আমাদের দেশে মুসলিম জনগোষ্ঠীর হার অনুপাতে বেশিরভাগ শিশু-কিশোরের মা-বাবা নিশ্চয়ই মুসলিম। তারা বিশ্বাস করেন পরকাল, প্রতিফল, জান্নাত ও জাহান্নাম। তবে কেন তাদের সন্তান আল্লাহভীরু ও রাসূলে পাকের আশেক হতে পারে না? একটি ছেলে অথবা মেয়ে যদি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লাকে চেনে, রাসূলে পাকের প্রতি অঘাত ভালোবাসা থাকে, ঈমান আনার অর্থ বোঝে, জান্নাত-জাহান্নামের কথা জানে, সে ছোট ছোট গুনাহ করে ফেললেও বড় বড় অপরাধ কখনোই করতে পারে না। কিশোর-কিশোরীদের আল্লাহ ও রাসূল ﷺ কে চেনার মধ্যে, দ্বীন বোঝার মধ্যে মা-বাবার কি কোনো হাত নেই?
সন্তান ঘর থেকে যা শিখছে, মা-বাবা শেখাচ্ছেন, স্কুল থেকে যা শিখছে তার দায়ও মা-বাবার। কারণ মা-বাবাই তার স্কুল নির্ধারণ করেছেন। তার আশপাশের সমাজটাও মা-বাবার নির্ধারণ করা। তবে তার অবাধ্যতার অন্ধকার থেকে বাবা-মায়ের কি মুক্তি আছে?
রাসুল ﷺ বলেন,
مَامِنْ مَوْلُوْدٍ إلاَّ يُوْلَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ فَأَبْوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ اَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ يُمَجِّسَانِهِ
‘প্রত্যেক মানবশিশুই ফিতরাতের উপরে জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদি, খ্রিস্টান, অগ্নিপূজক বানায়।’
আল্লাহর রাসুল ﷺ এখানে সমাজের কথা বলছেন না, শিক্ষকের কথা বলছেন না, বলছেন পিতা-মাতার কথা। আপনার কথা, আমার কথা। সন্তান মার কথা শোনে না, অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, মাকে পিঠ দেখিয়ে চলে যায়, মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে চলে যায়। তার দায় অনেকাংশেই বাবা ও মায়ের! তবে হ্যাঁ, নুহ আলাইহিস সালাম নিশ্চয়ই উত্তম পিতা ছিলেন। তাঁর সন্তানের মতো কারো ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলে ভিন্ন কথা। সন্তানের মানুষ হয়ে ওঠায় আমাদের কতটুকু হাত আর অজুহাত তা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলতে গেলে আলাদা বই রচনা করতে হবে, তাই আমরা সংক্ষিপ্তভাবে সন্তানের তারবিয়াত ও আমাদের আমল সম্পর্কে কিছু কথা আলোচনা করব, যেন এর মাধ্যমেই সন্তানের সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার প্রাথমিক ধারণা হয়ে যায়। আল্লাহ তাওফিকদাতা।
সন্তান সম্পর্কিত যাবতীয় সমস্যার কারণ হলো, দ্বীন সম্পর্কে উদাসীন থাকা, আর সকল সমস্যার সমাধান হলো নবীজি ﷺ এর রেখে যাওয়া আদর্শ অনুসারে সন্তানের সুষ্ঠু প্রতিপালন।
সন্তানকে সুষ্ঠুভাবে প্রতিপালনের জন্য যে পদক্ষেপগুলো আমাদের নিতে হবে তা একটা একটা করে নিচে তুলে ধরা হলো।
◾সন্তান প্রতিপালনের প্রথম পদক্ষেপ হলো: রুহের খাবারের ব্যবস্থা করা
একটি শিশু মায়ের শরীরে অবস্থান করার সাথে সাথে প্রথমেই আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকে একটাই শিশুর সুস্থতা। শুধু শিশুকে সুস্থ রাখার জন্য প্রেগন্যান্ট হওয়ার সাথে সাথে মায়ের খাওয়া, মায়ের ঘুম, মায়ের পরিশ্রম, সবকিছুর রুটিন বদলে নেওয়া হয়। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, শিশুর শারীরিক সুস্থতার জন্য যথেষ্ট মনোযোগ ও প্রচেষ্টা থাকলেও শিশুর মানসিক সুস্থতার দিকে তেমন একটা দৃষ্টিপাত করা হয় না। অথচ প্রত্যেক মানুষের শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে তার কলব বা আত্মা। কলব সুস্থ হলে শরীর সুস্থ, কলব অসুস্থ হলে শরীরও অসুস্থ। এটা হাদিসের কথা। তাই সন্তান মায়ের শরীরে অবস্থান নেওয়ার সাথে সাথে শিশুর কলবের সুস্থতার প্রতিও দৃষ্টি রাখা উচিত। কীভাবে? একদম সেভাবে, যেভাবে শিশুর শরীর সুস্থ রাখার চেষ্টা করা হয়। পেটের যেমন খাবার প্রয়োজন, কলবেরও খাবার প্রয়োজন। প্রেগন্যান্সির সময় মা যা যা খেয়ে থাকেন সন্তানও তাই খায়। একইভাবে মা নিজের কলবকে ভালো-মন্দ যে খাবার দিয়ে থাকেন, সন্তানের আত্মাও সে খাবারই পাবে। সে হিসেবেই তার আত্মা বেড়ে উঠবে।
শিশুর শরীরের সাথে সাথে তার আত্মাকেও পঙ্কিলতামুক্ত নির্মল খাবার দিয়ে বিকশিত হতে সাহায্য করা পিতা-মাতার সর্বপ্রথম দায়িত্ব। না হলে সন্তানের আত্মা শৈশব থেকেই ধীরে ধীরে এতই অবাধ্য হতে শুরু করে যে, বড় হয়ে বিকারগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। তাই পিতা-মাতার উচিত সুন্নাহসম্মত পদ্ধতিতে তারবিয়াতের মাধ্যমে সন্তানের জীবন শুরু করা।
তারবিয়াত অর্থ : সন্তানের বিশ্বাস, চরিত্র, বুদ্ধি, স্বাস্থ্য এবং তার আচার ব্যবহার ও গতিবিধি তথা জীবনের প্রতিটি বাঁকে তাকে এমন একটি পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতির ওপর নিয়ে আসা যা ইসলাম অনুমোদন করে।
আর তারবিয়াতের সর্বপ্রথম পদক্ষেপ হলো নিজেকে সংশোধন করা। সন্তানের তারবিয়াত শুরু হয় মায়ের প্রেগন্যান্সি থেকেই। এটা আশ্চর্যজনক শোনালেও সত্যি। মেডিক্যাল সায়েন্সও বলে, মায়ের পেটে চার-পাঁচ মাস বয়স থেকেই সন্তান শুনতে পায়। তাই প্রেগন্যান্সি থেকেই মিথ্যা, পরনিন্দা, গান শোনা ইত্যাদি পরিহার করা উচিত। একবার ভাবুন, সন্তান পৃথিবীতে আসার আগেই মায়ের প্রথম পরিচয়টা পাবে মিথ্যাবাদী ও মন্দ মানুষ হিসেবে, আল্লাহ ও রাসূল ﷺ এর অবাধ্য হিসেবে। শুধু তাই নয়, হিন্দি সিরিয়ালের কুপ্রভাবে সমাজে একের পর এক নানা ধরনের কুপ্রথা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। আর মায়েরা শো অফ করার লোভে পাপ করতে শুরু করেন পেটের সন্তানটাকে কেন্দ্র করে। এসব পাপের একটার নাম―বেবি শাওয়ার। ইসলামের সাথে যার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। অনলাইনে নারীদের প্রেগন্যান্সি গ্রুপগুলোতে, পরিচিত-অপরিচিত প্রচুর মুসলিম বোনকেই দেখেছি খুব উৎসাহের সাথে ‘বেবি শাওয়ারে’ অংশগ্রহণ করছেন। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন, সন্তান এখনো পৃথিবীতে আসেইনি, সে পেটে আসতেই মা তাকে উপলক্ষ্য করে আল্লাহ ও রাসূল ﷺ এর অবাধ্যতা করছেন, তাহলে সে কেন পৃথিবীতে আসার পর মায়ের অবাধ্য হবে না? যে আল্লাহ মা ও সন্তানকে সৃষ্টি করেছেন, দুজনের প্রাণ দিয়েছেন, সে মহান রবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মা যখন আল্লাহর অসন্তুষ্টিকে পরওয়া করে না, তখন সন্তান বড় হয়ে কীভাবে মায়ের পরওয়া করবে?
এ ব্যাপারে ফুযাইল বিন আয়ায রহ. বলেন, ‘যখনই আমি আল্লাহর কোনো হুকুম অমান্য করেছি, আমি এর প্রভাব আমার স্ত্রী, সন্তান, আমার কর্মচারী অথবা আমার গৃহপালিত প্রাণীর উপর দেখতাম যে, তারা আমার কথা অমান্য করছে।’
আর আমরা? সন্তানের জন্মই হয়নি, সে বিকলাঙ্গ, অন্ধ, বধির, বোবা হবে নাকি সুস্থ হবে তা নির্ভর করছে মহান আল্লাহর ওপর। অথচ মা সন্তানকে উপলক্ষ্য করে দ্বীনবিরোধী কাজ করতে শুরু করেছেন। আল্লাহ কী করে দেবেন মাকে একটি সুস্থ শরীর, সুস্থ মনের সন্তান? একজন মা কীভাবে দুনিয়ার গান্দেগিতে পরিপূর্ণ পাপ খেতে দিতে পারেন সন্তানের ছোট্ট নির্মল আত্মাটিকে?
মা কি চান সন্তানের শুভ্র আত্মায় জন্মের আগেই শয়তানের কালো আঁচড় পড়ুক? না চাইলে শুধু শারীরিক সুস্থতাসম্পন্ন শিশু নয় বরং একটি মানসিক সুস্থতাসম্পন্ন শিশুও যেন জন্ম নেয় সে চেষ্টাই করতে হবে। গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হবে, গান শুনবেন না, গীবত করবেন না। আর এর মাধ্যমে সন্তানের আত্মাকে দিন পুষ্টিকর খাবার। বেশি বেশি যিকির-তেলাওয়াত করুন। স্বামীকে তেলাওয়াত করে শোনাতে বলুন। যখন আপনি ক্লান্ত হয়ে শুয়ে থাকেন, সূরা রহমানের তেলাওয়াত ছেড়ে দিন। আপনি ঘুমিয়ে গেলেও সে হয়তো জেগে আছে। সে শুনবে―যে দুনিয়াতে সে আসছে তাকে রহমানুর রহিম কত নেয়ামত দিয়ে পূর্ণ করে রেখেছেন। আপনার নেক আমলের কল্যাণে নিজেকে আল্লাহর রহমতের ছায়ায় রাখুন, যেন ছোট্ট সোনামণিও মায়ের জরায়ুতে প্রশান্তিতে নিদ্রা যায়।
◾একটি ভালো সন্তানের মা হওয়ার জন্য দ্বিতীয় পদক্ষেপ হলো: দুআ করা
কোথাও পড়েছিলাম কোনো মাকে আল্লাহ তাআলা যে কোনো একটা জিনিস চাইতে বললে, দেখা যাবে মা বলছেন- ‘নিজের সন্তানের ভাগ্য নিজ হাতে লিখতে চাই।’
ব্যাপারটা পড়তেই প্রত্যেক মায়েরই মনে হবে, ইস, সত্যি যদি মাকে সন্তানের তাকদির লেখার সুযোগ দেওয়া হতো! অথচ অনেকেই জানেন না, আল্লাহ তাআলা মাকে সন্তানের তাকদির নিজ হাতে লেখার ক্ষমতা আগে থেকেই দিয়ে রেখেছেন। হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘দুআ ছাড়া অন্য কিছু মানুষের তাকদিরে পরিবর্তন ঘটাতে পারে না।’ [সুনানে তিরমিযি]
দুআ যখন তাকদিরে প্রভাব ফেলতে পারে তখন পিতা-মাতার দুআ কি আর বৃথা যেতে পারে! বিশেষ করে মায়ের দুআ?
সন্তান দুষ্টুমি করে, এটা সেটা উল্টে ফেলে, কারো কথা শুনে না, পড়ে না, ইত্যাদি বিষয়ে মা সবার কাছে বলে বলে হাহাকার করতে থাকেন। কিন্তু আল্লাহর দরবারে হাহাকার করে হাত তুলে দুআ করেন কতবার? অথচ সন্তানের পরিশুদ্ধ ও প্রশান্ত একটি কলবের জন্য দুআ করলে আল্লাহ চাইলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু দুআ কয়জন বাবা-মা করেন! অতিষ্ঠ হয়ে বরং বলতে দেখা যায়, মরে যা, পড়ে যা, ভালো হয়েছে ইত্যাদি! তারপর এই দুআগুলোই ফলে যায় অনেক সময়।
আর কোনো কোনো বাবা-মা আল্লাহর কাছে সন্তানের জন্য দুআ করলেও তাতে দ্বীনের চেয়ে দুনিয়াই বেশি প্রাধান্য পায়। আমার ছেলেমেয়ে পড়ালেখায় প্রথম হোক, তাদের লম্বা হায়াত, ভালো চাকরি, সম্পদ, শান্তি, শারীরিক সুস্থতা ইত্যাদির জন্য দুআ করেন। কিন্তু দুআ করেন না পরকালীন জীবনের জন্য। ‘সন্তান যেন আল্লাহর প্রকৃত দাস হয়; তার কলব যেন ঈমানে পরিপূর্ণ থাকে’ দুনিয়াবি চাওয়ার সাথে সাথে এই দুআটাই সন্তানের সুখের জন্য সবচেয়ে জরুরি। সম্পদ, সুস্থতা কিছুই সন্তানকে শান্তি দেবে না, যদি তার কলব পরিশুদ্ধ না থাকে। তাই শারীরিক সুস্থতার সাথে সাথে সন্তানের মানসিক সুস্থতার জন্যও দুআ করতে হবে। সন্তানের কলব যেন কলবে সালিমে পরিণত হয় এই দুআ করতে হবে। সে যেন পূত-পবিত্র হয় এই দুআ করতে হবে।
আল্লাহ তাআলা যাকারিয়া আলাইহিস সালামের ঘটনা উল্লেখ করে কুরআনে আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন সন্তানের জন্মের আগে থেকেই পরিশুদ্ধ সন্তানের জন্য দুআ শুরু করতে হবে। বলতে হবে:
رَبِّ هَبْ لِیْ مِنْ لَّدُنْكَ ذُرِّیَّۃً طَیِّبَۃً ۚ اِنَّكَ سَمِیْعُ الدُّعَآءِ
‘হে আমার পালনকর্তা, আপনার নিকট থেকে আমাকে পূত-পবিত্র সন্তান দান করুন। নিশ্চয়ই আপনি প্রার্থনা শ্রবণকারী।’ [আলে ইমরান : ৩৮]
একই সূরার ৩৫ নম্বর আয়াতে আছে:
رَبِّ اِنِّیْ نَذَرْتُ لَكَ مَا فِیْ بَطْنِیْ مُحَرَّرًا فَتَقَبَّلْ مِنِّیْ ۚ اِنَّكَ اَنْتَ السَّمِیْعُ الْعَلِیْمُ
‘হে আমার পালনকর্তা, আমার গর্ভে যা রয়েছে আমি তাকে আপনার নামে উৎসর্গ করলাম সবার কাছ থেকে মুক্ত রেখে। আমার পক্ষ থেকে আপনি তাকে কবুল করে নিন, নিশ্চয়ই আপনি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞাত।’
তারপর সূরা ফুরকানে আছে:
رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ اَزْوَاجِنَا وَ ذُرِّیّٰتِنَا قُرَّۃَ اَعْیُنٍ وَّ اجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِیْنَ اِمَامًا
‘হে আমাদের রব, আমাদের স্ত্রী এবং সন্তানদেরকে আমাদের চক্ষুশীতলতা বানিয়ে দিন। এবং আমাদেরকে মুত্তাকিদের ইমাম বানিয়ে দিন।’
কত সুন্দর দুআ! দুআ করতে থাকুন। চোখের প্রশান্তি হবে সন্তান। সে রবের এত বাধ্য হবে যে তার দিকে তাকালেই চোখ জুড়িয়ে যাবে। ঠোঁটে ফুটে উঠবে প্রশান্তির হাসি। আবেগে কাঁপতে কাঁপতে চোখ শীতল করে নেমে আসবে যে আনন্দ-অশ্রু, তা নীলনদের স্বচ্ছতাকেও হার মানাবে!