ভালোবাসা
রায়হান ক্বাদেরি
ইফতারের সময় টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখি কোথাও আনারসের শরবত নেই। আমি স্ত্রী শিলাবৃষ্টিকে ডেকে বললাম, শুধু লেবুর শরবত দেখছি। আনারসের শরবত কোথায়?
শিলাবৃষ্টি মাথা নিচু করে বললো, আনারসের শরবতটা বানানোর সময় পাইনি!
কথাটা শুনার পর মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। তাকে ধমক দিয়ে বললাম, তুমি কি রাষ্ট্র পরিচালনা করো যে শরবত বানানোর সময় পাওনি? সারাদিন রোজা রাখার পর একটু যে আনারসের শরবত খাবো সেটাও আমার কপালে নাই!
শিলাবৃষ্টি আর কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এ মেয়েকে নিয়ে এই এক সমস্যা; কোনো কাজ পরিপূর্ণভাবে করতে পারে না।
দুপুরের দিকে তাকে বললাম, ফ্রিজে কি মুরগির গোশত আছে?
শিলাবৃষ্টি বললো, হ্যাঁ, আছে।
আমি বললাম, এক কাজ করো তো; আজ ইফতারিতে মুরগির গোশত দিয়ে চপ বানিও!
আমার কথা শুনে নিষ্পলক নয়নে অধোবদনে হা করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি কিছুটা ধমকের সুরে বললাম, এইভাবে মাছের মতো হা করে তাকিয়ে আছো কেন?
অবাক শিলাবৃষ্টি আমতা আমতা করে বললো, মুরগির গোশত দিয়ে কীভাবে চপ বানায়?
এমনিতেই রোজা রেখেছি আর এখন মধ্যদুপুর। গরমে মেজাজ এমনিতেই খারাপ, তার উপর শিলাবৃষ্টির এই কথা শুনে মেজাজটা আরো খারাপ হয়ে গেল। শিলাবৃষ্টির দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললাম, তোমার মা কি তোমায় রান্না বান্না কিছু শিখিয়ে বড় করেনি? যেটা বানাতে বলি সেটাই দেখি পারো না। আমি জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল করেছি তোমাকে বিয়ে করে!
শিলাবৃষ্টি কিছু না বলে চুপচাপ আমার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। রাগকে বিরক্তিতে রূপান্তর করে আমি পাশের রুমে চলে গেলাম। এই মেয়েটাকে দেখলেই আমার আজকাল রাগ লাগে! দিন দিন আমার ওকে অসহ্য মনে হচ্ছে…!
সেহরির সময় ভাতে হাত রাখতেই বুঝলাম তুষারশুভ্র ভাতগুলো হিম হয়ে আছে! আমি কিছু না বলে শুধুই শিলাবৃষ্টির দিকে তাকালাম। আমার রগচটা চেহারা দেখে সে ভয়ে মাথা নিচু করে বলল,
– আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে। এখন গরম ভাত রান্না করলে আযান দিয়ে দিবে। আজ একটু কষ্ট করে ঠান্ডা ভাত খেয়ে নাও না, প্লিজ! কাল থেকে আর এমন হবে না।
শিলাবৃষ্টির কথা শুনে উনাকে আর কিছু বললাম না। চুপচাপ ভাতের প্লেটটা সরিয়ে রেখে টেবিল থেকে উঠে পড়লাম…
আমার বন্ধু কম; কয়েকজনমাত্র। খালিদ তাদের একজন। খালিদের বাসায় আজ ইফতারের দাওয়াত। বাসা কাছাকাছি হওয়ায় একটু তাড়াতাড়িই চলে গেলাম; একাই গেলাম। কলিংবেল বাজাতেই খালিদ দরজা খুললো। তার চেহারাসুরত দেখে তো আমি অবাক! ওর সারা মুখে পাউডারের মতো সাদা কী যেন লেগে আছে! খালিদকে বললাম, তোর এই অবস্থা কেন?
খালিদ মুচকি হেসে বললো, ইফতারি বানানোর কাজে অর্পিতাকে(খালিদের স্ত্রী) একটু হেল্প করছিলাম।
আমি তখন বললাম, তুই রোজা রেখে রান্নাবান্না করছিস?
খালিদ অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, তুই গাধা নাকি? শুধু তো আমি একা রোজা রাখিনি; অর্পিতাও তো রেখেছে। অফিস যেহেতু ছুটি সেহেতু আমি রোজা রেখে সারাক্ষণ বাসায় শুয়ে বসে দিন পার করি কিন্তু অর্পিতার কোনো ছুটি নেই। ও রোজা রেখে ঘর গুছাচ্ছে, কাপড় ধুচ্ছে, রান্নাবান্না করছে, আবার ইফতারিও বানাচ্ছে। বেগুনী, আলুর চপ, বুট-ভরা খেতে যতটা মজা এইসব বানানো ঠিক ততটাই কঠিন। ও একা হাতে সব কিছুই সামলায়; আমি মাঝে মধ্যে একটু হেল্প করি এই যা।
ইফতারের সময় আমি আড়চোখে খালিদ আর অর্পিতাকে দেখছিলাম। অর্পিতার প্রতি খালিদের ভালোবাসা দেখে নিজেকে তখন অমানুষ মনে হচ্ছিলো। হঠাৎ অর্পিতা খালিদকে বললো,
– তোমার শরবতে তো ইসপগুলের ভুসি দিতে ভুলে গেছি!
খালিদ মুচকি হেসে বললো,
– আরে দূর, একদিন ইসপগুলের ভুসি না খেলে কিচ্ছু হবে না।
খেতে খেতেই নিজেকে খালিদের জায়গায় দাঁড় করালাম। আজ যদি শিলাবৃষ্টি এমন ভুলটা করতো আমি হয়তো ওকে প্রচন্ড রকম গালিগালাজ করতাম, মুখে না হলেও মনেমনে; অন্যদিন যেমনটা করি। অথচ একদিন আনারসের শরবত না খেলে কিছুই হতো না। আমি শুধু আমার দিকটাই ভেবে দেখেছি, অথচ আমার পাশে একজন রোজাদার মানুষ কত কাজ করছে সেটা আমার কখনো কোনোদিন চোখেই পড়েনি! মাগরিবের পর বাসায় ফিরতে ফিরতে প্ল্যান করলাম; আজ থেকে ভালো মানুষ হয়ে যাবো, খুব ভালো, আমার শিলাবৃষ্টির কাছে, সে আমার মেহবুবা, আমার হৃদয়া, আমিও তার মেহবুব হবো আজ থেকে, তারই মতো করে; সবাই আমাকে মন্দ বলুক তাতে কিচ্ছুটি যায় আসে না।
বাসায় পৌঁছে এশা পড়ে চুপিসারে ঘুমিয়ে গেলাম! সেহরির সময় শিলাবৃষ্টির কপালে হাত রেখে তাকে ডাক দিতেই ও তাড়াহুড়ো করে ঘুম থেকে উঠলো। তার হরিণী চোখদুটোতে আমাকে দেখে কিছুটা ভয়েভয়ে বললো,
– আমি আজকেও দেরি করে ফেললাম, তাই না? কিছু মনে করো না, প্লিজ! আমি এক্ষুণি রান্না করছি!
আমি মুচকি হেসে বললাম,
– আমি রান্না করে ফেলেছি! তবে মাছের তরকারিটা মনে হয় খুব বেশি ভালো হয়নি। আজ একটু কষ্ট করে খেয়ে নাও, প্লিজ। আর হ্যাঁ, কাল আমায় মাছের তরকারি রান্না করা শেখাবে, বিনিময়ে মুরগীর গোশত দিয়ে কীভাবে চপ বানাতে হয় সেটা তোমায় শিখাবো।
এতদিনের আমার আজকের কথা শুনে শিলাবৃষ্টি প্রপাত ধরণিতল হয়ে আমায় কিছু বলতে চাচ্ছিল, কিন্তু ওকে থামিয়ে দিয়ে ওর হাতটা ধরে বললাম,
– আমার এতদিনের ব্যবহারের জন্য আমায় মাফ করে দিও, প্লিজ! কথা দিচ্ছি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো স্বামী হয়ে তোমাকে দেখাবো। তখন তোমার চোখে আমার প্রতি ভয় না; শুধু ভালোবাসা দেখা যাবে।
[বি. দ্র. : সকল মুসলমান ভাইদের প্রতি ভালবাসাপূর্ণ একটা অনুরোধ! আপনি যেমন রোজা রাখেন তেমনি আপনার মা বোন স্ত্রী কন্যারাও রোজা রাখে। ইফতারে দুয়েকটা আইটেম কম হলে রাগারাগি না করে বরং ইফতার বানানোর কাজে উনাদের যতটা সম্ভব সাহায্য করুন। বেশি কিছু না পারলেও অন্তত শরবত বানানোর দায়িত্বটা নিজে নিন না। সবাইকে পবিত্র মাহে রমজানের শুভেচ্ছা।]
.
সংগৃহীত একটা পোস্টের ভিত্তিতে আপাতভবিষ্যতকে কল্পনার তুলিতে আঁকার খানিক প্রয়াস।