ইশকে ইলাহী-পর্ব-০২: ইশকে ইলাহী কেন?

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

মূল

মাহবুবুলওলামা হযরত মাওলানা পীর
জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী

অনুবাদ ও সম্পাদনা
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী

ইশকে ইলাহী-পর্ব ০২: ইশকে ইলাহী কেন?

ইশকে ইলাহী কেন?

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَالَّذِيْنَ آمَنُوْ أَشَدُّ حُبَّ لِلَّهِ
‘ঈমানদার যারা তাঁরা আল্লাহর সঙ্গে প্রচণ্ড ভালোবাসা রাখে।’

আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার প্রচণ্ডতা গভীরতা ও পরিপক্কতা পরিপূর্ণ ঈমানের আলামত। অবস্থা ও অবস্থানের পরিবর্তনে এই ভালোবাসার মাঝে কোনো হেরফের মুমিন-জীবনে দেখা যায় না।

محبت محبت تو کہتے ہیں لیکن
محبت نہیں جس میں شدت نہیں ہے
محبت کی انداز ہیں سب پرانے
خبردار ہواس میں جدت نہیں
ভালোবাসার বুলি, কপচাও তুমি,
নেই ভালোবাসা, তীব্রতা ছাড়া;
নতুন কিছু নয় এই ভালোবাসা, 
এক রঙ মাখা সব ভালোবাসা।

আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার কারণে জীবনের তিক্ততা মিষ্টতায় রূপ নেয়। অন্তরে যদি থাকে ইশকে ইলাহী, রক্তের ভেতরে যার মহব্বতেই ইলাহী, দুনিয়ার পেরেশানি নিয়ে অস্থিরতা তার অন্তরে থাকবে কেন?

ازمحبت تلحہاشیریں شود
مز محبت سیمہازریں شود
از محبت دردہا صافی شود
ازمحبت دردہاشافی شود
ভালোবাসা এক আজব জিনিস, তিতা হয়ে যায় মিঠা,
অন্তরের এই ভালোবাসা রৌপ্যকে করে সোনা;
দূর করে সে সকল ব্যথা, এনে দেয় সে স্বস্তি,
দূরে ঠেলে দেয় পীড়া-ব্যাধি, লাভ হয় কেবল শান্তি।

ইশক ও মহব্বতের অর্থ

হযরত শিবলি রহ. বলেন,

سُمِّيَتِ الْمَحَبَّةُ لِاَنَّهَا تَمْحُوْ مِنَ الْقُلْبِ مَأ سِوَى المَحْبُوْبِ
মহব্বতকে ‘মহব্বত’ নাম দেয়া হয়েছে এজন্য যে, সে মাহবুব (প্রিয়তম) ব্যতিত সবকিছুকে মন থেকে বিলুপ্ত করে দেয়।

উস্তাদ আবুল কাশেম কুশাইরি রহ. বলেন,

اَلْمَحَبَّةُ مَحْوُ الْمُحِبِّ لِصِفَاتِهِ وَإثْبَاتُ الْمَحْبُوْبِ بِذَاتِهِ
‘মহব্বত’ বলা হয়, প্রেমিক প্রেমাষ্পদের গুণের কারণে নিজেকে তার সামনে বিলীন করে দেয়া এবং প্রেমাষ্পদকে তাঁর স্বকীয়তাসহ অন্যের সামনে তুলে ধরা।’

হযরত সামনুন মুহিব রহ. বলেছেন,

ذَهَبَ الْمُحِبُّوْنَ لِلَّهِ بَشَرَفِ الدُّنْيَا وَ الْآخِرَةِ لِاَنَّ النَّبِيَّﷺقَالَ : اَلْمَرءُ مَعْ مَنْ اَحَبَّ
‘যাঁদের ভালোবাসা আল্লাহর জন্য হয় তাঁরা দুনিয়া ও আখেরাতের সকল গৌরব লাভ করে নিল। কেননা, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, বান্দা যাকে ভালোবাসবে তার সঙ্গেই (পরকালে) থাকবে।’

মহব্বত অন্তরের একটা পরিস্থিতির নাম। যার কারণে প্রেমিক প্রিয়তমের কাছে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব থাকে। যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ওপর আয়াত নাযিল হল যে, لَعَمْرُكَ ‘আপনার জীবনের শপথ…’ তখন তিনি ইবাদত এতটাই বাড়িয়ে দিলেন যে, حَتَّىنَوَرَّمَتْ قَدَمَاهُ ‘এমনকি তাঁর দু’পা ফুলে উঠল। তখন আল্লাহ তাআলা বলেন,طَهَ. مَا أنْزَلَتْ عَلَيْكَ الْقُرآنَ لِتَشْقَى ‘ত্ব-হা। আপনি কষ্ট পাবেন, এজন্য আমি আপনার ওপর কোরআন অবতীর্ণ করি নি।’

ইমাম গাযালী রহ. এক ব্যক্তিকে নিম্নোক্ত ছন্দগুলো পড়তে দেখে তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলেন,

لَقَدْ سَلَعَتْ حَيَّةُ الهَوَى کبَدِىْ
فَلَا طَبِيْبٌ لَهَا وَلَا رَاقِىْ
اِلَّا الْحَبِيْبُ الَّذِىْ شَغَفْتُ
فَعِنْدَهُ رَقْبَتِىْ وَتَرْيَاقِى
ভালোবাসার যে সর্পটি দংশন করেছে আমায়,
ডাক্তার কিংবা মন্ত্রদাতার কাছে নেই নিরাময়;
তবে যার ভালোবাসায় তীর্থ আমি, যদি পেয়ে যাই তাঁকে,
সেই পারে আমায় ওষুধ দিতে আমার প্রাণ বাঁচাতে।

ডাক্তার ডাকা হল। তিনি নাড়ি-নক্ষত্র দেখে বললেন, একে মহব্বতের রোগ ধরেছে।

দু’টি সত্য কথা

ইশক ও মহব্বতের জগতে সারগর্ভ দু’টি কথা আছে-

এক. আশেক তাঁর মা’শুকে হাকিকির (প্রকৃত প্রেমাস্পদ) যতই প্রশংসা করে না কেন; নিতান্ত কম মনে হয়। আল্লাহ তাআলার বাণী-

قُل لَّوْ كَانَ الْبَحْرُ مِدَادًا لِّكَلِمَاتِ رَبِّي لَنَفِدَ الْبَحْرُ قَبْلَ أَن تَنفَدَ كَلِمَاتُ رَبِّي وَلَوْ جِئْنَا بِمِثْلِهِ مَدَدًا

বলুন! আমার প্রতিপালকের কথা লিপিবদ্ধ করার জন্য সমুদ্র যদি কালি হয়, তবে আমার প্রতিপালকের কথা শেষ হবার পূর্বেই সমুদ্র নিঃশেষ হয়ে যাবে- এমনকি আমরা এর সাহার্যার্থে অনুরূপ আরো সমুদ্র আনলেও তাও নিঃশেষ হয়ে যাবে। (সূরা কাহফ ১০৯)

দুই. যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভালোবাসে আল্লাহ তাঁর যশ-খ্যাতি বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে দেন। হাদীস শরিফে এসেছে, ‘বান্দা যখন নিজের ইবাদতের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলে তখন তিনি জিবরাইল আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দিয়ে আসমান ও জমিনের মাঝে এই ঘোষণা করে দেন যে, হে লোকসকল! আল্লাহ তাআলা অমুক বান্দাকে ভালোবাসেন।

ثُمَّ يُوضَعُ لَهُ الْقَبُولُ فِي الْأَرْضِ

‘তারপর আল্লাহতাআলা ওই বান্দার গ্রহণযোগ্যতা জমিনে প্রতিষ্ঠিত করে দেন।’ (বুখারী ৫৬৯৩)

ہرگز نمیرد آنکہ دلش زندہ شد بعشق
ثبت است بر جریدہ عالم دوام ما
অন্তর যার স্পন্দিত ইশকের সৌরভে
তার নাই ক্ষয় , অফুরান সে; চিরকাল এই ধরার মাঝে।

ইশইেইলাহির প্রমাণসমূহ
প্রমাণ-১ : আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে ভালোবাসেন। এজন্য তিনি বলেছেন, اللَّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُوا ‘আল্লাহ মুমিনদের বন্ধু।’
লক্ষণীয় বিষয় হল, কালিমা পাঠ করে মুমিন হয়েছে বান্দা, সুতরাং যুক্তির দাবি এভাবে বলা- ‘মুমিনগণ আল্লাহর বন্ধু।’ কিন্তু না এভাবে বলা হয় নি; বরং বলা হয়েছে- ‘আল্লাহ মুমিনদের বন্ধু।’
এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা বন্ধুত্বকে নিজের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করেছেন। এটা মুমিন বান্দার জন্য মালিকের পক্ষ থেকে সুমহান গৌরব ও মর্যাদাদান ছাড়া আর কী হতে পারে! সুতরাং এমন মালিকের জন্য বান্দা নিজেকে উৎসর্গিত করবে না কেন! পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ ‘আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন, তারা আল্লাহকে ভালোবাসে।’
এই আয়াতে আল্লাহ নিজের ভালোবাসার কথা আগে বলেছেন।

প্রমাণ- ২ : আল্লাহ তাআলা বলেন, 

‘إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ

নিশ্চয় আল্লাহ জান্নাতের বিনিময়ে মুমিনদের জান-মাল খরিদ করেছেন।
নিয়মের কথা হল, কোনো বস্তুর মাঝে যদি ক্রটি থাকে, বস্তুটির ক্রটি দেখা সত্ত্বেও যদি কোনো ব্যক্তি তা কিনতে চায়, তাহলে এর অর্থ হল, এই ক্রটিযুক্ত বস্তুটাই তার কাছে ভালো লেগেছে। এই নিয়মটাকে সামনে রেখে আমরা বলতে পারি, আল্লাহ তাআলা মানুষ সৃষ্টি করেছেন। মানুষের মাঝে অবস্থিত ক্রটিগুলো সম্পর্কে তিনি শুরু থেকে সম্যক অবগত। তিনি জানেন মানুষ ضَعِيْفًا (দুর্বল) عَجُوْلاً(তাড়াহুড়োপ্রিয়) هَلُوْعًاً (ঝগড়াটে) جَزُوعاً(হাপিত্যেসকারী) (বাঁধা প্রদানকারী)مَنُوعًاএতসব ক্রটি থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজের জান্নাতের বিনিময়ে মুমিনদেরকে খরিদ করে দিয়েছেন। এটা এ কথারই প্রমাণ যে, যারা ঈমানের অধিকারী হয় আল্লাহ তাঁর এ জাতীয় বান্দাকে অত্যাধিক ভালোবাসেন।

প্রমাণ- ৩ : হযরত বায়েজিদ বোস্তামি রহ. বলতেন,

اَلْمَحَبَّةُ إِسْتِقْلَالُ الْكَثِيْرِ مِنْ نَفْسِكَ وَ إِسْتِكْثَارُ الْقَلِيْلِ مِنْ حَبِيْبِكَ

‘মহব্বত বলা হয় নিজের পক্ষ থেকে বেশি দিয়েও কম দিয়েছি মনে করা এবং প্রিয়মতের পক্ষ থেকে কম পেয়েও বেশি পেয়েছি মনে করা।’

এই সংজ্ঞাকে সামনে রেখে কোরআন মজিদের প্রতি লক্ষ করুন। বলা হয়েছে, আল্লাহ তাআলা মানুষকে অগণিত অসংখ্য নেয়ামত দান করেছেন। وَإِن تَعُدُّوا نِعْمَةَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا ‘যদি তোমরা আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামত গণনা করতে চাও; পারবে না।’
দুনিয়াতে এত বেহেসেবি-নেয়ামত দান করার পরেও তিনি দুনিয়ার আলোচনা করতে গিয়ে বলেন,قُلْ مَتَاعُ الدُّنْيَا قَلِيلٌবলে দিন, দুনিয়ার সুখ-সম্পত্তি অল্প।’

বোঝা গেল, তিনি নিজের থেকে দানকৃত সুখ-সম্পত্তিকে বলেছেন, এগুলো বেশি নয়, অল্প। পক্ষান্তরে বান্দা যখন তাঁর যিকির করে তখন যদিও এই যিকির তাঁর শানের তুলনায় অতি তুচ্ছ, কিন্তু তিনি একে বলে দিচ্ছেন, এটা বেশি! যেমন তিনি বলেন,وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيرًا ‘যারা আল্লাহর বেশি যিকির করে।’

এটা একথার প্রমাণ যে, আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে ভালোবাসেন।

ফলাফল : মুমিনদের প্রতি আল্লাহ তাআলার এই ভালোবাসার একটা প্রতিফলন আছে। তা হল, মুমিনহৃদয়ও তখন আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা দ্বারা উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। এটার স্বীকৃতি আল্লাহ নিজেই দিচ্ছেন। তিনি বলেন,

وَالَّذِيْنَ آمَنُوْ أَشَدُّ حُبَّ لِلَّهِ
‘ঈমানদার যারা তাঁরা আল্লাহর সঙ্গে প্রচণ্ড ভালোবাসা রাখে।’

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment