ঘরের কাজকর্ম করা আসলে খুবই ছোট্ট একটা বিষয়। এটা নিয়ে কথা বললে মনে হয় পৃথিবীতে কথা বলার মতো কত বিষয়ই তো ছিল! এমন বিষয় নিয়েও কেন আলাপ করতে হবে! কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাপারটা খুবই বড় বিষয়। বছরের পর বছর ধরে নারীদের যে বঞ্চনা সেটা অনেক ক্ষেত্রে জুলুমের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। নারী-পুরুষের ইবাদাত, আল্লাহ তায়া’লা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে পর্যন্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় এই বিষয়কে কেন্দ্র করে। পুরুষের আচরণে ফুটে ওঠে জাহেলি যুগের আচরণ। আর নারী হয়ে ওঠে একগুয়ে অবাধ্য। এখন এই জাহালতের বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই ফেমিনিস্ট হয়ে যাওয়া নয়। নারীর প্রতি জুলুমের বিরুদ্ধাচরণ করা মানেই স্বামীর হক আদায়ে অনুৎসাহিত করা নয়। স্ত্রী স্বামীর হক আদায় করবে, আবার স্বামীকেও স্ত্রীর হক আদায় করতে হবে। আমাদের সমাজে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্ত্রীর হক আদায় তো দূর, স্ত্রীকে মানুষ হিসেবেই মূল্যায়ন করা হয় না।
একশ্রেণির মানুষ বলে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ফাতিমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)-কে দাসী দেননি। দুআ শিখিয়েছেন। কিন্তু আমি এই হাদিসে একদিকে দেখি নবীজি পিতা হিসেবে কন্যাকে সহনশীলতার শিক্ষা দেওয়া, অন্যদিকে স্ত্রী হযরত ফাতিমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র জন্য স্বামী হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র ভালোবাসা। হযরত আলী দরিদ্র ছিলেন। হযরত ফাতিমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র জন্য দাসীর ব্যবস্থা করতে পারেননি। স্ত্রীকে তিনি বুদ্ধি দেন, তোমার আব্বুর কাছে কিছু দাসী এসেছে। চলো, চেয়ে নিয়ে আসি।’
না, হযরত ফাতিমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) হযরত আলীর পুরো বংশের জন্য রান্না করতেন না। দেবর-ননদের জন্য খাবার বেড়ে দিতেন না। শ্বশুরশাশুড়ির ফজরের পরের নাস্তার যোগান দিতে গিয়ে নিজের ফরজ নামাজ কাযা করতেন না। হযরত ফাতিমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) নিজের ছোট্ট সংসারের জন্য কাজ করতেন। অনেক কাজ করতেন। অনেক কষ্ট করতেন। সেই কষ্টের বিনিময়ে হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) কখনো বলেননি, ‘সারাদিন ঘরে কী করো?’
বরং হযরত ফাতিমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র কষ্ট হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র চোখে লাগছিল। স্ত্রীকে ভালোবাসতেন যে! হযরত ফাতিমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র পিঠে হাতে দাগ পড়ে যেত, হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) সেটা দেখেছেন। খুব খুব ভালো না বাসলে পিঠের দাগ কি দেখা যায়?
কয়জন স্বামী দেখে তাদের স্ত্রীর হাতটা হাতে নিয়ে দেখে? কয়জন স্বামী দেখে তাদের স্ত্রী একসময় আর কোমর ব্যথায় সোজা হতে পারে না?
তারা হযরত ফাতিমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র মতো স্ত্রী চায়, কিন্তু তারা হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র মতো স্বামী হতে চায় না।
তারা স্ত্রীর রান্নার দায়িত্ব নিয়ে কথা বলে, অথচ দেখে না, ফকিহদের আলোচনাটা স্ত্রীর নিজের খাবারের রান্নার আলোচনা; যে স্ত্রী যদি বলে রান্না করতে পারব না, তখন সে (যদিও স্ত্রী লোকটি দ্বীনি সৌন্দর্য ও দায়িত্বের বাইরে চলে যাবে) বাধ্য নয়। স্বামীকে খাবারটা যোগাড় করে দিতে হবে।
তারা দেখে না, মেয়েরা যে প্রতিবাদ করছে তা তার নিজের রান্নার ব্যাপারে নয়, বরং স্বামীর বংশশুদ্ধ লোকজনের জন্য রান্নার ব্যাপারে। অনেক স্ত্রী পুরো পরিবারের জন্যও রান্না করতে রাজি। কিন্তু তারা ভালোবাসা চায়। সম্মান চায়। এই স্ত্রী লোকটিই একদিন মা হয়। তখনও তারা সংসারের ঘানি টানতে থাকে। বিনিময়ে না সম্মান, আর না কোনো সহযোগিতা। বাবা-দাদার দেখে দেখে সন্তানটাও হয় এমন। এটা খাব না, ওটা খাব না, কত বায়না! আর মা কোনো কাজের কথা বললেই আসমান ভেঙে পড়ে মাথায়!
তারা হযরত ফাতিমা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)’র উদাহরণ এমনভাবে দিবে যেন শুধু ঘরের কাজ করার নামই দ্বীন! কথাটা বর্তমানের ঘরোয়া কাজের ব্যাপারে মিলানোটা ভীষণ হাস্যকর। বর্তমানে একেককটি ঘরে যতটা আইটেম রান্না করা হয়, যতরকমের খাবার তৈরি করা হয়, তা কি হযরত খাদিজা ও হযরত ফাতিমা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)’র ঘরে হতো? সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার, বিকেলের নাস্তা, রাতের খাবার! খাওয়াটাই যারা জীন্দেগী বানিয়ে নিয়েছে, তারা ভাবে স্ত্রীর এইসব হরেক রকম আইটেম তৈরি করার নাম বুঝি দ্বীন!
কিছু কিছু মেয়েও যখন দ্বীনের নামে সারাদিন রান্নাঘরে পড়ে থাকাকে প্রমোট করে তখন সত্যিই আফসোস হয়! যদি এই হতো নারীদের জীবন তবে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)-কে বিয়ে করার প্রয়োজন ছিল না বয়স্ক নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ।
আমি ঘরের কাজ বাদ দিতে বলছি না। কমাতে বলছি। যৌথ ফ্যামিলিতে থাকলে আপনি আপনার বাবা মা কে দ্বীন বুঝান। অহেতুক কাজ যতটুকু কমানো সম্ভব কমান। স্ত্রীর কাজের চাপ কমিয়ে তাকে ইলম শেখার আমল করারও সুযোগ দিন। আপনি চান, সে সারাদিনরাত কাজ করবে, রাত হলে ওই ক্লান্ত শরীর নিয়ে হাসিমুখে আপনার আহবানে সাড়া দিবে, আর আপনি ইচ্ছেমতো বাধ্যবাধকতার সবক শুনিয়ে জুলুম করে যাবেন! অনেকে তো আরো বহুদূর এগিয়ে। স্বামীকে তুমি করে বললেও নাকি বেয়াদবি হয়ে যায়! এটা কেমন সম্পর্ক! কেমন প্রেম! কেমন জীবন! আপনি তুমি যার যেমন ইচ্ছে বলবে, এতে দোষ হবে কেন?
নবীজির সংসারেও তো মনোমালিন্য হতো। আমরা দেখি শ্রেষ্ঠ নারী হযরত ফাতিমা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)’র সাথেও রাগ করে তার স্বামী হযরত আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ঘর থেকে বেরিয়ে গেছেন। অভিমান করে মাটিতে শুয়ে আছেন, আর শ্বশুর গিয়ে বলছেন, হে মাটির বাবা! ওঠো ওঠো!
ইসলাম দেখাচ্ছে সহযোগিতার সম্পর্ক, একে অন্যের দরদ বুঝার সম্পর্ক, মিষ্টি ঝগড়ার সম্পর্ক। এই সম্পর্ক অন্যরকম। অন্য সব সম্পর্কের চেয়ে আলাদা। এখানে কে কাজ করবে, আর কে কাজ করবে না এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা তো উচিত নয়। বরং যেভাবে প্রত্যেকের দ্বীনি দায়িত্ব আদায় হয় সেভাবেই চলা উচিত।
স্ত্রী সন্তান লালন পালন করবে, স্বামীও সহযোগিতা করবে। যৌথ ফ্যামিলি হলে স্ত্রী শ্বশুর-শাশুড়িকে আল্লাহ ও রাসূলের জন্য ভালোবাসবে, এর নামই দ্বীন। আবার স্বামী নিজের মা-বাবার খেদমতের ফরজ দায়িত্ব আদায় করবে, এর নামই দ্বীন। স্ত্রীকে বাবা-মার দাসি বানিয়ে দিলে নিজের দায়িত্ব আদায় হলো কীভাবে? অথচ নিজে এই কাজ করলে স্ত্রীর ওপর থেকে কাজের চাপ কমবে এবং খুশিমনে অন্য কাজ করে নিবে। এভাবে একে অন্যকে ভালোবাসা, একে অন্যকে সহযোগিতা করাই আমাদের ধর্মের শিক্ষা। আল্লাহ বলছেন, ‘একে অন্যের পোশাক স্বরুপ।’ পোশাক একদিকে প্রয়োজন, অন্যদিকে পোশাক থেকে মানুষ উষ্ণতা অনুভব করে। কিন্তু এই সমাজ শিখিয়েছে শুধু পুরুষের পোশাক প্রয়োজন, উষ্ণতার প্রয়োজন। নারীর পোশাকের প্রয়োজন নেই। নারী শুধু পুরুষের পোশাক। ব্যস এই নারীর পরিচয়। এই ধ্যান ধারণা নিয়ে যারা বেঁচে আছে তাদের কথার প্রতিবাদ করার নাম যদি হয় ফেমিনিজম তবে তাই সই। কিন্তু সমাজের এই মানসিকতা দেখেও চুপ থাকা অন্যায় হয় এবং অন্যায়কে বাড়তে দেয়া হয়।
এই জাহালত এই সমাজ থেকে দূর করতে হবে। ইসলাম নারীকে পিতার সম্পত্তি থেকে ভাগ দিয়েছে, ভাইরা বঞ্চিত করছে। ইসলাম নারীকে মোহরানার সম্মান দিয়েছে, স্বামী প্রথম রাতের সুযোগেই মাফ চেয়ে সেই অধিকার মেরে দিয়েছে। ইসলাম নারীকে শিক্ষার অধিকার দিয়েছে, এমনকি দাসীকেও শিক্ষার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছে, পুরুষরা নারীর প্রয়োজন নেই বলে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করেছে।
ইসলাম নারীকে জিহাদের মতো কঠিন আমল থেকে বাঁচিয়ে দিলেও সওয়াবের ক্ষেত্রে ঠিকই সমান রেখেছে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘হজ্জই তোমাদের জিহাদ।’ এভাবে ইসলাম নানাভাবে নারীদেরকে সম্মান দিলেও এই সমাজের পুরুষরা জাহেলি যুগের মতো নারীকে ফেলনা বানিয়ে রেখেছে। হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমরা জাহেলি যুগে নারীদেরকে কোনো মূল্যই দিতাম না। তারপর আল্লাহ তাদের সম্পর্কে আয়াত নাযিল করেন।’
বর্তমানেও এই অবস্থা। একশ্রেণির মানুষের চোখে নারীর কোনো সম্মানই নেই। আরেকশ্রেণী অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে নারীকে নিয়ে যাচ্ছে আঁধারে। বর্তমানের নারীরাও পড়ে আছে গোলকধাঁধায়। বোনরা, সংসার আপনার। সংসার সামলান। সন্তান আপনার, সন্তানের প্রতিপালন করুন। স্বামীর খেদমত করুন। জান্নাতে যাওয়ার জন্য ফরজ ইবাদতের সাথে সাথে এর বেশি কিছু লাগে না। কিন্তু যখন দেখবেন, কোথাও জুলুম হচ্ছে তখন প্রতিবাদ করুন। ভাইরা সম্পত্তি মেরে দিলে, স্বামী মোহরানা না দিলে কথা বলুন। এটা ইসলাম প্রদত্ত অধিকার। সময় বের করে দ্বীনের ইলমও অর্জন করুন। অনেক বোন আছেন, ফরজ ইবাদতের মাসআলাগুলোও জানেন না। এমনকি নামাজের সঠিক মাসআলাগুলোও জানেন না। সংসারের ঘোরপ্যাঁচে পড়ে এ ব্যাপারে জ্ঞান অর্জনের কথা ভাবেনও নি।
আমার নিজের দেখা প্রচুর মহিলা এমন আছেন, যাদের সারাদিন কাজ কাজ আর কাজ। কাজ শেষ হচ্ছে না। এদিকে নামাজ কাযা হয়ে যাচ্ছে সে খবরই নেই। এইরকম অবস্থা হলে শুধু ঘরের কাজ করে কিছুতেই হযরত ফাতিমা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)’র আদর্শে আদর্শিত হওয়া যায় না।
বোনরা, সংসারকে দ্বীনের ক্ষেত্র মনে করুন, দ্বীন নয়। দ্বীনকে প্রায়োরিটি দিন, সংসারকে নয়। তাহলেই মনে যেমন প্রশান্তি থাকবে, সংসারেও থাকবে শান্তি।
আর ভাইরা, নারীকে সম্মান দিন, নারীকে ভালোবাসুন। নারী আপনারই সংসারের সবুজ বৃক্ষ। তাতে পানি দিন। তাকে আপনার উত্তাপে বিবর্ণ করবেন না। কাপুরুষের মতো তার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে আপনার সংসার ভালোবাসা দিয়ে সহমর্মিতা দিয়ে সামলানোর গুণ অর্জন করুন। আপনার স্ত্রীকে আপনার খেদমত করাতে বাধ্য করবেন না, বরং আপনাকে ভালোবাসতে বাধ্য করুন। দেখবেন, খেদমত এমনিতেই করবে। আপনার সংসার, আপনারই হয়ে উঠবে। আপনার সংসারের বৃক্ষ সবুজ থাকলে আপনারই শ্বাস প্রশ্বাসে প্রশান্তি থাকবে।