রোদ মাখা সকাল। আরবের রোদ। সূর্যের কিরণ শরীর জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো অবস্থা। মদিনা মুনিব (দ:) বসে ছিলেন। পাশে সাহাবায়ে কেরাম। কোনো এক বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো। হঠাৎ এক ব্যক্তি দরবারে এলো। সে এতিম। হুজুরের দরবারে আরজ করল। হে মুনিব (দ:)! আমার একটি খেজুরের বাগান আছে। আমি সে বাগানে টিলা বা বাউন্ডারি দিতে চাই। আমার সীমানার মধ্যে এক জনৈক এক ইহুদির গাছ চলে আসে। আমি তার কাছে এ গাছটি চাই। সে দিতে রাজি নয়। বিক্রিও করবে না আসে। হে মালিক! আপনি উপায় দিন। মদিনা মুনিব কথাগুলো মনযোগ দিয়ে শুনলেন। এতিমের প্রতি ভালোবাসা ছিল তার প্রবল। এতিমের দুঃখ সহ্য করতে পারতেন না। ডেকে পাঠালেন ইহুদিকে। সে দরবারে উপস্থিত হলো। মদিনা মুনিব আরজ করলেন। গাছটি এই এতিমকে দিয়ে দাও। ইহুদি অস্বীকৃতি জানায়। ক্রোধে তার গা জ্বলে যাচ্ছে। এতিম ছোকরার এত বড় স্পর্ধা মদিনা সরকারকে এ ব্যাপারে জানায়! হুজুর আবারো আরজ করলেন। গাছটি বিক্রি করো তার কাছে। সে বিক্রি করতেও না করল। মালিক এখন নড়ে চড়ে বসলেন। ইরশাদ করলেন। যদি তুমি গাছটি তাকে দেও, তাহলে জান্নাতে তুমি একটি এমন বড় গাছ পাবে যার ছায়া একশত বছর হাটলেও শেষ হবেনা। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে জান্নাতে যাওয়ার ইঞ্জিত। একটি গাছের জন্য মুনিব জান্নাত দিচ্ছেন দেখে সাহাবায়ে কেরাম অবাক হলেন। কপাল পোড়া যাকে বলে। ইহুদি ব্যক্তি এই চুক্তিতেও রাজি নয়। মদিনা মুনিব আশ্চর্য্য হলেন। আর কিছু বললেন না। সাহাবায়ে কেরাম তখনও বসা ছিল। প্রসিদ্ধ সাহাবী হজরত আবু দাহদা (রা:) উপস্থিত ছিলেন সেখানে। হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রা:)। তার ভাস্যনুযায়ী। আবু দাহদা (রা:) হুজুরের দরবারে আবদার করলেন। বললেন। হে সরকারে মদিনা (দ:)! আমি যদি এই গাছটি কোনো ক্রমে এই ইহুদি ব্যক্তির কাছ থেকে এনে এতিমকে দিতে পারি, তাহলে জান্নাতের সেই অফারটা কি আমার জন্যও আছে? সরকারে মদিনা মুচকি হাসলেন। বললেন কেন নয়। তোমার জন্যও সেই অফার প্রযোজ্য। সাহাবায়ে রাসূল খুশি হয়ে দরবার থেকে ইহুদির বাড়িতে রওয়ানা হলেন।
ছোট্ট একটি বাগান ইহুদির। বাগানেই তার বাসা। আবু দাহদা তার বাসার দরজায় দাঁড়ানো। ভিতরে আসার অনুমতি চাইলেন। ইহুদি চমকিত হলো। অনুমতি দিল গৃহ প্রবেশের। আবু দাহদা তাকে প্রশ্ন করলেন। তুমি কী আমায় চিন? ইহুদি অবাক হলো। বিজয়ী বেসে বলল। আপনাকে কে না চিনে! আপনার একটি খেজুরের বাগান আছে। যেখানে ৬০০ বড় বড় খেজুরের গাছ। আপনার খেজুর পুরো মদীনা জুড়ে প্রসিদ্ধ। মদিনার বড় বড় আমলারা আপনারার খেজুরের অপেক্ষায় থাকে। শুধু তাই নয়। আপনার বাগানের ভিতর রয়েছে এক আলিশান মহল। যা দেখতে প্রতিদিনই ভিড় করে আগন্তুক। আপনার মতো সুনামধন্য একজন ব্যবসায়ী আমার ঘরে এসেছে। আমি আনন্দে আত্মহারা। এবার আবু দাহদা তাকে এক অফার দিলেন। বললেন, যদি তুমি আমাকে ঐ গাছটি দিয়ে দাও তবে আমার পুরো বাগান, বাগানের গাছ, তার ভেতরের মহল সব তোমার। ইহুদির মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। আমাদের ভাষায় টাস্কি খাওয়া যাকে বলে। অবাক হয়ে বলল। আপনি মজা করছেন নাকি! আবু দাহদা না সূচক মন্তব্য করলেন। চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। একটি গাছের বদলে আবু দাহদার পুরো খেজুরের বাগান এখন তার।
আবু দাহদা (রা:) তার আলিশান মহলের নীচে দাঁড়িয়ে। বাহির থেকে আওয়াজ দিলেন তার স্ত্রীকে। হে উম্মে দাহদা! বেরিয়ে এসো। এই বাগান, মহল সব আমি আল্লাহর নামে বিক্রি করে দিয়েছি। উম্মে দাহদা স্বামীর স্বভাব জানতেন। এ অনেক বড় ব্যবসায়ী। ক্ষতিতে কোনো ব্যবসা করেননা। ভেতর থেকে বললেন, স্বামী! কিসের বিনিময়ে বিক্রি করেছ? আবু দাহদা বিজয়ী মুখে বললেন। জান্নাতের একটি গাছের বিনিময়ে। এখানে একটু খেয়াল করা দরকার। আজকের জমানায় কোনো স্বামী যদি তার স্ত্রীকে বলে, আমি আমার বাড়ি আল্লাহর নামে দিয়ে দিয়েছি। নিশ্চই ঝগড়া শুরু হবে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে। গালিগালাজের কোনো অংশই হয়তো অপূর্ন থাকবেনা। তবে দেখুন সেই সময়ে স্ত্রীরা স্বামীকে কতটুকু বিশ্বাস করত। কতটুকু আল্লাহ ওয়ালা ছিল। উম্মে দাহদা বেড়িয়ে আসতে আসতে বললেন। অনেক লাভের চুক্তি করেছেন স্বামী। আমরা লাভবান হলাম। তারা বেরিয়ে আসছেন সন্তানদের নিয়ে। ছোট্ট সোনামণি গুলোর হাতে খেজুর ছিল। সেগুলো তাদের হাত থেকে নিয়ে বাগানে রাখলেন। একদম ছোট্ট সন্তানের মুখে খেজুর ছিল। তিনি মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে বাগানে রাখলেন। সন্তানদের বললেন। বাবা রা! এই খেজুরের উপর এখন আর আমাদের কোনো অধিকার নেই। এ খেজুর ভক্ষণ করা এখন আমাদের কাছে অন্যায়। ঐতিহাসিক মুহাদ্দিসগণ এ ঘটনার বিবরনে বলেন। আবু দাহদা (রা:) এর কাছে এই বাগানটি ছাড়া আর কোনো সম্পত্তি ছিল না। তারপরও তিনি একটুও আফসোস করেননি।
আবু দাহদা আবারও হুজুরের দরবারে উপস্থিত হলেন। আরজ করলেন বারবার। হে মদিনা মুনিব! এই চুক্তি ফাইনাল তো? আমি জান্নাতের গাছ পাব তো? মদিনা মুনিব খুশি হলেন। আনন্দের সেই পাগল করা মুচকি হাসি তার চেহারা মোবারকে ভেসে উঠল। তিনি বললেন। কামমিন ইজকিন রাদাই লি আবি দাহদাই। কামমিন ইজকিন রাদাই লি আবি দাহদাই। তিনি বার বার কথাটি বলছেন। মুনিব হাসিমুখে বলেন। হে আবু দাহদা! কথাতো হয়েছিল একটি গাছের। তুইতো ৬০০টা গাছ বিক্রি করে দিয়ে এসেছিস রে পাগল। তোর জন্য এখন জান্নাতে রয়েছে ৬০০টি খেজুর গাছ। জান্নাতে তোর জন্য শুধু খেজুর আর খেজুর। খেজুর আর খেজুর। উপস্থিত সবাই হেসে ফেলল। এ আনন্দ সবার চোখে স্পষ্ট। আবু দাহদার জান্নাতের টিকেট ফাইনাল। এর মধ্যে আর কোনো সন্দেহ নেই।
অনেকেই হয়তো ভাববেন আবু দাহদার গল্প এখানেই শেষ। নাহ। এরা সাহাবায়ে রাসূল। এরা জান্নাতের টিকেট পাওয়ার পরও ইসলামের খেদমতে নিজেকে নগন্য করে রেখেছেন। হুজুরের প্রতি ভালোবাসা তাদের ছিল রন্দ্রে রন্দ্রে। সেই আবু দাহদা যুদ্ধের ময়দানে হুজুরের মহব্বতে হাসতে হাসতে শাহাদাত বরণ করেন। যুদ্ধ শেষে মদিনা মুনিব ইরশাদ করলেন। আমার আবু দাহদা কে আমাকে দেখিয়ে দাও। আমি তাকে দেখতে চাই। মুনিব আবু দাহদাকে দেখলেন। তিনি মুচকি হাসি হাসলেন। ইরশাদ করলেন, আবু দাহদা! জান্নাতে শুধু খেজুর আর খেজুর। খেজুর আর খেজুর আছে তোর জন্য।
সম্মানিত পাঠক, এ ঘটনা শিক্ষা এতিমকে ভালোবাসার। আপনি এতিমকে ভালোবাসুন। আল্লাহ আপনাকে ভালোবাসবেন। এতিমের সুখ দুঃখে নিজেকে শরিক করুন। তাদের সঙ্গে আনন্দে মেতে উঠুন। তাদের সহযোগিতা করুন সর্বাবস্থায়। নিশ্চই আল্লাহ আপনার জন্য রাখবেন উত্তম প্রতিদান।
লেখক:- গোলাম শাফিউল আলম মাহিন