
বাংলা সাহিত্যে মাওলা আলী : একটি সংক্ষিপ্ত সংকলন
🖋 আবু সাঈদ নয়ন
কবি, সাহিত্যিকদের একটি চিরজাত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নিজ-নিজ গোত্র, জাতি বা সম্প্রদায়ের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা তাদের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। আর তাদের একটি চিরজাত উদ্দেশ্যে হচ্ছে, কবিতা বা সাহিত্যের মাধ্যমে স্ব-সম্প্রদায়, জাতিকে জাগিয়ে তোলা, অনুপ্রাণিত করা। ইসলামের চতুর্থ খলিফা মাওলা আলী যখন বাংলা কবিতায় স্বতন্ত্র বিষয় হয়ে উঠলেন তখন বাঙালি-মুসলমান জীর্ণশীর্ণ কাঁথা গায়ে জড়িয়ে কালঘুমে ডুবন্ত। আর সেজন্যই আমরা দেখতে পাই, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের পূর্বে যত কবি, সাহিত্যিক মাওলা আলীকে বিষয় হিসেবে নিয়েছেন প্রত্যেকেই মাওলা আলীর খায়বার বিজয়, জুলফিকার ইত্যাদিকেই একমাত্র প্রকরণ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। খায়বার বিজয়ে শেরে খোদার অসাধারণ শক্তিমত্তা প্রদর্শন এবং জুলফিকার তরবারির ঐতিহাসিকতা কাব্যের রঙে রঞ্জিত করে বাঙালি-মুসলমান সাহিত্যিকবৃন্দ স্ব-সম্প্রদায়কে কালঘুম থেকে উদ্ধার করতে চেষ্টা করেছিলেন। আর এ চেষ্টার ফাঁকে যে, মাওলা আলীর সমগ্রজীবনের মহত্ত্ব, প্রজ্ঞাপ্রণালী এবং মানবিক জীবনবোধ তাঁদের কাব্যের বিষয় হয়ে উঠেনি তা ভেবে আফসোস না করে উপায় নেই।
বাংলা গদ্যে মাওলা আলীর চর্চা কতটুকু হয়েছে তা সুস্পষ্টভাবে বলা যায় না। ‘সংস্কৃত কথা’ গ্রন্থের লেখক কাজী মোতাহার হোসেন হযরত আলীর ব্যাপারে একটি খসড়া তৈরি করছিলেন। কিন্তু কবি কায়কোবাদ যেভাবে গাউসে পাকের জীবনী রচনায় হাত দেবার পূর্বে তাঁর পীর সাহেবের সাথে হায়াতের মেয়াদ অকালে ফুরিয়ে না-যাবার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন সেভাবে কারো সাথে চুক্তিবদ্ধ না থাকায় খসড়া সম্পূর্ণ করার পূর্বেই ইন্তেকাল করলেন। তবে, যতটুকু লিখেছেন ততটুকু তাঁর রচনাবলীতে সংযুক্ত আছে। কেন্দ্রীয় বাঙলা উন্নয়ন বোর্ডের নির্দেশনায় ১৯৬৮ সালে সাহিত্যিক আবুল ফজল “হযরত আলী” শিরোনামে যে গ্রন্থটি রচনা করেছেন সেটিই এখনো পর্যন্ত বাংলা গদ্যে লিখিত মাওলা আলীকে নিয়ে শ্রেষ্ঠতম কাজ। এ গ্রন্থে মাওলা আলীর জীবনের বিভিন্ন অংশকে খণ্ড-খণ্ড করে যেভাবে পাঠকসমীপে হাজির করা হয়েছে তা খুবই গুরুত্ববহ। আহমদ পাবলিশিং হাউসের প্রকাশনায় গ্রন্থটি এখনো পাওয়া যায়।
আলাওল থেকে শুরু করে আব্দুল মান্নান সৈয়দ পর্যন্ত প্রায় সকল বাঘা-বাঘা বাঙালি-মুসলিম সাহিত্যিকের রচনাসমগ্রে মাওলা আলীর উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। তবে স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে বাংলা কাব্যে তাঁর পদচারণা উনিশ শতকের পূর্বে ঘটেনি। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম বাঙালি-মুসলমান কবি হিসেবে ধর্তব্য দাদ আলীর কবিতা থেকে আরম্ভ করে সর্বশেষ আল-মাহমুদ তক প্রায়-প্রতিজন প্রভাবশালী বাঙালি-মুসলমান কবির রচনায় স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবেই হাজির হয়েছেন তিনি। তবে, পরিস্থিতি অনুকূলে না-থাকায় এখানে আমরা মাত্র চারজন কবির কাব্য হাজির করার সুযোগ পাবো।
১. কাজী নজরুল ইসলাম: নজরুল ইসলাম ব্যক্তিকে বিষয় হিসেবে নিয়ে যত কবিতা, পদ্য লিখেছেন প্রতিটিতেই তাঁর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো, তাঁদের জীবনের বিভিন্ন উপকথা পদ্যে অলঙ্করণের মধ্য দিয়ে বাঙালি-মুসলমানদের জীবনবোধ জাগিয়ে তোলা। মাওলা আলীকে নিয়ে কাজী নজরুল যে একমাত্র সঙ্গীতখানা রচনা করেছেন তাতেও উক্ত উদ্দেশ্যের ব্যত্যয় ঘটেনি। “খয়বর জয়ী আলী হাইদার”কে কতটা প্রাণোচ্ছলতায় সঙ্গীতে প্রকাশ করতে পেরেছেন নজরুল তা-ই আমরা দেখবো।
“খয়বর-জয়ী আলী হাইদার, জাগো জাগো আরবার,
দাও দুশমন দুর্গ-বিদারী দুধারী জুলফিকার।
এস শেরে খোদা ফিরিয়া আরবে
ডাকে মুসলিম ‘ইয়া আলী’ রবে,
হায়দারী হাঁকে তন্দ্রা-মগনে কর কর হুঁশিয়ার।
আল-বোর্জের চূড়া গুড়া-করা গোর্জ আবার হানো,
বেহেশতী সাকী, এ মৃত-জাতিরে আবে কওসর দানো,
আজি বিশ্ব-বিজয়ী জাতি যে বেহোঁশ্,
দাও তারে নব কুয়ত ও জোশ্,
এস নিরাশার মরুধূলি উড়ায়ে দুল্ দুল্ আস্ওয়ার।”
২. ফররুখ আহমদ: হযরত আলীকে নিয়ে বাংলা ভাষায় দীর্ঘতম কবিতাটি লিখেছেন কবি ফররুখ আহমদ। বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ফররুখ রচনাবলীতে সাত পৃষ্ঠা জুড়ে বিস্তৃত এ কবিতাও ‘খায়বার-জয়ী আলী হায়দর’র শক্তিমত্তা, প্রাণাবেগের বিবরণে উচ্ছলিত। তবে আশার বাণী হলো, মাওলা আলীর জীবনের মহত্ত্ব ও মানবিকবোধেরও বিচ্ছুরণ কিছু ঘটেছে এখানে। আর এজন্যই, হযরত আলীকে নিয়ে রচিত এ কবিতাটি পড়ে যে কোনো শ্রেণির পাঠকের তৃপ্তির পূর্ণতা জেগে উঠতে বাধ্য। আমরা আ-নখ-শির পুরো কবিতাটি চয়নের দুঃসাহস দেখাতে পারছি না, কেবল দু’টি অংশ তুলে ধরছি। ফররুখ আহমদ কি জানতেন যে, তিনি নিজেই অবচেতনে দু’টি অংশে পুরো কবিতার মর্মশাঁস পুঞ্জীভূত করে রেখেছেন?
“সে কী তূরন্ত দুরন্ত-গতি মরুতে ঝড়ের বেগে!
জড়পিণ্ড এ বিয়াবানে বুঝি আগুন উঠেছে জেগে
হাজার ঘোড়ার খুরের আঘাতে লক্ষ উলকা জ্বলে,
দিগকাওসের বাঁকা রেখা উড়ে চলে,
তীরের মতন বেগে স‘রে যায় পদতলে মরুভূমি,
শহীদের খুনে মরণ তূফান জীবনের মৌসুমী …
তারি সাথে ঘন চমকায় হাতে দুধারী জুলফিকার,
নিমেষে সূর্য ছিঁড়ছে শাণিত অস্ত্রে আঁধি-প্রাকার
চমকে জুলফিকার
জেহাদের মাঠ চাষ ক’রে তার মেঘে উঠে হুংকার …
হে মহামানব! তুমি শুধু নও বীর তলওয়ারধারী
অসংযমের উপর হেনেছ সত্যের তরবারী,
কোন মলিনতা করেনি তোমার চিত্ত কলুষ কভু
আল্লাকে ছাড়া আর কারু তুমি মানো নাই তব প্রভু
তাঁর নির্দেশ মাথা পেতে নিয়ে তব অলঙ্ঘ শির,
সবার উপরে র’য়েছে ঊর্ধ্বে সব পাপ-গোলামীর।
আল্লার পথে জানি তুমি শুধু ধরিয়াছো তরবারি,
চির-সংযমী ভুলেও কখনো হওনি অত্যাচারী,
কাফেরের থুথু সারা মুখে নিয়ে নাও নাই প্রতিশোধ,
আল্লার দাস দমন ক’রেছে সব অন্যায় ক্রোধ।
ফেরেশতাদের ঊর্ধ্বে তুলেছে তোমারি সে মানবতা
হে সুফী সাধক ! তাই জিনিয়াছ নভঃ দুর্লংঘতা!
প্রজ্ঞাপূর্ণ মহানগরের হে বিরাট শাহীদ্বার!
তাছাওফের যে নূরানী ঈলমে তনুমন একাকার,
তার নিভৃত ইংগিত পেয়ে নলবনে উঠে সুর
শামাদানে জ্বলে প্রেমের শিখায় বেদনা যে অবগাহী
কোটি মুসলিম পেয়েছে ফিরিয়া চিত্তের বাদশাহী!
মহানগরের হে শাহী দরজা ! তোমার আকাশ খোলা!
সম্মুখ দিয়ে পার হ’য়ে যায় হূরের চতুর্দোলা
হে নূর পিয়াসী! কে রাখে তার খবর?
আল্-আহাদের সন্ধানে তার নাই তিল অবসর!
আল্লা’র কাছে ক’রেছে সে তার পূর্ণ সমর্থন,
তাই সে মানে না অত্যাচারীর, জালিমের বন্ধন,
তাই মরুপাটে রুদ্ধ কপাট ডাকে যবে খায়বার,
অমনি সূর্য ঝলসে তোমার দু’ধারী জুলফিকার।”
৩. বে-নজীর আহমদ: মাওলা আলীর বিষয়ে সর্বাধিক, ৩টি কবিতা লিখেছেন কবি বে-নজীর আহমদ। দুইটি ‘জুলফিকার’ শিরোনামে, আরেকটি ‘শেরে খোদা’ নামে। বে-নজীরের কাছে খায়বার-জয়ী আলী হায়দারই একমাত্র কাব্যাঙ্কিত হয়েছে; মাওলা আলীর জ্ঞান-প্রজ্ঞা, জীবনের মহত্ত্ব নিয়ে তিনি একেবারেই নীরব। কারণ কি? তিনি সন্ত্রাস ছিলেন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ধরা পড়ে বৃটিশ কারাগারে জেলও খেঁটেছেন। এমন একজন কবির কাছে ‘খায়বার-জয়ী’ আলীই যে প্রাধান্য পাবে তা সহজেই অনুমেয়। ‘শেরে খোদা’ কবিতার শেষাংশ তুলে দিচ্ছি:
“শেরে খোদা আজ তোমারে জানাই আমাদের ফরিয়াদ,
শেরের বাচ্চা ফেরু বনে গেছে ভুলে গেছে লহু স্বাদ।
ভুলে গেছে তার জোয়ানী জাদিদ শহীদের সুধা সাধ,
ভুলে গেছে তার জঙ্গী জাহান তশবীর জয়-নাদ,
ঝাণ্ডার নয়া স্বাদ।
জিন্দারা আজ বান্দারে সেবে জিন্দেগী বরবাদ।
শেরে খোদা আজ তোমারে জানাই আমাদের ফরিয়াদ।”
৪. আব্দুল মান্নান সৈয়দ: বাঙালি-মুসলমানের মধ্যে আব্দুল মান্নান সৈয়দকে একমাত্র কবি মনে করি, যিনি মাওলা আলীর জীবনের মহত্ত্ব এবং মানবিকবোধকে তাঁর শক্তিমত্তা, হায়দারী হাঁকের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। এবং এজন্যই বাংলা ভাষায় মাওলা আলীর চর্চায় আব্দুল মান্নান সৈয়দকে আমি বিশেষ মনে করি এবং তাঁর কবিতাটিকে মাওলা আলীর ব্যাপারে ‘সম্পূর্ণ’ বলে বিবেচিত করি। কবিতাটির আপাদমস্তক তুলে দিচ্ছি।
“যোদ্ধা-কবি একইসঙ্গে, একই সঙ্গে রৌদ্রে-জোৎস্নায়
প্লাবিত তোমার আত্মা। ভাতৃরক্তে রাঙা পৃথিবীতে
চেষ্টা করেছিলে তুমি অফুরান শান্তি এনে দিতে
যে-ব্যর্থতা ভরে আছে লাবণ্য ও মহৎ আভায়।
আবুজরের সঙ্গেও গিয়েছিলে রাবজায় তুমি ;
উসমানকে বাঁচাতেও পাঠিয়েছিলে নিজেরেই পুত্রকে ;-
দরদী সেবক তুমি। অবিচল সুখে, শোকে।
বহু বিপরীতে গড়া তোমার আশ্চর্য মনোভূমি।
প্রজ্ঞার শহরে যিনি প্রদীপিত এক সিংহদ্বার,
মৃত্যু তাঁকে কি করবে? – তাঁকে আরো করেছে অবার।
খায়বরের যুদ্ধজয়ী, আসাদুল্লাহ, জ্ঞানেরও সম্রাট,
একই সঙ্গে যোদ্ধা-কবি : কালোত্তর, মহান, বিরাট।
রসুলের চারিত্রের রঙে রঞ্জিত বিশাল দিল্ –
আজ তাঁর প্রশংসায় ভরপুর সমস্ত নিখিল।”
বিশেষত: নজরুলের সঙ্গীতে ব্যবহৃত ‘দুধারী জুলফিকার’ শব্দগুচ্ছটি যে ফররুখ ঋণ নিয়ে তাঁর কাব্যের শ্রী বৃদ্ধির জন্যে বারংবার ব্যবহার করেছেন তা সচেতন পাঠকের দৃষ্টি এড়ানো সম্ভব নয়। আমার বিশ্বাস, নজরুলই বাংলা সাহিত্যে জুলফিকারের পূর্বে ‘দুধারী’ বিশেষণটির জন্মদাতা, এবং এক্ষেত্রে আমার বিশ্বাস যে অবিনাশী নয় সেটাও আমি বলছি না। মাওলা আলীর জ্ঞান নিয়ে একটি অতিখ্যাত হাদিসের ‘আলিয়্যুন বাবু-হা’ অংশটির অত্যন্ত চমকপ্রদ অনুবাদ করেছেন ফররুখ আহমদ : “প্রজ্ঞাপূর্ণ মহানগরের হে বিরাট শাহীদ্বার”। আব্দুল মান্নান সৈয়দ ফররুখের হুবহু অনুকরণ থেকে বাঁচতেই সম্ভবত কিঞ্চিৎ মার্জনা করে অনুবাদ করেছেন এভাবে : “প্রজ্ঞার শহরে যিনি প্রদীপিত এক সিংহদ্বার”। উভয়ের অনুবাদে ‘প্রজ্ঞা’ শব্দটি অত্যন্ত লক্ষ্যণীয়; আমরা কিন্তু হরহামেশা এ হাদিসের অনুবাদে ‘জ্ঞান’ শব্দটি ব্যবহার করি, এটি যথাযথ নয়। ‘প্রজ্ঞা’ও যে একেবারে পূর্ণাঙ্গ অর্থ বহন করে তা আমি বলছি না, কিন্তু তা অর্থ এবং ভাবের তুলনায় ‘জ্ঞান’ থেকে অনেক-অনেক নিকটবর্তী। সবশেষে নজরুল, ফররুখ সব ছাপিয়ে আব্দুল মান্নান সৈয়দের দু’টি পঙক্তিই আমার হৃদয়ে কামড় দ্যায়:
খায়বরের যুদ্ধজয়ী, আসাদুল্লাহ, জ্ঞানেরও সম্রাট,
একই সঙ্গে যোদ্ধা-কবি : কালোত্তর, মহান, বিরাট।






Users Today : 418
Users Yesterday : 759
This Month : 5452
This Year : 177323
Total Users : 293186
Views Today : 10126
Total views : 3465237