আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আজকে আমরা এই আর্টিকেলে তুলে ধরেছি ২০ টি অসাধারণ ইসলামীক শিক্ষণীয় গল্প, গল্পগুলি কাল্পনিক অবাস্তব বা মনগড়া কোন কাহিনী নয়। প্রতিটি গল্প হাদিস গ্রন্থ থেকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। শিক্ষণীয় এ গল্পগুলিতে শিশু- কিশোরসহ সর্বশ্রেণীর পাঠকই উপকৃত হবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। প্রতিটি গল্পের শেষে শিক্ষণীয় বিষয় সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছে। যাতে গল্পের মৌলিক শিক্ষাটি অনুধাবন করতে পাঠকের কষ্ট না করতে হয়। সাথে সাথে পাঠকের নৈতিক চরিত্র ও সুস্থ মননশীলতা বিকাশে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। বলা বাহুল্য গল্প বর্ণনার মূল উদ্দেশ্য এটাই।
শিক্ষনীয় গল্প গুলো
১. আবুবকর (রাঃ)-এর ঈমানী দৃঢ়তা
(১) খলীফা আবুবকর (রাঃ) খেলাফতের গুরু দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন। রাসূল (ছাঃ)-এর প্রেরিত সেনাবাহিনী তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে মদীনায় ফিরে এসেছে। এক্ষণে তাদের রাজধানী রক্ষার জন্য মদীনায় রাখা হবে, না পুনরায় প্রেরণ করা হবে- এ নিয়ে শীর্ষস্থানীয় ছাহাবীগণের মধ্যে আলোচনা হ’ল। অধিকাংশের পরামর্শ হ’ল, এ মুহূর্তে রাজধানী মদীনাকে রক্ষা করাই হবে সবচেয়ে বড় কর্তব্য। তাছাড়া সেনাপতি পরিবর্তন করাও আবশ্যক। কেননা সে হ’ল বয়সে তরুণ এবং গোলামের পুত্র উসামা বিন যায়েদ বিন হারেছাহ (রাঃ)। আনছার ও মুহাজির সেনারা তাঁর নেতৃত্ব মানতে চাইবে না। খলীফা আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বললেন, ‘মদীনার রক্ষাকর্তা আল্লাহ । যুদ্ধে বিজয় দানের মালিকও আল্লাহ। আর ইসলামে সাদা-কালোর কোন ভেদাভেদ নেই। অতএব মৃত্যুর পূর্বে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যার মাথায় জিহাদের পাগড়ী বেঁধে যে উদ্দেশ্যে তাকে প্রেরণ করেছিলেন, আমি সে পাগড়ী খুলে নিতে পারব না’। অতঃপর আল্লাহ্র নামে তিনি সেনাবাহিনীকে খৃষ্টান পরাশক্তির বিরুদ্ধে রওয়ানা হবার নির্দেশ দিলেন এবং যুদ্ধ শেষে যথারীতি তারা বিজয়ী বেশে মদীনায় ফিরে এল। চারিদিকে শত্রু-মিত্র সবার মধ্যে নতুন মাদানী রাষ্ট্র সম্পর্কে শ্রদ্ধার আসন দৃঢ় হ’ল (আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ 9/820) 1
(২) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর যাকাত জমা দিয়ে তাঁর দো’আ পাবার সুযোগ নেই- এই অজুহাতে একদল লোক নতুন খলীফার নিকটে যাকাত জমা করতে অস্বীকার করল। শূরার বৈঠক বসল। খলীফা আবুবকর (রাঃ) ওদের বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করতে চাইলেন। কিন্তু শূরা দ্বিমত পোষণ করল। এমনকি ওমর (রাঃ) বললেন, হে খলীফা! তারা যে কলেমাগো মুসলমান । আপনি কিভাবে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন? খলীফা বলে উঠলেন, আল্লাহ্র কসম! আমি ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবশ্যই যুদ্ধ করব, যে ব্যক্তি ছালাত ও যাকাতের দু’টি ফরয (একটি হাক্কুল্লাহ অন্যটি হাক্কুল ইবাদ)-এর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে? আল্লাহ্র কসম! রাসূল (ছাঃ)-এর সময়ে যাকাত হিসাবে জমাকৃত একটি বকরীর দড়িও যদি কেউ আজকে দিতে অস্বীকার করে, আমি অবশ্যই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব’। ওমর (রাঃ) বলেন, আল্লাহর কসম, আমি দেখলাম আল্লাহ আবুবকরের বক্ষকে যুদ্ধের জন্য সুপ্রশস্ত করে দিয়েছেন। ফলে আমি বুঝতে পারলাম তিনি হক-এর উপরই প্রতিষ্ঠিত আছেন’ (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৭৯০)। এই যুদ্ধের ফলে ভবিষ্যতে আর কেউ কোন ফরয বিধানকে হালকা করে দেখার সাহস পায়নি এবং এভাবে হাক্কুল ইবাদ রক্ষার ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের আর্থিক ভিত মযবুত হ’ল। গরীবদের অধিকার রক্ষা পেল।
শিক্ষা : আবুবকর (রাঃ)-এর অপূর্ব ঈমানী দৃঢ়তার স্বাক্ষর উপরোক্ত ঘটনা দু’টি। এর মাধ্যমে তিনি হাক্কুল ইবাদ কঠোরভাবে রক্ষা করলেন। সাথে সাথে ইসলামের কোন ফরয ইবাদতকে হালকা করে দেখার যে কোন অবকাশ নেই- সেটিও জনগণকে বুঝিয়ে দিলেন।
২. আবুবকর (রাঃ)-এর মৃত্যুকালীন অছিয়ত
ইসলামের ১ম খলীফা আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ)-এর মৃত্যুক্ষণ উপস্থিত হ’লে তিনি সূরা ক্বাফ-এর ১৯নং আয়াতটি তেলাওয়াত করেন (‘মৃত্যুযন্ত্রণা অবশ্যই আসবে; যা থেকে তুমি টালবাহানা করে থাক’)। অতঃপর তিনি স্বীয় কন্যা আয়েশা (রাঃ)-কে বললেন, আমার পরিহিত দু’টি কাপড় ধুয়ে তা দিয়ে আমাকে কাফন পরিয়ো। কেননা মৃত ব্যক্তির চাইতে জীবিত ব্যক্তিই নতুন কাপড়ের অধিক হকদার (মুসনাদে আবী ইয়া’লা হা/৪৪৫১)। অতঃপর তিনি পরবর্তী খলীফা হযরত ওমর (রাঃ)-কে অছিয়ত করেন এই মর্মে যে, ‘নিশ্চয়ই রাত্রির জন্য আল্লাহ এমন কিছু হক নির্ধারণ করে রেখেছেন, যা তিনি দিবসে কবুল করেন না। আবার দিবসের জন্য এমন কিছু হক নির্ধারণ করেছেন, যা রাতে কবুল করেন না। কোন নফল ইবাদত কবুল করা হয় না, যতক্ষণ না ফরযটি আদায় করা হয়। নিশ্চয়ই আখেরাতে মীযানের পাল্লা হালকা হবে দুনিয়ার বুকে বাতিলকে অনুসরণ করা এবং নিজের উপর তা হালকা মনে করার কারণে। অনুরূপভাবে আখেরাতে মীযানের পাল্লা ভারী হবে দুনিয়াতে হক অনুসরণ করা এবং তাদের উপর তা ভারী হওয়ার কারণে’ (মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, হা/৩৫৫৭৪)।
শিক্ষা : রাষ্ট্রীয় গুরুদায়িত্ব পালনকারীর জন্য অলসতা ও বিলাসিতার কোন সুযোগ নেই। তাকে কোন অবস্থাতেই বাতিলের সাথে আপোষ করা চলবে না। বরং যেকোন মূল্যে সর্বাবস্থায় হক তথা আল্লাহ প্রেরিত সত্যকে কঠিনভাবে আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে। কেননা দুনিয়াতে সকল কাজের উদ্দেশ্য হবে আখেরাতে মীযানের পাল্লা ভারী করা।
৩. আবুবকর (রাঃ)-এর গোপন আমল
ইসলামের প্রথম খলীফা আবুবকর (রাঃ) ফজরের ছালাত আদায় করে মরুভূমির দিকে হাঁটাহাঁটি করতেন এবং কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থানের পর শহরে ফিরে আসতেন। ওমর (রাঃ) তাকে প্রতিদিন শহরের বাইরে ঘোরাফিরা করতে দেখে কৌতূহল বোধ করলেন। তাই একদিন ফজরের ছালাতের পর আবুবকর (রাঃ) যখন বের হলেন, তখন তিনি পায়ে পায়ে তাঁকে অনুসরণ করতে লাগলেন। অতঃপর আবুবকর (রাঃ) মরুভূমিতে হাঁটতে হাঁটতে একটি পুরাতন তাঁবুতে প্রবেশ করলে ওমর (রাঃ) একটি টিলার পিছনে লুকিয়ে থাকলেন সন্তর্পণে। কিছুক্ষণ পর আবুবকর (রাঃ) সেই তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসে আবার শহরের পথ ধরলেন। এদিকে ওমর (রাঃ) টিলার আড়াল থেকে বের হলেন এবং উক্ত তাঁবুতে প্রবেশ করলেন। সেখানে তিনি এমন একজন অন্ধ দুর্বল মহিলাকে দেখতে পেলেন, যার কয়েকটি শিশু সন্তান রয়েছে। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান, তোমার নিকটে কে আসে? মহিলা বলল, আমি তাকে চিনি না। তিনি একজন মুসলিম। প্রতিদিন সকালে তিনি আমাদের বাড়িতে এসে আমাদের গৃহ পরিষ্কার করেন। তারপর রুটি তৈরীর জন্য আটা পিষে এবং গৃহপালিত পশুগুলির দুগ্ধ দোহন করে চলে যান। একথা শুনে ওমর (রাঃ) বিস্ময়াভিভূতভাবে বেরিয়ে আসলেন এবং স্বগতোক্তি করলেন, হে আবুবকর! পরবর্তী খলীফাদের উপর তুমি কত কষ্টই না চাপিয়ে দিলে’! (তারীখু মাদীনাতি দিমাশক)।
শিক্ষা : অসহায় গরীব-দুঃখীদের খোঁজ-খবর নেয়া ও তাদেরকে সহযোগিতা করা রাষ্ট্র প্রধানের কর্তব্য।
৪. নীলনদের প্রতি ওমর (রাঃ)-এর পত্র
২০ হিজরী সনে দ্বিতীয় খলীফা ওমর (রাঃ)-এর শাসনামলে বিখ্যাত ছাহাবী আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে সর্বপ্রথম মিসর বিজিত হয়। মিসরে তখন প্রবল খরা । নীলনদ পানি শূন্য হয়ে পড়েছে। সেনাপতি আমরের নিকট সেখানকার অধিবাসীরা অভিযোগ করে বলল, হে আমীর ! নীলনদ তো একটি নির্দিষ্ট নিয়ম পালন ছাড়া প্রবাহিত হয় না। তিনি বললেন, সেটা কি? তারা বলল, এ মাসের ১৮ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আমরা কোন এক সুন্দরী যুবতীকে নির্বাচন করব। অতঃপর তার পিতা-মাতাকে রাযী করিয়ে তাকে সুন্দরতম অলংকারাদি ও উত্তম পোষাক পরিধান করানোর পর নীলনদে নিক্ষেপ করব।
আমর ইবনুল ‘আছ তাদেরকে বললেন, ইসলামে এ ধরনের কাজের কোন অনুমোদন নেই। কেননা ইসলাম প্রাচীন সব জাহেলী রীতি-নীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। অতঃপর তারা পর পর তিন মাস পানির অপেক্ষায় কাটিয়ে দিল। কিন্তু নীলনদের পানি বৃদ্ধির কোন লক্ষণ দেখা গেল না। অতঃপর সেখানকার অধিবাসীরা দেশত্যাগের কথা চিন্তা করতে লাগল। এ দুর্যোগময় অবস্থা দৃষ্টে সেনাপতি আমর ইবনুল আছ (রাঃ) খলীফা ওমর (রাঃ)-এর নিকটে পত্র প্রেরণ করলেন। উত্তরে ওমর (রাঃ) লিখলেন, হে আমর! তুমি যা করেছ ঠিকই করেছ। আমি এ পত্রের মাঝে একটি পৃষ্ঠা প্রেরণ করলাম। এটা নীলনদে নিক্ষেপ করবে।’ ওমরের পত্র যখন আমরের নিকটে পৌছাল, তখন তিনি পত্রটি খুলে দেখলেন সেখানে এ বাক্যগুলি লেখা রয়েছে- ‘আমীরুল মুমিনীন ওমর-এর পক্ষ থেকে মিসরের নীলনদের প্রতি। যদি তুমি নিজে নিজেই প্রবাহিত হয়ে থাক, তবে প্রবাহিত হয়ো না। আর যদি একক সত্তা, মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তোমাকে প্রবাহিত করান, তবে আমরা আল্লাহ্র নিকটে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন তোমাকে প্রবাহিত করেন’। অতঃপর আমর (রাঃ) পত্রটি নীলনদে নিক্ষেপ করলেন। পর দিন শনিবার সকালে মিসরবাসী দেখল, আল্লাহ তা’আলা এক রাতে নীলনদের পানিকে ১৬ গজ উচ্চতায় প্রবাহিত করে দিয়েছেন। তারপর থেকে আজও পর্যন্ত নীলনদ প্রবাহিতই রয়েছে। কখনো বিশুষ্ক হয়নি (আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৭/১০০; তারীখু মাদীনাতি দিমাশক ৪৪/৩৩৭: তাবাকাতুশ শাফিইয়্যাহ আল-কুবরা ২/৩২৬)।
শিক্ষা : আল্লাহ্র হুকুমেই পৃথিবীর সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে। তাঁর নির্দেশ ব্যতীত গাছের একটা পাতাও নড়ে না। অতএব যেকোন দুর্যোগে কেবল তাঁর কাছেই সাহায্য চাইতে হবে। কোন জাহেলী ও শিরকী পন্থার আশ্রয় নেয়া যাবে না।
৫. রাষ্ট্রপ্রধানের জবাবদিহিতা
মুহাম্মাদ বিন ওবায়দুল্লাহ হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা দ্বিতীয় খলীফা ওমর (রাঃ)-এর নিকটে কিছু কাপড় আসলে তিনি সেগুলি হকদারগণের মাঝে বণ্টন করে দেন। এতে আমাদের প্রত্যেকে একটি করে কাপড় পেল। কিন্তু তিনি নিজে দু’টি কাপড় দিয়ে তৈরী একটি পোষাক পরিধান করে খুত্বা দিতে মিম্বরে আরোহণ করলেন। কিন্তু শ্রোতাদের অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, হে লোকসকল! তোমরা কি আমার কথা শ্রবণ করছ না? এমতাবস্থায় বিখ্যাত ছাহাবী সালমান ফারেসী (রাঃ) উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, জি না, আমরা শ্রবণ করব না। ওমর (রাঃ) বললেন, কেন হে আবু আব্দুল্লাহ? তিনি বললেন, আপনি আমাদেরকে একটি করে কাপড় দিয়েছেন। অথচ আপনি পরিধান করেছেন (দুই কাপড়ের) বড় পোষাক! ওমর (রাঃ) বললেন, ব্যস্ত হয়ো না হে আবু আব্দুল্লাহ! অতঃপর তিনি ছেলে আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ)-এর দিকে ইশারা করলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। অতঃপর ওমর (রাঃ) বললেন, আমি আল্লাহ্র কসম করে জিজ্ঞেস করছি, আমার পোষাকে যে অতিরিক্ত কাপড় রয়েছে, সেটা কি তোমার নয়? আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) বললেন, জি, আমার । অতঃপর সালমান ফারেসী (রাঃ) বললেন, এখন আপনি বক্তব্য শুরু করুন, আমরা শ্রবণ করব (ইবনুল কাইয়িম, ই’লামুল মুওয়াক্কেঈন ২/১২৩: ছিফাতুছ ছাফওয়াহ ১/২০৩)।
শিক্ষা : রাষ্ট্রপ্রধান জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নন। তাঁকে পরকালে যেমন আল্লাহ্র কাছে তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে, তেমনি দুনিয়াতেও তিনি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন।
৬. আমানতদারিতার অনন্য দৃষ্টান্ত
ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ১৬ হিজরীতে মুসলিম সৈন্যদল মাদায়েন জয় করেছে। গণীমতের মাল জমা হচ্ছে। এমন সময় এক ব্যক্তি মহামূল্যবান ধন- রত্ম নিয়ে এল। জমাকারী বললেন, এমন মূল্যবান সম্পদ তো আমরা ইতিপূর্বে দেখিনি। তুমি এখান থেকে নিজের জন্য কিছু রেখে দাওনি তো ভাই? লোকটি বলল, ‘আল্লাহ্র কসম! যদি আল্লাহ্ ভয় না থাকত, তাহ’লে আমি কখনোই এ সম্পদ আপনাদের কাছে নিয়ে আসতাম না’। সবাই তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি অস্বীকার করে বলেন, যদি আমি পরিচয় দেই, তাহ’লে আপনারা আমার প্রশংসা করবেন। অথচ আমি কেবল আল্লাহ্র প্রশংসা করি এবং তাঁর নিকটেই প্রতিদান কামনা করি এরপর তিনি চলে গেলেন। তখন তার পিছনে একজন লোককে পাঠানো হ’ল এবং জানা গেল যে, তিনি হলেন, আমের বিন আবদে কায়েস (তারীখুত ত্বাবারী ২/৪৬৫)।
শিক্ষা : আমানতদারিতা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পক্ষান্তরে আমানতের খেয়ানত করা মুনাফিকের অন্যতম লক্ষণ।
৭. পাত্রী নির্বাচন
ওমর (রাঃ) জনসাধারণের সঠিক অবস্থা জানার জন্য রাত্রিতে ঘুরে বেড়াতেন । এক রাতে একটি ছোট্ট কুটিরের সামনে এলে তিনি বাড়ীর ভিতরের কথাবার্তা শুনতে পেলেন। মা মেয়েকে আদেশ করছেন, দুধের সাথে পানি মিশাও। ভোর হয়ে এল’। মেয়েটি উত্তর দিল, ‘না মা, ওমর (রাঃ) দুধে পানি মিশাতে নিষেধ করেছেন । তিনি জানতে পারলে শাস্তি দিবেন’।
মা বললেন, ‘ওমর দেখতে পেলে তো? মেয়ে বলল, ‘আমি প্রকাশ্যে তাঁর আনুগত্য করব, আর গোপনে তাঁর অবাধ্যতা করব? আল্লাহর কসম! এটা আমার পক্ষে মোটেই সম্ভব নয়। অন্য বর্ণনায় এসেছে, সে বলল, ওমর (রাঃ) হয়ত আমাদেরকে দেখছেন না, কিন্তু তাঁর প্রভু তো আমাদেরকে দেখছেন! গোপনে সব শুনে ওমর (রাঃ) বাড়ীটি চিহ্নিত করে ফিরে এলেন। পরে তার ছেলে আছেমের সাথে ঐ মেয়ের বিবাহ দিলেন। তার গর্ভে দু’টি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করল, যাদের একজনের গর্ভে ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ)-এর জন্ম হয়েছিল (তারীখু মাদীনাতি দিমাশক ৭০/২৫৩)।
শিক্ষা : পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে অন্যান্য সকল গুণের উপর দ্বীনদারী ও আল্লাহভীরুতাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
৮. ন্যায়পরায়ণ শাসক
ওমর ফারূক (রাঃ) কৃষ্ণায় একজন গভর্ণর নিয়োগ করেছিলেন। এমনিতেই সমস্ত ছাহাবা ন্যায়পরায়ণ, সৎ ও নিষ্ঠাবান ছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে গভর্ণর আরো একধাপ অগ্রগামী ছিলেন। তাঁর চোখে বিচারাদি সহ সকল বিষয়েই ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, উঁচু-নীচু এবং ছোট-বড় সমান ছিল। কোন ব্যাপারে কারো কোন তোয়াক্কা না করে ন্যায়সঙ্গতভাবে বিচারাদি ও শাসন কাজ চালাতেন। এতে করে এক শ্রেণীর হোমড়া-চোমড়া ও ধনাঢ্য ব্যক্তি অসন্তুষ্ট হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করল। তারা বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পারল, গভর্ণর ওমর (রাঃ)-এর সাথে সাক্ষাত করার জন্য মদীনা যাবেন। এই সুযোগে চাঁদা তুলে দুই হাযার দীনার জমা করে তাদের কয়েকজন মদীনা যাত্রা করল। সেখানে পৌছে গভর্ণর যখন ওমর ফারূক (রাঃ)-এর সাথে দেখা করার জন্য গেলেন, তখন তারাও সেখানে হাযির হল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কারা? কোথা থেকে এসেছেন? কি চান? তারা বলল, আমরা কৃষ্ণার নাগরিক এবং সেখান থেকেই এসেছি। তেমন কোন কাজ নেই। বেড়াতে এসেছি এবং সামান্য একটি ব্যাপার নিয়ে আপনার সাথে দেখা করতে আসলাম। তিনি বললেন, কোন্ ব্যাপারে? তারা বলল, আপনার এই অলী (গভর্ণর) বায়তুল মালের সম্পদ আত্মসাৎ করে আমাদের নিকট এই দুই হাযার দীনার জমা রেখেছিল। ওটা আপনাকে ফেরৎ দিতে এলাম। ফারূকে আযম (রাঃ) গভর্ণরকে প্রশ্ন করলেন, তাদের অভিযোগ কি সত্য? তিনি বললেন, না তারা মিথ্যা বলেছে। আমি ওদের নিকট চার হাযার দীনার জমা রেখেছিলাম । কিন্তু তারা দুই হাযার আত্মসাৎ করে বাকী দুই হাযার জমা দিতে এসেছে। ওমর ফারূক (রাঃ) বললেন, তুমি একাজ কেন করলে? তিনি উত্তরে বললেন, আমি মরে যাবার পর ছেলে-মেয়েদের জীবিকা যেন ভালভাবে চলে সেজন্য। তারা গভর্ণরকে বিপদে ফেলতে এসে নিজেরাই বিপাকে পড়ে গিয়েছে ভেবে আমীরুল মুমিনীন ওমর ফারূক (রাঃ)-এর নিকট ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে বলল, হে আমীরুল মুমিনীন, আপনার এই অলী (গভর্ণর খুবই কড়া শাসক । শাসন কাজ চালাতে গিয়ে আমাদের কোন পরামর্শ নেন না এবং আমাদের মান-সম্মানের দিকে লক্ষ্য রেখে একটুও এদিক-ওদিক করেন না। এতে করে আমাদের মান-সম্মান ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, কাজেই তাকে আমাদের ওখান থেকে সরাবার জন্য আমরা চাঁদা তুলে দুই হাযার দীনার জমা করে এই ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছিলাম। আসলে উনি আমাদের নিকট দুই হাযার তো দূরের কথা দুই দীনারও রাখেননি। ওমর ফারূক (রাঃ) উক্ত গভর্ণরকে লক্ষ্য করে বললেন, কি ব্যাপার! তিনি উত্তরে বললেন, এখন ওরা ঠিক বলছে। ফারূকে আযম তাঁর গভর্ণরের বুদ্ধিমত্তা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলেন। সে কিভাবে শত্রুর মুখ থেকেই তার সততা ও ওদের চক্রান্তের কথা বের করে নিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে অলী! তুমি কেন এ ধরনের কৌশল অবলম্বন করলে? তিনি উত্তরে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন, তারাতো কয়েকজন। একজন দাবী পেশ করেছে, তার সাথে ক’জন সাক্ষী আছে। কিন্তু আমারতো সাক্ষী নেই। কাজেই কৌশল অবলম্বন ছাড়া আরতো কোন উপায় ছিল না। আমীরুল মুমিনীন তাঁকে ধন্যবাদ জানালেন।
শিক্ষা : ন্যায়পরায়ণ শাসকের কাছে ধনী-গরীব সবাই সমান। তিনি সৎভাবে রাষ্ট্র চালালে আল্লাহপাক তাকে যেকোন বিপদ-আপদে সাহায্য করবেন।
৯. কাযী শুরাইহ-এর ন্যায়বিচার
কাযী শুরাইহ বিন হারেছ আল-কিন্দী ইসলামের ইতিহাসে ন্যায়পরায়ণতা, বুদ্ধিমত্তা ও অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী একজন খ্যাতনামা কিংবদন্তী বিচারপতি ছিলেন। তিনি একাধারে ওমর, ওছমান, আলী এবং মু’আবিয়া (রাঃ)-এর শাসনামলে বিচারপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ৬০ বছর যাবৎ বিচারকার্য পরিচালনার পর ৭৮ হিজরী সনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার নিরপেক্ষ বিচারের দীপ্তিমান ইতিহাস সর্বযুগের জন্যই অনুপ্রেরণার উৎস। নিম্নে তার দু’টি ঘটনা বিবৃত হ’ল-
১. ইসলামের ২য় খলীফা ওমর (রাঃ) একদা এক ব্যক্তির নিকট থেকে ভালভাবে দেখেশুনে একটি ঘোড়া ক্রয় করলেন। অতঃপর ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে স্বীয় গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পর ঘোড়াটি অসুস্থ হয়ে পড়ল এবং খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে লাগল । ওমর (রাঃ) কালবিলম্ব না করে সরাসরি বিক্রেতার নিকটে ফিরে এলেন এবং তাকে বললেন, তুমি তোমার ঘোড়া ফিরিয়ে নাও, এটা ত্রুটিযুক্ত। বিক্রেতা বলল, হে আমীরুল মুমিনীন! আমি ঘোড়াটি ফেরত নিব না, কেননা আপনি তা সুস্থ ও সবল অবস্থাতেই আমার নিকট থেকে ক্রয় করেছেন। ওমর (রাঃ) বললেন, ঠিক আছে, তাহ’লে তোমার মাঝে ও আমার মাঝে একজন বিচারক নির্ধারণ করো। বিক্রেতা বললেন, ঠিক আছে, কাযী শুরাইহ আমাদের মাঝে ফায়ছালা করবেন। ঘটনার বর্ণনাকারী শা’বী বলেন, তারা উভয়েই শুরাইহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লেন এবং তার নিকটে পৌঁছে তাকে প্রকৃত ঘটনা বিবৃত করলেন। কাযী শুরাইহ ঘোড়ার মালিকের অভিযোগ শ্রবণ করে ওমর (রাঃ)- কে বললেন, আপনি কি ঘোড়াটিকে সবল ও সুস্থ অবস্থায় কিনেছিলেন? ওমর (রাঃ) বললেন, জি হ্যাঁ। বুদ্ধিমত্তা ও ন্যায়পরায়ণতার মূর্ত প্রতীক কাযী শুরাইহ ঘোষণা করলেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি যা ক্রয় করেছেন তা গ্রহণ করে সন্তুষ্ট হৌন অথবা যে অবস্থায় ঘোড়াটিকে গ্রহণ করেছিলেন, সে অবস্থায় ফেরত প্রদান করুন। হতচকিত খলীফা মুগ্ধ দৃষ্টিতে কাযী শুরাইহের দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ! এটাই তো ন্যায়বিচার। হে বিচারপতি! আপনি কৃষ্ণায় গমন করুন। আমি আপনাকে কুফার প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ দান করলাম (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ ৯/২৫)।
২. ৪র্থ খলীফা আলী (রাঃ) একদিন বাজারে গিয়ে দেখেন, জনৈক খৃষ্টান লোক একটা লোহার বর্ম বিক্রি করছে। আলী (রাঃ) তৎক্ষণাৎ বর্মটি চিনে ফেললেন এবং বললেন, এ বর্ম তো আমার। চল, আদালতে তোমার ও আমার মধ্যে ফায়ছালা হবে। সেসময় ঐ আদালতের বিচারক ছিলেন কাযী শুরাইহ। তিনি যখন আমীরুল মুমিনীনকে আসতে দেখলেন, তখন তাঁর বসার স্থান থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং আলী (রাঃ)-কে নিজ স্থানে বসিয়ে তিনি তাঁর পাশে বসলেন । আলী (রাঃ) বিচারপতি শুরাইহকে বললেন, এই ব্যক্তির সাথে আমার বিরোধ মিটিয়ে দিন। শুরাইহ বললেন, আমীরুল মুমিনীন! আপনার বক্তব্য কি? আলী বললেন, এই বর্মটি আমার। অনেক দিন হ’ল এটি হারিয়ে গেছে । আমি তা বিক্রয় করিনি, কাউকে দানও করিনি। শুরাইহ বললেন, ওহে খৃষ্টান! আমীরুল মুমিনীন যা বলছেন, সে ব্যাপারে তুমি কী বলতে চাও? সে বলল, আমি আমীরুল মুমিনীনকে মিথ্যাবাদিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করছি না, তবে বর্মটি আমারই। শুরাইহ বললেন, বর্মটিতো এই ব্যক্তির দখলে রয়েছে। কোন প্রমাণ ছাড়া তার কাছ থেকে সেটা নেয়া যাবে বলে আমি মনে করি না। আপনার কাছে কোন প্রমাণ আছে কি? আলী (রাঃ) হেসে ফেললেন এবং বললেন, শুরাইহ ঠিকই বলেছেন। আমার নিকট তো কোন প্রমাণ নেই। নিরুপায় শুরাইহ সত্য জানা সত্ত্বেও প্রমাণের অভাবে খৃষ্টানের পক্ষেই রায় দিলেন এবং সে বর্মটি গ্রহণ করে রওয়ানা হ’ল। কিন্তু কিছু দূর গিয়ে সে আবার ফিরে এল এবং বলল, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এটাই নবীদের বিধান ও শিক্ষা । আমীরুল মুমিনীন নিজের দাবী বিচারকের সামনে পেশ করেছেন, আর বিচারক তার বিপক্ষে রায় দিচ্ছেন। আল্লাহ্র কসম, হে আমীরুল মুমিনীন! এটা আপনারই বর্ম। আমি এটা আপনার কাছে বিক্রয় করেছিলাম। পরে তা আপনার মেটে রঙের উটটির উপর থেকে ছিটকে পড়ে গেলে আমি ওটা তুলে নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহ্র রাসূল। আলী (রাঃ) বললেন, তুমি যখন মুসলমান হয়ে গেলে, তখন এ বর্ম এখন থেকে তোমার। অতঃপর আলী (রাঃ) তাকে ভাল দেখে একটা ঘোড়াও উপহার দিলেন এবং তাতে চড়িয়ে তাকে বিদায় দিলেন।
ইমাম শা’বী বলেন, আমি পরবর্তীকালে এই নওমুসলমানকে নাহরাওয়ানের যুদ্ধে খারেজীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে দেখেছি। অপর বর্ণনায় শা’বী বলেন, আলী (রাঃ) এছাড়া তার জন্য দু’হাযার দিরহাম ভাতাও নির্ধারণ করে দেন। অবশেষে এই ব্যক্তি ছিফফীনের যুদ্ধে আলী (রাঃ)-এর পক্ষে লড়াই করে শহীদ হন (বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা ১০/১৩৬, হা/২০২৫২; আল-বিদায়াহ ওয়ান- নিহায়াহ ৮/৫)।
শিক্ষা : ইসলাম সর্বাবস্থাতেই ন্যায়বিচারকে সমুন্নত রাখতে বলে। আল্লাহ্ আইনের সামনে রাজা-প্রজা, মুসলিম-অমুসলিম সকলেই সমান। কারো মাঝে কোন বিভেদ করার সুযোগ নেই। তাই ইসলামী বিচারব্যবস্থায় বিচারককে বিচক্ষণ, মহৎ ও সৎসাহসী হওয়ার সাথে সাথে নিরপেক্ষও হতে হয়। হতে হয় সরল-সহজ ও ক্ষমাশীল।
১০. হাক্কুল ইবাদ রক্ষার অনুপম দৃষ্টান্ত
সিরিয়া বিজেতা সেনাপতি আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ (রাঃ) যুদ্ধ কৌশল হিসাবে সিরিয়া থেকে আপাততঃ সৈন্যদল পিছিয়ে অন্যত্র চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। ফলে সিরিয়ার খৃষ্টান নেতৃবৃন্দকে ডেকে তিনি তাদের নিকট থেকে গৃহীত জিযিয়া কর ফেরত দিয়ে দিলেন। এতে শহরের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা দলে দলে এসে ক্রন্দন করতে লাগল ও আকুতি-মিনতি করে বলতে লাগল, আপনারাই আমাদের এলাকা শাসন করুন। আমাদের স্বজাতি খৃষ্টান যালেম শাসকদের হাতে আমাদেরকে পুনরায় ন্যস্ত করবেন না। সেনাপতি বললেন, *আপাততঃ আপনাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়া যেহেতু সম্ভব হচ্ছে না, সেহেতু আপনাদের প্রদত্ত জিযিয়া কর আমরা রাখতে পারি না’। হাক্কুল ইবাদ রক্ষার এই অনুপম দৃষ্টান্ত দেখে তারা খুবই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ল (বালাযুরী, ফুতূহুল বুলদান, পৃঃ ১৩৪)।
শিক্ষা : তরবারির মাধ্যমে ইসলাম প্রসার লাভ করেছে- এ ধারণা সর্বৈব নির্জলা মিথ্যা। বরং মুসলমানদের আদব-আখলাক ও জনগণের অধিকার রক্ষায় তাদের সচেতনতাই এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।
১১. ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ)-এর সাদাসিধে জীবনযাপন
খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয (রাঃ) আড়াই বছর খেলাফতে থাকার পর মাত্র সাড়ে ৩৯ বছর বয়সে শত্রুদের বিষ প্রয়োগে শাহাদত বরণ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হ’ল যে, তিনি দুটি বদ্ধ ঘরে সোনা-দানা ভর্তি করে রেখে গিয়েছেন, যার সবই রাষ্ট্রীয় বায়তুল মাল থেকে তিনি আত্মসাৎ করেছেন। পরবর্তী খলীফা ইয়াযীদ বিন আব্দুল মালেক অভিযোগকারীকে সাথে নিয়ে ওমরের বাড়ীতে গিয়ে উক্ত কক্ষ দু’টি খুললেন। দেখা গেল সেখানে আছে কেবল একটি চামড়ার চেয়ার, একটি পিতলের বদনা, ৪টি পানির কলসি। অন্য ঘরে আছে একটি খেজুর পাতার চাটাই, যা মুছাল্লা হিসাবে রাখা হয়েছে। আর আছে ছাদের সঙ্গে ঝুলানো একটি শিকল। যার নীচে গোলাকার একটি বেড়ী রয়েছে, যার মধ্যে মাথা ঢুকানো যায়। ইবাদতে রাত কাটানোর সময় কাহিল হয়ে পড়লে বা ঝিমুনি আসলে এটা তিনি মাথায় ঢুকিয়ে দিতেন, যাতে ঘুমিয়ে না পড়েন। সেখানে একটি সিন্দুক পেলেন, যার মধ্যে একটি টুকরী পেলেন। যাতে ছিল একটি জামা ও একটি ছোট পাজামা।
আর তাঁর পরিত্যক্ত বস্তুর মধ্যে তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে পেলেন, তালি দেওয়া একটা জামা ও একটি মোটা জীর্ণশীর্ণ চাদর। এ অবস্থা দেখে খলীফা কেঁদে ফেললেন এবং অভিযোগকারী ভাতিজা ওমর ইবনে ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালেক লজ্জিত হয়ে বললেন, ‘আসতাগফিরুল্লাহ’। আমি কেবল লোকমুখে শুনেই অভিযোগ করেছিলাম (আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৯/২২৩)।
শিক্ষা : ইসলামী খিলাফতের খলীফাগণ এমনই মহত্তম দৃষ্টান্ত পৃথিবীবাসীর জন্য রেখে গেছেন, যা শত্রু-মিত্র সকলের জন্য এক চিরন্তন শিক্ষা বহন করে।
১২. আলী বিন হুসায়েন (রহঃ)-এর গোপন আমল
আলী (রাঃ)-এর পৌত্র আলী বিন হুসায়েন (রহঃ) বলতেন, ‘রাতের অন্ধকারে কৃত ছাদাক্বা আল্লাহ্ ক্রোধ দূরীভূত করে’। তাই রাতের আঁধারে তিনি ছাদাক্বার খাদ্যসমূহ পিঠে বহন করে শহরের ফকীর-মিসকীন ও বিধবাদের গৃহে পৌঁছে দিতেন; অথচ তারা জানতে পারতো না কে তাদেরকে সেসব খাদ্যসামগ্রী দিয়ে গেল। আর সবার অজান্তে যাতে এ কাজ করতে পারেন, সেজন্য তিনি কোন খাদেম, দাস বা কারোরই কোন সহযোগিতা নিতেন না। এভাবে অনেক বছর যাবৎ তিনি গোপনে এ কাজ করে যাচ্ছিলেন। অথচ ফকীর ও বিধবারা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি যে, কিভাবে তাদের নিকটে এ খাদ্য আসে। অতঃপর তিনি মৃত্যুবরণ করলে তারা তার পৃষ্ঠদেশে কালো দাগ দেখে বুঝতে পারল যে, তিনি তাঁর পিঠে কিছু বহন করার ফলে এই দাগের সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে তাঁর মৃত্যুর পর শহরে উক্ত গোপন দান বন্ধ হয়ে গেল। রাবী ইবনে আয়েশা বলেন, তাঁর মৃত্যুর পর শহরবাসী বলতে লাগল, আলী বিন হুসায়েন মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা গোপন দান থেকে বঞ্চিত হইনি (হিলইয়াতুল আওলিয়া ৩/১৩৬; ছিফাতুছ ছাফওয়াহ ২/৯৬; আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ৯/১১৪; তাহযীবুল কামাল ১৩/২৪২, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৪/৩৯৩)।
শিক্ষা : মানুষের যেকোন কাজের মূল লক্ষ্য হবে আল্লাহ্ সন্তুষ্টি অর্জন। সে লৌকিকতার জন্য কোন কাজ করবে না।
১৩. ইমাম মাওয়ার্দী (রহঃ)-এর গোপন আমল
ইরাকের বিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত ইমাম মাওয়ার্দী ( ৯৭২-১০৫৮ খ্রিঃ)-এর গোপন আমল সম্পর্কে একটি কাহিনী প্রসিদ্ধ রয়েছে। তিনি তাফসীর, ফিক্বহ, সমাজ ও রাষ্ট্রনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে অনেক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় সেসব গ্রন্থের কোনটিই প্রকাশিত হয়নি। পরে মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে তিনি তাঁর একজন বিশ্বস্ত অনুচরকে ডেকে এনে বললেন, ‘অমুক স্থানে যে বইগুলি রয়েছে সবগুলিই আমার রচিত। যখন আমার মৃত্যুযন্ত্রণা উপস্থিত হবে, তখন তুমি তোমার হাতকে আমার হাতের মধ্যে রাখবে। এসময় যদি আমি আমার হাত টেনে নেই, তাহ’লে তুমি বুঝবে যে, আমার কিছুই আল্লাহ্র নিকটে কবুল হয়নি। এমতাবস্থায় তুমি রাতের আঁধারে আমার সমস্ত লেখনী দজলা নদীতে নিক্ষেপ করবে। আর যদি আমি আমার হাত প্রসারিত করি, তাহ’লে বুঝবে যে, আমার লেখাগুলো আল্লাহ্র নিকটে কবুল হয়েছে। আর আমি আমার খালেছ নিয়তে কৃতকার্য হয়েছি’। অতঃপর মৃত্যুকালে তিনি স্বীয় হাত প্রসারিত করে দিলেন। ফলে তাঁর অছিয়ত মোতাবেক পরবর্তীতে তাঁর সকল লেখনী প্রকাশিত হ’ল (অফায়াতুল আ’ইয়ান ৩/২৮৩: তারীখু বাগদাদ ১/৫৪; তাবাকাতুশ শাফেঈয়্যাহ ৫/২৬৮)।
শিক্ষা : মানুষের প্রতিটি কাজই নিয়তের উপর নির্ভরশীল। নিয়ত পরিশুদ্ধ হলেই কেবল তার নেক আমল আল্লাহ্ নিকট গৃহীত হয়।
১৪. কুরআনের ইলাহী সংরক্ষণ ও একজন ইহুদী পণ্ডিতের ইসলাম গ্রহণ
আব্বাসীয় খলীফা মামূনুর রশীদের দরবারে মাঝে মাঝে শিক্ষা সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হ’ত। এতে তৎকালীন বিভিন্ন বিষয়ের বিদগ্ধ পণ্ডিতগণ অংশগ্রহণ করতেন। একদিন এমনি এক আলোচনা সভায় সুন্দর চেহারাধারী, সুগন্ধযুক্ত উত্তম পোষাক পরিহিত জনৈক ইহুদী পণ্ডিত আগমন করলেন এবং অত্যন্ত প্রাঞ্জল, অলংকারপূর্ণ এবং জ্ঞানগর্ভ আলোচনা রাখলেন। বিস্মিত খলীফা সভা শেষে তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি ইহুদী? তিনি স্বীকার করলেন । মামূন তাকে বললেন, আপনি যদি মুসলমান হয়ে যান তবে আপনার প্রতি সুন্দরতম আচরণ করা হবে। তিনি উত্তরে বললেন, পৈতৃক ধর্ম বিসর্জন দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এই বলে তিনি প্রস্থান করলেন। কিন্তু এক বছর পর তিনি মুসলমান হয়ে আবার দরবারে আগমন করলেন এবং আলোচনা সভায় ইসলামী ফিকহ সম্পর্কে সারগর্ভ ও যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করলেন। সভা শেষে মামূন তাকে ডেকে বললেন, আপনি কি ঐ ব্যক্তি নন, যিনি গত বছর এসেছিলেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ আমিই ঐ ব্যক্তি মামূন জিজ্ঞেস করলেন, তখন তো আপনি ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। এখন মুসলমান হওয়ার কারণ কি?
তিনি বললেন, এখান থেকে ফিরে যাওয়ার পর আমি সমকালীন বিভিন্ন ধর্মগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার মনস্থ করি। আমি একজন সুন্দর লিপিকার। স্বহস্তে গ্রন্থাদি লিখে উঁচু দামে বিক্রয় করি। তাই পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে তাওরাতের তিনটি কপি লিপিবদ্ধ করলাম এবং এগুলির অনেক জায়গায় নিজের পক্ষ থেকে কিছু কমবেশী করে লিখলাম। অতঃপর কপিগুলো নিয়ে আমি ইহুদীদের উপাসনালয়ে উপস্থিত হ’লাম। তারা অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে আমার কপিগুলো কিনে নিল। অতঃপর একইভাবে ইঞ্জীলের তিন কপি করলাম এবং তাতে কমবেশী করে লিখে খৃষ্টানদের গীর্জায় নিয়ে গেলাম। সেখানেও তারা খুব আগ্রহভরে কপিগুলো ক্রয় করে নিল। এরপর আমি কুরআনের ক্ষেত্রেও একই কাজ করলাম এবং এতেও কম-বেশী করে লিখলাম এবং বিক্রয়ের জন্য নিয়ে গেলাম। কিন্তু ক্রয়কারীকে দেখলাম, সে প্রথমে আমার লেখা কপিটি নির্ভুল কি না যাচাই করে দেখল। অতঃপর সেখানে কমবেশী দেখতে পেয়ে ক্রয় না করে কপিগুলো ফেরত দিল।
এ ঘটনা দর্শনে আমি এ শিক্ষাই গ্রহণ করলাম যে, নিশ্চয়ই এ গ্রন্থ সংরক্ষিত, আল্লাহ তা’আলা স্বয়ং এর সংরক্ষক। আর এই উপলব্ধিই আমার ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ালো। এই ঘটনা বর্ণনাকারী কাযী ইয়াহ্ইয়া বিন আকছাম বলেন, ঘটনাক্রমে সে বছরই আমার হজ্জব্রত পালন করার সৌভাগ্য হয়। সেখানে প্রখ্যাত আলেম সুফিয়ান ইবনে উয়ায়নার সাথে সাক্ষাত হ’লে ঘটনাটি আমি তার নিকটে ব্যক্ত করলাম। তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে এরূপ হওয়াই যথার্থ। কারণ কুরআনেই তো এ চিরন্তন সত্যের সমর্থনে আয়াত রয়েছে। তিনি বললেন, কোথায় রয়েছে? সুফিয়ান বললেন, কুরআনে যেখানে তাওরাত ও ইঞ্জীলের আলোচনা এসেছে, সেখানে এসেছে, ‘তাদেরকে আল্লাহ্র কিতাবের হেফাযতের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এবং তারা এ ব্যাপারে সাক্ষী ছিল’ (মায়েদা ৫/৪৪)। অতঃপর যখন তারা দায়িত্ব পালন করেনি তখন গ্রন্থদ্বয় বিকৃত ও পরিবর্তিত হয়ে বিনষ্ট হয়ে গেছে। পক্ষান্তরে কুরআনের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, ‘আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতরণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক’ (হিজর ১৫/৯)। আল্লাহ নিজেই আমাদের জন্য কুরআনকে সংরক্ষণ করেছেন ফলে তা বিনষ্ট হয়নি (আল-মুনতাযাম ১০/৫১; কুরতুবী ১০/৫; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ১/৩৮৮)।
শিক্ষা : অন্যান্য আসমানী গ্রন্থসমূহ কালের বিবর্তনে বিকৃত হয়ে গেলেও কুরআন রয়ে গেছে সম্পূর্ণ অবিকৃত। এটা কুরআনের অন্যতম মু’জিযা।
১৫. বীর সেনানী মুহাম্মাদ বিন কাসিম
বিখ্যাত তরুণ সেনাপতি মুহাম্মাদ বিন কাসিম ঐতিহাসিক সিন্ধু বিজয়ের পর মাত্র সাড়ে তিন বছর সেখানে অবস্থান করেন। তাঁর সুচারু দেশ পরিচালনায় সিন্ধুবাসী এতই মুগ্ধ হয়ে পড়ে যে, যখন তিনি সিন্ধু ছেড়ে রাজধানী দামেশকে ফিরে যাওয়ার মনস্থ করেন, তখন সিন্ধুর অমুসলিম নাগরিকরা পর্যন্ত রাস্তায় কেঁদে গড়াগড়ি দিয়েছিল যেন তিনি এ দেশ থেকে চলে না যান। পরে মিথ্যা অজুহাতে যখন তাঁর মৃত্যুদণ্ড দেয়া হ’ল, সে খবর শুনে অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী তাঁর ‘মূর্তি’ গড়ে পূজা শুরু করে দিয়েছিল (বালাযুরী, ফুতূহুল বুলদান, পৃঃ ৪৪৬)।
শিক্ষা : মুসলিম বিজেতাগণ তাদের সুসভ্য আচরণের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছিলেন। ইতিহাসের সোনালী পাতায় লিপিবদ্ধ এমনই অসংখ্য ঘটনার মধ্যে এটি একটি জ্বলন্ত ঘটনা।
১৬. অমুসলিমের অধিকার রক্ষায় বাদশাহ আওরঙ্গযেব
বাদশাহ আওরঙ্গযেব বিশাল ভারতবর্ষের একচ্ছত্র সম্রাট হওয়া সত্ত্বেও রাজকোষ থেকে কোন বেতন-ভাতা নিতেন না। নিজ হাতে টুপী সেলাই করে আর কুরআন মজীদ কপি করে যা পেতেন, তাই দিয়ে অতি কষ্টে দিন গুযরান করতেন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও গভীর রাতে উঠে তাহাজ্জুদে দণ্ডায়মান হয়ে কেঁদে চক্ষু ভাসাতেন । তাঁর জীবনের অসংখ্য শিক্ষণীয় ঘটনাবলীর মধ্যে একটি ছিল নিম্নরূপ: তাঁর একজন মুসলিম সেনাপতি পাঞ্জাব অভিযানকালে একটি গ্রাম অতিক্রম করছিলেন। সে সময় একজন ব্রাহ্মণের পরমা সুন্দরী এক মেয়েকে দেখে তিনি তার পিতার কাছে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। পিতা অনন্যোপায় হয়ে বাদশাহ্র শরণাপন্ন হলেন। ওয়াদা অনুযায়ী উক্ত সেনাপতি একমাস পরে বরের বেশে উক্ত ব্রাহ্মণের বাড়ীতে উপস্থিত হলেন। কিন্তু ঘরে প্রবেশ করেই দেখলেন ছদ্মবেশী সম্রাট আলমগীর উলঙ্গ তরবারি হাতে স্বয়ং তার সম্মুখে দণ্ডায়মান। ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে সেনাপতি সেখানেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। গ্রামবাসী হিন্দুরা ঐদিন থেকে গ্রামের নাম পাল্টিয়ে রাখলো ‘আলমগীর’। যে কামরায় বসে বাদশাহ আলমগীর ঐ রাতে ইবাদতে রত ছিলেন, ঐ কামরাটি আজও হিন্দুদের নিকট পবিত্র স্থান বলে সম্মানিত হয়ে আছে। কেউ সেখানে জুতা পায়ে প্রবেশ করে না (ইতিহাসের ইতিহাস, পৃঃ ১৬৬)।
শিক্ষা : আধুনিক বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দাবীদার রাষ্ট্র ভারত সরকার কি বর্তমানে সেখানে সংখ্যালঘু মুসলমানদের অধিকার রক্ষা করতে পারছে? না, বরং প্রতিনিয়ত তাদের প্রতি চালাচ্ছে নির্যাতনের স্টীম রোলার। অথচ মুসলিম শাসক আওরঙ্গযেব মাত্র একজন হিন্দুর অধিকার হরণের ঘটনাকে বরদাশত করতে না পেরে নিজেই এগিয়ে গিয়েছিলেন। এরপরেও কি তাদের বোধোদয় হবে না?
১৭. সম্রাট বাবরের মহত্ত্ব
১৫২৬ খৃষ্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবর দিল্লীর সম্রাট ইবরাহীম লোদীকে পরাজিত করে দিল্লীর সিংহাসন লাভ করেন। ভারতের বাইরের মুসলিম সম্রাটগণ বহুবার ভারতের বিভিন্ন অংশে অভিযান চালিয়ে বহু ধন-সম্পদ হস্তগত করে আবার স্বদেশে ফিরে গেছেন। কিন্তু সম্রাট বাবর এর ব্যতিক্রম ছিলেন। তাঁর মধ্যে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কোন লক্ষণ দেখা গেল না। রাজা সংগ্রাম সিংহ রীতিমত চিন্তিত হয়ে পড়ল। সে বাবরকে বেশি শক্তিশালী হ’তে আর সময় দিতে চাইল না। তাই সে বাবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। যুদ্ধে সংগ্রাম সিংহ পরাজিত ও নিহত হ’ল। ফলে বাবর আরো শক্তিশালী হ’লেন ।
এদিকে পরাজয়ের গ্লানিতে ক্ষুব্ধ রাজপুতদের মধ্য থেকে এক যুবক মনে করল, বাবরকে সরাসরি যুদ্ধে পরাজিত করা যাবে না। তাই ছদ্মবেশ ধারণ করে তাঁর প্রাণ সংহার করতে হবে। যুবক বাবরের রক্তে জন্মভূমির পরাজয়ের গ্লানি মুছে ফেলতে চাইল। তাই সে বাবরের সন্ধানে ছুরিসহ ছদ্মবেশে দিল্লীর রাজপথে ঘুরে বেড়াতে লাগল। বাবরকে ছুরিকাঘাতে নিহত করাই তার একমাত্র পণ।
একদিন সে দিল্লীর রাজপথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমন সময় দেখতে পেল, জনগণ রাজপথ ছেড়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছে। রাজপথে পাগলা হাতী ছুটে চলেছে। তারই ভয়ে জনগণের এই ছুটোছুটি। এদিকে পথে একটি শিশু পড়ে আছে। ভয়ে কেউ শিশুটিকে উদ্ধার করতে এগুচ্ছে না। সবাই হায় হায় করে বলতে লাগল যে, শিশুটি হাতির পদতলে পিষ্ট হয়ে মারা যাবে। কে একজন শিশুটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তাকে নিরস্ত করা হ’ল। বলা হল, অচ্ছুৎ মেথরের ছেলেকে ছুঁয়ো না।
এমন সময় জনতার ব্যূহ ভেদ করে কে একজন সাহসী ব্যক্তি দ্রুতগতিতে শিশুটিকে উঠিয়ে জনতার কাতারে মিশে গেলেন। হাতীটি হুংকার করতে করতে চলে গেল। পরে জানা গেল সেই সাহসী ব্যক্তিটি ছিলেন স্বয়ং সম্রাট বাবর।
স্বচক্ষে এ দৃশ্য দেখে যুবকটির ভাবান্তর হ’ল। উদ্ধারকর্তাকেও সে চিনতে পারল। তিনিই সে ব্যক্তি যার প্রাণ সংহার করতে সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যুবকটি তৎক্ষণাৎ তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে স্থির করল যে, সে বাবরের কাছে তার পরিচয় দিয়ে দিল্লীর রাজপথে তার ঘুরে বেড়ানোর উদ্দেশ্য ব্যক্ত করবে। পরিণাম যাই-ই হৌক তাতে তার কিছু যায় আসে না। তাই সে ধীরপদে বাবরের সামনে এল এবং লুক্কায়িত ছুরি বের করে বাবরের সামনে রাখল । অতঃপর বলল, এই ছুরির আঘাতে আমি আপনার প্রাণনাশ করতে চেয়েছিলাম। আপনার মহত্ত্ব আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি উপলব্ধি করলাম, প্রাণনাশের চেয়ে প্রাণরক্ষা করাই মহৎ কাজ। বাবর যুবককে বুকে টেনে নিলেন এবং তাঁর দেহরক্ষী হিসাবে নিয়োজিত করলেন।
শিক্ষা : মহত্ত্ব নিজেই এমন একটি মহৎ গুণ, যা মহৎ ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদেরও মহৎ করে তুলে।
১৮. তাক্বওয়ার পুরস্কার
আল্লাহ তা’আলা মানব জাতিকে লক্ষ্য করে বলেন, – “হে মানব সকল! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর’ (নিসা ৪/১)।
অন্যত্র তিনি ঈমানদারগণকে লক্ষ্য করে বলেন, –
ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় কর। আর তোমরা অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ কর না’ (আলে ইমরান ৩/১০২)। আল্লাহ পাক আরো বলেন, – ‘তোমরা পুণ্যের কাজে ও আল্লাহভীতিতে একে অপরকে সাহায্য কর এবং পাপ কাজে ও সীমালংঘনে পরস্পরকে সাহায্য করো না, আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর’ (মায়েদাহ ৫/২)।
এ সম্পর্কিত উপদেশমূলক একটি ঘটনা, সিরিয়ার বিখ্যাত আলেমে দ্বীন শায়খ ত্বানতাভী (রহঃ) উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটা এই যে, একটি ছেলে নেক ও সৎ স্বভাবের ছিল। তার মধ্যে তাক্বওয়া (আল্লাহভীতি) ও পরহেযগারিতা ছিল। বিদ্যার্জনের প্রতি তার খুব একটা স্পৃহা ছিল না। সে একটা মাদরাসায় পড়ত। সে শিক্ষকের নির্দেশ মোতাবেক চলত। জ্ঞানার্জনের শেষ পর্যায়ে একদিন তার উস্তাদ তাকে এবং তার সহপাঠীদেরকে নছীহত করলেন, জীবনে কখনো মানুষের মুখাপেক্ষী হবে না। কারণ মানুষের সামনে হাত পেতে ধরা আলেম কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়। এজন্য যে, দাতারা যা কিছু বলবে এবং যা কিছু করবে দানগ্রহীতা আলেম তার কোন প্রতিবাদ করতে পারে না। কারণ সে তাদের অনুগ্রহের ভিখারী হয়ে পড়ে। অতএব তোমরা ফিরে গিয়ে নিজ নিজ পিতার পেশা অবলম্বন করে জীবিকার্জন করবে। আর যেকোন কাজে আল্লাহকে ভয় করবে ও তাক্বওয়া অবলম্বন করবে।
শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ বাড়ী ফিরে গেল। ঐ ছেলেটিও বাড়ী গিয়ে তার মাকে জিজ্ঞেস করল, মা আমার বাবার পেশা কি ছিল? ছেলের এই প্রশ্নে মা হতভম্ব হয়ে গেলেন এবং বললেন, বেটা বহুদিন অতিবাহিত হয়ে গেছে তোমার বাবা ইন্তিকাল করেছেন। তোমার বাবার পেশার সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক? এতদিন পরে তুমি আমাকে এ কথা জিজ্ঞেস করছ কেন? ছেলে তার বাবার পেশা জানার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল। আর তার মা টালবাহানা করতে থাকলেন। ছেলের পীড়াপীড়িতে এক পর্যায়ে মা ছেলের পিতার পেশা বলতে বাধ্য হ’লেন। তিনি বললেন, তোমার আব্বার কোন ভাল পেশা হ’লে তা বলতে আমার এত দ্বিধা হ’ত না। তোমার পীড়াপীড়িতে বলতে হচ্ছে, তোমার আব্বার পেশা ছিল চৌর্যবৃত্তি। ছেলে তার মায়ের উত্তর শুনে বলল, আম্মা! আমার উস্তাদ সকল ছাত্রকে বলেছেন, তোমরা তোমাদের পিতার পেশা অবলম্বন কর। আর সব কাজে তাক্বওয়ার খেয়াল রেখো। মা বললেন, চুরি করতে তাক্বওয়া অবলম্বন! এ কেমন কথা? ছেলে বলল, আম্মা! উস্তাদ এই কথাই বলেছেন।
অতঃপর ছেলেটি চুরি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানার্জন করতে শুরু করল। যথারীতি প্রশিক্ষণ নিল । সে প্রয়োজনীয় উপকরণও সংগ্রহ করল । প্রশিক্ষণ শেষে সে চিন্ত া-ভাবনা করে কাজের পরিকল্পনা তৈরী করল। একদিন এশার ছালাত আদায় করার পর লোকজনের ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষা করতে লাগল। লোকজন যখন ঘুমিয়ে পড়ল, চতুর্দিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল, তখন সে প্রথমে প্রতিবেশীর ঘরেই চুরি আরম্ভ করার সংকল্প করল। সে প্রতিবেশীর বাড়ীতে প্রবেশ করতে গেলে উস্তাদের নছীহত তার স্মরণ হ’ল। সে মনে মনে বলতে লাগল, প্রতিবেশীর ঘরে চুরি করা ও তাকে কষ্ট দেওয়া তো তাক্বওয়া বিরোধী কাজ। এতে আল্লাহ তা’আলা অসন্তুষ্ট হবেন। সুতরাং সে প্রতিবেশীর ঘর ছেড়ে অন্য ঘরের দিকে অগ্রসর হ’ল। সেটা ছিল এক ইয়াতীম-অনাথের ঘর। এর ঘরে চুরি করাও তাক্বওয়াবিরোধী কাজ। কারণ আল্লাহ তা’আলা ইয়াতীমের মাল ভক্ষণ করতে নিষেধ করেছেন। ফলে সে এ ঘর ছেড়ে অন্য ঘরের দিকে অগ্রসর হ’ল। এইভাবে যখনই সে কোন ঘরের কাছে আসে এবং চুরি করার ইচ্ছা করে তখনই কিছু না কিছু ভাবনা তার মনে উদয় হয়, অতঃপর তা তাক্বওয়াবিরোধী কাজ ভেবে আরও অগ্রসর হতে থাকে। এভাবে সে একটা ঘরের কাছে এসে দাঁড়াল। এটা জনৈক ব্যবসায়ীর ঘর। সে একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী। তার একটা মাত্র কন্যা সন্তান। মনে মনে বলল, হ্যাঁ, এই ঘরে চুরি করা চলে। অতঃপর চাবি দিয়ে তালা খুলে ঘরে প্রবেশ করে দেখল এতে অনেকগুলি কক্ষ রয়েছে। সে ঐ বিশাল ঘরে ঘুরতে লাগল। যেন সে চোর নয়; বরং কোন মেহমান। শেষে তার দৃষ্টি পড়ল একটা সিন্দুকের উপর। সেটা খুলে দেখল তা সোনা-চাঁদি, টাকা-পয়সায় পরিপূর্ণ। সে সিন্দুক থেকে মাল-ধন বের করার ইচ্ছা করল। কিন্তু তার উস্তাদের উপদেশ মনে পড়ল। মনে মনে বলতে লাগল, প্রথমতঃ এই ব্যবসায়ী তার মালের যাকাত দিয়েছে কি-না, তা জানা নেই। সর্বাগ্রে তার যাকাতের হিসাব পর্যালোচনা করা যাক। সুতরাং সে হিসাব সংক্রান্ত খাতাপত্র বের করে সঙ্গে আনা ছোট লণ্ঠনটি জ্বেলে নিল এবং তার আলোতে খাতাপত্রগুলি তন্ন তন্ন করে দেখতে লাগল। সে হিসাব-কিতাবে বেশ অভিজ্ঞ ছিল। সে দ্রুত সম্পদের পূর্ণ হিসাব করে ফেলল এবং যাকাতের অংশ বের করে পৃথক রাখল ।
হিসাব-নিকাশে সে এমনভাবে ডুবে গিয়েছিল যে, সময়ের কোন খেয়াল ছিল না। হঠাৎ মনে হ’ল ফজরের সময় হয়ে গেছে। সে নিজের মনেই বলল, তাক্বওয়ার চাহিদা হচ্ছে প্রথমে ফজরের ছালাত সমাপন, তারপর কাজ। সে ঘর থেকে বের হয়ে আঙ্গিনায় এসে ওযূ করল। তারপর ছালাতের জন্য ইকামত দিল। ঘরের মালিক ইকামত শুনে ঘাবড়ে গিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠল। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল ছোট একটি লণ্ঠন টিপ টিপ করে জ্বলছে। সিন্দুক খোলা এবং তার সম্মুখে এক তরুণ ছালাত আদায় করার জন্য ইকামত দিচ্ছে। ঘরের গৃহীনীও জেগে গেছে। সে এইসব দেখে স্বামীকে জিজ্ঞেস করছে, ওখানে কি হচ্ছে? গৃহকর্তা বলল, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। অতঃপর সে দোতলা থেকে নেমে ঐ তরুণের কাছে গিয়ে বলল, তুমি কে? আর তুমি করছই বা কি? চোর ছেলেটি বলল, প্রথমে ছালাত, পরে কথা। ঘরের মালিক যথেষ্ট ঘাবড়ে গিয়েছিল। তরুণ তাকে বলল, আপনি শীঘ্র ওযূ করে আসুন । সে ওযূ করে এলো। তরুণ বলল, আপনি ছালাতে ইমামতি করুন। সে তরুণকে বলল, না, বরং তুমি ইমামতি কর। তরুণ বলল, আপনি এই ঘরের মালিক । আপনিই ইমামতি করার বেশী হকদার। সে এসব চিন্তাই করতে পারেনি। সে নিজের জানমাল নিয়ে শঙ্কিত। কোন রকমে ছালাত শেষ করল। ভয় ও শঙ্কায় তার মনের অবস্থা ভাল ছিল না। ছালাত শেষ হ’লে মালিক বলল, এখন বল তুমি কে? এখানে কি উদ্দেশ্যে এসেছ? আমার সিন্দুক খোলা কেন? তরুণ বলল, আমি চোর, চুরি করার জন্য এসেছি। কিন্তু আপনি বলুন, যাকাত আদায় করেন না কেন? আমি আপনার খাতাপত্রগুলি পরীক্ষা- নিরীক্ষা করে দেখেছি। আপনি ছয় বছর থেকে যাকাত আদায় করেননি। এটা আল্লাহ্র হক্ক, যা ফরয। আমি হিসাব করে দিয়েছি এবং যাকাতের মাল পৃথক করে রেখেছি। যাতে আপনি যাকাতের হক্বদার ব্যক্তিদেরকে পৌছে দিতে পারেন। এসব কথা শুনে গৃহস্বামী স্তম্ভিত হয়ে গেল। তুমি এসব কি করেছ? তুমি কি পাগল? সে বলল, আমি পাগল নই, সম্পূর্ণ সুস্থ-সবল ও জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি। গৃহকর্তা বলল, তাহ’লে তুমি চুরি করছ কেন? উত্তরে ছেলেটা সম্পূর্ণ কাহিনী ব্যবসায়ীকে শুনাল।
ব্যবসায়ী ছেলেটির সহজ-সরল সুদর্শন চেহারা এবং হিসাব-নিকাশে তার দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হয়ে স্বীয় স্ত্রীর কাছে গেল এবং তরুণ চোর সম্পর্কে সব বৃত্তান্ত খুলে বলল । অতঃপর সে বলল, তুমি তোমার একমাত্র কন্যার বিবাহের জন্য পেরেশান ছিলে। আল্লাহ তা’আলা তোমার ঘরে পাত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। সবকিছু শুনে স্ত্রীও একমত পোষণ করল । অতঃপর সে তরুণ ছেলেটার নিকটে এসে বলল, দেখ চুরি করা খুব জঘন্য কাজ। তোমার ধন-সম্পদ দরকার হ’লে এবং তুমি চাইলে আমি তোমাকে আমার সম্পদের অংশীদার করতে পারি। তরুণ বলল, সেটা কিভাবে ? ব্যবসায়ী বলতে লাগল, আমার একটি মাত্র কন্যা। আমি তার বিবাহ তোমার সঙ্গে দিতে চাই। আমি তোমাকে আমার সম্পদের প্রধান হিসাব রক্ষক নিয়োগ করতেও প্রস্তুত আছি। তোমাকে বাসস্থান ও প্রয়োজনীয় অর্থ আমি প্রদান করব। তুমি তোমার মার সঙ্গে পরামর্শ করে নাও । তরুণ ছেলেটি এই প্রস্তাবে তার সম্মতি প্রকাশ করল। সে তার মাকে বলতেই তিনি রাযী হ’লেন । পরবর্তীতে দিন ধার্য করে ব্যবসায়ী ঐ তরুণের সঙ্গে তার কন্যার বিবাহ দিলেন।
শিক্ষা : তাক্বওয়াশীল মানুষকে আল্লাহ তার তাক্বওয়ার মাধ্যমেই হেদায়াত দান করেন এবং বিনিময়ে অঢেল পুরস্কার প্রদান করেন।
১৯. মৃত্যুর দুয়ারে ত্যাগের মহিমা
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ মুমিন হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই ভালবাসবে যা সে নিজের জন্য ভালবাসে’ (বুখারী হা/১৩)।
ইয়ারমুক যুদ্ধের বিশাল ময়দান। এক প্রান্তে ক্ষুদ্র মুসলিম সেনাদল আর অপর প্রান্তে রোমকদের বিশাল সৈন্যবাহিনী। উভয় দলই ভয়াবহ এক যুদ্ধের মুখোমুখি দণ্ডায়মান। যুদ্ধ শুরুর পূর্বমুহূর্তে আবূ ওবায়দাহ, মু’আয বিন জাবাল, আমর ইবনুল আছ, আবূ সুফিয়ান, আবু হুরায়রা প্রমুখ ছাহাবী সৈন্যদের উদ্দেশ্যে হৃদয়গ্রাহী উপদেশ দেন। আবূ ওবায়দাহ উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, ‘হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা আল্লাহকে সাহায্য করো, আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পদযুগলকে স্থির রাখবেন। হে মুসলিম সেনাবাহিনী! তোমরা ধৈর্যধারণ করো। কেননা ধৈর্য কুফরী থেকে বাঁচার, আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের এবং লজ্জা নিবারণের উপায়। তোমরা তোমাদের যুদ্ধের সারি থেকে সরে দাঁড়াবে না। কাফেরদের দিকে এক ধাপ ও অগ্রসর হবে না এবং আগ বেড়ে তাদের সাথে যুদ্ধের সূচনাও করবে না। শত্রুদের দিকে বর্শা তাক করে থাকবে এবং বর্ম দিয়ে আত্মরক্ষা করবে। তোমাদেরকে যুদ্ধের নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তোমরা মনে মনে আল্লাহ্র যিকির করতে থাকবে’। যুদ্ধ শুরু হ’ল এবং প্রচণ্ড আকার ধারণ করল। যুদ্ধের সময় হুযায়ফা (রাঃ) আহতদের মধ্যে তার চাচাতো ভাইকে খুঁজতে শুরু করলেন। তার সাথে ছিল সামান্য পানি। হুযায়ফার চাচাতো ভাইয়ের শরীর দিয়ে অবিরত ধারায় রক্ত ঝরছিল। তার অবস্থা ছিল আশংকাজনক। হুযায়ফা (রাঃ) তাকে বললেন, তুমি কি পানি পান করবে? সে তার কথার কোন উত্তর দিতে সক্ষম না হয়ে হ্যা সূচক ইঙ্গিত করল। আহত ব্যক্তি হুযায়ফার কাছ থেকে পানি পান করার জন্য হাতে নিতেই তার পাশে এক সৈন্যকে পানি পানি বলে চিৎকার করতে শুনল। পিপাসার্ত ঐ সৈনিকের বুকফাটা আর্তনাদ শুনে তার পূর্বে তাকে পানি পান করানোর জন্য হুযায়ফাকে ইঙ্গিত দিলেন। হুযায়ফা তার নিকট গিয়ে বললেন, আপনি কি পানি পান করতে চান? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তিনি পান করার জন্য পাত্র উপরে তুলে ধরতেই পানির জন্য অন্য একজন সৈন্যের চিৎকার শুনতে পেলেন । তিনি পানি পান না করে হুযায়ফা (রাঃ)-কে বললেন, তার দিকে দ্রুত ছুটে যাও এবং সে পানি পান করার পর কিছু অবশিষ্ট থাকলে আমাকে দিয়ো। হুযায়ফা আহত সৈন্যটির কাছে গিয়ে দেখলেন, সে মারা গেছে। অতঃপর দ্বিতীয় জনের কাছে ফিরে এসে দেখলেন, সেও মারা গেছে। অতঃপর চাচাতো ভাইয়ের কাছে ফিরে আসলে দেখেন তিনিও শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করে জান্নাতবাসী হয়েছেন। পানির পাত্রটি তখনও হুযায়ফার হাতে। এতটুকু পানি। অথচ তা পান করার মত এখন আর কেউ বেঁচে নেই । যাদের পানির প্রয়োজন ছিল তারা আরেক জনের পানির পিপাসা মিটাবার জন্য এতই পাগলপরা ছিলেন যে, অবশেষে কেউ সে পানি পান করতে পারেননি। অথচ সবারই প্রাণ ছিল ওষ্ঠাগত (আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৭/৮- ১১ প্রভৃতি দ্রঃ)।
শিক্ষা : মুমিন ব্যক্তি সর্বদা মানুষের জন্য অন্তঃপ্রাণ থাকে। সে নিজেকে কখনো পরের উপরে প্রাধান্য দেয় না। বরং সর্বদা অপরের কল্যাণকেই ধ্যান- জ্ঞান করে। জীবনের চরম ঝুঁকিপূর্ণ মুহূর্তে পর্যন্ত সে তার কর্তব্য ভুলে যায় না। এমনকি পরার্থে নিজের জীবন বিলিয়ে দিতেও সে সামান্যতম কুণ্ঠাবোধ করে না। সর্বদাই তাঁর হৃদয়কন্দরে গুঞ্জরিত হতে থাকে, ‘সকলের তরে আমরা সবে, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’।
২০. শত্রুর জিঘাংসা
হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়্যাহ কর্তৃক বর্ণিত, হযরত আলী বিন আবু ত্বালিব (রাঃ)-এর হত্যাকারী আব্দুর রহমান বিন মুলজিম বন্দী অবস্থায় (হযরত আলীকে হত্যার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল) থাকাকালীন সময়ে হযরত হাসান বিন আলী (রাঃ)-এর নিকট যখন নিয়ে আসা হ’ল, তখন সে বলল, হে হাসান! আমি তোমার সাথে কানে কানে কিছু কথা বলতে চাই। তিনি অস্বীকার করলেন এবং সাথীদেরকে বললেন, তোমরা জান সে কি চেয়েছে? তারা উত্তর দিলেন, না। হযরত হাসান বললেন, সে চেয়েছিল আমি আমার কান তার মুখের কাছে নিয়ে গেলে সে দাঁত দিয়ে আমার কানটি কেটে নিবে। ঐ পাপী একথা শুনে বলল, আল্লাহ্র কসম আমি ঠিক এমনটাই ইচ্ছা পোষণ করেছিলাম। চিন্তা করে দেখুন, সবেমাত্র হযরত হাসান (রাঃ)-এর পিতৃবিয়োগ হয়েছে। মুসলিম উম্মাহ এখন বিব্রতকর অবস্থায় আছে। এমন পরিস্থিতিতে তিনি কিভাবে ঐ বদমায়েশের কূট-কৌশলের রহস্যটি বুঝতে পেরে সতর্ক হয়ে গেলেন এবং ঐ শয়তান মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও কি ধরনের জঘন্য চাল চালতে চাইল!! (ইবনুল কাইয়িম, আত-তুরুক আল-হুকমিইয়্যাহ ১/৩৭)।
শিক্ষা : শত্রু সুযোগ পেলেই ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। অতএব সর্বদা সাবধান থাকতে হবে।
শেষ কথা: যেসব সম্মানিত লেখকের চমৎকার গল্পগুলি এই পোস্টটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, সঙ্গত কারণেই তাদের নামগুলি প্রকাশিত হ’ল না। তবে তাদের প্রতি আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা রইল।