আখির’ শব্দটি আরবী। এর অর্থ- শেষ। আর ‘চাহার শোম্বাহ’
হচ্ছে ফার্সী শব্দ। এর অর্থ- বুধবার। আরবী ও ফার্সী শব্দের
সংমিশ্রণে ‘আখিরী চাহার শোম্বাহ’ বলতে ছফর মাসের
শেষ বুধবারকে বুঝানো হয়ে থাকে। মূলত, এ দিনটি মুসলিম
উম্মাহর জন্য এক বিশেষ খুশির দিন।
এ মুবারক দিনটি সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, সাইয়্যিদুল
মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, রহমতুল্লিল
আলামীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিদায়ের পূর্ববর্তী মাসের
অর্থাৎ ছফর মাসের শেষ
সপ্তাহে তিনি ভীষণভাবে অসুস্থতা অনুভব করেন অতঃপর
দিন দিন উনার অসুস্থতা বাড়তেই থাকে। কিন্তু এই মাসের
৩০ তারিখ বুধবার দিন ভোর বেলা ঘুম
থেকে জেগে তিনি বললেন, আমার নিকট কে আছেন? এ
কথা শুনামাত্রই উম্মুল মু’মিনীন হযরত
আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম তিনি ছুটে আসলেন
এবং বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার মাতা-পিতা আপনার জন্য
কুরবান হোক। আমি হাযির আছি। তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন,
হে আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম! আমার
মাথা মুবারক-এর ব্যথা দূর হয়ে গেছে এবং শরীর মুবারকও বেশ
হালকা মনে হচ্ছে। আমি আজ বেশ সুস্থতা অনুভব করছি।
সুবহানাল্লাহ! এ কথা শুনে উম্মুল মু’মিনীন হযরত
আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম তিনি অত্যন্ত
আনন্দিত হলেন এবং তাড়াতাড়ি পানি আনয়ন করে হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মাথা মুবারক
ধুয়ে দিলেন এবং সমস্ত শরীর মুবারক-এ
পানি ঢেলে ভালোভাবে গোসল করিয়ে দিলেন।
গোসলের ফলে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম উনার
শরীর মুবারক হতে বহু দিনের রোগজনিত অবসাদ
অনেকাংশে দূর হয়ে গেল। তারপর উনি বললেন,
হে আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম!
ঘরে কোনো খাবার আছে কি? তিনি জবাব দিলেন, জী-হ্যাঁ,
কিছু রুটি পাকানো আছে। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, আমার জন্য
তা নিয়ে আসুন আর সাইয়্যিদাতুন নিছা হযরত
মা ফাতিমা আলাইহাস সালাম উনাকে খবর দিন, তিনি যেন
উনার আওলাদগণ উনাদেরকে সঙ্গে নিয়ে তাড়াতাড়ি আমার
নিকট চলে আসেন। হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস
সালাম তিনি সাইয়্যিদাতুন নিসা হযরত
মা ফাতিমা আলাইহাস সালাম উনাকে সংবাদ দিলেন
এবং ঘরে যে খাবার তৈরি ছিলো তা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট পরিবেশন করলেন।
সাইয়্যিদাতুন নিসা হযরত মা ফাতিমা আলাইহাস সালাম
উনার আওলাদগণ উনাদেরকে নিয়ে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট হাজির হলেন। হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সাইয়্যিদাতুন
নিসা হযরত মা ফাতিমা আলাইহাস সালাম উনাকে নিজের
গলা মুবারক-এর সাথে জড়িয়ে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিলেন,
নাতিগণ উনাদের কপাল মুবারক-এ চুমো খেলেন
এবং উনাদেরকে সাথে নিয়ে আহারে বসলেন। কয়েক
লোকমা খাবার গ্রহণ করার পর অন্যান্য উম্মুল মু’মিনীন
আলাইহিন্নাস সালামগণ উনারাও খিদমতে এসে হাজির
হলেন। অতঃপর পর্যায়ক্রমে বিশিষ্ট ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহুম উনারাও বাইরে এসে হাজির হন।
কিছুক্ষণ পর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
তিনি বাইরে এসে উনাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন,
হে ছাহাবীগণ! আমার বিদায়ের পর আপনাদের অবস্থা কিরূপ
হবে? এ কথা শুনে ছাহাবীগণ
উনারা ব্যাকুলচিত্তে কান্না শুরু করলেন। উনাদের এ
অবস্থা দেখে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
তিনি উনাদেরকে সান্ত¡না দান করলেন। অতঃপর হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
তিনি মসজিদে নববী শরীফ-এ ওয়াক্তিয়া নামাযের
ইমামতি করলেন।
আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি দীর্ঘদিন অসুস্থতার পর সুস্থ
দেহ মুবারক-এ মসজিদে নববী শরীফ-এ আগমন করেন
এবং নামাযের ইমামতি করেন। এই অপার আনন্দে হযরত
ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা নিজ নিজ
সামর্থ্য অনুসারে অনেক কিছু হাদিয়া করেন।
কোনো কোনো বর্ণনায় জানা যায় যে, খুশি হয়ে হযরত আবু
বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম তিনি সাত হাজার দীনার,
হযরত উমর ফারুক আলাইহিস সালাম তিনি পাঁচ হাজার
দীনার, হযরত উসমান যুন নূরাইন আলাইহিস সালাম তিনি দশ
হাজার দীনার, হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু
আলাইহিস সালাম তিনি তিন হাজার দীনার, হযরত আব্দুর
রহমান ইবনে আউফ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি একশত
উট ও একশত ঘোড়া মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টির জন্য
হাদিয়া করতঃ মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের মুহব্বত ও সন্তুষ্টি লাভ
করেন। ( সিরাতে ইবনে হিশাম ২য় খন্ড ৬৫৩পৃঃ )
হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, “তোমাদের জন্য আমার সুন্নত
এবং খুলাফায়ে রাশিদীন তথা হযরত ছাহাবায়ে কিরাম
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের সুন্নত অবশ্য পালনীয়।”
বিশ্বের সকল মুসলমানসহ সমস্ত মুসলিম দেশের সরকারের
উচিত যিনি ঈমানের মূল এবং সমস্ত মাখলুকাতের জন্য রহমত ও
নাজাতের কারণ আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল
মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অকল্পনীয় ও বেমেছাল
মর্তবা ও মর্যাদা এবং ফাযায়িল-ফযীলত সম্পর্কে অবগত
হওয়া। শুধু তাই নয়, উনার সাথে সম্পৃক্ত বিশেষ দিন ও
ঘটনাগুলো বিশেষভাবে অবগত হওয়া এবং অত্যন্ত আদব ও
মুহব্বতের সাথে সেগুলো পালনে কোশেশ করা। এমনই
একটি দিন হচ্ছে আখিরী চাহার শোম্বাহ। বদ আক্বীদাভুক্ত
অনেকে দিনটি পালনকে নাজায়িয ও বিদয়াত
বলে আখ্যায়িত করে থাকে, যা সম্পূর্ণ অশুদ্ধ ও ভুল। বরং হযরত
ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের
অনুসরণে এই দিনটি উপলক্ষে সাধ্যমতো হাদিয়া করা, দান-
ছদকা করা, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
উনার প্রতি বেশি বেশি ছলাত ও সালাম পেশ
করা মুসলমানদের জন্য রহমত ও নাজাতের কারণ।
আখিরী চাহার শোম্বাহ বরকতময় দিনটিকে যথাযথ মর্যাদার
সাথে পালন করা সকল মুসলমানসহ সব মুসলিম দেশের
সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
মহান আল্লাহ পাক আমাদের খাছ ভাবে কবুল করুন। আমীন
জাওয়াহেরুল কুনজ ৫ম খন্ডের ৬১৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে:
সফর মাসের শেষ বুধবার সূর্যোদয়েরর পূর্বে গোসল করা উত্তম।সূর্যোদয়েরর পর দুই রাকাত নফল নামায পড়া ভাল।
নিয়ম: ১ম রাকাতে ‘কুলিল্লাহুম্মা মালিকাল মুলক এবং ২য় রাকাতে ‘কুল আদয়ুল্লাহ আদয়ুর রহমান’ থেকে সূরার শেষ পর্যন্ত পাঠ করবে।সালাম ফেরানোর পর নিন্মোক্ত দোয়া পাঠ করবে_
আল্লাহুম্মা আন্নী শাররা হাযাল ইয়াউমা ওয়াছমনী মিন শাউমিহি ওয়াজতানিবনী আম্মা আখাফু ফীহি মিন নহুছাতিহী ওয়া কুরবাতিহী বিফাদ্বলিকা ইয়া দাফিয়াশ শুরুরি ইয়া মালিকান নুশূরি ইয়া আরহামার রাহিমীন।
অনুরুপভাবে, “জাওয়াহেরুল কুনজ” ৫ম খন্ড,৬১৭ পৃষ্ঠায় আছে,
“মাহে সফরের শেষ বুধবার ‘সপ্তসালাম’ লিখে তা পানিতে ধুয়ে পানিটুকু পান করবে।”
আবদুল হাই লক্ষৌনভী সাহেব তার ” মজমুয়ায়ে ফতওয়ায়”ও একথা উল্লেখ করেছেন।
” তাযকিরাতুল আওরাদ” কিতাবে উল্লেখ আছে-
‘ যে ব্যক্তি আখেরী ছাহার শোম্বার প্রত্যেক ওয়াক্ত নমাযের পর আয়াতে রহমত( সাত সালাম) পাঠ করে নিজের শরীরে ফুঁক দেয় বা তা পানের উপর লিখে ধুয়ে পান করে, আল্লাহ পাক তাকে সবরকম বালা মুছিবত ও রোগব্যাধি হতে নিরাপদ রাখবেন।’
“আনওয়ারুল আউলিয়া” কিতাবে বর্নিত আছে-
যে ব্যক্তি আখেরী ছাহার শোম্বার দিন দুই রাকাত নফল নামায আদায় করবে আল্লাহ পাক তাকে হ্রদয়ের প্রশস্ততা দান করবেন। প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতিহার পর ১১বার সূরা এখলাস।নামায শেষে ৭০ বার দরুদ শরীফ পড়বে অথবা প্রতি রাকাতে ৩ বার সুরা এখলাস দ্বারা নামায শেষ করে ৮০ বার সুরা আলাম নাশরাহলাকা, সুরা নছর, সুরা ত্বীন ও সুরা এখলাস।