বিস্মৃত এক রাজদুলারীঃ সাইয়্যিদা নাফিসা আত্ তাহিরা (رضي الله عنه)
🖋লেখকঃ মুহাম্মদ শাহীদ রিজভী
(✰) জোছনার প্লাবনেঃ
১৪৫ হিজরী-৭৬০ খৃস্টাব্দের প্রথম বসন্তের একাদশ রজনী। ঠিক ৫৭০ খৃস্টাব্দের এমন এক চন্দ্রালোকিত রজনীতে বিশ্ব চরাচরে শুভাগত হয়েছিলেন স্রষ্টার পরম বন্ধু সৃষ্টির অনুপম রহমতে আলম নূরে মুজাসসাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম। আজও বিশ্ব পুলকিত হলো মক্কাতুল মোকাররমার সাইয়িদ মহল্লায় রেসালতের ফুলবাগানের অনুপম শুভশ্রী এক রাজকুমারীর শুভাগমনে। একাদশ রজনীর জোছনার প্লাবন ম্লান হয়ে গেলো বেহেশতী রাজকুমারীর অপরুপ রুপমাধূর্যে।
(✰) সোনার শেকলেঃ
পিতা হযরাত সাইয়্যিদ আল-হাসান আল-আনওয়ার, যিনি মদীনাতুল মুনাওয়ারার গভর্নর ছিলেন। যিনি ছিলেন বেহেশতী যুবকদের সরদার শাহে কারবালা হযরত ইমাম হাসান আলাইহিস সালামের নাতি হযরত সাইয়িদ জায়দ আল আবলায এঁর পুত্র। অর্থাৎ সম্পর্কে কূল কায়েনাতের জাঁহাপনা রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লামার নাতনী। গর্ভধারিনী জননীও রত্নসভার এক মহতী মণি। সাইয়িদা জয়নাব বিনতে আল হাসান ইবনে ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম। অন্যদিকে পরিণত বয়সে নবী বাগানের এই গোলাপ সাইয়িদা নাফিসা আত্ তাহিরা পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন নবীবাগানের আরেক তাজ হযরত সাইয়িদ ইসহাক আল মু’তামিন রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর সাথে। যিনি ছিলেন দ্বাদশ ইমামের অন্যতম খ্যাত হযরত ইমাম জাফর আস সাদিক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর পুত্র। আর ইমাম জাফর আস সাদিক হলেন বেহেশতী যুবকদের সরদার শাহে কারবালা হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামের পুত্র ইমাম আস সাজ্জাদ জয়নুল আবেদীন রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর পুত্র হযরত ইমাম মুহাম্মাদ আল বাকির রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর ছেলে।
(✰) জেগে ওঠো নীলনদ!
তখন ২০১ হিজরী, ৮১৬ খৃঃ। নীলনদ শুকিয়ে গেছে। খরায় জমিন ফেটে চৌচির। চারিদিকে হাহাকার। তৃণগুল্ম ফুল ফসল এর লেশমাত্র নেই। প্রাচীন সভ্যতার মিশরে যেন আজ ফারাও কালের সপ্তবর্ষের দুর্ভিক্ষের হাতছানি! মিশরের জমিন এক ইউসুফের খোঁজে হয়রান।
একাধারে আহলে বায়তে আতহার এঁর রাজকন্যা, অন্যদিকে নবী পরিবারের পুত্রবধূ। পবিত্র রমণী অবস্থান করছিলেন প্রাচীন সভ্যতার পাদপীঠ মিশরের রাজধানীতে। আধ্যাত্মিকতার অতি উচ্চ মার্গে অবস্থানকারী হযরাত সাইয়িদা নাফিসা আত্ তাহিরার কাছে জনতা ছুটে এলো। তৃষ্ণার্ত জনতা আরজ করলো মায়ের চরণে মাগো তোমায় লাখো সালাম। দোয়া করো জননী। নবী পরিবারের ফুল সাইয়িদা নাফিসা আত্ তাহিরা আপন বুরকার নেকাব এর কিয়দংশ দিলেন ভক্তদের। বললেন, এই নেকাবের টুকরো নাও- যাও নীলনদের পাড়ে। নীলকে বলো নাফিসা আত্ তাহিরা নির্দেশ দিয়েছেন, “নীলনদ! তুমি গর্জে উঠো।” জনতা নীলনদের পাড়ে গিয়ে আম্মাজান এর নেকাবের টুকরো উপহার দিলো। অতঃপর ইতিহাসের সেরা বন্যায় নীলনদ তার দু কূল ছাপিয়ে দিলো। কবির বাণী সত্যি হয়ে উঠলোঃ
“দুঃখ কী ভাই হারানো ইউসুফ কেনআনে আবার আসিবে ফিরে,
দলিত শুষ্ক এ মরুভূ পুনঃ হয়ে গুলিস্তাঁ হাসিবে ধীরে।”
(✰) মাক্কী ও মাদানী জীবনেঃ
সাইয়িদা নাফিসাহ আত তাহিরা (রাঃ) ১৪৫ হিজরিতে মক্কা আল-মুকাররামায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি খুব অল্প বয়সে আল কুরআন হিফজ করেন এবং পাশাপাশি কুরআনিক সাইয়েন্স সম্পর্কে জ্ঞান আহরণে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ইতিমধ্যে খলিফা আবু জাফর আল-মনসুর তাঁর পিতা সাইয়িদ আল-হাসান আল আনওয়ার-কে মদিনার গভর্নর নিযুক্ত করলে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে নিয়ে মদিনাতুল মুনাওয়ারায় চলে আসার পর তিনি সেখানেই বেড়ে ওঠেন। তাঁকে সর্বদা মসজিদে নবুবী ও রওজা মোবারকে পাওয়া যেত। সাইয়িদা নাফিসাহ আত তাহিরা ত্রিশবার হজ্বব্রত পালনসহ অসংখ্য বার রওজা মোবারক জিয়ারত করেন। তাঁর প্রচন্ড আল্লাহভীতি ও ইশকে ইলাহী এমনই ছিল যে তিনি হজ্বে গেলে কা’বার পর্দা জড়িয়ে বিলাপ ধরে কান্নাকাটি করে বলতেন,
“হে আমার পালনকর্তা! আমাকে আপনার সন্তুষ্টির আনন্দ এবং সুখানুভূতি দিন। এমন কিছু থেকে মুক্ত রাখুন যা আমাকে আপনার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেবে।
(✰) মুতমাঈনের করকমলেঃ
১৬১ হিজরীর রজব মাস। মাত্র পাঁচ মাস আগে শোকাবহ কারবালার ঘটনার একশো বছর পূর্তি হয়েছে। এখনো হৃদয়ের অলিন্দে আঘাত করে চলেছে। যেন এই কদিন আগেই ফোরাতের তীরে দাদাজী ইমাম আলী মাকাম ডাক দিয়ে চলেছেন, “তোমাদের দলে কি একজনও ঈমানদার নেই”! কিংবা “তোমরা কি জানো না আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এঁর দৌহিত্র হোসাইন!” ফোরাতের দু’ কূল ছাপিয়ে সেই বজ্রনিনাদ যেন আকাশে বাতাসে পুনরায় গগনভেদী আওয়াজ তোলে। আহা! এই বুঝি দুধের শিশু সাইয়েদ আলী আসগর এঁর কন্ঠনালী ভেদ করে চলেছে ইয়াজিদ শিবিরের তীর! ওইখানে কী ইমাম আস সাজ্জাদ জয়নুল আবেদীন এর জ্বরাক্রান্ত ক্ষীণকায় দেহে ফুপীমা সাইয়িদা জয়নাব যতনের পরশ বুলিয়ে চলেছেন। দুলদুলের পিঠের দগদগে সে ঘা যেন আজো শুকোয়নি। এরই মাঝে অতুলনীয়া পবিত্র কন্যা ৩০পারা আল কুরআন এর হাফিজা, সাইয়িদা নাফিসা আত্ তাহিরা ষোড়শী তন্বী। পিতা হযরাত সাইয়িদ আল-হাসান আল-আনওয়ার এঁর মনের গহীনে পিতৃত্বের দায়িত্ববোধ তীব্রতা ধারণ করলো। প্রিয়তমা কন্যাকে সুপাত্রস্থ করতে হবে। চারিদিকে খোঁজ খোঁজ রব উঠে গেল। নবী বাগানের পুষ্পকন্যা সাইয়িদা নাফিসাহ’র জন্য সেরা পাত্রটি চাই। কোনো পাত্রই পিতার মন জয় করতে পারে না। এরই মাঝে কিছু শুভানুধ্যায়ী নবী-বাগানের আরেক পুষ্পরাজ ইমাম সাইয়িদ জাফর আস সাদিক এঁর শাহযাদা সাইয়িদ ইসহাক আল মুতমাঈন (তৃপ্ত আত্মা) এঁর জন্য শাহযাদী নাফিসার শাদীর পয়গাম নিয়ে আসেন। পিতা সিদ্ধান্ত গ্রহণে ইতস্তত হন। বোধ হয় পৃথিবীর প্রতিটি জনকই এমন! আদরের দুলালীর জন্য যে তাঁর সেরা রত্নটিই চাই। সিদ্ধান্তহীনতায় ছুটে চললেন সেই রাওজায়ে মোকাদ্দাসে যেখানে শুয়ে আছেন কুল মাখলুকাতের’ প্রাণনিধি। সালাত সালাম আরজে ইলহাম হলো, “হে প্রিয়! আমার বাগানের ফুল নাফিসা’র জন্য চিন্তিত হয়ো না। আমার নাফিসাকে আস সাদিক এর কলিজার টুকরোর করকমলে বুঝিয়ে দাও। এ মহতী রত্নের আমানত শুধু ইসহাক আল মুতমায়িন এর।” রাসুল অতুল এঁর রুহানি নির্দেশ শিরোধার্য করে ১৬১ হিজরীর ৫ রজব সাইয়িদা নাফিসা আত্ তাহিরা কে হযরত সাইয়িদ ইসহাক আল মুতমাঈন এঁর করকমলে তুলে দিয়ে পিতা নিজ কর্তব্য যথাশীঘ্রই পালন করলেন।
(✰) শৈশবেই মুনাওয়ারাঃ
অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছি, ইলমে শরীয়ত ও মারিফাত, ইশক, ইবাদত ও জুহুদ এর এই গুপ্তধন কতো কুরবানী দিয়েছেন! যিনি একজন নারী হয়েই যুগসেরা ওলামা, সূফি, ফকীহ, মোফাসসির, মোহাদ্দিস এমনকি মাযহাবের ইমাম পর্যন্ত তৈরি করেছেন। এ বিশেষ যোগ্যতা কোন্ সাধনায় অর্জন করেছিলেন মা জননী?
সাইয়িদা নাফিসা ছয় বছর বয়স থেকে মসজিদে আন-নববি (ﷺ)-তে পিতার সাথে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। পিতা তাঁকে হাত ধরে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজা আতহার তথা মা আয়িশার হুজরা শরীফে নিয়ে যেতেন। তিনি রাসুলুল্লাহ ﷺ- কে সরাসরি সম্বোধন করে বলতেন: “ইয়া জিদ্দী, ইয়া রাসুলুল্লাহ! হে নানাজান! আল্লাহর প্রিয়তম রাসুল! আমি আমার মেয়ে নাফিসার প্রতি সন্তুষ্ট, আপনিও তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান!” তিনি এই ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন যতক্ষণ না একদিন প্রাণনিধি নানাজান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে স্বপ্নে হাজির হয়ে বললেন, “ইয়া হাসান, আমি তোমার কন্যা নাফিসার প্রতি সন্তুষ্ট, কারণ তুমি তার প্রতি সন্তুষ্ট এবং আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হলেন কারণ আমি আমি তার প্রতি সন্তুষ্ট।”
(✰) মাওলার দরবারেঃ
সাইয়িদা নাফিসা আত্ তাহিরা তেষট্টি বছরের সুন্নাতি হায়াতে মোট ত্রিশবার হজ্বব্রত পালন করেন। উল্লেখ্য তাঁর প্রতিটি হজ্বব্রত পদব্রজে পালিত হয়। গভর্নরের কন্যা ছাড়াও আহলে বায়তের সদস্যা এবং নিজের গুণবতী সুষমার খ্যাতিতে জনতার সম্মানসূচক আগ্রহের কেন্দ্র ছিলেন এই সাইয়িদজাদী। তাই আমীর ওমরাহ, আরব্য বণিক থেকে শুরু করে সাধারণ জনতা তাঁর সেবায় আগ্রহ ব্যক্ত করে মরুর জাহাজ উট, ভারবাহী গাধা ও দ্রতগতিসম্পন্ন ঘোড়াসজ্জিত কাফেলা দিতে উদ্যত হলে তিনি প্রত্যাখ্যান করে বলতেন, “পদব্রজে হজ্বব্রত পালন আমার পবিত্র রক্তের পূর্বসূরী ইমাম হোসাইন আলাইহিস সালামের সুন্নাহ অনুসরণেই করছি। যিনি বলতেন, আমার প্রভুর দরবারে হাজিরা দিতে বান্দা কিভাবে বাহন সজ্জিত হয়ে কাফেলা ও বাহিনী নিয়ে যেতে পারে?”
সাইয়িদা নাফিসা তাহিরা আল আবিদা কাবাতুল্লাহ দেখতে পেলে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলতেন,”মাতি আনি বি রিদ্বাকা আন্নি” (mati`ani bi-ridaaka `annee) “প্রভু! আমার প্রতি তোমার সন্তুষ্টি ব্যতীত আমার কিছুই চাওয়ার নেই।”
(✰) গুলবাগিচায় ফুটলো কলিঃ
সাইয়িদ ইসহাক আল মুতমাঈন ও সাইয়িদা নাফিসাহ আত তাহিরা। রাসুলের ফুলবাগানে যেন শুধু পুষ্পবীথি নয়, দুই সাগরের মিলন মোহনা- মারাজাল বাহরাইন। মহান হাবীবের উত্তরসূরী দম্পতির দু’ কোল আলো করে জন্ম নিলেন সাইয়িদ আল-কাসিম ও সাইয়িদা উম্মে কুলছুম। যারা উভয়ই তাঁদের পবিত্র জননীর দুনিয়ার জমিন ত্যাগের পর অন্তিম শয়ানে যান এবং জান্নাতুল-বাকীতে সমাধিস্থ হন।
(✰) উদারতার ধ্রুবতারাঃ
সাইয়িদা নাফিসাহ আত তাহিরা রাঃ আধ্যাত্মিকতার এক সমুজ্জ্বল তারকা হয়ে আপন দ্যুতির বিভায় বিশ্ব আলোকিত করেন। তাঁর রুহানি মজলিসে নিয়মিত অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ ওলামা, মাশাইখ, ইমাম, মুফাসসির, মুহাদ্দিস। এমনকি যুগের মোজাদ্দিদ, যুগান্তরের ইমাম, কুতুব, নুকাবা সকলেই তাঁর দোয়া ও স্নেহাশিস প্রার্থী ছিলেন। যথাসময়ে আমরা তাঁর মজলিসে অংশগ্রহণকারী পূণ্যাত্মা মহৎ ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করবো ইনশাআল্লাহ। এই পূণ্যাত্মাদের অন্যতম ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ ওলী, এখনো আউলিয়ায়ে কামেলীনদের শান উল্লেখ করতে গেলে যাঁকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হয় সেই হযরত বিশর ইবনে হারিছ, মহাকালের স্রোতধারায় যিনি রুহানিয়তের অনন্য রাহী হিসেবে সুপরিচিত হন বিশর আল হাফী (রাঃ) নামে। একদা অসুস্থতার কারণে বিশর আল হাফী মায়ের মজলিসে যোগ দিতে পারেন না। ভক্তকূলের পবিত্র মুকুট, পরম মমতাময়ী আম্মাজান সাইয়িদা নাফিসাহ আত তাহিরা ছুটে চললেন প্রিয় ভক্ত বিশর আল হাফী’র কুটিরে। তিনি যখন আল হাফী কুটিরে নীত হন তখন সেখানে উপস্থিত যুগের মোজাদ্দিদ, যুগান্তরের ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল। তিনি পর্দানশীন সাইয়িদা নাফিসাহ আত তাহিরা কে চিনতে পারেন না। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল বিশর আল হাফীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কে এই মহীয়সী?” বিশর আল হাফী জবাব দিলেন, “হযরাত! ইনি অতুলনীয় পবিত্র রমণী! নবী বাগানের অতুল গোলাপ! অধমের অসুস্থতার কথা শুনে জননী আমায় দেখতে এসেছেন।”
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল আরজ করলেন, “আহলে বায়তে আতহার এঁর এই রাজকুমারীকে আমাদের জন্য প্রার্থনা করতে অনুরোধ করো।’
বিশর শুধালেন, “জননী! আমাদের জন্য প্রার্থনা করুন।”
দয়ার মূর্ত প্রতীক সাইয়িদা নাফিসাহ আত তাহিরা দু হাত তুলে মাওলাকে ডাক দিলেন, “আয় রাহমান! বিশর ইবনুল হারিছ এবং আহমদ ইবনে হাম্বল জাহান্নামের আগুন থেকে আপনার সুরক্ষা প্রার্থী। সুতরাং এ থেকে তাদের রক্ষা করুন হে পরম করুণাময়।” পরিচিত অপরিচিত নিকট দূরের সবার জন্য এভাবে উন্মুক্ত দোয়া বিতরণ করতেন রসুল ﷺ- বাগের অতুল গোলাপ সাইয়িদা নাফিসাহ আত্ তাহিরা।
(✰) মদীনা থেকে রাজধানীতেঃ
আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থের লিখক আবুল ফিদা হাফিজ ইবনে কাসির আদ দামেশকী (রহ.) বলেন, ইমাম নাসাঈ আলাইহির রাহমা তাঁর উর্ধ্বতন সনদে সাইয়িদ আবু মুহাম্মদ হাসান আল আনওয়ার এর মাধ্যমে তাবেয়ী হযরত ইকরিমা (রাঃ) সূত্রে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাঃ) হতে এ হাদীস রিওয়ায়াত করেছেন, রাসুলুল্লাহ ﷺ- ইহরাম অবস্থায় শিংগা লাগিয়েছেন।
সাইয়িদা নাফিসা আত্ তাহিরা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহার পিতা হযরত আবু মুহাম্মদ হাসান আল আনওয়ার ইবনে জায়দ আবলায ইবনে ইমাম হাসান মদীনায় পাঁচ বছর খলীফা মানসুরের নায়িব (গভর্নর) ছিলেন। তিনি মদীনায় গভর্নর হিসেবে অর্পিত দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করে জনগণের প্রিয়ভাজন ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেন। একজন সুশাসক ও ন্যায়পরায়ণ আমীর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর খ্যাতির বার্তা রাজধানী বাগদাদে ছড়িয়ে গেলে খলিফা তাঁকে মদীনাতুল মুনাওয়ারা থেকে মদীনাতুস সালামে (রাজধানী বাগদাদে) তলব করে পাঠান। সপরিবারে বাগদাদ পৌঁছালে সাইয়িদ হাসান আল আনওয়ার’ কে খলিফা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু বাগদাদের গভর্নর পদে নিয়োগ দান করেন।
(✰) জুলুমের জিনজিরায়ঃ
যুগ যুগ ধরে আহলে বায়তে আতহার এঁর সদস্যরা আপামর জনসাধারণের কাছে ভক্তি শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বরিত। বাগদাদের জনগণ আহলে বায়তের এ মহান পুরুষকে কাছে পেয়ে উৎফুল্ল হয়। লোকজন তাঁর আধ্যাত্মিকতার রসপানে গৌরবান্বিত হয়। তিনি তাঁর সুশাসন ও ন্যায়পরতার পাশাপাশি সাইয়িদজাদা হওয়ায় বাগদাদ এর সাধারণ মানুষের মধ্যমণি হয়ে উঠেন। আর এ জনপ্রিয়তাই কাল হয়ে দাঁড়ায়। খলিফা আবু জাফর আল মানসুর ঈর্ষান্বিত হয়ে মনে করতে থাকেন গভর্নর সাইয়িদ হাসান আল আনওয়ার একে তো সুশাসক, তার উপরে তিনি হলেন সাইয়িদজাদা। এতে মানুষ তাকে সম্মানিত করতে থাকলে এক সময় এ গভর্নর তার ক্ষমতার মসনদে হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারেন। পরে কোনো কারণ দর্শানো ব্যতিরেকেই খলিফা আবু জাফর আল মানসুর তাঁকে গভর্নর পদ থেকে বরখাস্ত করেন এবং তাঁর যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ও সঞ্চয় বাজেয়াপ্ত করলেন এবং তাঁকে বাগদাদে কারারুদ্ধ করে রাখলেন৷ সাইয়িদা নাফিসাহ আত্ তাহিরা প্রিয়তম পিতার বিচ্ছেদে এক আল্লাহর দরবারে নীরবে নিভৃতে অশ্রুজলে সিক্ত হয়ে বিনিদ্র রজনী কাটানো শুরু করেন।
[হাফিজ ইবনে কাছির তাঁর আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া-তে বলেন, ইতিপূর্বে হানাফী মাযহাবের ইমাম নু’মান ইবনে ছাবিত আবু হানিফা (রাহঃ)ও খলিফা আল-মনসুর কর্তৃক কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। এমনকি মালিকী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম মালিক ইবনে আনাসও তার শাসনামলে নিপীড়িত হন। তবে ইমাম মালিক এর উপর নিপীড়নে আল-মনসুর জড়িত ছিলেন না, মূলত তার এক ভাই যিনি ঐ সময় মদীনার শাসক ছিলেন তিনিই এজন্য দায়ী। আল মানসুর পরে তার ভাইকে শাস্তি দেন এবং ইমাম মালিককে সমর্থন করেন।]