নিজস্ব মত আর প্রবৃত্তির চাহিদার উপর শতভাগ আমরাই সঠিক এই মানসিকতা আজ ১৪০০ পর এসে পুনরায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পবিত্র আহলে বাইত ও সাহাবী আমীরে মোয়াবিয়া (রা:)।হযরত আলী (রা) এর সাথে মোয়াবিয়া (রা) খেলাফত ভাগ, পরবর্তীতে ইয়াজিদের মনোনয়ন, নবী দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা) শাহাদাত এগুলো পুরোনো আলোচনা। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের এ বিষয়ে একটা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে। সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে একদিকে তারা যেমন আহলে বাইতে আতহারের মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করেনি তেমনি সাহাবা বিশেষত আমীরে মোয়াবিয়া (রা) কে নিয়েও এমন কোন মন্তব্য তারা করেনি যাতে সাহাবা মর্যাদায় আঘাত আসে। কিন্তু আজকে ফিতনার এই যুগে এসে পুনরায় এই আলোচনার কারণ কি? যে বিষয়গুলোর সমাধান আছেই, আমাদের চেয়ে কুরআন, হাদীস, ফিকহ, ইতিহাস, তাকওয়া, ফরহেজগারীতা, ইবাদত রিয়াজতে অতুলনীয় মানুষগুলো যেখানে সমাধান দিয়ে গেছেন সেখানে নতুন সমাধান খোজার মানে কি? এর পেছনে মূলত আহলে বাইতের ভালোবাসার আড়ালে শিয়াইজম আবার অপরপক্ষে আহলে বাইতের বিপক্ষে খারেজিয়তকে উসকে দেয়া নয় কি?এর পেছনে কি তাহলে অর্থই মূল কলকাটি? আসল আলোচনায় আসি।
১.মওলা আলী (রা) ও আমীরে মোয়াবিয়া (রা) এর যে দ্বন্দ্ব তা মূলত ইজতিহাদগত। এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা। এবং এই দ্বন্দ্বে আলী(রা) হক। কারণ তিনি মনোনীত খলিফা ছিলেন এবং তার উপর সবার ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু আমীরে মোয়াবিয়া (রা) বিরোধিতার মূল কারণ খেলাফত অস্বীকার নয় বরং তার কারণ ছিল হযরত ওসমান (রা) হত্যার বদলা নেয়া। চাচাত ভাই হিসেবে এটা দাবী করা করা তাঁর অধিকারে ছিল। কিন্তু তিনি পরিস্থিতিকে গুরুত্ব না দিয়ে দাবীর উপর অটল ছিলেন। এটাই তাঁর ইজতিহাদগত ভুল ছিল। আলী (রা) যখন তাঁকে এ ব্যাপারে বুঝাতে প্রতিনিধি নিয়োগ করেন তখন তাঁর জবাব ছিল ওসমান (রা) হত্যাকারীদের বিচার করা হোক। আমি বাইয়াত নিবো। কিন্তু সাবাইদের ষড়যন্ত্র এত গভীর ছিল যে আলী রা: পক্ষে তাৎক্ষণিক বিচার শুরু করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু মোয়াবিয়া রা: বিদ্রোহ করে বসেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে সিফফিন, জামালের মতো যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এখানে মূল ভূমিকা রেখেছে সাবাইরা। অর্থাৎ কোনভাবেই সুষ্ঠু আলোচনার পরিবেশ তারা তৈরি হতে দেয় নি। কিন্তু এখানেও আলী রা: হক ছিলেন যা রাসূল (দরূদ) ভবিষ্যৎবাণী আম্মার ইবনে ইয়াসীরের শাহাদাত দ্বারা প্রকাশ পায়। সুতরাং আমাদের এই মতটাই মানতে হবে। হক ছিল আলী রা: কিন্তু মোয়াবিয়া রা: ইজতিহাদগত ভুলের স্বীকার হয়েছেন। কিন্তু এটাকে যারা সমালোচনার ক্ষেত্র বানিয়েছে তাদের উচিৎ আল্লাহকে ভয় করা এবং সাহাবাদের সমালোচনার ব্যাপারে রাসূলে আকরামের সতর্ক বার্তাকে মাথায় রাখা।
২.ইয়াজিদের মনোনয়নের ক্ষেত্রেও মোয়াবিয়া রা: ইজতিহাদি ভুলের স্বীকার হয়েছেন। এই বিষয়টা পর্যালোচনা করতে গেলে সে সময়ের পরিস্থিতিতির দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মনে রাখা উচিৎ মোয়াবিয়া রা: হযরত ওমর রা: কতৃক মনোনীত গভর্নর ছিলেন। যেহেতু ওমর রা: নিয়োগ দিয়েছেন সেহেতু মোয়াবিয়া রা: যোগ্যতা সম্পর্কে তিনিই বেশি জানেন। এবং ওমর রাঃ নিয়েগের উপর প্রশ্ন তোলার মতো কোন বাপের বেটা আছে কি? এরপর দীর্ঘ সময় তিনি গভর্নর ছিলেন।সুতরাং ইয়াজিদের মনোনয়নের ক্ষেত্রে তাঁর যে ইজতিহাদ ছিল তা হলো হজরত হাসান রা: খেলাফত মোয়াবিয়া রা: হাতে স্থানান্তরের মাধ্যমে যে একটা স্থিতিশীলতা এসেছে তা বজায় রাখা। কারণ দীর্ঘ সময় তাঁর অধীনে শাসিত হওয়ার পর তার শাসনের প্রতি সবায় একমত হয়ে যায়। যদি তিনি কাউকে নিযুক্ত করে না যান তাহলে সে স্থিতিশীলতা থাকবে না। কারণ একদিকে কুফাবাসী তথা শীয়াবে আলীরা মাথাছাড়া দিয়ে উঠবে অন্যদিকে মদীনার বিশিষ্ট সাহাবীরা আছে। তাদের প্রতি মানুষের আবেগ কাজ করবে। এবং খেলাফতের যোগ্য দাবীদার তারাই। তিনি ভেবেছিলেন যদি বিশিষ্ট সাহাবীরা ইয়াজিদকে মেনে নেয় তাহলে এই স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি মদীনার সাহাবাদের পরামর্শ করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর রা: তাঁকে বলেছিলেন এটা শূরার উপর ছেড়ে দিতে। কিন্তু আমীরে মোয়াবিয়া রা: চিন্তা করেছেন যেহেতু সিরিয়াবাসীরা তাঁর প্রতি একমত সেহেতু খেলাফত অন্য কারো হাতে গেলে তারা বিদ্রোহ করবে। পুনরায় বন্ধ হওয়া রক্তপাত শুরু হবে। এটা বিবেচনা করে ইয়াজিদকে মনোনয়ন দেন। তবে মনে রাখতে হবে খেলাফতের জন্য কাউকে মনোনয়নই যথেষ্ট নয় তার জন্য সমগ্র উম্মাহর একনিষ্ঠ ঐকমত্য হতে হবে। নতুবা তার খেলাফত বৈধ হবে না।এবং হলোও এটাই। ইয়াজিদের ব্যাপারে মদীনার বিশিষ্ট সাহাবারা এবং কুফাবাসীরা একমত হয় নি। এখানেই মোয়াবিয়া রা: ইজতিহাদ ভুল হলো। কিন্তু তাঁর চিন্তা ছিল সঠিক। উম্মতের ঐক্য ঠিক রাখা। কিন্তু ইয়াজিদ তাবেয়ী ছিলেন। আর ওদিকে যোগ্যরা সাহাবা। সবচেয়ে যিনি যোগ্য তিনি আহলে বাইত। নবী দৌহিত্র। তিনি যদি বাইয়াত নিতেন তাঁর উপরই সবাই একমত হতো।
৩.ইয়াজিদের চরিত্রের ব্যাপারে সত্যাসত্য নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তার চারিত্রিক ত্রুটির বাইরে ইমামে আলী মকামের শাহাদাত, মদিনা ও মক্কা আক্রমণ দিয়ে তার চরিত্র নিরুপন করতে পারি। যদি তার চরিত্র মদ্যপ, বানর নিয়ে খেলা করা, আরো যা আছে তা তার খলিফা হওয়ার পরে হতে পারে কিন্তু তাকে মনোনয়ন করা পর্যন্ত তার চরিত্র ঠিক ছিল। এটাই আকিদা হওয়া উচিত। কেননা মোয়াবিয়া রা: এবং মুগীরা ইবনে শোবা রা: মতো বৃদ্ধ সাহাবী এত ক্ষমতালিপ্শু হয় নি যে একজন মদ্যপকে খলিফা বানাবে। তাছাড়া মোয়াবিয়া রা: পক্ষে আরো যে সমস্ত সাহাবী তাবেয়ী ছিল তারা একজন মদ্যপকে খলিফা হিসেবে মেনে নিবে। সুতরাং এখানে শিয়া প্রভাব বেশি হওয়ার সম্ভাবনা জোরালো।
কিন্তু খলিফা হওয়ার পর তাকে যখন কুফিরা এবং মদীনার বিশিষ্ট সাহাবীরা মেনে নেয় নি তখনই তার জবর দখলদারীতা আসে। যদি তার খলিফা হওয়ার আগেই চরিত্র এমন হয় তাহলে পরোক্ষভাবে সাহাবীদের উপরই তোহমত আসে।
৪.এক ধরনের ডোনার মোল্লারা ইতিহাস বিকৃতি করে প্রপাগান্ডা চালায় যে ইমামে হোসাইন রা: বিদ্রোহী ছিল। তিনি ক্ষমতার জন্য কুফা গিয়েছিল। তাদের উপর আল্লাহর লানত। এখানে ইমামে হোসাইন রা: হক ছিলেন। এর কারণ হলো খলিফা হওয়ার জন্য মূল শর্ত হলো উম্মতের একমত হওয়া। যেহেতু ইয়াজিদের উপর খলিফা হওয়ার যোগ্য সাহাবীরা একমত হয় নি। সেহেতু ততক্ষণ পযন্ত সে বৈধ খলিফা নয়। দ্বিতীয়ত সমগ্র মুসলিম অঞ্চলের লোকেরা ইয়াজিদের উপর বাইয়াত নেয় নি। এক্ষেত্রও তিনি বৈধ খলিফা নন। তাছাড়া ইমাম হোসাইনকে একটা জামাত আহবান করেছে। কুফাবাসীরা অসংখ্য চিঠি তাঁর কাছে প্রেরণ করছে বাইয়াত হবে বলে। সেক্ষেত্রে ইমাম হোসাইন রা:উপর ফরজ ছিল বাইয়াত নেয়া। কিন্তু যখনয় তিনি জানতে পারলেন কুফাবাসীরা আলী রা:,ইমাম হাসান রা: সাথে যেরুপ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ইমাম হোসাইন রা: সাথেও তেমন করেছে। তখন তিনি ইয়াজিদ বাহীনীর কাছে তাঁর বক্তব্যে বলেছে তাকে ছেড়ে দিতে। নিরাপদে মদীনায় ফিরে আসতে চেয়েছেন কিন্তু এখানেও মোস্তফার ভবিষ্যৎবাণী কবুল হয়েছে।
অনেকেই দাবী করে ইমাম হোসাইনকে বিশিষ্ট সাহাবীরা মক্কা থেকে বের হতে নিষেধ করেছে। ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে নিষেধ করেছে। আচ্ছা ইতিহাসের কোন পাতা থেকে দেখাতে পারবে ইমাম হোসাইন রা: বিদ্রোহের ডাক দিয়েছেন? দেখানো যাবে না। নিষেধের মূল কারণ ছিল কুফাবাসীদের অবিশ্বস্ততা এবং ইমাম হোসাইন রা: শাহাদাতের আগাম ঘোষণার প্রসিদ্ধি। হাদিসের অনেক জায়গায় তাঁর শাহাদাতের কথা বর্ণিতে হয়েছে।
সুতরাং আমাদের উচিৎ যেই বিষয়টা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকাবেররা সমাধান করে দিয়েছেন সেটাকে বিনা বাক্যে মেনে নেওয়া। এবং এ বিষয়ে সংজম অবলম্বন করা। আহলে বাইতের ভলোবাসা ইমানের একটা অংশ। কিন্তু সেই ভালোবাসাকে পুঁজি করে আমরা যেন সাহাবী সমালোচনায় মেতে না উঠি।
আবার তাদের সমালোচনা করে আমরা যেন জাহান্নামের কিটে পরিনত না হয়।
আমার এই লেখার নিজস্ব মতামত এবং যাবতীয় ভুলত্রুটি যেন আল্লাহ ক্ষমা করেন। সে সাথে দলমতের উর্ধ্বে যেন আল্লাহ আমাদের চিন্তা করার তাওফিক দেন। লেখাটা হয় তো যেভাবে চিন্তা করেছি সেভাবে লিখতে পারি নি। চিন্তার শূন্যতায় লেখগুলো আগোচালো হতে পারে। এই বিষয়ে লেখাটা আমার মতো পাপির পক্ষে উচিৎ মনে করিনা। তবুও দু কলম লিখলাম। ভুলগুলো আল্লাহর কাছে ক্ষমার আশা রাখি।
বিহুরমতি সায়্যিদিল মুরসালিন
লেখাটা লিখতে যে বইগুলো আমি পড়েছি।
১.শামে কারবালা:মুফতি শফি ওকাড়বি (রহ) :পাকিস্তান।
২.শাহাদাতে ইমাম হোসাইন :ড. তাহির আল কাদেরী। পাকিস্তান।
৩.শিয়া পরিচিতি ও আমীরে মোয়াবিয়া:আবুল হাসান ওমাইর রেজবী।
৪.ইতিহাসের কাঠগড়ায় আমীরে মোয়াবিয়া:জাস্টিস মুফতি তক্বি ওসমানী। পাকিস্তান।
৫.হাসান ইবনু আলী(রা:) জীবন ও কর্ম। ড. আলী মুহাম্মদ সাল্লাবী। লিবিয়া।
৬.কি ঘটেছিল কারবালায়? কারা ইমাম হোসাইনকে শহীদ করেছে? এটা সবচেয়ে বিরক্তিকর এবং বানোয়াট ছিল। কতিত আহলে হাদীস আবু বকর জাকারিয়া সম্পাদিত।
মুহাম্মদ জমির উদ্দিন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।