♥বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম♥
স্কুলে ভর্তি হলাম। সপ্তম শ্রেণি দ্বিতীয় বর্ষে! গণিতে রেকর্ড করেছি। তিন পরীক্ষা মিলিয়ে পেয়েছি ০৯। প্রথম পরীক্ষায় জোড়া শূন্য। দ্বিতীয় মেয়াদে চার। বার্ষিকে পাঁচ। উন্নতি হচ্ছিল। ক্রমে নাম্বার বাড়ছিল। কিন্তু স্যাররা মানে না। আমাকে উঠাবে না। ঘাড়ত্যাড়া স্কুল। দ্বিতীয় বর্ষেই ঢুকালো।
বীজগণিত বুঝি না। প্লাস কেন সমান চিহ্নের ওপাশে মাইনাস হয়, স্যারকে জিগাতাম। উত্তর মিলত না। খেতাম ধ্যাতানি। শিক্ষার্থীরা আদুভাই ডাকে। আমার বিকার নেই। জানালা দিয়ে বাহিরে দেখি। আকাশটা কত বিশাল। তোমাদের গণিত তোমরা রাখো। দিনে দিনে তালগাছ হচ্ছিলাম। বেঁচে থাকি একাকী। আকাশের ঠিকানায় চিঠি লেখি।
দেখতে খারাপ ছিলাম না। রাজপুত্তুর না হলেও মন্ত্রীপুত্র ছিলাম! এখন অবশ্য গোপালভাঁড়। ভূরি বেড়েছে। টাক তালুতে টোকাচ্ছে।
যাহোক, কয়েক মাস গেল। টিফিনে সবাই বেরোতো। আমি চুপচাপ বসতাম। হ্যাগার্ডের উপন্যাস পড়তাম। একটা বিষয় খেয়াল করলাম। কয়েকটা মেয়েও ইদানীং বেরোয় না। ক্লাসেই থাকে। খিলখিল হাসে। তাকাতাম না। লজ্জা না; ভাল্লাগতো না।
আরো কয়েক হপ্তা গেল। টিফিন হয়েছে। ছোটঘরে গেলাম। প্রকৃতির ডাক এসেছে। হাত ধুয়ে বেরিয়েছি। দেখি একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। চিনতাম না। চলে আসছিলাম। মেয়েটা ডাকলো। থামলাম।
– জ্বী, কিছু বলবেন?
– আমি না, লিমা বলবে!
লিমা কে চিনছি না। অবাকও হচ্ছি। স্কুলে আমার যে সম্মান, তাতে কোনো মেয়ে কথা বলবে না। এটাই স্বাভাবিক।
– মাফ করবেন, কোন লিমা? কোথায় সে? আপনি কে?
– আমাকে চিনছো না!আমি লিমার বান্ধবী। তুমি, আমি, লিমা এক ক্লাসে পড়ি। ঐ যে, ওদিকে লিমা।
মেয়েটা ইশারায় দেখালো। তাকালাম। করিডোরের শেষ মাথায় কেউ দাঁড়িয়ে। এখন টিফিন। সবাই ক্যান্টিনে। তিন-চার তলা প্রায় ফাঁকা। মেয়েটা আরও নির্জনে দাঁড়িয়ে। ওদিকে কেউ যায় না সচরাচর। এগুলাম। মনে হাজারও প্রশ্ন। আমাকে কেন ডাকবে? পৌঁছালাম মেয়েটার কাছে। তাকালাম। সুন্দরী মেয়ে, ভয়াবহ সুন্দরী! কাঁপছে। দিশেহারা হয়ত।
– কিছু বলবেন?
– গালিব… আমি একটা কথা বলব। কাউকে বলো না। প্লিজ, বলো না।
– জ্বী, চেষ্টা করব।
– তোমাকে মিস করি! বাসায় ভাল্লাগে না। স্কুলে তোমাকে দেখতেই আসি!
– আচ্ছা, এখন কী করতে পারি?
– মানে… মানে… আমি তোমাকে… আই লা…
ব্যস! এতটুকু শুনেছি। একশো আশি ডিগ্রি ঘুরলাম। দিলাম অলিম্পিকের দৌড়। উসাইন বোল্টকেও হারিয়ে দিতাম সেদিন! ক্লাসে ঢুকলাম। এবার আমি কাঁপছি। এরইমধ্যে সবাই ফিরেছে। টিফিন শেষ। স্যারও আসলেন। দাঁড়ালাম।
– স্যার! বাড়ি যাব।
– কেন বাসা কেন? কাছে আসো। কাঁপছ কেন? শরীর খারাপ?
গেলাম। স্যার ছুঁয়ে দেখলেন। আরে তোমার তো জ্বর আসছে, যাও বাসা যাও। বাসায় আসলাম। সাতদিন স্কুলে যাইনি। তিনদিন জ্বর ছিল। “আই লা…” শুনেই এ অবস্থা। পুরোটা শুনলে কী হতো জানি না।
যায়যায় দিন। বাড়ে আমার একাকিত্ব। ঘর বন্ধ করে, অন্ধকারে থাকতাম। নচিকেতা, কবির সুমন শুনতাম। হ্যাগার্ড, কোনান ডয়েল, সত্যজিত, বুদ্ধদেব, মুজতবা আলী পড়তাম। মানসিক রোগ কি না জানি না। মানুষ ভাল্লাগতো না। বেশির ভাগের চেহারায় মৃত্যুর গন্ধ আসত। সমাজ থেকে দূরে থাকতে লাগলাম। এরইমধ্যে ভাই ওয়াইফাই নিল। বাসায় কম্পিউটার ছিল। নেট ঘাঁটতে লাগলাম।
একদিন নাত শুনছি। মদিনা-মুনিব (দ) এঁর প্রশংসা সংগীতকে “নাত” বলে। ওয়াইস রেযা সাহেব গাইছেন। “লাম ইয়াতি নাজিরুকা ফি নাযারিন” ও “মুস্তাফা জানে রহমত পে লাখোঁ সালাম”- নাত দুটো আমাকে স্থবির করে দিল। ভেতরে কোথায় যেন কী হচ্ছিল। অজানা, অদেখা গালিব কাঁদছিল হয়ত। খুঁজলাম নাতের লেখক কে। জানলাম ইমাম আ’লা হযরত। কে তিনি? স্মৃতির আগে আগে যাচ্ছে। মনে পড়ল। আরে, কয়েকমাস আগেই তো জেনেছি! বন্ধু খোরশেদ জানিয়েছিল। সে এক মহাকাব্যের কাহিনী।
সার্চ দিলাম। উইকিপিডিয়া দেখলাম। সেখান থেকে আ’লা হযরত ডট নেট। এরপর ওয়েবসাইট থেকে ওয়েবসাইট। রাতের পর রাত পড়লাম। শুনলাম ইউটিউবে প্রায় সমস্ত নাত। নাত ও বইয়ের ইংরেজি ভাষান্তর পেলাম। একেএকে গিললাম। তাঁর লেখায় একেএকে জ্ঞানের দরজা খুলতে লাগল। অচেনা মহামানবদের চিনলাম। জানলাম মহামানবদের যুগের ইতিহাস। একের সাথে আরেকটা জোড়া লাগানো।
প্রথম জানলাম ইমাম মাতুরিদিকে। তিনি আকাইদের ইমাম। আকাইদ মানে ধর্মের মৌলিকত্ব। তাঁকে জানতে গিয়ে জানলাম মুতাজিলা সম্প্রদায়কে। মুতাজিলা জানতে গিয়ে আব্বাসীদের। আব্বাসীদের জানতে গিয়ে আবু মুসলিম খোরাসানীকে। হালাকু খান হয়ে মোঙ্গল দস্যুদের। আব্বাসীদের সময়টা সভ্যতার স্বর্ণসময়, বাগদাদীযুগ। বাগদাদকে বলা হত নগরসমূহের রাণী। মুসলিম-সভ্যতার অজানা আবিষ্কারে বিস্মিত হলাম। আব্বাসীদের আগে উমাইয়াদের। উমাইয়া থেকে আরব-মাওয়ালী। আরব-মাওয়ালী দ্বন্দ্বের কারণে পারস্য-মুসলিম সাহিত্য-সভ্যতার বিকাশ। জানলাম জামি, রুমি, সাদিদের অতলান্তিক ঋদ্ধতা। সেখান থেকে ইমাম বু’সিরিদের সাহিত্য বিপ্লব। পারস্য সাহিত্য ঘাঁটতে গিয়ে সুপ্রাচীন পারস্য-সভ্যতার গলিঘুপচি ঘুরলাম।
জানলাম ইবনে আরাবীকে। যাঁকে আ’লা হযরত বলেছেন শায়খুল আকবর। শিক্ষকদের শিক্ষক। জানলাম ওয়াহদাতুল ওজুদ তত্ত্ব। চিরন্তন ঐশীদর্শন। অত বুঝতাম না, এখনো বুঝি না। তবুও শরীর শিউরে ওঠে। তাসাউফ, ফালসাফা-দর্শনে আন্দালুসিয়ান বাতাস বইছিল হৃদয়ে। ইবনে আরাবী থেকে উসমানিদের (Ottoman)। উসমানিদের জানতে গিয়ে সেলজুক, জঙ্গী, সাফাভিদ, ফাতেমি, আইয়ুবিদের। আইয়ুবি মানেই সালাউদ্দিন আইয়ুবি। তাঁকে জানতে গিয়ে ক্রুসেড, নাইট, পোপতন্ত্র, ম্যাসনিক চক্রান্ত। চার্চের অত্যাচার, ম্যানর-ইউরোপীয় আর্থসামাজিক ক্রমবিবর্তন।
জানলাম ওহাবি আন্দোলন। সৌদ্দাদের উত্থান। উসমানিয়দের পতন। লরেন্স অব এরাবিয়া, উইলিয়াম হামফ্রে অধ্যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ইসরাইল, জায়োনিজম। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের পাল্টাপাল্টি। সেখান থেকে আজকের আফগান, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন। বুঝলাম আইএস, আলকায়েদার সূতিকাগারের কাহিনী।
আবু হানিফা, মালেক, বিন হাম্বল, শাফেয়ী, তাবারী, তাহাবীদের জানলাম। বুখারি, মুসলিমদের হাদিস সংগ্রহ-সংগ্রামের ইতিহাস জানলাম। কাদেরি, চিশ্তী, নকশবন্দী, সোহরাওয়ার্দী, মাদারি, সাজুলি, মোজাদ্দেদীদের জানলাম। ইসলামের ধারাবাহিকতা জানলাম। জানলাম আমরা কেউ আলাদা নই। কিন্তু স্বতন্ত্র।
আ’লা হযরত শেখালেন খাজার প্রেম; খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতির। খাজাকে চিনতে যেয়ে চিনলাম পৃথ্বীরাজ ও মুহাম্মাদ ঘুরিকে। জানলাম ঘুরিকে ঘিরে ভারতবর্ষে মুসলিম সালতানাত ও প্রবলপ্রতাপ মোঘল সাম্রাজ্যের সোনালি বিকাশ। ভারতে ইসলামের বিজয়রথ। সুফীদের আগমন, ইসলামের ক্রমবিস্তার। সুফীদের বিস্তার বুঝতে গিয়ে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, আফ্রিকায় ঘুরে এলাম। সেখানেও সুফীদের ইসলাম প্রচার দেখলাম। ফকির মজনু শাহ, কেফায়েত উল্লাহ কাফি, আল্লামা হক খয়রাবাদীদের রাজনৈতিক রক্তক্ষয় জানলাম। ভারতকে জানতে গিয়ে হিন্দুদের। হিন্দুদের জানতে গিয়ে হিন্দু মিথলজি। হিন্দু মিথলজির কারণে ইজিপশিয়ান, গ্রেকো-রোমান, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান মিথলজিও ঘুরলাম।
আ’লা হযরত গাউসে পাকের দাসত্ব শেখালেন। গাউসে পাকের দাসত্বে নবীবংশ বা আহলে বাইতকে পেলাম। পেলাম মওলা আলী থেকে হাসনাইন কারিমাইন হয়ে ইমাম জয়নুল আবেদিন, ইমাম জাফর সাদেক এবং বারো ইমামদের। নবীবংশের বৃক্ষকে।
তিনি শেখালেন, সৃষ্টিতে রং দুটি- একটি সবুজ, অন্যটি অসবুজ। শিখলাম, যে মানবিক না সে ধার্মিক না। তিনি দয়া- মানবতা শেখালেন। উলুহিয়াত- উপাসনা শেখালেন।
সবকিছু ছাপিয়ে দান করলেন, মদিনাপ্রেম ও দাসত্ব। অস্তিত্বের পরিচয় দিলেন। দিলেন চেতনা। জীবনের লক্ষ্য। কেন বেঁচে আছি? আমার লক্ষ্যই বা কী? তাঁকে পেয়েই বুঝলাম।
এক বিক্ষিপ্ত কিশোরকে, লক্ষ্যহীন মানুষকে তিনি বাঁচিয়ে তুলেছেন। চরম নৈরাশ্যের এক কিশোরে তিনি আবেহায়াতের সঞ্জীবনী সুধা ঢেলেছেন। তাঁর জন্য দরজা খুলেছি। অন্ধকার ঘরে আলো জ্বালিয়েছি। ধুলোজমা বই পড়তে শিখেছি।
আ’লা হযরত একটি প্যাকেজ। একটি প্যাকেজে যেমন প্রয়োজনীয় সবকিছুই ঢুকানো হয়, এরপর অন্যখানে খুঁজতে হয় না, তেমনি ইমাম আ’লা হযরতকে জানতে থাকলে সব পাওয়া যায়। তিনি টেনেটেনে সবক্ষেত্রে ঘুরিয়ে আনেন।
প্রথমবার প্রেমে পড়লাম। কাউকে ‘আই লাভ ইউ’ বলিনি। এবার একজন পেয়েছি। কিন্তু সে না চাইলে আমার সাধ্য নেই দেখা পাওয়ার।
বিরহের প্রেমানলে দিন পুড়ছিল। একদিন ঘুমিয়েছি। সে আসলো! ফুলঝরা পথে হেঁটে। ডাকলাম তাঁকে। তিনি ফিরলেন। হাত বাড়ালেন। কাছে ডাকছেন। আমি দৌড়ে যাব। জড়াব তাঁর কদম। কাঁদব প্রাণ জুড়িয়ে।
তখনই কেউ পিছে টানলো। কৃষ্ণগহ্বরের মত গিলছে আমাকে। দূরত্ব বাড়ছে। হারিয়ে যাচ্ছে সে। চেঁচিয়ে উঠলাম। প্রথমবার কাউকে বললাম- আই.. লাভ.. ইউ.. আ’লা.. হযরত! আই লাভ ইউ!