ধর্ষণ। আজকের সমাজে এই শব্দটি শুনা হচ্ছে প্রতিদিনই। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঠিক এই মুহূর্তে হয়তো কোন বোন লড়াই করছে নিজের আত্মসম্ভ্রম রক্ষা করতে মানুষরূপী কোনো হিংস্র জানুয়ারের সাথে। কেউবা লড়তে লড়তে বিসর্জন দিচ্ছে নিজের প্রাণ, কেউ আবার সমাজের বোঝা মাথায় নিয়ে এই পৃথিবীর রাস্তায় জীবন্ত মৃত আত্মার মানুষ হয়ে রয়ে গিয়েছে। দেশে গত ৯মাসে প্রায় ১০৫০জনেরও বেশি নারী ধর্ষিত হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় সংখ্যাটা কমার বদলে বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। আসুন তাহলে জেনে নেই এই সমাজ ধর্ষণহীন করতে আমাদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কি করা উচিত।
নারী সমাজের করণীয়:-
ধর্ষণ যে প্রতি নিয়তই আমাদের সমাজে বাড়ছে সে সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত। কিন্তু কেন এই ধর্ষণ প্রথা সমাজে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়তই। মানুষ দেখছে যে ধর্ষণ করেছে সে সমাজের কাছে নিকৃষ্ট। তারপরও কেন এই ধর্ষণ থামছে না? এর কারণ কি কেবল পুরুষ জাতি হিংস্র নর-পশুতে পরিণত হয়েছে এজন্যই? অবশ্যই না। এ কাজে খানিকটা নারীদেরও দোষ আছে। আচ্ছা, আপনি আজ থেকে শত বছর আগের কথা চিন্তা করুন। অথবা যারা বৃদ্ধা রয়েছেন তাদের সঙ্গে কথা বলুন। একসময় তারাও জোয়ান ছিলেন। রূপের সৌন্দর্য তাদের সময়ও কম ছিল না। তখন কি এরকম ধর্ষণের খবর হরহামেশা শুনা যেত? নাহ যেত না। তাহলে এখন কেন এরকম হচ্ছে প্রতিদিনই? মানুষতো আগের থেকে অনেকটাই সচেতন, শিক্ষিত। তারপরও এ কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ছে কেন? কারণটা খুবই স্পস্ট। আমরা আমাদের সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়েছি। আদিমকালে বাংলার সংস্কৃতি কি ছিল। হিন্দু-মুসলিম উভয় পরিবারের নারীরা একটা প্রটোকলের মধ্যে থাকত। বাড়ি থেকে বের হলে নিজেদের কে পর্দা করে বের হতো। মুসলিম নারীরা বোরকা পড়ে, আর হিন্দু নারীরা শাড়ির ঘুমটা টেনে। তখনকার পুরুষ সমাজও ছিল শালীন। দুয়েকজন দুষ্ট প্রকৃতির মানুষ ছাড়া বাকি সবাই নিজের মা-বোনদের সম্মান করতে জানত। নিজের বোনের ইজ্জত যেমনি ভাবে রক্ষা করতে জানত, অন্যের বোনের দিকেও তাদের নজর ছিল না। কিন্তু পৃথিবীর সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে এই বাংলাও নিজেদের সংস্কৃতি দিয়েছে বিসর্জন। আপন করে নিয়েছে তাদের পোশাকগুলোও। আমরা ধর্ষকদের পশু বলি। পশু থেকে বেঁচে থাকাটা কি আমাদের কর্তব্য নয়? আপনি যখন কোনো জঙ্গলে যাবেন অবশ্যই আপনি মাংসাশী পশু গুলো থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবেন। তাহলে এখানে কেন করছেন না। সমাজে পুরুষরূপী অনেক পশুই ছড়িয়ে আছে একটা সুযোগের জন্য। তাদের কেন নিজের দিকে আকৃষ্ট করছেন। পরিহার করুন পশ্চিমা কালচার, তাদের পোশাক। নিজ ধর্মের ছায়াতলে আসুন। অনেক নারীবাদীরা প্রশ্ন ছুড়বেন বোরকা পড়লেই কি নারী নিরাপদ। পুরোপুরি নিরাপত্তার জন্য নারীকে রাখতে হবে বাড়ির মধ্যে। আজকের সমাজে সেটা যেহেতু সম্ভব না, তাহলে বোরকা পড়ে নারী অনেকখানিই নিরাপদ। কারণ আমাদের সমাজ এখনো বোরকা পড়া নারীদের সম্মান করে, তাদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকে। পুরোপুরি নিরাপত্তা না পেলেও অনেক অংশেই আপনি নিরাপদ।
ইসলাম কিন্তু ধর্ষিত কোনো নারীকে দূরে ঠেলে দেইনি। ইসলামে বলা আছে কোনো নারী যদি নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যু বরণ করে তাহলে সে শহীদের মর্যাদা পাবে। আর যারা জীবিত থাকবেন তাদেরকেও হ্যায় করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কারন তিনি মজলুম। তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। আর নিশ্চই নির্যাতিত ব্যক্তিদের সাথে আল্লাহ আছেন।
ধর্ষকের শাস্তি:
প্রথমেই জেনা ব্যভিচার এসব কিছুই কেয়ামতের আলামত বলে আমরা দায় সেরে নিতে পারি। কিন্তু না। কেয়ামতের আলামত রাসূল (স.) এর ইন্তেকালের পর যা কিছু ঘটছে, তার সবকিছুই। ধর্ষণ যারা করে তাদের এক বাক্যে আমরা মানবরূপী জানুয়ার হিসেবে উল্লেখ করি। এই জানোয়ারদের শাস্তি ভয়াবহ। বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ষোল বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া, অথবা ষোল বৎসরের কম বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।’ ধর্ষণের ক্ষেত্রে একপক্ষে ব্যভিচার সংগঠিত হয়। আর অন্যপক্ষ হয় নির্যাতিত। তাই নির্যাতিতের কোনো শাস্তি নেই। কেবল অত্যাচারি ধর্ষকের শাস্তি হবে।
ব্যভিচারের শাস্তি ইসলামে নির্ধারিত রয়েছে। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ব্যভিচারিণী নারী ব্যভিচারী পুরুষ, তাদের প্রত্যেককে একশ’ করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকর কারণে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকো। মুসলমানদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে। ’ –সূরা নূর: ২
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘অবিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে শাস্তি একশ’ বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য দেশান্তর। আর বিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে একশ’ বেত্রাঘাত ও রজম (পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড)। ’ –সহিহ মুসলিম
এই হাদিসের আলোকে অন্য মাজহাবের ইসলামি স্কলাররা বলেছেন, ব্যভিচারী অবিবাহিত হলে তার শাস্তি দুটো। ১. একশ’ বেত্রাঘাত, ২. এক বছরের জন্য দেশান্তর।
আর হানাফি মাজহাবের বিশেষজ্ঞরা বলেন, এক্ষেত্রে হদ (শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি) হলো- একশ’ বেত্রাঘাত। আর দেশান্তরের বিষয়টি বিচারকের বিবেচনাধীন। তিনি ব্যক্তি বিশেষে তা প্রয়োগ করতে পারেন।
তবে ইমাম মালেক সে বিষয়ে ঐক্যমত পোষন করেননি। তিনি এই শাস্তি চেয়েছিলেন আরো ভয়াবহ। তাই আল্লাহর আরেকটি এদেশের উপর তিনি গুরুত্বারোপ করেছেন। তারা চান মুহারাবা শাস্তি। মুহারাবা হলো, পথে কিংবা অন্যত্র অস্ত্র দেখিয়ে বা অস্ত্র ছাড়া ভীতি প্রদর্শন করে ডাকাতি করা। এতে কেবল সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া হতে পারে, আবার কেবল হত্যা করা হতে পারে। আবার দু’টোই হতে পারে।
মালেকি মাজহাবের আইনজ্ঞরা মুহারাবার সংজ্ঞায় সম্ভ্রম লুট করার বিষয়টি যোগ করেছেন। তবে সব ইসলামি স্কলারই মুহারাবাকে পৃথিবীতে অনাচার সৃষ্টি, নিরাপত্তা বিঘ্নিতকরণ ও ত্রাস সৃষ্টি ইত্যাদি অর্থে উল্লেখ করেছেন।
মুহারাবার শাস্তি আল্লাহতায়ালা এভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের সঙ্গে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলিতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হস্তপদসমূহ বিপরীত দিক থেকে কেটে দেওয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটি হলো- তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্চনা আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি। ’ –সূরা মায়িদা: ৩৩
এ আয়াতের আলোকে মালেকি মাজহাবে ধর্ষণের শাস্তিতে ‘মুহারাবা’র শাস্তি যুক্ত করার মত দেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, সমাজে ধর্ষণ মহামারির আকার ধারণ করলে, সমাজ থেকে ধর্ষণ সমূলে নির্মূল করার লক্ষ্যে এ শাস্তি প্রয়োগ করা জরুরি। (আল মুগনি : ৮/৯৮)
আর যদি ধর্ষণের সঙ্গে হত্যাজনিত অপরাধ যুক্ত হয়, তাহলে ঘাতকের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
পরিশেষে বলব বাংলাদেশে এখন যে হারে ধর্ষনের মাত্রা বেড়েছে তাতে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য। ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিয়ে সমাজে যারা এখনও নর পশু হয়ে চলাফেরা করছে তাদের মনে ভয় জাগ্রত করতে হবে। প্রতিটা ধর্ষকের শাস্তি যদি মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়, তাহলে সমাজ থেকে ধর্ষণ অনেক হারেই হ্রাস পাবে। এই শাস্তি অনেক ধর্ষকের জন্যই দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে তাদের কৃতকর্মের।
লেখকঃ গোলাম শাফিউল আলম মাহিন
শিক্ষার্থী, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম।