পরহেজগার খুনি
✍️ আবুল হাসান মুহাম্মদ বায়েজিদ
[২১ রমজান শেরে খোদা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুর পবিত্র শাহাদাত দিবস উপলক্ষে নিবেদিত, মনোযোগ দিয়ে পড়ার ও অনুধাবনের আরজি রইল]
============================
ধোকাবাজী আর প্রবঞ্চনাময় এই দুনিয়ায় প্রতারকদের চিহ্নিত করা প্রায়শ:ই মুশকিল হয়ে যায়। নেকছুরতে ঠকবাজীর ঘটনায় ইতিহাসের পাতা ভরপুর হয়ে আছে। কিন্তু এরপরও কি আমরা সতর্ক হয়েছি? ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হল ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না, সাবধান হয় না। ফলে মানবরূপি শয়তান ধোকাবাজরা প্রতারণা করেই যায়।
আজকে আপনাদের ইতিহাস নিকৃষ্ট এক ঠক-ধোকাবাজ-প্রতারক খুনীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। যে হন্তারক ওলী-আল্লাহর ছুরতে নির্মমভাবে শহীদ করেছিল মাওলায়ে কায়েনাত, প্রিয়নবী ﷺ এর অতীব প্রিয় সহচর, সাইয়্যেদায়ে কায়েনাত ফাতেমা যাহরার পতি, জান্নাতের যুবকদের সর্দার ইমাম হাসান-হুসাইন সালামুল্লাহে আলাইহিমের পিতা শেরে খোদা হযরত আলী ইবনে আবি তালেব আলাইহিস সালামকে। আমীরুল মোমেনীন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু সেদিন ফজরের সালাত আদায়ের জন্য মসজিদের উদ্দেশ্য বের হয়েছিলেন। আশপাশের মানুষদের আস সালাত, আস সালাত আহ্বান করতে করতে সামনে এগুচ্ছিলেন। আচানক মাথার উপর তরবারীর ধারালো আঘাত এসে পড়লো। প্রথম আঘাত ঠিক মত না লাগায় নরপিশাচ আবারও সজোরে আঘাত করলে এবার আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু মারাত্মকভাবে আহত হলেন। তার শুভ্র নুরাণী চেহারা-দাঁড়ি রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল। তিনি সজোরে বলে উঠলেন- فزت ورب الكعبة রব্বে কা’বার শপথ আমি সফল হয়ে গেছি। অর্থাৎপরম কাঙ্খিত শাহাদাত সন্নিকটে দেখে এটাকেই তিনি মহা সফলতায় অভিহিত করেছেন।
কে সেই খুনী? তার নাম-পরিচয় কি? সে কেমন প্রকৃতির লোক ছিল?
আপনি মনে মনে ধারণা করছেন সে হয় তো চরম দুষ্ট প্রকৃতির, ছুরত-ছিরতে ষন্ডা-পান্ডা জাতীয় কেউ। এটা মনে করলে ভুল হবে। কারণ ঐ খুনী মোটেও গুন্ডা-সন্ত্রাসী ছুরতের ছিল না। বরং সে ছিল পাক্কা আল্লাহওয়ালা টাইপের। ঐতিহাসিকগণ তার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন-
তার নাম -আবদুর রহমান বিন মুলজিম হিমইয়ারী লা’নাতুল্লাহে আলাইহি। সে কি বদ আমল-আখলাক, নেশাখোর, বে-নামাজী ইত্যাদি ছিল? জ্বি না!
তার ব্যাপারে বলা হয়েছে সে আল্লাহকে এত বেশি সেজদা দিত যে তার চেহারায় ‘আছারুছ সুজুদ’ তথা সেজদার আলামত প্রকাশ্যে ছিল, সে ছিল অধিক ইবাদতগুজার, আল্লাহর প্রতি অধিক অনুগত, সময়ের অন্যতম সেরা ক্বারীউল কুরআন, প্রখ্যাত সাহাবী হযরত মুআজ বিন জাবাল রাদি. এর কাছে সে কুরআন শিখেছে, ফিকহী জ্ঞানেও তার বিশেষ পান্ডিত্য ছিল। সুললিত কন্ঠে কুরআন তেলাওয়াত জানায় হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে মিসরে হযরত আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে পাঠিয়েছিলেন মানুষকে কুরআন শিক্ষা দেয়ার জন্য। ছুরত-ছিরতে, ইবাদত-বন্দেগীতে সে ছিল পাক্কা বুযুর্গ। চেহারাও ছিল সুন্দর-আকর্ষণীয়, মাথার চুল সুন্নতী বাবরি তরিকায়। দিনরাত মসজিদে পড়ে থাকতো আল্লাহর জিকির আর ইবাদতে।
অথচ এই মানুষটিই কি না শেরে খোদা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে শহীদ করলো? বাহ্যিক ছুরতে পাকা ধার্মিক, বড় হুজুর আর অন্তরে কি পরিমাণ বিষ? আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে যে তরবারী দিয়ে আঘাত করেছে তাতে সে একমাস যাবত মারাত্মক বিষের প্রলেপ দিয়েছে। নামাজ-রোজা, কুরআন তেলাওয়াত-তাহাজ্জুদের আড়ালে সে ছিল মূলত: জাহান্নামের কুকুর খারেজী। কি সাংঘাতিক আকিদা ছিল তার! মুমিনদের মাওলা তথা অভিভাববকে শহীদ করেছে তাও আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তে।
এই দুষ্ট-দুরাচারকে ধরে যখন ইমাম হাসান মুজতাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুর সামনে আনা হলো- তখন তিনি তাকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমাকে এমন এক আঘাত করব তাতে তুমি জাহান্নামে পৌঁছে যাবে। জবাবে সে বলল, আমি যদি জানতাম এ ক্ষমতা (জাহান্নামে দেয়ার) তোমার হাতে থাকতো তাহলে তোমাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করতাম না। অত:পর তার দুই হাত দুই পা কর্তন করা হলো। এ অবস্থায়ও সে অনবরত আল্লাহর জিকির করতেছিল। যখন তার জিহ্বা কাটতে চাইল তখন সে ছটফট করতে লাগল; আর বলতেছিল আমার ইচ্ছা ছিল এই জিহ্বা সর্বদা আল্লাহর জিকিরে সিক্ত রাখবো। চিন্তা করে দেখুন আল্লাহর প্রতি কিরূপ ভক্তি-ভালোবাসা তার? কিন্তু কোন কাজে আসবে? রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কলিজার টুকরাকে খুন করেছে তাও আবার আল্লাহকে খুশী করার জন্য! এরা ছিল ইসলামের লেবাসে ধোকাবাজ-প্রতারক। এ যুগেও এমন অনেক প্রবঞ্চক-ঠক আছে। যাদের ছুরত-ছিরত বুযুর্গীতে ভরা, কুরআন-হাদিসেও পারদর্শী, মুখে মিষ্টি মধুর ভাষা, কুরআন তেলাওয়াত হৃদয় কেড়ে নেয় কিন্তু অন্তরভরা নবী বিদ্বেষ, আহলে বাইতের প্রতি শত্রুতায়। সুতরাং সতর্ক থাকুন। কারও মুখের মধুর কথায় গলে যাওয়ার আগে তাকে মহব্বতে রাসূল, মহব্বতে আহলে বাইত, তা’জীমে সাহাবার নিক্তিতে মেপে দেখুন। নইলে আপনার নামাজ-রোজা জিন্দেগীর সব ইবাদত বিফলে যাবে।
[পোষ্টে উল্লেখিত তথ্যসমূহ সংগ্রহ করা হয়েছে- বিদায়াহ নেহায়াহ, সিয়ারু আ’লামীন নুবালা, আ’লাম লি যারকালী, লিসানুল মিজান, আল ইস্তেয়াব ফি মা’রেফাতিল আসহাব প্রভৃতি নির্ভরযোগ্য কিতাব থেকে]