তারাবীহঃ একটি পর্যালোচনা ▆
তারাবীহ সালাতের মর্যাদা
হাদীসে সালাতুত-তারাবীহ বা তারাবীহর সালাত— এ নামটি নেই। হাদীসে বলা হয়েছে ‘কিয়ামু রামাদান’।
প্রিয় নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ঈমানের সাথে এবং সাওয়াবের আশায় রামাদানে কিয়াম করবে, তার অতীতের পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’
[গ্রন্থ সূত্রঃ সহীহুল বুখারী-২০০৮, সহীহ মুসলিম-১৭৪।]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ওপর রামাদানের সিয়াম (রোযা) ফরয করেছেন আর আমি তোমাদের জন্য তার কিয়ামকে সুন্নাত করেছি। অতএব যে ঈমানের সাথে এবং সাওয়াবের আশায় কিয়াম করবে তার পূর্বের পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’
[গ্রন্থ সূত্রঃ সুনান তিরমিযী; সুনানে নাসায়ী-১/৩০৮।]
হাদীসে উল্লেখিত ‘কিয়াম’ অর্থ হলো সালাত আদায়। এ সালাত হলো ফরয সালাতের বাইরের সালাত। এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হলো যে, রামাদানে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ও বিতরের সালাতের বাইরে বিশেষ সালাত আছে, আর সে সালাতই তারাবীহ (ক্বিয়ামু রামাদ্বান) এর সালাত হিসাবে পরিচিত।
তারাবীহর সালাতের সূচনাঃ
রামাদান মাসের এ বিশেষ সালাতের সূচনা সম্পর্কে ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম আম্মা হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহার সূত্রে বর্ণনা করেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গভীর রাতে ঘর থেকে বের হয়ে মসজিদে এসে সালাত শুরু করলেন। (মসজিদে উপস্থিত) লোকজন তাঁর সাথে সালাত আদায় করলো। পরে লোকজন এ সালাত নিয়ে বলাবলি শুরু করলো। দ্বিতীয় রাতে আরো বেশি লোকজন উপস্থিত হলো। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রাতেও বের হলেন। লোকজন এ সালাত নিয়ে আলোচনা করলো। তৃতীয় রাতে মসজিদে লোকজনের উপস্থিতি আরো বেড়ে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হলেন। লোকজন তাঁর সাথে সালাত আদায় করলো। চতুর্থ রাতে লোকজনে মসজিদ ভরে গেল। এ রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হলেন না। লোকজন বলতে লাগলো ‘সালাত’ ’সালাত’ (নামায, নামায)। কিন্তু তিনি বের হলেন না। তিনি ফজরের সালাত আদায় করে লোকদের দিকে মুখ করে আল্লাহর উলুহিয়্যাত ও রিসালাতের সাক্ষ্য দেয়ার পর বললেন, ‘তোমাদের রাতের বিষয়টি আমার কাছে অস্পষ্ট নয়। তবে আমার ভয় হচ্ছিল যে, রাতের এ সালাতটি তোমাদের ওপর ফরয হয়ে গেলে তোমরা তা আদায়ে অপারগ হয়ে পড়বে।’
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওফাতে যাওয়া পর্যন্ত আর কখনো কিয়ামে রমাদান বা তারাবীহর সালাত জামাতে পড়েন নি। হযরত আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহুর সময়ও এ সালাত জামাতে পড়া হতো না।
ইমাম সুয়ূতী (রাহি.) বলেন, ‘আমীরুল মুমিনীন হযরত উমার রাদিআল্লাহু আনহু সর্বপ্রথম জামাতের সাথে কিয়ামে রামাদান (তারাবীহর সালাত) শুরু করেন।’
[গ্রন্থ সূত্রঃ ইমাম সুয়ূতি রহ. : তারীখুল খুলাফা-খলীফাগণের ইতিহাস।]
মুহাম্মাদ বিন সা‘দ বলেন, ‘উমার রাদিআল্লাহু আনহু ১৪ হিজরী সনের রামাদান মাসে জামাতে তারাবীহ চালু করেন।’
[গ্রন্থ সূত্রঃ তাবাকাতে ইবনে সা’দ।]
ইমাম বুখারী (রাহি.) আবদুর রাহমান বিন আবদুল কারীর সূত্রে বর্ণনা করেন, ‘আমি রামাদানের এক রাতে হযরত উমার বিন আল-খাত্তাবের (রা.) সাথে মাসজিদের উদ্দেশ্যে বের হলাম। দেখলাম, লোকজন বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। কেউ একাকী সালাত আদায় করছে, আবার কেউ কয়েকজনকে নিয়ে জামাতে সালাত আদায় করছে। হযরত উমার (রা.) বললেন, ‘আমি ভাবছি যদি লোকজনকে এক ইমামের সাথে একত্রিত করে দিতে পারতাম, তাহলে এটি উত্তম হতো।’ তিনি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে উবাই ইবনে কা‘বের ইমামতিতে সবাইকে একত্রিত করে দিলেন।
তারপর তাঁর সাথে আরেক রাতে বের হলাম; তখন লোকজন তাদের ইমামের সাথে সালাত আদায় করছে। উমার (রা.) বললেন, এটি কতই না সুন্দর ব্যবস্থা।
তবে, ‘যারা এখন (সালাত আদায় না করে) ঘুমায় তারা, এখন যারা সালাত আদায় করছে তাদের চেয়ে উত্তম।’
এর দ্বারা তিনি বুঝাতে চেয়েছেন শেষ রাত, আর লোকেরা প্রথম রাতে সালাত আদায় করতো।’
[গ্রন্থ সূত্রঃ সহীহুল বুখারী।]
তারাবীহর সালাতের মর্যাদা ও তারাবীহর সালাতের সূচনায় বর্ণিত হাদীসসমূহ থেকে যে বিষয়গুলো জানা গেল, তা হলো—
১/ সালাতুত-তারাবীহ বা তারাবীহর সালাত— এ নামটি হাদীসে নেই। হাদীসের পরিভাষা হলো ‘কিয়ামে রামাদান’ অর্থাৎ রামাদানের রাতের সালাত।
২/ সালাতুত-তারাবীহ একটি সুন্নাত সালাত; যেটি প্রবর্তন করেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
৩/ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো এক রামাদানে তিন রাত মাসজিদে এ সালাত আদায় করেছেন, উপস্থিত সাহাবীগণ তাঁর সাথে এ সালাতে শরীক হয়েছেন।
৪/ এ তিন রাত ছাড়া তিনি তাঁর জীবদ্দশায় আর কখনো এ সালাত মাসজিদে জামাতে আদায় করেননি।
৫/ তিনি এ সালাত আদায় করেছেন গভীর রাতে। হাদীসে ‘জাউফুল-লাইল’ বলা হয়েছে। এর অর্থ গভীর রাত।
৬/ তিনি এ সালাত কত রাকাত পড়েছেন, তা এখানে সুস্পষ্ট নয়। যে হাদীসে এ সালাতের মর্যাদা বলা হয়েছে যে, ‘যে ব্যক্তি ঈমান ও সাওয়াবের আশায় রামাদানের কিয়াম করবে, তার আগের পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে’— তাতেও রাকাত সংখ্যা উল্লেখ নেই।
৭/ প্রিয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় তিন রাত ছাড়া বাকী জীবনে, হযরত আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহুর সময় এবং হযরত উমার রাদিআল্লাহু আনহুর সময়ের প্রথম দিক পর্যন্ত দীর্ঘ সময় তারাবীহর সালাত জামাতে হতো না।
৮/ হযরত উমার (রা.) সর্বপ্রথম একজনের ইমামতিতে জামাতে এ সালাত আদায় চালু করেন।
এ সালাতকে কেন তারাবীহ সালাত বলা হয়ঃ
হাদীসে এ সালাতকে বলা হয়েছে ‘কিয়ামু রামাদান’— রামাদানের রাতের সালাত। পরবর্তীতে এটি তারাবীহর সালাত হিসাবে পরিচিত হয়।
তারাবীহ শব্দটির একবচন তারবীহাহ। এর অর্থ বিশ্রাম নেয়া, প্রশান্ত করা।
এ সালাত দীর্ঘ সালাত। মুসল্লীগণ প্রতি চার রাকাতের পর একবার বিশ্রাম নিয়ে আবার সালাত আদায় করেন, এজন্য এটিকে বহুবচনে তারাবীহর সালাত বলা হয়।
ইবনু মানজুর বলেন, ‘তারাবীহ’ তারবীহাহ শব্দের বহুবচন। তারবীহাহ অর্থ: একবার বিশ্রাম নেয়া। রামাদানের তারবীহার নাম এজন্য হয়েছে যে, যারা এ সালাত আদায় করে, তারা প্রতি চার রাকাত পর বিশ্রাম নেয়।’
[গ্রন্থ সূত্রঃ লিসানুল আরব।]
তারাবীহ সালাতের রাকাত সংখ্যাঃ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন রাত মাসজিদে কিয়ামু রামাদান তথা রামাদানের রাতের সালাত আদায় করেছেন। মাসজিদে উপস্থিত লোকজন তাঁর সাথে এ সালাতে শরীক হয়েছেন।
এ বিষয়টি যেসব বর্ণনায় এসেছে তাতে রাকাত সংখ্যার উল্লেখ নেই। হযরত উমার (রা.) হযরত উবাই বিন কা‘ব (রা.)-কে ইমাম বানিয়ে জামাতে এ সালাত আদায়ের প্রচলন শুরু করেছেন, তাতেও রাকাত সংখ্যার উল্লেখ নেই। তারাবীহর সালাতের রাকাত সংখ্যার বিষয়ে প্রধানত দুটি মত দেখা যায়। যথাঃ
০১. তারাবীহ আট রাকাত।
০২. তারাবীহ বিশ রাকাত।
তারাবীহ আট রাকাতঃ
যারা তারাবীহ আট রাকাত— এ মতটি পোষণ করেন, তারা আবার দু’ভাগে বিভক্ত। কেউ মনে করেন আট রাকাতের বেশিও পড়া যাবে, তবে আট রাকাত পড়া উত্তম। আবার কারো মত হলো, আট রাকাতের বেশি পড়া যাবে না। আট রাকাতের বেশি পড়া বিদআহ।
আট রাকাত তারাবীহর পক্ষে তাদের দলীলঃ
হযরত আবু সালমান বিন আবদুর রহমান আম্মা হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহাকে রামাদানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সালাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তিনি বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাদানে এবং রামাদানের বাইরে এগারো রাকাতের বেশি সালাত পড়তেন না। তিনি চার রাকাত পড়তেন; তুমি আমাকে তার সৌন্দর্য্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে প্রশ্ন করো না। অতঃপর তিনি চার রাকাত পড়তেন; তার সৌন্দর্য্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে প্রশ্ন করো না। অতঃপর তিনি তিন রাকাত পড়তেন।’
[গ্রন্থ সূত্রঃ সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিম।]
যারা আট রাকাত তারাবীহর পক্ষে, তারা তাদের মতের সমর্থনে এ হাদীসটি পেশ করেন। তাদের যুক্তি হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাদান ও রামাদান ছাড়া অন্য মাসেও রাতে বিতরসহ এগারো রাকাত সালাত আদায় করতেন।
নোটঃ আট রাকাত তারাবীহর সমর্থনে এ হাদীসকে দলীল হিসাবে পেশ করা কতটা যুক্তিসঙ্গত তা পর্যালোচনা প্রয়োজন।
আম্মা হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণিত হাদীসটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সারা বছরের কিয়ামুল লাইল তথা রাতের সালাতের দলীল হতে পারে। তবে কিয়ামু রামাদান (তারাবীহ সালাতের) দলীল হতে পারে না। কারণ ‘কিয়ামু রামাদান’ রামাদান মাসের রাতে বিশেষ সালাত।
তার প্রমাণ হলো—
০১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তোমাদের ওপর রামাদানের সিয়াম ফরয করেছেন আর আমি তোমাদের জন্য তার কিয়ামকে (রাতের সালাতকে) সুন্নাত করেছি।’
[গ্রন্থ সূত্রঃ সুনান তিরমিযী।]
০২. তিনি আরো বলেছেন, ‘যে ঈমানের সাথে ও সাওয়াবের আশায় রামাদানে কিয়াম (রাতের সালাত আদায়) করবে, তার অতীতের পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’
০৩. তিনি একাধারে তিন রাত মাসজিদে এসে উপস্থিত সাহাবীগণকে নিয়ে সালাত আদায় করেছেন। ফরয হওয়ার আশঙ্কায় চতুর্থ রাত থেকে মাসজিদে আসেননি। কিন্তু তিনি সাহাবীগণকে তা আদায়ে নিষেধ করেন নি।
এটিও প্রমাণ করে— কিয়ামু রামাদান সারা বছরের কিয়ামুল লাইল বা তাহাজ্জুদ নয়, বরং এটি বিশেষ সালাত।
০৪. হযরত উমার (রা.) ১৪ হিজরী সনের রামাদানে জামাতে ‘কিয়ামু রামাদান’ (তারাবীহর সালাত) চালু করেন। অথচ কিয়ামুল লাইল বা তাহাজ্জুদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় থেকেই চালু ছিল। এটিও প্রমাণ করে— কিয়ামু রামাদান তথা তারাবীহ বিশেষ সালাত।
আম্মা হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসটিকে তারাবীহ আট রাকাতের পক্ষে দলীল হিসাবে পেশ করা যুক্তিযুক্ত নয়।
যারা এ হাদীসের ভিত্তিতে তারাবীহ আট রাকাত পড়ে এবং এবং বলে যে, তারাবীহ আট রাকাতই পড়তে হবে এবং এটিই সুন্নাহসম্মত আমল— তাদেরকে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে।
তা হলো—
০১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন রাত মাসজিদে এ সালাত জামাতে আদায় করেছেন। তাঁর সুন্নাহ যথাযথ অনুসরণ করতে হলে পুরো রামাদান মাসজিদে জামাতে তারাবীহর সালাত আদায় করা যাবে না। কারণ এটি তিনি করেন নি। পুরো রামাদান মাসজিদে জামাতে তারাবীহর প্রবর্তন হযরত উমার (রা.) করেছেন।
০২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ অনুসরণ করতে হলে, রামাদান ও রামাদান ছাড়া অন্য মাসেও এগার রাকাত সালাত আদায় করা প্রয়োজন।
০৩. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই এগার রাকাত এশার পরপর পড়তেন না, বরং তিনি শেষ রাতে পড়তেন। তার প্রমাণ হলো, ফজরের আযানের আগে এ সালাত শেষ করতেন। ফজরের আযান হলে ফজরের দু’রাকাত সুন্নাত পড়ে, ডান কাত হয়ে কিছুটা সময় শুতেন; তারপর মসজিদে গিয়ে ফজরের ফরয আদায় করতেন।
০৪. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীর্ঘ সময় নিয়ে এ সালাত আদায় করতেন। আম্মা হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চার রাকাত সালাত আদায় করতেন, আমাকে তার সৌন্দর্য্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে প্রশ্ন করো না! আরো চার রাকাত পড়তেন, তার সৌন্দর্য্য ও দীর্ঘতা নিয়ে প্রশ্ন করো না!’
এ এগার রাকাত সালাত আদায়ে কত সময় লাগতো তা হাদীসে উল্লেখ করা হয় নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে কতটা সময় জাগতেন, তা কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে।
কালামে পাকে ইরশাদ হয়েছেঃ
ﺇِﻥَّ ﺭَﺑَّﻚَ ﻳَﻌْﻠَﻢُ ﺃَﻧَّﻚَ ﺗَﻘُﻮﻡُ ﺃَﺩْﻧَﻰٰ ﻣِﻦ ﺛُﻠُﺜَﻲِ ﺍﻟﻠَّﻴْﻞِ ﻭَﻧِﺼْﻔَﻪُ ﻭَﺛُﻠُﺜَﻪُ ﻭَﻃَﺎﺋِﻔَﺔٌ ﻣِّﻦَ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻣَﻌَﻚَ ۚ ﻭَﺍﻟﻠَّﻪُ ﻳُﻘَﺪِّﺭُ ﺍﻟﻠَّﻴْﻞَ ﻭَﺍﻟﻨَّﻬَﺎﺭَ
অর্থাৎ : ‘নিশ্চয় আপনার রব জানেন যে, আপনি রাত্রে জাগ্রত থাকেন- কখনো রাতের দু’তৃতীয়াংশের কাছাকাছি, কখনো অর্ধরাত্রি, কখনো এক তৃতীয়াংশ; এবং আপনার সাথে একটি দলও; আর আল্লাহ্ রাত ও দিনের পরিমাণ নির্ণয় করেন।’
[সূত্রঃ ক্বুরআ’নুল কারিম; সুরা মুয্যাম্মিল (৭৩): আয়াত শরীফ ২০।]
এ আয়াত থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কমপক্ষে রাতের এক তৃতীয়াংশ জেগে ‘কিয়ামুল লাইল’ বা তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতেন।
যারা আম্মা হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণিত এগার রাকাতের হাদীসকে আট রাকাত তারাবীহর দলীল হিসাবে পেশ করে আট রাকাত তারাবীহ পড়ে এবং বলেন যে, তারাবীহর রাকাত সংখ্যা আটই, এর বেশি নয়— তারা শুধু আট সংখ্যাটিকেই গুরুত্ব দেয়। বাকী বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখে না। রাখলে অবশ্যই তাদের আমল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মতোই হতো।
এ হাদীসের ওপর যারা যথাযথ আমল করতে চান, তারা কখনো রাতের দুই তৃতীয়াংশ (২/৩), কখনো আধা রাত ১/২) আবার কখনো এক তৃতীয়াংশ (১/৩) রাত জেগে এগার রাকাত সালাত আদায় করবেন।
শুধু রামাদানে নয়, বরং সারা বছর এ নিয়ম মেনে চলবেন। মাসজিদে নয়, বাসায় এ নিয়মে সালাত আদায় করবেন। মাসজিদে আদায় করতে চাইলে শুধুমাত্র তিন রাত জামাতে আদায় করবেন।
তারা আম্মা হযরত ‘আয়েশা (রা.) বর্ণিত হাদীস— রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগার রাকাতের বেশি সালাত পড়তেন না, রামাদানেও না, রামাদানের বাইরেও না’— এর ভিত্তিতে তারাবীহ আট রাকাত পড়ে এবং আট রাকাতই পড়তে হবে, এর বেশি নয়— এমন দাবী করে।
অথচ তারা হাদীস থেকে শুধু রামাদান মাস আর সংখ্যাটিই গ্রহণ করেছে, আর কিছু গ্রহণ করে নি। যেমন, রামাদান ছাড়া অন্য মাস, রাতে কমপক্ষে এক তৃতীয়াংশ (১/৩) জেগে এ সালাত আদায়, দীর্ঘসময় (২/৩) নিয়ে সুন্দরভাবে আদায় ইত্যাদি।
মনে রাখতে হবে যে, তারাবীহর সালাত চালু হওয়ার পর থেকে সহস্রাধিক বছরে কেউ এমন দাবী করেননি যে, তারাবীহ আট রাকাতই পড়া সুন্নাহ, এর বেশি পড়া যাবে না।
এছাড়াও আম্মা হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণিত এগার রাকাতের হাদীস তারাবীহ আট রাকাতের প্রমাণ হতে পারে না, কেননা তাঁর থেকে তের রাকাতের বর্ণনাও আছে। যেমন তিনি বলেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে তের রাকাত সালাত পড়তেন। তন্মধ্যে বিত্র ছিল পাঁচ রাকাত, যাতে তিনি মাঝে না বসে একবারে শেষে বসে সালাম ফিরাতেন।’
[গ্রন্থ সূত্রঃ সহীহ মুসলিম।]
আরেক বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে নয় রাকাত সালাত পড়তেন।
[গ্রন্থ সূত্রঃ সুনান আবু দাউদ।]
অপর বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাতের সালাত ছিল তের রাকাত যার মধ্যে বিত্র ছিল পাঁচ রাকাত, যাতে তিনি মাঝে না বসে সর্বশেষ রাকাতে বসতেন। মুআয্যিন আযান দিলে দাঁড়িয়ে সংক্ষেপে ফজরের দু’রাকাত সুন্নাত পড়তেন।’
[সূত্রঃ সুনান আবু দাউদ।]
তারাবীহ বিশ রাকাত
খায়রুল কুরুনে তারাবীহ— তারাবীহর রাকাত সংখ্যার বিষয়ে প্রসিদ্ধ মত হলো— তারাবীহ বিশ রাকাত। দলীল হলো, সাহাবী সায়িব বিন ইয়াযীদ (রাঃ) বলেছেন, ‘উমার বিন আল খাত্তাব রাদিআল্লাহু আনহুর সময় লোকজন রামাদান মাসে বিশ রাকাত সালাত আদায় করতেন।’
[গ্রন্থ সূত্রঃ বায়হাকী।]
ইমাম নববীসহ অনেক হাদীস বিশারদ হাদীসটিকে সহীহ তথা বিশুদ্ধ বলেছেন।
অন্য বর্ণনায় এসছে, তিনি বলেছেন, উমার (রা.) যখন উবাই ইবন কা‘বের ইমামতিতে লোকজনকে একত্রিত করে দিলেন তখন তিনি বিশ রাকাত সালাত পড়তেন।
[গ্রন্থ সূত্রঃ আল ইনসাফ- শাইখ মুহাম্মাদ বিন আবদুল ওয়াহ্হাব আন নযদীয়া]
প্রখ্যাত তাবিয়ী ইমাম আবু হানীফা (রাহি.), ইমাম শাফিয়ী (রাহি.) ও ইমাম আহমাদ (রাহি.)— তারাবীহ বিশ রাকাত— এ মতটি গ্রহণ করেছেন।
ইমাম মালিক (রাহি.)-এর মতে, তারাবীহ ছত্রিশ রাকাত।
শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী রহঃ বলেন— আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত চার মাযহাবে সীমাবদ্ধ। এ চার ইমামের মাঝে প্রথম ইমাম হলেন প্রখ্যাত তাবিয়ী ইমাম আবু হানীফা রহঃ [মৃত্যু ১৫০ হিজরী] ও বিশ রাকাত তারাবীহের প্রবক্তা। [ফাতাওয়া কাজীখান-১/
১১২।] ইমাম মালিক রহঃ এঁর একটি বক্তব্য বিশ রাকাতের পক্ষে, দ্বিতীয় বক্তব্য ৩৬ রাকাতের পক্ষে। [যাতে বিশ তারাবীহ আর ১৬ রাকাত নফল]
[গ্রন্থ সূত্রঃ হেদায়াতুল মুজতাহিদ-১/১৬৭।]
হারামাইন শরীফাইনে তারাবীহ— হারামাইন শরীফাইন (মক্কার মাসজিদে হারাম এবং মদীনার মাসজিদে নববীতে) বিশ রাকাত তারাবীহ ও তিন রাকাত বিত্র পড়া হয়। এ দুই মাসজিদের তারাবীহতে নির্দিষ্ট কোনো মাযহাবের আলেমগণ ইমামতি করেন না। বরং ইমামতি করেন সহীহ সুন্নাহর অনুসারী বিশেষজ্ঞ আলেমগণ। তাঁদের ইমামতিতে এখানে সালাত আদায় করেন হাজার হাজার সহীহ হাদীসের অনুসারী হকপন্থী আলেমগণ। সুস্থ বিবেক এবং পরিচ্ছন্ন ও প্রশস্ত হৃদয় এটি মেনে নিতে পারে না যে, এসব যুগশ্রেষ্ঠ সত্যপন্থী আলেমগণ যুগ যুগ ধরে সহীহ সুন্নাহর বদলে বিশ রাকাত তারাবীহ আদায় করছেন। ইহার কারণ এছাড়া আর কিছুই নয় যে, বিশ রাকাত তারাবীহই সহীহ্ সুন্নাহ্।
আট রাকাতের পক্ষের লোকজন বলবেন, হারামাইন শরীফাইন দলীল নয়। দলীল হলো কুরআন ও সুন্নাহ।
তারাই আবার ফরয সালাতের পর সমবেত মুনাজাত না দেয়ার পক্ষে হারামাইন শরীফাইনকে দলীল হিসাবে পেশ করেন।
যেমন বিশ রাকাতের পক্ষের লোকজন এ ক্ষেত্রে হারামাইন শরীফাইনের দলীল দেন। কিন্তু সালাতের পর সমবেত মুনাজাতসহ অনেক বিষয়ে তারা এ দুটোকে দলীল হিসাবে মানেন না। উভয়ের ক্ষেত্রেই এরুপ বৈসাদৃশ্য বিদ্যমান।
আমরা দলীল হিসাবে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহকেই মানবো। তবে শত শত বছর ধরে চলে আসা হারামাইন শরীফাইনে প্রতিষ্ঠিত আমলকে উপেক্ষা করতে পারবো না। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হারামাইন তথা মক্কা ও মদীনা যেসব বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছে, তা মানার জন্য উৎসাহিত করেছেন।
[গ্রন্থ সূত্রঃ সহীহুল বুখারী-কিতাবুল ই‘তিসাম।]
তারাবীহ ২০ রাকাআত এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের মাঝে আমলী ইজমা হয়েছিল।
ইবনে কুদামা হাম্বলী রহঃ [মৃত্যু ৫৯৫ হিজরী] আলমুগনী গ্রন্থের ২য় খন্ডের ১৬৭ নং পৃষ্ঠায়, আল্লামা কাশতাল্লানী শাফেয়ী রহঃ [মৃত্যু ৯২৩ হিজরী] “ইরশাদুস সারী” এর ৩য় খন্ডের ৫১৫ নং পৃষ্ঠায় বিশ রাকাতের উপর সাহাবাগণের ইজমার কথা উল্লেখ করেছেন।
মোল্লা আলী কারী হানাফী রহঃ [মৃত্যু ১০১৪হিজরী] “শরহুন নুকায়া” এর ২য় খন্ডের ২৪১ পৃষ্ঠায় এবং আল্লামা সাইয়্যেদ মুরতাজা জুবাইদী [মৃত্যু-১২০৫ হিজরী] সাহেব “ইতহাফুল সাদাতুল মুত্তাকীন” কিতাবের ৩য় খন্ডের ৭০০ নং পৃষ্ঠায় সাহাবাগণের এ ইজমাকে নকল করেছেন।
উম্মতে মুসলিমার ইজমাঃ
১২৮৪ হিজরীর ইংরেজ আমলের আগে পৃথিবীর কোন মসজিদে রমজানের পুরো মাস মসজিদে আট রাকাত তারাবীহ জামাতের সাথে পড়ার কোন নজীর নেই। একটি মসজিদের নাম কোন কথিত আহলে হাদীস দেখাতে পারবে না। না মসজিদে নববীতে কোনদিন আট রাকাত তারাবীহ পড়া হয়েছে। না বাইতুল্লায়। না পৃথিবীর কোন মুসলিম পল্লিতে।
রানী ভিক্টোরিয়ার আমলে সর্বপ্রথম এ বিদআতের সূচনা হয়।
এর আগে সমগ্র উম্মতে মুসলিমা ঐক্যমত্বের ভিত্তিতে ২০ রাকাত তারাবীহ পড়ে আসছেন। দেখুন-
০১- মিরকাত-৩/১৯৪।
০২- ইতহাফুল সাদাতিল মুত্তাকীন-৩/৪২২।
০৩- আনারাতুল মাসাবীহ-১৮।
০৪- হাশিয়ায়ে শরহে বেকায়া মাওলানা আব্দুল হাই লক্ষ্ণৌবী রহঃ।
০৫- উমদাতুল কারী-৫/২৬৭।
০৬- ফাতাওয়ায়ে কাজীখান-১১০।
০৭- আলমুগনী-১/৮০৩।
০৮- শরহে মুকান্না’-১/৮৫২।
০৯- শরহুল বুখারী লিলকাসতাল্লানী।
১০- আওযাজুল মাসালেক-১/৩৯০।
১১- শরহে নুকায়া-১০৪।
১২- আউনুল বারী-২/৩০৭।
১৩- কিতাবুল আজকার-৮৩।
১৪- ফাতহুল কাদীর-১/৪০৭।
১৫- আরফুশ শাজী-২৩০।
১৬- আলবাহরুর রায়েক-২/৬৬।
১৭- ফাতাওয়ায়ে শামী-১/৫১১।
১৮- বাদায়েউস সানায়ে-১/২৮৮।
১৯- আলমাসাবীহ-১৬।
২০- হালবী শরহে মুনিয়্যা-৩৮৮।
✘ আট রাকাতপন্থীগণের সহীহ হাদীস লঙ্ঘনঃ
আট রাকাতপন্থীগণ আট সংখ্যাটি ঠিক রাখতে গিয়ে কয়েকটি সহীহ হাদীস লঙ্ঘন করে।
সেগুলো হলো:
০১. ‘রাতের সালাত দুই রাকাত, দুই রাকাত। কেউ সকাল হওয়ার আশংকা করলে এক রাকাত পড়ে নিবে, যা তার পূর্ববর্তী সালাতকে বিজোড় করে দিবে।’
[গ্রন্থ সূত্রঃ সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিম।]
০২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে তের রাকাত সালাত পড়তেন। ফজরের আযান শুনলে তিনি সংক্ষেপে দু’রাকাত সালাত পড়তেন।
[গ্রন্থ সূত্রঃ সহীহুল বুখারী, মুয়াত্তা মালিক।]
এ দু’রাকাত হলো ফজরের দু’রাকাত সুন্নাত।
০৩. আট রাকাতপন্থীগণ যেসব মাসজিদে বিশ রাকাত তারাবীহ হয়, সেসব মাসজিদে এমনকি মক্কার মাসজিদে হারাম ও মাদিনার মাসজিদে নববীতেও আট রাকাত পড়ে মাসজিদ থেকে বের হয়ে যায়। এটি সহীহ হাদীস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মর্যাদা পরিপন্থী।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘ইমাম সালাত শেষ না করা পর্যন্ত যে ইমামের সাথে সালাত আদায় করবে, তার জন্য পুরো রাতের কিয়াম (সালাত আদায়ের সাওয়াব) লিখে দেয়া হবে।’
[গ্রন্থ সূত্রঃ সুনান তিরমিযী।]
আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছে।
আল্লাহ্ সর্বজ্ঞানী। আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান।
তারাবীহ সালাতের একটি বিশদ পর্যালোচনা
পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।