়। সে মানুষকে আল্লাহ তায়ালার গুণাবলী অস্বীকারের প্রতি আহ্বান করে। একই সময়ে খোরাসানে মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের আবির্ভাব হয়। সে আল্লাহর গুণাবলী সাব্যস্তের ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন করে, এমনকি সে আল্লাহর দেহ সাব্যস্ত করে। এই দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে তাবেয়ী ও সালাফে-সালেহীন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, তাদের বিরুদ্ধে মানুষকে সতর্ক করেন এবং তাদের প্রচারিত বিদয়াত থেকে মানুষকে সচেতন করেন।
[ত্ববাকাতুল হুফফায, খ.১, পৃ.১৫৯।]
খতীব বাগদাদী (رحمة الله) তাফসীর বিষয়ে তার জ্ঞান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। খতীব বাগদাদী (رحمة الله) বলেন, সে মানুষের তাফসীর একত্র করে নিজের নামে চালিয়ে দিতো এবং মুফাসসিরদের কাছ থেকে শোনা ব্যতীত তাদের বর্ণনা উল্লেখ করতো।
[তারীখে বাগদাদ, খ.১৩, পৃ.১৬২। তাহযীবুল কামাল, খ.২৮, পৃ.৪৩৬।]
মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের আক্বিদাগত ভ্রান্তির ব্যাপারে কোন সংশয় নেই। এ ব্যাপারে কোন ইমামের দ্বিমত নেই। মুজাসসিমাদের প্রতি অন্যায় প্রীতির কারণে ইবনে তাইমিয়া (رحمة الله) মুকাতিল ইবনে সুলাইমান সম্পর্কে যা কিছু বলেছে তার বাস্তব কোন ভিত্তি নেই। নিজস্ব কিছু ধারণার উপর ভিত্তি করে ইবনে তাইমিয়া (رحمة الله) এর পক্ষে এধরনের ভিত্তিহীন মন্তব্য খুবই আশ্চর্যজনক।
আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য দেয়ার বিষয়টি শুধু মুকাতিল ইবনে সুলাইমান এর মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে অনেক মুহাদ্দিসই এসব ইসরাইলী বর্ণনা দ্বারা প্রভাবিত এই ভ্রান্ত আক্বিদায় নিপতিত হয়েছিলো। মুহাদ্দিসরা শুধু এগুলো বর্ণনা করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, বরং এগুলো তাদের আক্বিদা হিসেবে প্রচার করেছে এবং এর বিরোধীতাকারীদেরও মারাত্মক সমালোচনা করেছে। অনেকে এক্ষেত্রে এক ধাপ অগ্রসর হয়ে আহলে কিতাবদের বর্ণনাগুলো রাসূল স. এর হাদীস বলে চালিয়ে দিয়েছে এবং এভাবেই আল্লাহর গুণাবলীর ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের জাল বর্ণনার উদ্ভব হয়েছে।
ইমাম শাহরাস্তানী (رحمة الله) বলেন,
وزادوا في الأخبار أكاذيب وضعوها ونسبوها إلى النبي عليه الصلاة والسلام وأكثرها مقتبس من اليهود فإن التشبيه فيهم طباع حتى قالوا اشتكت عيناه فعادته الملائكة وبكى على طوفان نوح حتى رمدت عيناه وإن العرش ليئط من تحته أطيط الرحل الجديد وإنه ليفضل من كل جانب أربعة أصابع
অর্থ: তারা আল্লাহর গুণাবলীর বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা বর্ণনার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে এবং এগুলোকে রাসূল স. এর হাদীস হিসেবে চালিয়ে দিয়েছে। এসব বর্ণনার অধিকাংশ ইহুদীদের কাছ থেকে নেয়া। কেননা আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য দেয়ার বিষয়টি ইহুদীদের স্বভাবজাত ছিলো। এমনকি তারা বলত, আল্লাহর দুই চোখ অসুস্থ হয়ে পড়লে ফেরেশতা তার শুশ্রুষা করেন। নূহ আ. এর তুফানের সময় আল্লাহ তায়ালা এতো ক্রন্দন করেন যে তার দুই চোখ ফুলে ওঠে। নতুন বাহনে আরোহণের সময় যেমন আওয়াজ হয় তেমনি আল্লাহ তায়ালা যখন আরশে আরোহণ করেন তখন আওয়াজ হয়। তিনি আরশের চার দিক থেকে চার আঙ্গুল পরিমাণ পৃথক রয়েছেন। [আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১০৬]
অনেক মুহাদ্দিস ইহুদীদের এসব বর্ণনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মুশাববিহাদের আক্বিদা পোষণ করতো। তাদের লিখিত আক্বিদা বিষয়ক কিতাবগুলো তাদের এই ভ্রান্তির স্পষ্ট প্রমাণ। আস-সুন্নাহ, আল-ইবানা বা আর-রদ্দু আলাল জাহমিয়া নামে তারা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যেসব কিতাব লিখেছে এগুলো পড়লে বোঝা যায়, তারা ইসরাইলী বর্ণনা দ্বারা কতটা প্রভাবিত ছিলো। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, অনেক মুহাদ্দিস শুধু ইসরাইলী বর্ণনা একত্র করার উদ্দেশ্যে কিতাব লিখেছেন। তারা এর থেকে কোন আক্বিদা প্রমাণ করেননি এবং এর বিপরীত আক্বিদা পোষণকারীদেরও সমালোচনা করেননি। আমরা সেসব মুহাদ্দিসগণ সম্পর্কে আলোচনা করছি না। বরং যেসব মুহাদ্দিস রীতিমত এগুলো দ্বারা তাদের আক্বিদা প্রমাণ করেছেন এবং এর বিপরীত আক্বিদা পোষণকারীদের কঠোর সমালোচনা করেছেন, আমরা কেবল তাদের সম্পর্কে আলোচনা করছি।আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী (رحمة الله) বলেন,
على أنه حيث سمى كتابه (السنة) يفيد أن ما حواه ذلك الكتاب هو العقيدة المتوارثة من الصحابة والتابعين.. فلا حاجة إلى مناقشته فيما ساقه من الأسانيد… فيتبين بذلك الفرق بين ذكر شيء في كتاب يسميه مؤلفه باسم (السنة) وبين ذكره في كتاب لا يسمى بمثل هذا الاسم، لأن الثاني لا يدل على أن جميع ما فيه مما يعتقده مؤلفه، بل قد يكون جمع فيه ما لقي من الروايات تاركاً تمحيصها للمطالع بخلاف الأول فلا نناقش المؤلف في الأسانيد بل نوجه النقد إلى المؤلف مباشرة من جهة أن ما حواه هو معتقده
অর্থ: যেহেতু সে এই কিতাবের নাম রেখেছে কিতাবুস সুন্নাহ, তার এই নামকরণ দ্বারা বোঝা যায় সে এই কিতাবে যা কিছু লিখেছে এগুলো সাহাবা ও তায়েবীগণ থেকে পরম্পরাসূত্রে বর্ণিত আক্বিদা। সুতরাং তার লিখিত কিতাবের সনদ নিয়ে আলোচনার কোন প্রয়োজন পড়ে না। স্পষ্টত: লেখক তার কিতাব যদি আস-সুন্নাহ হিসেবে নামকরণ করে তাহলে তার মধ্যে ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য থাকে। কেননা যারা তাদের কিতাবকে এজাতীয় নামে নামকরণ করেনি তারা বর্ণনাগুলো সংকলনের সময় তাদের আক্বিদা প্রমাণকে মুখ্য গণ্য করে না। অনেক সময় একই বিষয়ক সকল বর্ণনা একত্র করার উদ্দেশ্যে বর্ণনা উল্লেখ করে থাকে। প্রথম ব্যক্তি এর বিপরীত। সে মূলত: এসব বর্ণনা দ্বারা তার আক্বিদার প্রমাণ দিয়েছে। সুতরাং আমরা এসব বর্ণনার সনদ বিশ্লেষণ ছাড়া সরাসরি তার লেখকের আক্বিদা বিশ্লেষণ করবো, কেননা সে তার আক্বিদার কিতাবে যা কিছু লিখেছে সেটি তার আক্বিদা হিসেবেই লিখেছে। [মাকালাতুল কাউসারী, পৃ৩২৬।]
যারা তাদের আক্বিদার কিতাবে ইসরাইলী বর্ণনাগুলো উল্লেখ করেছে তারা মূলত: এসব বর্ণনা দ্বারা তাদের আক্বিদা প্রমাণ করতে চেয়েছে। সুতরাং এক্ষেত্রে বর্ণনা দুর্বল না সহীহ, সেটা এখানে মুখ্য নয়। বরং সে এই বর্ণনা থেকে যে আক্বিদা প্রমাণ করেছে সেটাই মুখ্য। সুতরাং যেসব মুহাদ্দিস তাদের আক্বিদার কিতাবে ইহুদীদের এসব ভ্রান্ত আক্বিদা বর্ণনা করে নিজেদের আক্বিদা প্রমাণের চেষ্টা করেছে, তাদের এসব বর্ণনার সনদ বিশ্লেষণ করার পূর্বে তাদের আক্বিদা নিযে প্রশ্ন করা হবে। জাল, যয়ীফ ও ইসরাইলী বর্ণনা দ্বারা কেউ যদি আক্বিদা প্রমাণ করার চেষ্টা করে, তবে তাকে শুধু একারণে নির্দোষ বরা যাবে না যে, সে জাল বর্ণনা এনেছে। বরং এসব জাল বর্ণনা থেকে সে কী কী ভুল আক্বিদা প্রমাণ করতে চেয়েছে সেগুলোও বিশ্লেষণ করা হবে। বিষয়টি সালাফী শায়খরাও গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন।
ড. রেজা বিন না’সান লিখেছেন,إن علماء السلف قد ألفوا كتباً كثيرة وقد أطلق على كثير منها اسم الإبانة…. وأحيانا يطلقون على هذه المؤلفات اسم (السنة) أو (شرح السنة) – وعد كتباً منها كتاب السنة لعبد الله بن أحمد، والسنة لابن أبي عاصم، ثم قال- ويهدف مؤلفو هذه الكتب إلى إبراز عقيدة السلف كما كانت خالصة من شوائب الفرق الأخرى وشبهها، وذلك من خلال روايتهم للآثار الواردة في هذه العقيدة. ويكاد يكون موضوع هذه الكتب ونهجها واحداً وهو كما قلنا رواية الأحاديث الواردة في جميع أبواب العقيدة السلفية وذكر عقائد السلف الصالح
অর্থ: পূর্ববর্তী আলেমগণ (আক্বিদা বিষয়ক) অনেক কিতাব লিখেছেন। তদের অনেক কিতাবের নাম আল-ইবানা। কখনও কখনও তারা এসব আক্বিদার কিতাবের নাম দিয়েছে আস-সুন্নাহ অথবা শরহুস সুন্নাহ। এজাতীয় কিতাবের মধ্যে রয়েছে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) এর ছেলের কিতাব আস-সুন্নাহ এবং ইবনে আবি আসেম এর লেখা আস-সুন্নাহ। এসব কিতাবের লেখকদের মূল উদ্দেশ্য হলো, সালাফে-সালেহীনের আক্বিদা বিশ্বাস সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা। অন্যান্য বাতিল ফেরকার ভ্রান্তি স্পষ্ট করে সালাফে-সালেহীনের বিশুদ্ধ আকিদা বর্ণনাই ছিলো এসব কিতাব লেখার মূল উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে তারা নিজেদের আক্বিদা প্রমাণের জন্য এ বিষয়ে বিভিন্ন বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। সত্য কথা হলো, আক্বিদা বিষয়ক এজাতীয় সকল কিতাব রচনার পদ্ধতি একই। সেটি হলো, তারা সালাফে-সালেহীনের আক্বিদা বর্ণনার ক্ষেত্রে প্রত্যেক অধ্যায়ে সংশ্লিষ্ট আক্বিদা ও এসম্পর্কিত হাদীস উল্লেখ করেছেন।
[ইবনে বাত্তা এর লেখা আল-ইবানা এর তাহকীক, খ.১, পৃ.৪৮।]
কাররামিয়া ফেরকা:
এই ফেরকার আক্বিদা-বিশ্বাস জানার পূর্বে কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়া জরুরি। প্রথমত: মুশাববিহা ও মুজাসসিমাদের অন্যান্য ফেরকা সময়ের পরিবর্তনে বিলুপ্ত হলেও এই ফেরকার আক্বিদা বিশ্বাস এখনও মুসলিম সমাজে প্রচলিত। এই ফেরকার প্রবর্তকের মৃত্যুর সঙ্গে এটি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। এই ফেরকার অনেক আক্বিদা-বিশ্বাসই বর্তমানে সালাফী আক্বিদার মোড়কে আমাদের সমাজে বিদ্যমান রয়েছে। বর্তমান সালাফী আক্বিদা মূলত: পূর্ববর্তী মুজাসসিমা ও মুশাববিহা আক্বিদার নতুন রূপ, যা নতুন মোড়কে সাধারণ মানুষের নিকট উপস্থাপন করা হয়েছে। এই ফেরকার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিভিন্ন শ্লোগান, কৌশলের আশ্রয় নিয়ে এই ফেরকা সাধারণ মানুষের মাঝে আক্বিদাগত ভ্রান্তি ছড়িয়ে দেয়। এই ফেরকার অনেকেই বাহ্যিক ইবাদত বন্দেগি দ্বারা সাধারণ মানুষকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করতো এবং তাদের মাঝে ছড়িয়ে দিতো কুফুরী আক্বিদা সমূহ। এভাবে তারা ইসলামের কয়েক শতাব্দীব্যাপী মুসলমানদের একটি শ্রেণীকে আক্বিদার ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত করেছে। সময়ের পরিবর্তনে এদের মতাদর্শে নিত্য-নতুন মতবাদের উদ্ভব হয়েছে। আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে কাররামিয়া ফেরকাটি মূলত: মুসলমানদের মাঝে ইহুদী আক্বিদার প্রতিনিধিত্ব করেছে। কাররামিয়া ফেরকার উত্তরসূরী হলো বর্তমান সময়ের সালাফী ও আহলে হাদীস ফেরকা। কাররামিয়াদের ভ্রান্ত আক্বিদা-বিশ্বাস উল্লেখের পরে এদের ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করবো ইনশাআল্লাহ।কাররামিয়া ফেরকার প্রতিষ্ঠাতা:কাররামিয়া ফেরকার প্রতিষ্ঠাতা হলো আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে কাররাম। সে সিজিস্তানে জন্মগ্রহণ করে এবং সেখানেই বড় হয়। সে সিজিস্তান থেকে খোরাসানে প্রবেশ করে, পরবর্তীতে নিশাপুরে ফিরে আসে। এবং সেখানে তার ভ্রান্ত মতবাদ প্রচার শুরু করে। সিজিস্তান থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর নিশাপুরে গেলে সেখান থেকেও সে বিতাড়িত হয়। পরবর্তীতে সে বাইতুল মুকাদ্দাসে অবস্থান শুরু করে। সেখানেই সে ২৫৫ হি: ইন্তেকাল করে।
ইবনে কাররাম মূলত: ইবাদত বন্দেগী ও বুযুর্গীর মাধ্যমে মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতো। সে খুবই সামান্য ইলম অর্জন করেছিলো। প্রত্যেক মাযহাব থেকে কিছু কিছু নিয়ে নিজস্ব মতবাদ প্রতিষ্ঠা করে। দুনিয়া বিমুখতা ও খোদাভীতি দেখিয়ে নিজের দিকে সাধারণ মানুষকে ভিড়াতো। তার এসব কৌশলের কারণে অনেক সাধারণ মানুষ তার ভক্ত হয়। এমনকি তার একদা তার অনুসারীদেরকে গ্রেপ্তার করা হলে প্রায় সত্তর হাজারী অনুসারী গ্রেপ্তার হয়।তার মৃত্যুও সময় বাইতুল মুকাদ্দাসে তার অনুসারী ছিলো প্রায় বিশ হাজার। সিজিস্তান ও খোরাসানে এরকম হাজার হাজার অনুসারী ছিলো।
[আত-তাবসীর ফিদ দীন, পৃ.৬৫। আল-মুনতাজিম, ইবনুল জাওযী, খ.১২, পৃ.৯৮।]
কাররামিয়াদের ভ্রান্ত কুফুরী আক্বিদা-বিশ্বাস: কাররামিয়াদের অনেক ফেরকা ও মতবাদ রয়েছে। ভ্রান্ত ফেরকার উপর লিখিত গ্রন্থগুলোতে এদের অনেক ফেরকার নাম পাওয়া যায়। ইমাম আবু মনসুর বাগদাদী (رحمة الله) আল-ফরকু বাইনাল ফিরাক এর মধ্যে এদের তিনটি দলে ভাগ করেছেন। ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (رحمة الله) এদেরকে ছয়টি দলে বিভক্ত করেছেন। ইমাম শাহরাস্তানী (رحمة الله) এদের বারটি দলের কথা উল্লেখ করেছেন। আমরা তাদের বিভিন্ন ফেরকা সম্পর্কে আলোচনার পরিবর্তে তাদের মৌলিক আক্বিদাগুলো এখানে তুলে ধরবো।মুহাম্মাদ ইবনে কাররামের একটি মৌলিক ভ্রান্ত আক্বিদা হলো, আল্লাহ তায়ালা দেহ ও শরীর বিশিষ্ট। তার দেহের একটি সীমা ও সমাপ্তি রয়েছে। তার মতে আল্লাহর দেহের নিচের দিকের কেবল সীমা ও সমাপ্তি রয়েছে, যেই দিক আরশের সাথে সংশ্লিষ্ট।
[আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ.২০৩, আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১০৮, ই’তেকাদু ফিরাকিল মুসলিমিন, পৃ.১৭।]
ইবনে কাররামের আরেকটি আক্বিদা হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশের উপরের অংশ স্পর্শ করে আছেন।
[আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ.২০৪, আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১০৮।]
ইবনে কাররামের বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর স্থির হয়ে আছেন। সত্ত্বাগতভাবে তিনি উপরের দিকে রয়েছেন। আরশ হলো আল্লাহর অবস্থানের স্থান।ইবনে কাররামের নিকট আল্লাহ তায়ালা চলা-ফেরা করেন, তিনি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করেন, তিনি উপর থেকে নিচে অবতরণ করেন।সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, ইবনে কাররামের মতে আল্লাহ তায়ালার ভার বা ওজন রয়েছে। ইমাম বাগদাদী (رحمة الله) বলেন,
وأعجب من هذا كله أن ابن كرام وصف معبوده بالثقل وذلك أنه قال في كتاب عذاب القبر في تفسير قوله تعالى “إذا السماء انفطرت” إنها انفطرت من ثقل الرحمن عليها
অর্থ: পূর্বোক্ত কুফুরী আক্বিদাগুলোর চেয়ে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক আক্বিদা হলো মুহাম্মাদ ইবনে কাররাম আল্লাহ তায়ালার জন্য ওজন বা ভার সাব্যস্ত করেছে। সে তার আজাবুল কবর বইয়ে সূরা ইনফেতার এর প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লাহর ওজন সাব্যস্ত করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন (অর্থ:) যখন আসমান বিদীর্ণ হবে।
[সূরা আল-ইনফিতার, আয়াত নং ১।]
সে এর ব্যাখ্যায় লিখেছে, আসমান আল্লাহর ভারে বিদীর্ণ হবে। [আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ.২০৭।]
ইবনে কাররামের আরেকটি কুফুরী আক্বিদা হলো, সে আল্লাহর জন্য কাইফিয়াত বা অবস্থা সাব্যস্ত করেছে। ইমাম বাগদাদী (رحمة الله) লিখেন,ثم إن ابن كرام ذكر في كتابه عذاب القبر باباً له ترجمة عجيبة فقال: باب في كيفوفية الله عز وجل، ولايدري العاقل من ماذا يتعجب أمن جسارته على إطلاق لفظ الكيفية في صفات الله عز وجل؟ أم من قبح عبارته عن الكيفية بالكيفوفية، وله من جنس هذه العبارة أشكال ৃ وقد عبر عن مكان معبوده في بعض كتبه بالحيثوثية وهذه العبارات لائقة بمذهبه السخيف
অর্থ: ইবনে কাররাম তার আজাবুল কবর নামক কিতাবে একটি আশ্চর্যজনক পরিচ্ছেদ লিখেছে। পরিচ্ছেদের নাম দিয়েছে, আল্লাহর কাইফিয়াত বা অবস্থার বর্ণনা। আমি জানি না, একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি তার এই পরিচ্ছেদের নাম দেখে আশ্চর্যন্বিত হবে না কি আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে কাইফিয়াত বা অবস্থা সাব্যস্তের মতো ধৃষ্টতা দেখে আশ্চর্য হবে, না কি তার নিকৃষ্ট শব্দ ব্যবহারে আশ্চর্য হবে? সে আরবী কাইফিয়াত শব্দ থেকে বিকৃত শব্দ কাইফুফিয়াত বানিয়েছে। সে এজাতীয় আরও অনেক বিকৃত শব্দ ব্যবহার করেছে। সে তার একটি কিতাবে আল্লাহর স্থান সাব্যস্তের জন্য হাইসুসিয়াত শব্দ ব্যবহার করেছে। এধরনের বিকৃত শব্দ শুধু তার নিকৃষ্ট মাযহাবেরই উপযুক্ত।
[আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ.২০৭]
মুহাম্মাদ ইবনে কাররাম ও তার অনুসারীদের ভ্রান্ত আক্বিদাসমূহ:
ইমাম আব্দুল কাহের বাগদাদী, ইমাম ইসফারাইনী, ও ইমাম শাহরাস্তানী (رحمة الله) মুহাম্মাদ ইবনে কাররাম ও তার অনুসারীদের আক্বিদা বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। আমরা তাদের মৌলিক আক্বিদাগুলো সংক্ষেপে উল্লেখ করছি,
১. আল্লাহ তায়ালার পরিমাপ ও সীমা রয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা রয়েছে। পরিভাষা অনুযায়ী দৈঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা বিশিষ্ট বস্তুকে মূলত: দেহ বলা হয়। এজন্য প্রত্যেক মুজাসসিমা আল্লাহ তায়ালার দেহ সাব্যস্ত করে থাকে।
২. আল্লাহ তায়ালাকে পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা সম্ভব। এমনকি আল্লাহ তায়ালাকে স্পর্শ করা সম্ভব। কারণ তাদের মতে আল্লা তায়ালা জিসম বা দেহবিশিষ্ট। আর প্রত্যেক দেহ বিশিষ্ট বস্তু র্শ করা সম্ভব।
৩. আল্লাহ তায়ালা আরশ স্পর্শ করে আছেন। কেননা তিনি আরশের উপর বসে আছেন। তাদের কারও কারও মতে তিনি আরশ থেকে পৃথক অবস্থায় আরশের উপরে রয়েছেন।
৪.আল্লাহ তায়ালার অঙ্গ-প্রতঙ্গ রয়েছে। যেমন, হাত, চোখ, পা ইত্যাদি।
৫. অধিকাংশ মুজাসসিমার মতে আল্লাহ তায়ালা সব দিক থেকে সীমাবদ্ধ। তাদের কেউ কেউ বলে, আল্লাহ তায়ালা নিচের দিক তথা আরশের দিক থেকে সীমাবদ্ধ এবং আরশ ব্যতীত অন্যান্য দিকে অসীম।
৬. আল্লাহ তায়ালার শোনা, দেখা, ইলম, কুদরত মোট কথা সব গুণ নশ্বর। এগুলো আল্লাহর সত্ত্বার মাঝে সৃষ্টি হয়।
৭. আল্লাহ তায়ালার কোন কাজের জন্য নড়া-চড়া প্রয়োজন। সুতরাং আল্লাহ তায়ালা কিছু করার জন্য নড়া-চড়া বা হরকত করেন। তাদের কেউ কেউ বলে, আল্লাহ তায়ালার নড়া-চড়াই হলো আল্লাহর কাজ।
[আল-কাশিফুস সগীর, সাইদ আব্দুল-লতিফ ফুদা, পৃ.৩১-৩২।]