আগন্তুক (৪)

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

শিশু চিকিৎসক হিসাবে তিনি সবসময় টেলিভিশন দেখাকে নিরুৎসাহিত করেছেন, কারণ এটা অনেক সময় হিংস্র জিনিস প্রচার করে। বাচ্চাদের কার্টুনে অনেক সময় নানা ধরনের জোরালো শব্দ থাকে, ‘বুম’, ‘ব্যাঙ’ ইত্যাদি। এমনকি আমরা যখন টম অ্যান্ড জেরি দেখতাম, সেখানেও ‘দুম-দুম-দুম-দুম’ করে পিটানোর শব্দ থাকত। আমরা মনে করি এটা তো বিনোদন, এগুলো তো সত্যি কিছু না – কিন্তু বাচ্চাদের মাথায় এই জিনিসগুলো ঢুকে যায়। এমনকি বিজ্ঞাপনেও যা দেখান হতো, সেগুলো নিয়ে তিনি চিন্তা করতেন যে, ওগুলো ক্ষতিকর, ওগুলো এড়িয়ে চলা উচিৎ। তার নিজের বাচ্চা জন্মানোর আগেও, এসব নিয়ে এধরনের তিনি চিন্তাভাবনা করতেন।

কিন্তু নিজের বাচ্চা হওয়ার পর, আস্তে আস্তে বুঝলেন যে, টিভিতে যা-ই দেখান হোক না কেন তা-ই আসলে বাচ্চাদের জন্য ক্ষতিকর – এমনকি যদি জীব-জন্তু, গাছ-পালা দেখান হয় তাহলেও। আমরা অনেক সময় মনে করি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বা ডিসকভারি চ্যানেল মনে হয় খুব উন্নতমানের প্রচার মাধ্যম – কিন্তু আসলে ব্যপারটা তা না। তার বাচ্চা হওয়ার পর টিভির আসল ক্ষতিটা কোথায়, সেটা তিনি বুঝতে শুরু করলেন। কী দেখান হচ্ছে সেটা মূল ব্যাপার ছিল না, কারণ, তিনি সচেতনভাবে সমস্ত মারামারি-হানাহানি-অশ্লীলতা বাদ দিতেন! কিন্তু তারপরও দেখলেন যে, তার বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কেন নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল সেটা দেখব আমরা।

আমরা অনেকেই এখন বাচ্চাদের “টিভি” ঘুষ দিয়ে থাকি। আজকাল অনেক পরিবারেই স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করেন। বাচ্চাদের জন্য তাদের সময় নাই। বেশী টাকার বা বড় মাইনের চাকরির প্রয়োজন – মৌলিক চাহিদা মেটাতে নয়, বরং মূলত দামী দামী “জিনিস” বা “আসবাবপত্র” সংগ্রহ করতেই দুজনের চাকুরী করা প্রয়োজন। আপনাকে যে সময়টাতে বাচ্চারা “মিস” করছে, ওই সময়টা আপনি ঘরে, টিভির সামনে, বসিয়ে রাখছেন তাদের।

আমাদের দেশ সাদা সাহেবরা শাসন করে গেছে, কিন্তু আমরা অনেক রক্ষণশীল ছিলাম। একটা মুসলিম পরিবারের  শোবার ঘরে কখনো তারা ঢুকতে পারেনি, এমনকি আমাদের বাড়িতেও কখনো ঢুকতে পারেনি। আমরা বলি, মুসলিম পরিবার হচ্ছে আপনার দুর্গ, এটা সবার জন্য উন্মুক্ত না। তারা কখনো আমাদের স্ত্রীদের সামনে আসেনি। আজকে কী হচ্ছে, শোবার ঘরে টেলিভিশনের পর্দায় একজন সাদাচামড়ার সাহেব গান গাচ্ছে – আপনার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতবহ গান – আপনার স্ত্রী দেখছেন না? আমরা কোথায় নিয়ে এসেছি তাদের কথাকে, সংষ্কৃতিকে!

শিশুবিশেষজ্ঞ সুজান বলছেন, কী দেখান হচ্ছে সেটা কোন ব্যাপার না। টিভির মাধ্যমে তার বাচ্চার আচরণ পরিবর্তন হয়ে গেল। আপনারা দেখবেন, বাচ্চারা যখন টিভি দেখে, তখন তারা কিন্তু আপনার সাথে ভালোভাবে কথা বলবে না; অর্ধেক মনোযোগ দিয়ে সে আপনাকে শুনছে, তার চোখ-কানের অর্ধেক ওইদিকে। সে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছে, দাঁড়িয়েও শুনছে না আপনার কথা। তার আচরণ পাল্টে যাচ্ছে। টিভি দেখার আগে, দেখার সময় ও পরে তার মানসিক ও শারীরিক নড়াচড়া পাল্টে যাচ্ছে। তিনি কিন্তু অমুসলিম মহিলা – সাধারণ পর্যবেক্ষণের কথা বলছেন – সব অবস্থাতেই তার বাচ্চার আচরণ পাল্টে গেছে, যা দেখে আসলে তিনি রীতিমত ‘ভয়’ পেয়েছেন।

তারপর উনি বলছেন, যখন বাচ্চা টিভি দেখত না তখন সে প্রকৃতির মাঝে থাকত, পোকামাকড়ের প্রতি কৌতুহল প্রকাশ করত। গ্রামে গেলে দেখবেন আমাদের এদেশীয় বাচ্চারা জোনাকি পোকা নিয়ে কি করে – ধরবে, ধরে গ্লাসের ভেতর ঢুকাবে, দেখবে কতক্ষণ জ্বলে! তো, তার বাচ্চাও প্রকৃতির সাথে বড় হচ্ছিল। আমরাও তো ছোটবেলায় বালু দিয়ে, পানি দিয়ে খেলতাম, দুর্গ বানাতাম। তারপর সুজান বলছেন, তার বাচ্চা প্রকৃতির মাঝে শান্তিতে ছিল – নিজেকে নিয়ে, নিজের শরীর নিয়ে, তার পারিপার্শ্বিকতাকে নিয়ে। যদি আপনি দেখেন একটা বাচ্চা প্রকৃতির মাঝে খেলছে, দেখবেন সে আনমনে অনেক কিছু করে যাচ্ছে। আমাদের মায়েরা ছয় ছয়টা বাচ্চা প্রতিপালন করেছেন, কোথায় অত সময় দিতে পেরেছেন তারা? এখন তো ওয়াশিং মেশিন, ডিশ ওয়াশার, ব্লেন্ডার আছে। তখন তো ওসব ছিল না। আমাদের মায়েরা আমাদের প্রতিপালন করেছেন কী করে? আমরা প্রকৃতির মাঝে বড় হয়েছি। কিন্তু আজকে আমাদের বাচ্চারা খোপের ভেতর বড় হচ্ছে এবং তাদের আচরণ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন চাইলেই শহর ভেঙ্গে গ্রাম বানিয়ে ফেলতে পারব না। কিন্তু আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল যেভাবে ছেলেমেয়েদের বড় করতে বলেছেন, তার সাথে কিন্তু সুজানের উৎকন্ঠা ও চাওয়াগুলো মিলে যায় – তিনি খুব ইসলামিক একটা কথা বলেছেন না জেনেই।

তারপর তিনি বলছেন, যখন তার বাচ্চা টিভি দেখতে শুরু করল, সে তার প্রতি খুবই অমনোযোগী হয়ে গেল। উনি ডাকছেন অথচ বাচ্চার কোন সাড়া নেই। চোখটা আঠার মতো লেগে আছে টিভিতে। সে তার চারপাশের পরিবেশের প্রতিও অমনোযোগী হয়ে গেল। ঘরে একজন মেহমান এলো – তার কথা বলার সময় নাই, তাকানোরও সময় নাই। আমাদের ছোটবেলায় ঘরে আপন মামা, চাচা আসলে আমরাই চা, শরবত নিয়ে গেছি; কাজের মানুষ না। এগুলোর সময় নেই তার। এখন আমাদের আরও যেটা হয়, ছোট বাচ্চাদের খাওয়ানোর উপায় হচ্ছে টিভি, ওদিকে তাকিয়ে বিজ্ঞাপন দেখছে আর গিলছে। খাবারের দিকে তার কোন মনোযোগ নাই, খাবার সে চাবাচ্ছে না; তার তো পেট খারাপ হবেই! কারণ আমাদের খাওয়াটা গন্ধ, স্পর্শ, রংসহ দেখতে যা লাগে – তা থেকে আমাদের মুখে পানি আসে, লালা আসে, ইচ্ছা জাগে খাওয়ার। আমরা চিবাই আর খাবারটা সহজে হজম হয়। কিন্তু টিভির দিকে তাকিয়ে ওভাবে গিললে, খাবার হজম হয় না। বাচ্চারা অপুষ্টিতে ভোগে; দাঁত ওঠে না, চোখে দেখে না – কতরকম সমস্যা হচ্ছে না এখন? এগুলো কিন্তু অনেক কারণে হয়, এসব চিন্তা করার ব্যপার। মুসলিমরা চিন্তা করবে – আল্লাহ তাদের কেন জন্ম দিলেন, কী কারণে, কোনটা করলে সবচেয়ে ভালো হয় ইত্যাদি।

তারপর উনি বলছেন, আমি যখন টিভি বন্ধ করে দিতাম, সে বিরক্ত হত, ঘ্যানঘ্যান করত, কখনো চিৎকার করত, কখনো কাঁদতো – টিভিটা আবার ছেড়ে দেয়ার জন্য। তার খেলাধুলাগুলো অগোছালো হয়ে যাচ্ছিল, কোন নিয়মের ধার ধারত না সে। তার নড়াচড়াও ঠিক ছিল না – বাচ্চাদের যেমন স্বাভাবিক হওয়ার কথা তেমন ছিল না। তার খেলায় নিজস্ব কল্পনা থাকত না। বিদেশীদেরও কিন্তু দেখবেন – আল্লাহ ওদের অনেক জায়গাজমি দিয়েছেন – তারা কল্পনাশক্তি ব্যবহার করত খেলাধুলায়, গাছের ওপর ঘর বানাত ইত্যাদি। এই যে নিজের চিন্তা থেকে কিছু করা – এগুলোর কোন আগ্রহ রইলো না সুজানের বাচ্চার, যখন সে টিভি দেখতে শুরু করল। সে নিজে থেকে কিছু না করে টিভিতে যা দেখছে, ঠিক তার মতো করেই একটা কিছু করার চেষ্টা করছে।

এরপর উনি আট থেকে এগার বছরের ছয়টা বাচ্চাকে নিয়ে গবেষণা করলেন। আমরাও মনে প্রাণে বিশ্বাস করি এক থেকে এগার/বার বছরের মধ্যে বাচ্চাদের মাথায় যেটা ঢুকে, সেটা বের করা যায় না। এই সময়টা আল্লাহর ওয়াস্তে নিজের বাচ্চাদের যত্ন নিজে নেবেন, তাকে দ্বীন শেখাবেন, আল্লাহর কথা শোনাবেন, নবীর গল্প শোনাবেন, ইসলামের ইতিহাস শোনাবেন – আল্লাহর ওয়াস্তে কুফফার, নাসারা, ইহুদীদের জিনিসপত্র তাদের কাছে উন্মোচিত করবেন না। কারণ এই সময় যা শিখবে, তা মাথা থেকে বের হবে না। আমার মনে আছে ওই রকম বয়সে আমার স্কুলের টিচার একটা কথা বলেছিলেন যা প্রকারান্তরে বোঝায় বিজ্ঞান ঠিক, কুরআন ভুল। অথচ উনি যা বলেছিলেন, তা কুরআনে কোথাও লেখা নেই। আমার মনে আছে আমার কেমন লেগেছিল তখন, আমার কিশোর মন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে কী হয়? আল্লাহ, আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে মনে হীনমন্যতা জন্মায়, পরবর্তীতে আমরা কিন্তু আর ইসলামকে শ্রদ্ধা করতে পারব না। আমাদের কাছে কুফফার, নাসারা, ইহুদীদের জিনিসই প্রাধান্য পাবে। এ জন্য এই বয়সটা খুব যত্ন নেবেন বাচ্চাদের, তাদের সময় দেবেন, টিভির মতো আবর্জনা থেকে দূরে রাখবেন – ইসলামের বা সাধারণ সুন্দর সুন্দর গল্প বলবেন, টিভি বা কার্টুনের ঘুষ দিয়ে বসিয়ে রাখবেন না।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment